-“ঐ,ঐ কিরে সৌম্য এখানে বসে কি ভাবছিস,চল দ্যাখ ঐ মালটা কম্পিটিশনে নাম দিয়েছে, এবার নাচবে।চল ভাই চল।সাথে তিন্নি ও আছে চল না ভাই যাই।”
-“কি বললি ,নাচবে?চল চল যাই।ঐ তুই মাল বললি কেন রে ওকে, বৌদি হবে তোর বুঝলি?”
-“ইশশ,তোকে ও বিয়ে করবে, কে বলেছে!!!তুই গিয়ে প্রপোজ টা কর দেখি আগে।তবে বুঝবো,বাওয়া, এসব অত ইজি না।৪বছর ধরে নাম জানতে পারলেন না মশাই বিয়ে করবে ঐ মেয়েকে।”
-“যা চল ফোট,বেশি বকিসনা।”
-“খচে গেছে ,খচে গেছে।হাহাহা।চলো সোনা , সুন্দরীর নেত্য দেখবো আমরা।হাহাহা।”
ন্ডপে প্রচুর লোক তখন, একের পর এক নাম ঘোষণার সাথে সাথেই পাড়ার মেয়েরা মঞ্চে নাচ করে যাচ্ছে।সৌম্য মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঐ মেয়েকে একদৃষ্টে দেখছিল। মেয়েটি ও যেন এতক্ষণ সৌম্যকেই খুঁজছিল।ষষ্ঠীর সন্ধেটা আজ যেন স্বপ্নের মত সৌম্যর কাছে, গত ৪বছর ধরে মানে সৌম্য যখন ক্লাস টেনে পড়ত তখন থেকেই তিন্নির সাথে ওকে দেখেছিল,আজ তার নাম জানতে পারবে।এই ভাবনা ওকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে।মাইকে সুতপা চ্যাটার্জি নাম ঘোষণার সাথে সাথেই পদ্মাবত সিনেমার ‘ঘুমর’ নাচটা নাচলো ঐ মেয়ে।সৌম্যর চোখের সামনে তখন দীপিকা পাড়ুকোনের চেয়েও ওর প্রেয়সীর নাচটা অধিক ভালো লেগেছিল।নাচের শেষে সবার চেয়ে জোড়ে হাততালি দিয়ে বুঝিয়ে ছিল নাচটা ওর কতটা ভালো লেগেছিল।সুতপা লজ্জায় লাল হয়েগেছিল সেই সন্ধ্যায়।সেদিন যদিও প্রতিযোগিতায় সুতপা কোনো পুরষ্কার পায়নি তবুও সৌম্যর উৎসাহ ও হাততালি যেন ওর কাছে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার ছিল।সৌম্য আনন্দে প্রিয়মকে জড়িয়ে ধরে বলে,-“দেখ দেখ ভগবান আগে থেকেই সব ঠিক করে ফেলেছে না হলে দুজনের নামের এত মিল থাকতো?এস ফর সৌম্য আর এস ফর সুতপা, সব ব্যাপারটা একদম জমে ক্ষীর।আহা কি প্রেম ,ভগবান সব জানেরে।”প্রিয়ম মুখ ভেংচি কেটে বলে,-“তুই ক্ষীর খা ভাই,আমি আজ কাকাদের সাথে হোলনাইট ঠাকুর দেখব,চলিরে।”
.
***********************************************
সপ্তমীর সকালে তিন্নিদের বাড়ির চারপাশে সাইকেলে চেপে ঘুরে এল সৌম্য আর প্রিয়ম ।দুজনেই ঐবাড়ির মেয়েদের দেখতে গেছিল কