অনেক দিন পরে দেখা হবে ওর সাথে। একটা সময় ছিল যখন একদিন বা একবেলা ওর দেখা না পেলে হৃদয় মোচড়ানো ব্যথা অনুভব করতাম। পৃথিবীটা যেন কক্ষপথে ঘোরা বন্ধ করে দিত।
ও বলেছে কলেজের গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে মাঠের গোলপোস্টের কাছেই ও থাকবে। সাড়ে চারটেয় ওর ক্লাস শেষ।
আমার আবার গেট দিয়ে ঢুকতে একটু বাধো বাধো লাগছে। ওকে নিশ্চই বন্ধুরা ঘিরে রাখবে। আড্ডা চলবে , ক্লাস শেষের আড্ডা। আমি তার মাঝে কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হতে রাজি নই।
আমি কলেজে গেটের বাইরে বড় রাস্তায় ওর জন্য অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছি সেই বিকেল পৌনে চারটে থেকে।
প্রায় পৌনে পাঁচটায় ওকে দেখলাম দূর থেকে। আমায় মাঠে খুঁজে না পেয়ে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে গেটের দিকেই আসছে। পরণে কালো রঙের কুর্তা অার নীল জিন্সের প্যান্ট। সেই ফর্সা সুন্দর মুখ। পনি টেইল এ কী অপূর্ব সুন্দর লাগছে ওকে ! আমি হাঁ করে চেয়েই থাকলাম। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
এক ভ্যালেন্টাইনস ডে তে ওকে উদ্দেশ্য করে আমার লেখা কবিতার কটা লাইন খাপছাড়া ভাবে মনে পড়ে গেল। শুরুর দিকটা মনে আসছে না। এ কবিতা এখনও ওকে দেখাইনি।
“…….বলো আমার, শুধু আমার হবে তুমি
তোমার চোখে প্রতিবিম্বিত
আমার স্বদেশ ভূমি…….
….. তুই কি আমার ভ্যালেন্টাইন হবি?
তোর বিরহে কাঙাল আমি, আমি ব্যর্থ কবি।”
ও আমায় দেখতে পেয়েছে! চোখে আনন্দের ঝিলিক। মুখে অনাবিল খুশির হাসি।
বন্ধুরা কিছু বোঝার আগেই এক দৌড়ে এসে সোজা আমার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বললো, ভেতরে এলে না কেন? আচ্ছা, ছাড়ো ওসব। ব্ল্যাক টি শার্টে তোমাকে দারুন স্মার্ট লাগছে। ভুঁড়িটা একটু কম হলে আমার বন্ধুরাও তোমার জন্য ফিদা হয়ে যাবে। জিম করছ না আজকাল?
ভিড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি ওর কপালে একটা চুমু দিলাম। আর বললাম, কী রে, কফি খাবি?
এখন মনে পড়লো ওকে নিয়ে লেখা কবিতার প্রথম অংশটা:
” তিরিশ বছর আগে যদি
তোর সঙ্গে হতো আমার দেখা,
তিস্তা নদীর জংলা পাড়ে,
নির্জনতায়, একা
আমি বলতাম, বলো, আমার, শুধু আমার হবে তুমি।
তোমার চোখে প্রতিবিম্বিত আমার স্বদেশ ভূমি ।”
জানিনা এর আগে কজন বাবা তাদের মেয়েকে নিয়ে এমন কবিতা লিখেছেন।
হ্যাঁ, ও আমার টিন এজার মেয়ে, ওর নাম কঙ্কনা। ওর মা চলে যাবার পর থেকে ওই এখন একাধারে আমার গার্জেন, মেয়ে এবং সবথেকে ভালো বান্ধবী।
আমার কোলে যে খেলতো, আমার গলা জড়িয়ে থাকতে চাইতো সবসময়, আমার সেই ছোট্ট পুতুলের মত মেয়েটা কবে জানি তার পুরোনো ভূমিকায় প্রাক্তন হয়ে গেছে, অার মা অার বান্ধবীর ভূমিকায় বর্তমান হয়ে আছে। ও থাকে দক্ষিণ কলকাতায়, পেয়িং গেস্ট হয়ে। অার আমি দু বছরের জন্য বিশেষ কাজে মার্কিন দেশের শিকাগো শহরের কাছে সাউথ বেন্ড বলে এক জায়গায় একটা প্রজেক্ট নিয়ে গেছি। আগামী মার্চে দেশে ফিরব।
আমার খুব একলা লাগে ওই বড্ড শীতের দেশে। তবে আমি জানি আমার মায়ের মতন, সেরা বান্ধবীর মতন একজন এই দূর থেকেও আমার ওপর স্নেহের নজর রাখে।
আর এও জানি যে একদিন একটা ওর মতনই স্মার্ট ছেলে ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। ছেলেটির প্রাক্তন বান্ধবী সেইদিন ওর বর্তমান স্ত্রী হয়ে যাবে। অার ও, যেখানেই থাকুক, আমার মা হয়েই থেকে যাবে।
*******
আমার বাবা আর মা একসাথে আমাকে ছেড়ে চলে যান। এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার ওনাদের ছিনিয়ে নেয়। আমার তখন সবে সাতাশ বছর বয়েস, মাত্র মাস ছয়েক আগেই বিয়ে হয়েছিল আমার। অতএব, আমার স্ত্রীকে আমার বাবা মায়ের ভূমিকায় বড্ড তাড়াতাড়ি নেমে পড়তে হয়।
আমার ধার্মিক মা আর বাবা আমাকে প্রায়ই বলতেন, দ্যাখ, এই ব্রহ্মাণ্ডে কোনো কিছুই একেবারে হারিয়ে যায় না, শুধু রূপ বদলায়। মেঘ যেমন বৃষ্টি হয়ে ঝরে গিয়ে নদী, সমুদ্র অার ক্ষেতের ফসল হয়ে যায়। আমরা ভাবি, মেঘ বুঝি মরেই গেলো। কিন্তু, ভেবে দ্যাখ, সত্যিই কি তাই হয়? মেঘ তো নদী, সমুদ্র অার ফসলের ঢেউ এ বেঁচেই থাকে।
আবার নদী, পুকুর, সাগরের জল বাষ্প হয়ে মেঘ হয়ে জন্মায়। আবার তারপরে বৃষ্টি হয়ে ঝরে, কিন্তু মরে না। মেঘেরা কখনো ” প্রাক্তন” হয় কি? নাকি সম্পর্কেরা ?