(প্রথম_পর্ব)
__”ভিতরে আসতে পারি মালবিকা দেবী?”অপরিচিত এক নারীকন্ঠের আওয়াজ শুনে ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতা থেকে বিরক্তভাবে চোখ তুলে তাকান মালবিকা সান্যাল।এই অসময়ে আবার কে এলো?আর সিকিউরিটিদের বলিহারি মনে মনে ভাবেন মালবিকা। মোটা মাইনে দিয়ে পুষলেও কোথায় যে থাকে এরা সুযোগ পেলেই ফাঁকি মেরে খৈনি,নস্যি টিপছে আর যাকে তাকে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে। অবশ্য সিকিউরিটিদেরও বা দোষ কোথায়?সমাজসেবার কাজের খাতিরে খুব কম মানুষ আছে যারা “আঁধারে আলো” ট্রাস্টের মালকিন মালবিকা সান্যালকে চেনেনা।বলতে গেলে এই পুরো শহর থেকে শহরতলি ওনার নামটার সাথে সুপরিচিত।বেশ আত্মসুখও অনুভব করেন মালবিকা এসব ভেবে।যাইহোক ম্যাগাজিনটা মেহগনি কাঠের সেন্টার টেবিলে রেখে পরিচিত কায়দায় চশমার ফ্রেমটা ঠিক করে মালবিকা দেখেন একটি মেয়ে চোখের নীচে কালো ছাপ ওনার সামনে মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রাথমিকভাবে ওকে মনে হচ্ছে কোনো দুশ্চিন্তায় আছে যার জেরে দু তিন রাত ভালো করে ঘুমাতে পারেনি।
ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ঝুলিয়ে মালবিকা বলেন, “হ্যাঁ বল কি দরকার?কি করতে পারি তোমার জন্য।তবে হ্যাঁ স্বামী পালানো কেস হলে আমার সংস্থা তোমার জন্য বিশেষ কিছু করতে পারবে না।থানায় চলে যাও সোজাসুজি।বা কয়েকজন পুলিশকর্তার নম্বর দিতে পারি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারো।”মেয়েটা এবার আকস্মিকভাবে ওনার খুব কাছে চলে এসে ওনার হাতদুটো ধরে বলে,”ম্যাডাম আমি রোজি।বাড়ি কাঁচরাপাড়া।পেশায় একজন নৃত্যশিল্পী।তবে আপনি যা ভাবছেন ওসব কিছুই নয়।আমি অবিবাহিত কিন্তু মা হতে চলেছি।”
ওর হাতদুটো ছাড়িয়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে মালবিকা বলেন,”বুঝেছি এবার।কুমারী মা তাইতো!তোমার সাথে এইসব কুকর্ম যে করেছে তাকে ধরে আনতে হবে তাইতো নাকি সন্তানের জন্মের ব্যবস্থা করতে হবে?”
ঈষৎ থেমে রোজি এবার বলে,”আমার সন্তানের বাবা তো পালায়নি কাকে খুঁজবেন আপনি?সেতো আপনার সামনেই আছে”এই বলে ঘরের ভেলভেট টাচ দেওয়ালে টানানো সুদৃশ্য ফটোফ্রেমটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে দেখায়।শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে কিছুক্ষণের জন্য নেমে আছে একরাশ নিস্তব্ধতা। মালবিকার চোখ বিস্ফারিত এই রোজি মেয়েটা বলে কি মাথা খারাপ হল নাকি ওর?নিজেকে সামলে নিয়ে উনি বলেন,”কি বললে তুমি?জান কার সামনে দাঁড়িয়ে একথা বলছ তুমি?কি করেছে আমার ছেলে রোহিত তোমার সঙ্গে?”
মৃদু কন্ঠে রোজি বলে,”আপনি নিজে একজন সন্তানের মা হয়ে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কি হয়েছে আমার সাথে। একটি মেয়ে আর যাইহোক মাতৃত্ব নিয়ে মিথ্যা কথা বলতে কাঁচরাপাড়া থেকে সল্টলেকে এতদূর ছুটে আসে না এই দুপুর রোদে!রোহিতের সাথে আমার পরিচয় একটি ড্যান্স ক্লাবে।প্রমোটারির সূত্রে আমাদের ওদিকে ওর যাতায়াত ছিল।তারপরে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা,শরীর বিনিময়।বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় ও আমায়।আমিও ভেসে যাই আবেগের স্রোতে।কিন্তু আমার পেটে নতুন প্রাণ আসার খবর শোনার পর থেকেই রোহিত পুরো বেপাত্তা।এমনকি ওর ফোনের সুইচ অফ।রোহিতের মুখেই বেশ কয়েকবার শুনেছিলাম আপনার নাম আর বাড়ি সল্টলেক।সেই অনুসন্ধান করেই এলাম। এখন আপনিই ভরসা। আমার বাড়িতে এখনও পর্যন্ত ব্যাপারটা কেউ জানেনা। আমিও লজ্জার চোটে কিছু বলতে পারিনি মা,বাবা আর ছোট ভাইকে।”
__”রাখ তোমার এসব গাঁজাখুরি গল্প।আমার ছেলেকে আমি চিনি ছোটবেলা থেকে।এমন কাজ রোহিত করতেই পারেনা।না জানি কার না কার পাপ আমার ছেলের কাঁধে চাপাতে এসছ।ভালো চাও তো মানে মানে কেটে পড় এখান থেকে। নইলে কিছু টাকা দিচ্ছি কোনো ক্লিনিকে গিয়ে পাপ বিদায় করো।বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।”
মালবিকার কথা শুনে ধীরে ধীরে পাল্টে যায় রোজির কণ্ঠ।কাটা কাটা ভাবে ও এবার বলে,”তার মানে আপনি কিছুই করবেন না তাইতো?এসব লোক দেখানো সমাজসেবা,আঁধারে আলো ট্রাস্ট সবই ভন্ডামি নিজের পরিচিতি পাওয়ার জন্যই সব নোংরা খেলা।স্বার্থে ঘা লাগলেই আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে সবার।আমি সবাইকে সবটা জানিয়ে দেব।দেখি কি করে মুখ দেখান আপনি এবার।”
__”খুব যে চাটাং চাটাং বুলি আওড়াচ্ছো।কি ভেবেছ আমি ছেড়ে দেব তোমায়?লোক লাগিয়ে তোমাদের ভিটেমাটি যা আছে নিয়ে নেব।আর তোমাদের যা অবস্থা শুনছি তাতে তোমার মা,বাবা একটা গোটা ফ্ল্যাট পেলে বর্তে যাবে। সারাজীবন কুড়েঘরে কাটিয়ে শেষজীবনে একটা ফ্ল্যাট সেইসাথে তোমার ভাইয়ের ভবিষ্যত।তখন তোমার মত মেয়ের কথা ভাবতে বয়েই গেছে ওদের।তাছাড়া ওরা যখন তোমার কুকীর্তি যখন শুনবে তখন তো এমনিতেই ওই বাড়িতে তোমার কোনো ঠাই হবেনা।এবার ভেবে দেখ আমার মুখোশ খুলবে নাকি নিজের মুখ বাঁচাবে?টাকাটা নিলে নাও নইলে বিদেয় হও এবার আমার চোখের সামনে থেকে।একটু পরেই পার্লার থেকে লোক আসবে আমার পেডিকিউর করাতে।অনেক বাজে সময় নষ্ট হল তোমার মত ফালতু মেয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে।আমি এবার উঠব।”কথাগুলো শেষ করে উঠে দাঁড়ান মালবিকা।
রোজি বলে,”ও পাপের টাকা আপনি রেখে দিন মালবিকাদেবী।আমি আসি।”
__”হল তো বুলি বন্ধ। যত্তসব উটকো ঝামেলা”তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অন্য ঘরে চলে যান উনি।খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়ায় রোজি।
অনেকক্ষণ বাসস্টপে বসে থাকে ও।বিকেল হতে চলেছে প্রায় পাখিরা তাদের বাসায় ফিরছে কিন্তু রোজি কোথায় ফিরবে।পা দুটো যে আর চলছেনা ওর। বেশ খানিকক্ষণ বসার পর বাস ধরে শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছায় ও।তারপর ফেরার ট্রেন ধরে।একটা বসার জায়গাও পেয়ে যায় কোনমতে।জানলার বাইরে চোখ রেখে রোজি ভাবে আচ্ছা কি করবে ও এখন বাড়ি কি ফেরা যাবে আদেও?মিসেস সান্যাল এতক্ষণে যদি ওর বাড়িতে সবটা জানিয়ে দিয়ে থাকেন তাহলে তো সব শেষ।না একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে ওকে তা সে যত কঠিন হোক না কেন।স্টেশনে নামে ও।কাঁচরাপাড়া স্টেশনে খুব বেশি লোকজন নেই এখন।একটা ফাঁকা বেঞ্চে এসে বসে রোজি। মুখের চোয়াল শক্ত হয় ওর।নিজের সিদ্ধান্ত ঠিক করে নিয়েছে ও। তবে তার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে রাত না বাড়লে ওকে যে কেউ দেখে ফেলে কাজে বাধা দিতে পারে তখন আরেক বিপত্তি। একবারেই যা করার করে ফেলতে হবে।সাইড ব্যাগ নিজের ঘুঙুর জোড়া বের করে পরম মমতায় হাত বোলাতে থাকে রোজি কত ইচ্ছে ছিল নিজের একটা নাচের স্কুল খুলবে।কচিকাঁচাদের কলরবে ভরে উঠবে চারদিক।সে সব স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেল। শেষবারের মতো ঘুঙুরজোড়ায় স্নেহচুম্বন এঁকে ট্রেন লাইনের ধারে এসে দাঁড়ায় ও।না এখন আর আশপাশে বিশেষ কেউ নেই দু চারজন ভবঘুরে এদিক ওদিক ঘুমে ঢুলছে আর একপাল কুকুর টিকিট ঘরের সামনে ঝগড়ায় মত্ত। এই সুযোগ।ট্রেনের আওয়াজ শুনতে পায় রোজি দুর থেকে দূর থেকে আবছা দেখা যায় ট্রেনের আলো।সর্বক্ষণের ভালোবাসার সঙ্গী ঘুঙুর জোড়াকে আঁকড়ে ধরে ও বাড়ায় সেদিকে।।।
(দ্বিতীয় পর্ব)
ট্রেনের আলোটা কাছাকাছি আসতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে রোজি।এমনসময় কাঁধের পিছন থেকে একটা হ্যাঁচকা টান।মনে হয় ট্রেন লাইন থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়ল ও।প্রায় সাথেসাথেই অপরিচিত এক পুরুষ কন্ঠ বলে ওঠে,”মরার খুব সখ হয়েছিল বুঝি?নিজে নিজেকে খুন করা একটা বড় অপরাধের সামিল।জানেন আত্মহত্যা করতে যাওয়ার জন্য আপনাকে আমি জেলে পাঠাতে পারি?”
ঘটনার আকস্মিকতা সামলে এবার চোখ মেলে তাকায় রোজি।বুকটা তখনও ধুকপুক করছে।কোনমতে ঢোক গিলে বলে,”বরং জেলেই নিয়ে চলুন তাহলে।কি নিয়ে বাঁচব বলতে পারেন।সেইজন্য তো মরতে এসছিলাম।কে আপনি কেনোই বা বাঁচালেন আমায়।কি লাভ আমার বেঁচে থেকে?”
__”আমি পরম মানে পরমামন্দ পালিত,পেশায় একজন পুলিশ।ঠাম্মা সখ করে আমার রেখেছিলেন নামটা কিন্তু বড্ড সেকেলে বলে আমি পরম বলি।আর হ্যাঁ আমি চাই সকলে আনন্দে থাকুক।কিন্তু আপনি সবকথা কি এই রাতদুপুরে স্টেশনে বসে শুনবেন নাকি এই অধমের সাথে বিশ্বাস করে যাবেন আমার বাড়ি?খুব বেশি দূর নয় কাছাকাছিই বলতে পারেন।আমিতো রাত্রে ঘুম না পেলে এখানে চলে আসি। মাঝরাতের নিস্তব্ধতা, ট্রেনের হুইসল খুব ভালো লাগে জানেন।মন ভালো হলে আবার ঘরে ফিরে যাই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছেন।তবুও ভরসা দেখতে পারেন একবার এই বন্ধুটিকে।”অচেনা পুরুষটির কথা বলার ধরনের মধ্যে কি ছিল জানেনা রোজি।এমনিতেও কোথাও যাবার জায়গা নেই।যা থাকে কপালে ভরসা করে পরমের সাথে পথ চলতে শুরু করে ও।ওর বাড়ি গিয়ে পৌঁছায়।কিন্তু বাড়ি তো ফাঁকা।একটু ইস্ততত করতেই পরম বলে,”কি ভাবছেন এত?এখানে আমি একাই থাকি অবশ্য সারা দুনিয়ায় আমার বন্ধু বলতে শুধু আমি নিজে।
__”কেন আপনার মা, বাবা, ঠাম্মা সকলে কোথায়?দেশের বাড়িতে বুঝি?” রোজি ওর দীঘলকালো চোখদুটো পরমের দিকে তুলে জিজ্ঞাসা করে।
পরম হাতদুটো উপরের দিকে তুলে বলে,”ওই যে আকাশের তারা হয়ে গেছে ওরা একসাথে তিনজন। আমার তখন বছর দশ বয়স।দিল্লি বেড়াতে গেছিলাম সকলে মিলে। ফেরার পথে ট্রেন দুর্ঘটনাতে সব শেষ।শুধু আমি বেঁচে যাই অদ্ভুতভাবে।মামা মামীমার কাছে মানুষ হই তারপর।যাক সেসব!আচ্ছা শুনুন খাবারদাবার তেমন কিছুই নেই ঘরে ব্যাচেলর মানুষ তো।কাল সকাল হলে দেখব।আজ রাতটা বরং চা,বিস্কুট খেতে খেতে আপনার গল্পটা শোনা যাক।একটু অপেক্ষা করুন বানিয়ে নিয়ে আসি”; এইবলে পরম চা বানাতে যায়।
সোফায় বসে রোজি জড়সড় হয়ে।একটু অপেক্ষা করতেই চা এসে পড়ে।সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি রোজির।খেতে খেতে ধাতস্থ হয়ে সমস্তটা খুলে বলে ও।যা অবস্থা তাতে লুকিয়েও কোনো লাভ নেই। সবটা শুনে পরম বলে,”অনেক ধকল গেছে আপনার উপর দিয়ে। এবার একটু বিশ্রাম নিন।”
__”কিন্তু আপনি?”রোজি বলে।
__”কাজের খাতিরে রাত জাগা আমার ভালই অভ্যেস আছে।ওই নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।নিন শুয়ে পড়ুন”পরম উত্তর দেয়।
এমনিতেও আর কথা বলার মত অবস্থায় ছিলনা রোজি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দু চোখে ঘুম নেমে আসে। ওকে ঘুমাতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বারান্দায় আসে পরম।আজ একটা প্রাণ থুড়ি দু দুটো প্রাণকে বাঁচাতে পেরেছে ও। রোজি যে মা হতে চলেছে। সুস্থভাবে ওর সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতেই হবে।নিজের সিদ্ধান্ত ঠিক করে নেয় পরম।তবে কিছু কাজ এখনও বাকি আছে।যা করার এই মাঝরাতেই করতে হবে ওকে।বাড়ি থেকে বেরোয় ও।সকালে ঘুম থেকে উঠে পরমকে কোথাও দেখতে পায়না রোজি।সত্যি এই মানুষটাকে বোঝা দায়! বিপদে উদ্ধারকর্তা রূপে দেখা দিয়ে এখন নিজেই গায়েব যাবার আগে একটু বলে তো যেতে পারত ওকে।কি যে হতে চলেছে কে জানে। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে এবার।একা ঘরে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজটা ছাড়া আর কিছু নেই।অদ্ভুত মানুষ বটে পরম এসব ভাবতে ভাবতে স্নানঘরে ঢোকে রোজি।জল গায়ে পড়লে যদি একটু ভালো লাগে এই ভেবে।
অন্যদিকে একই সময় সল্টলেকের প্রাসাদোপম বাড়ির ড্রইংরুমে বসে মালবিকা সান্যালের চোখ তখন খবরের কাগজের পাতায়।একটা জায়গায় এসে চোখ আটকে যায় ওনার কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে ভোররাতে উদ্ধার হয়েছে এক তরুণীর মৃতদেহ তার ব্যাগে একজোড়া ঘুঙুর সন্দেহ করা হচ্ছে ওটা কোনো নৃত্যশিল্পীর মৃতদেহ।কিন্তু ট্রেনের ধাক্কায় পুরো তালগোল পাকিয়ে মাংসপিণ্ডর দলাতে পরিণত হয়েছে।চেনার কোনো উপায় নেই। পুরোটা পড়ে মালবিকার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে একটা ক্রুর হাসি।যাক আপদ বিদেয় হয়েছে তাহলে।ওনাকে আর নিজের হাতে কিছু করতে হলনা।রোহিতকে জানাতেই হচ্ছে ব্যাপারটা, ও জানলে খুব খুশি হবে।কদিন ধরে ও টেনশনে ছিল ওই রোজির জন্য পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল এদিক ওদিক।এবার ওকে বাড়ি ফিরতে বলতে হবে।সেইমত ফোনে ছেলেকে সবটা জানিয়ে একটা বিকেলে বাড়িতে একটা ছোটখাট পার্টির আয়োজন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মিসেস সান্যাল। হাজার হোক নিজের ছেলে বলে কথা ওই আলটপকা মেয়েটার জন্য কম ধকল তো যায়নি বেচারার উপর দিয়ে…
ধকল যে রোজির উপর দিয়েও কম কিছু যায়নি সেকথা ভাবছে কে? সাওয়ারের নীচে ভিজতে ভিজতে ভাবে ও।জলের ফোঁটা ফোঁটা বিন্দুরা কি পারবে ওর মনের তীব্র দহনজ্বালা মেটাতে? সে যাইহোক স্নান সেরে বেরাতে বেরাতেই রোজি দেখে পরম বাড়ি ফিরেছে হাতে একখানা পেল্লায় ব্যাগ।ওকে দেখেই পরম হেসে বলে ওঠে,”এই যে ম্যাডাম সুপ্রভাত।সরি হটাৎ একটা কাজ মনে পড়ায় গতকাল বেরিয়ে যেতে হয়েছিল।আপনাকে ওভাবে ঘুমাতে দেখে আর ডাকিনি। এবার ধরুন এগুলো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করতে হবে তো?”
__”রাখুন আপনার খাওয়াদাওয়া।অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!রাত্রে রেলস্টেশনে একা একা ঘুরে বেড়ান,মাঝরাতে বেরিয়ে যান কিসের এত কাজ বলবেন?”;চুল থেকে গড়িয়ে পড়া জল মুছতে মুছতে বলে রোজি।
সকালের আলো এসে পড়ছে ওর চোখেমুখে।ওর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পরম বলে,”কি কাজ সেটা সময় আসলেই বুঝতে পারবেন।তবে বন্ধু হিসেবে একটা কথা বলছি আপনাকে কিন্তু মনের দিক থেকে অনেক শক্তিশালী হতে হবে।অন্তত যে আসছে তার কথা ভেবে।” পরমের কথায় একটু চমকে পেটের উপর হাত রাখে রোজি।নতুন প্রাণের স্পন্দন কানে বাজে ওর।সত্যি যার আসার জন্য এত লড়াই তার জন্য ওকে ঠিক থাকতেই হবে।নাহ্ পরম ভুল কিছু বলেনি।ওর দিকে একবার চোখ তুলে তাকায় রোজি তারপর অস্ফুটে বলে,”রাখব পরম নিশ্চয় খেয়াল রাখব। এখন কি খাবেন বলুন?”
__”জো আপকি মর্জি তবে আপাতত একটু চা চাই।কাল রাত থেকে যা যাচ্ছে একের পর এক তবে আরো অনেক কিছু বাকি সেটা চা খেতে খেতে বলব।”,উত্তর দেয় পরম।
রোজি ঝটপট চা নিয়ে আসতেই পরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে,”এই নিন আজকের সংবাদপত্র। ভালো করে পড়ে দেখুন।”পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় গিয়ে চোখ আটকায় রোজির।মনের মধ্যে জমা ঘন কালো মেঘের মাঝে উঁকি দিয়ে যায় একফালি রুপোলি বিদ্যুতের রেখা।সব আশা শেষ হয়ে যায়নি তাহলে।কাগজটা হাতে নিয়ে রোজি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।নীরবতা ভেঙে পরম বলে,”আমাদের খুব বেশিদিন আর এখানে থাকলে চলবেনা ঠিকানা বদলে ফেলতে হবে আত্মসুরক্ষার স্বার্থে।নিন উঠে পড়ুন যেটুকু যা আছে গুছিয়ে নিয়ে আজ রাতের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব আমরা নতুন ঠিকানায়।”
(তৃতীয়_পর্ব)
সেই রাতের মধ্যে কাঁচরাপাড়া ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায় ওরা।যেখানে রোজিকে কেউ চেনেনা।একটা বাড়ি ভাড়াও পেয়ে যায় ওরা শেষমেশ। ছোট্ট হলেও বাড়িটা বেশ ছিমছাম।ধীরে ধীরে পরমের সাহচর্যে জীবনের মূলস্রোতে ফিরতে থাকে রোজি।পরমের একার সংসারটাও রোজির স্পর্শ পেয়ে সেজে উঠতে থাকে নতুন ছন্দে।সম্পর্কটাও আপনির গণ্ডি ছেড়ে তুমিতে এসে পৌঁছায়।রোজ সকালে উঠে পরম কাজে বেরোবে বলে ওর জন্য খাবার করা,দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে রোজি ভিতরে ভিতরে অনুভব করে যত দিন যাচ্ছে ও পরমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।আচ্ছা এটা কি ভালোবাসার পরিচয় নাকি শুধুই ভালোলাগা!না আর ওসব পথে পা বাড়াবে না ও।পরম নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে যা করছে ওর জন্য তাতে এসব ভালোবাসার বললে যদি ওদের বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়ে যায় এই ভেবে মনের ভাব মনেই চেপে রাখে রোজি।সময় এগিয়ে চলে তার আপন ছন্দে।এইভাবে পেরিয়ে যায় প্রায় মাস চারেক।প্রতিদিন পরম বেরিয়ে যাওয়ার পর আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় রোজি।আজও তার কোনো ব্যতিক্রম হয় না।চেহারার পরিবর্তন আর পেটের মধ্যে নড়াচড়া প্রতিমুহূর্তে জানান দিচ্ছে কদিন পরেই একটা নতুন প্রাণ আসবে।যাকে রোজি নিজের শরীরের মধ্যে সযত্নে লালন করে চলেছে এটা ভেবেই শিহরিত হয় ও।
কিন্তু তারপর কি হবে? বাচ্চাটা কি পরিচয়ে বড় হবে! অবশ্য নতুন জায়গায় সকলেই ওকে আর পরমকে স্বামী স্ত্রী ভাবে।এইতো দিন দুই আগে বাড়িওয়ালা বৌদি এসে ওকে পুজোর রান্নাভোগ, ফুল আর একপাতা সিঁদুর দিয়ে বলে গেল,”তোমার স্বামীর মঙ্গলকামনায় প্রতি বৃহস্পতিবার এই সিঁদুর পরো কিন্তু।খুব জাগ্রত ঠাকুর উনি, মনের সব ইচ্ছাপূরণ হয়।”চমকে উঠেছিল রোজি। কে ওর স্বামী,কি ওর আসল পরিচয়।আর কেউ জানুক না জানুক প্রত্যেক সময় মনের অন্তরমহলে কি ঝড় চলে তা শুধু রোজিই জানে।বাইরের লোককে সেটা বুঝতে দিলে আখেরে নিজের ক্ষতি সেইসাথে পরমের ক্ষতি ডেকে আনা এই ভেবে পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়েছিল রোজি।
কিন্তু আর কতদিন? নেপথ্যচারিণীর মত এভাবেই কি কাটিয়ে দিতে হবে সারাজীবন।লোকসমক্ষে আর কি কখনো কি আসতে পারবেনা রোজি।ঘুঙুরের শব্দ কি চিরতরে হারিয়ে যেতে চললো ওর জীবন থেকে।
সেদিন রাতে ওই ঘটনার পর তো প্রাণের প্রিয় জিনিসটাকে হারিয়ে এসছিল ও স্টেশন চত্বরে।আচ্ছা পরমকে কি ও একবার বলে দেখবে আরেকজোড়া নতুন ঘুঙুর আনার কথা।না থাক বরং…
একে নিজে পরমের উপর উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তারপর আবার ঘুমুরের সখ!মানুষের মন তো বসতে পেলেই শুতে চায়।নিজে নিজের মনকে ধমকায় রোজি।এমনসময় দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটার ঘণ্টা পড়ে।ছি ছি এতক্ষণ ভাবনার সাগরে ডুবে এসব কি ভাবছিল ও।পরম ফেরার সময় হয়ে গেল প্রায়।চিঁড়ের পোলাও বানাবে ভেবেছিল আজ ওর জন্য।অনেক দেরি হয়ে গেল।ঝটপট রান্নাঘরে যায় রোজি রান্নার আয়োজন করতে থাকে।পোলাও প্রায় শেষের দিকে এমনসময় দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ শোনে রোজি।ওই পরম ফিরলো বোধয়।হ্যাঁ যা ভেবেছে ঠিক তাই আইহোল দিয়ে রোজি দেখে পরম দাঁড়িয়ে,ওর হাতে একটা সুদৃশ্য প্যাকেট।দরজা খুলতেই পরম ওর চোখ চেপে ধরে নিয়ে যায় আয়নার সামনে।
__”আরে করছটা কি?কি পাগলামি হচ্ছে এসব?”রোজি বলে।
__”পাগলামি ছাড়া বন্ধুত্ব জমে নাকি।একদম চোখ খুলবে না আমি না বলা পর্যন্ত…”পরম বলে ওকে।
__”আচ্ছা অগত্যা তাই সই”;বলে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে ও।
এমনসময় রোজি ওর পায়ে অনুভব করে খুব চেনা একটা জিনিসের স্পর্শ।আহা কতদিন পর মনে হচ্ছে শিকড়ের খুব কাছাকাছি আছে ও।পরম বলে,”এবার চোখ খোলো।”
চোখ মেলে তাকাতেই রোজির চোখ বেয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ে বিন্দু বিন্দু খুশির জল ওর পায়ে শোভা পাচ্ছে এক জোড়া ঘুঙুর ঠিক আগেরটার মত।পরম কি টেলিপ্যাথি জানে নাকি?ও কি করে বুঝল আজ রোজি ভীষণভাবে ওর ঘুঙুরজোড়াকে মিস করছিল।
পরম এবার নিজের পরিচিত ভঙ্গিতে বলে,”কি অবাক হয়ে গেলে তো?”
_”হুম এযে মেঘ না চাইতেই জল ভাবিনি কখনো এভাবে হারিয়ে যাওয়া জিনিসটার মতই অবিকল আরেকটা পাব”; অস্ফুটে বলে রোজি।
__”শুধু হারিয়ে যাওয়া ঘুঙুর নয়।হারিয়ে যাওয়া সবকিছুর বিচার পেতে এবার শুরু করতে হবে অন্যদের অবাক করার খেলা।তুমি প্রস্তুতি শুরু করো আস্তে আস্তে আর এই ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করবে আমাদের নতুন বন্ধু রশ্মি।মনে রেখ নতুন অতিথি মনে তোমার সন্তান আসার পরই পুরো মাত্রায় লেগে পড়তে হবে কিন্তু।রশ্মি কিন্তু আগামীকাল থেকেই আসবে এখানে।কি পারবে তো সব?”পরম জিজ্ঞাসা করে।
হাতের মুঠি শক্ত করে রোজি বলে,”আমি পারবই পারব পরম।আমি হেরে গেলে যে তুমি আর তোমার এত লড়াই সব হেরে যাবে সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না।”
__”এইতো গুড গার্ল।এবার দাও দেখি আজ কি বানালে টিফিনে?চিঁড়ের পোলাওয়ের গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে..”;বলতে বলতেই পরম রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
__”আচ্ছা পেটুক তো,আগে হাত পা ধোও।দিচ্ছি আমি”; হেসে উঠে রোজি বলে ওকে।জমে ওঠে ওদের বন্ধুত্বের খুনসুটি।
রশ্মি এসে পড়ে পরদিন। রোজিকে দেখাশোনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে শুরু হয় বুদ্ধিমত্তার তালিম,বিপদে পড়লে কি করে আত্মরক্ষা করা যায় তার খসড়া বানানো।ইতিমধ্যে কয়েকমাস পরেই জন্ম নেয় নতুন প্রাণ।পরম,রোজি মিলে নাম রাখে স্পন্দন।ওকে রশ্মির দায়িত্বে রেখে রোজি এবার পুরোপুরি তৈরি যুদ্ধে নামার জন্য।
অন্যদিকে রোহিত সান্যালের জীবনে নেমে আসে অন্য বিপত্তি।বছরখানেক ধরে রোজি নামের আপদটা বিদেয় হয়ছে ভেবে বেশ নিশ্চিত ছিল ও।এদিক সেদিক গজিয়ে ওঠা সিন্ডিকেট,ফ্ল্যাট, রঙিন পানীয়র ফোয়ারা কিছুই বাকি কিন্তু সম্প্রতি অজানা এক মহিলা কণ্ঠ ওকে জ্বালিয়ে মারছে সারাক্ষণ।বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে রোজির কণ্ঠে বলছে।রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে এক অচেনা নারীও যেন ওর পিছু নিচ্ছে রাতবিরেতে।কিন্তু রোজি কি করে ফিরে আসবে?মা মালবিকা যে বলেছিলেন ও কাঁচরাপাড়া স্টেশনচত্বরেই মারা গেছে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে কাটা পড়ে। খবরের কাগজটাও তো দেখেছিল ও নিজের চোখে তবে কি রোহিত ভুল দেখেছিল? এমনটা তো হবার নয়।এমনকি পরে রোজির বাড়িতে,ওই এলাকাও তন্নতন্ন করে খুঁজে এসছে রোহিতের লোকজন।কোনজায়গায় কিচ্ছু পাওয়া যায়নি।তবে কি এটা হ্যালুসিনেশন।কোনো ডাক্তারের সাথে একবার আলোচনা করে নেবে রোহিত ভাবতে ভাবতে নিজের শীততাপনিয়ন্ত্রিত চেম্বারে বসে মনোবিদ ডাক্তার সুধীন হাজরার নম্বর ডায়াল করে পরদিনের অ্যাপয়েনমেন্ট ঠিক করে ও। তারপর ফোন ছেড়ে পার্কিং লটে এসে সদ্য কেনা বিদেশি গাড়িতে উঠতে যাবে এমনসময় পিছন থেকে এক নারীকন্ঠ বলে ওঠে,”ডাক্তার সুধীন হাজরার অধীনে ভর্তি হবে রোহিত?পাগল হয়ে গেলে নাকি এই রোজির ভয়ে।”
পিছন ফিরে তাকাতেই রোহিত দেখে আশপাশে কোথাও কেউ নেই কিন্তু খুব চেনা একটা পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে ও।হ্যাঁ মনে পড়েছে রোজি এই বিশেষ ব্র্যান্ডের পারফিউম ব্যবহার করতো। চিৎকার করে রোহিত বলে,”যেই হও সাহস থাকে তো সামনে এসে কথা বল। মালবিকা সান্যালের ছেলে ভয় পায় না।”
__”আচ্ছা তাই নাকি তাহলে এবার থেকে মাঝেমধ্যেই দেখা হবে আজকে আসি” সেই নারীকণ্ঠ বলে ওঠে আবার। মাথা চেপে ধরে গাড়ির মধ্যে বসে পড়তেই রোহিত দেখে একটা ঝাপসা নারীর মূর্তি পায়ে ঘুঙুর বাঁধা একছুটে বেরিয়ে গেল ওর সামনে দিয়ে।
অন্তিম পর্ব
অতিথিরা এইসব কাণ্ড দেখে হকচকিয়ে যান, খাওয়াদাওয়া মাথায় ওঠে।মালবিকার স্বামী উত্তেজিত হয়ে পরমের সামনে দাঁড়িয়ে হুমকি দিতে থাকেন ছেলে রোহিত আর স্ত্রী মালবিকাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।নিকিতাও ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে মা বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় কি শুনছে ও এসব।কার ক্ষতি করেছে রোহিত?কে এই রোজি।
মালবিকা চিৎকার করে বলতে থাকেন,”চাইলেই এভাবে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া যায় নাকি উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া…”
__”প্রমাণ তো সব তৈরিই আছে ম্যাডাম সান্যাল। তাছাড়া এতগুলো লোকের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার ছেলে যা স্বীকার করলো সেগুলো কিন্তু সব রেকর্ড হয়ে গেছে।এখানে প্রত্যেক টেবিলের নীচে রেকর্ডার লাগানো ছিল আগেভাগেই।রোজি বেরিয়ে এসো এবার”;পরমের ডাকে বেরিয়ে আসে রোজি।ওর পায়ের ঘুঙুর জোড়ার আওয়াজে মাথা নীচু করে বসে পড়ে রোহিত।সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মত মেরুদণ্ড যে ওর নেই।রোজি মালবিকার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”কি ম্যাডাম চিনতে পারছেন?আঁধারে আলো ট্রাস্টের মালকিন আপনি শহরজোড়া নাম আপনার।আজ তার মুখোশটা বেরিয়ে পড়ল তো!”
বেগতিক বুঝে এবার পিছু হটতে থাকেন মালবিকা। পিছন থেকে ওনাকে ধরে ফেলে রশ্মি বলে,”কোনো লাভ নেই ম্যাডাম পালানোর চেষ্টা করে।নর্তকী আর ওয়েটারের ছদ্মবেশে এখানে যারা রয়েছে তারা সব পুলিশেরই লোক।”
মুখ থেকে আর কথা সরেনা মালবিকার।পরম এবার অতিথিদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে,”দয়া কেউ বিভ্রান্ত হবেন না।সকলের কাছে অনুরোধ একটু ধৈর্য্য ধরে পুরোটা শুনুন যার সাথে এই ঘটনা ঘটেছে স্বয়ং তার মুখ থেকে…”এই বলে রোজির দিকে এগিয়ে দেয় মাইক্রোফোন।
এসব দেখে অনেকেরই ঔৎসুক্য আর ধরছিল না পুরোটা শোনার জন্য।এবার রোজি বলতে থাকে একদম প্রথম দিনের ঘটনা থেকে
__”আমি রোজি।এক সাধারণ নারী,পেশায় একজন নৃত্যশিল্পী।খুব সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে।দু চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে আমিও চাইতাম আমার পরিবারটাকে দাঁড় করাতে।কিন্তু আমার জীবনটা অন্য খাতে বইতে শুরু করল যখন রোহিত এলো আমার জীবনে।ওর মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয়ে আবেগের স্রোতে ভেসে গেছিলাম আমি।তার ফলস্বরূপ নতুন প্রাণের সঞ্চার হয় আমার শরীরে। রোহিত দায়িত্ব এড়াতে কেটে পড়ে।আমি বাধ্য আর নিরুপায় হয়ে মালবিকাদেবীর কাছে আসি। হাজার হোক উনি তো একজন মা,আরেকজনের মায়ের কষ্ট উনি নিশ্চয়ই এড়িয়ে যেতে পারবেন না এই ভেবে।
কিন্তু না! আমার কথা ধোপে টিকলনা ওনার কাছে,হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন উনি সেদিন আমাকে ওনার বাড়ি থেকে।অন্যদিকে আমার বাড়িতেও আমার মা হতে চলার খবর শুনলে সমাজে আর কোথাও আমাদের থাকার ঠাই হবেনা এই লজ্জায় অনেক ভেবে আমি সেদিন রাতে ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দিতে যাই।কিন্তু না পরমের সাথে সৌভাগ্যক্রমে আলাপ হওয়ায় বেঁচে যাই আমি।তারপর ওকে খুলে বলি আমার জীবনকাহিনী।ও আমায় ভরসা যোগায় পরম বন্ধুর মতই।
পরদিন ভোরে কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে লাশ আর ঘুঙুর উদ্ধারটাও ছিল মালবিকা আর রোহিতকে ধোঁকা দেবার জন্য।যাতে ওদের বিশ্বাস হয় রোজি নিজের লজ্জা ঢাকতে আত্মঘাতী হয়েছে।পুলিশের উঁচু বিভাগে চাকরির সূত্রে মর্গ থেকে বেওয়ারিশ লাশ জোগাড় করা পরমের কাছে খুব একটা কঠিন কাজ ছিলনা।সেই সুযোগটাই কাজে লাগে ও।আর মালবিকারা সেই টোপ গিলেও ফেলেন। ওদের বিশ্বাস আরো দৃড় হয় যখন আমার ঠিকানায় গিয়ে ওরা আমাকে খুঁজে পায়না। কারণ ঠিকানা বদল করে আমি তখন পরমের সাথে চলে গেছিলাম কাঁচরাপাড়া থেকে অনেক দূরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক ছোট্ট গ্রাম পিয়ালীতে।ওখানেই ধীরে ধীরে আমার সাথে হওয়া সমস্ত অন্যায়ের জবাব দেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি আমি সঙ্গে অবশ্যই ছিল এই পরম আর রশ্মি। আমার বাচ্চাটাও পৃথিবীর আলো দেখে।
তারপর সান্যালবাড়ির উপর নজর রাখা থেকে ফোনে আড়ি পাতা,রোহিতের পিছু নেওয়া সবই চলতে থাকে।আর বাড়ির অন্দরমহলের খবর পরম আর আমাকে এনে দিত বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক মীনা।ওই বাড়ি থেকে মীনাকে বেরোনোর ঢোকার সময় মীনাকে অনুসরণ করে মোটা টাকার প্রলোভন দেখাতেই ও রাজি হয়ে যায় কাজটা করে দিতে। ওর বাড়িতে অসুস্থ স্বামী,ছেলের পড়াশুনোর মুখ চেয়ে।ব্যাস তারপরই কেল্লাফতে। রোহিতের এনগেজমেন্ট পার্টির দিন যে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার হাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে পুরো মাস্টার প্ল্যানটা করি আমরা।”এতক্ষণ রুদ্ধশ্বাসভাবে সকলে শুনছিলেন সকলে, কারুর চোখের পাতা পড়তেই চাইছিল না।এযে সত্যিসত্যিই এক নারীর হার না মানার লড়াইয়ের গল্প।
রোজির কথা শেষ হয়।গ্রেপ্তার হয় ঘটনার মূল পান্ডা রোহিত আর মালবিকা।ওদের লক আপে ঢুকিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পালা পরমের।রাত তখন অনেক গভীর।রোজি পরমকে বলে,”আর কি,এবার তো গল্প শেষ।স্পন্দনকে নিয়ে আমাকে যেতে হবে নতুন ঠিকানায়।অনেক করলে পরম আমার জন্য।ধন্যবাদ দিয়ে তোমায় ছোট করব না।”
__”কে বললো ম্যাডাম গল্প শেষ!এই তো সবে শুরু।এখনও অনেক বাকি পথ চলা আর স্পন্দন কি তোমার একার নাকি?তাছাড়া তোমার নাচের স্কুল ঘুঙুরের জন্য জমিজায়গা দেখতে যেতে হবে তো?সব কাজ কি আমি একা করব!তার উপর এই রবিবার আবার আমার মামা,মামী আসছেন বোলপুর থেকে।অনেকদিন ধরে ওরা আমার বিয়ে দেবার জন্য উদগ্রীব। আর ওদের ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছেনা।তাই বিয়ের সম্মতিটা দিয়েই দিলাম শেষমেশ।ওরা না আসা পর্যন্ত তোমার ছুটি নেই।নাও গাড়িতে ওঠ এবার”; এই বলে পরম গাড়ির দরজা খুলে অপেক্ষা করে রোজির জন্য।
__”তোমার জন্য পাত্রী দেখা হবে সেখানে আমি থেকে কি করব বলো?অনধিকার চর্চা করার কি দরকার?তোমার ওখানে আমার থাকাটা ওনারা ভালোভাবে নাও মানতে পারেন তাই বলছি….”;রোজি বলে মৃদু কণ্ঠে।
মুচকি হেসে পরম বলে,”কোনটা দরকার আর কোনটা দরকার নেই সেটা কি তোমার একার সিদ্ধান্ত?মামা মামী মানবেনা মানে?আরে বিয়ের পাত্রী সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আর কোথায় যাবে ওরা পাত্রী দেখতে!শোনো আমি ওদের যা বলার বুঝিয়ে বলে দিয়েছি।কোনো আপত্তি নেই ওদের।”
__”মানে কি বলেছ তুমি ওদের?”রোজি বলে বিস্ময়ভরা চোখে। নিজের কানকে ওর বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
__”বলেছি তুমি আমার স্ত্রী হতে যাচ্ছ।সত্যি এত বোঝাতে হয় তোমাকে,পাগলি একটা!”; এই বলে বলে রোজির কপালে চুমু এঁকে দেয় পরম।
কথায় কথায় কখন অন্ধকার রাত কেটে গেছে।ভোরের আলো ফুটছে এখন চারদিকে।সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে পরমের কাঁধে মাথা রাখে রোজি।তারপর ব্যাগ থেকে ঘুঙুরজোড়া বের করে পরমের হাতে তুলে দিয়ে বলে,”আরেকবার পরিয়ে দেবে নতুন করে?”
গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে তখন বাজছে,”ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে…”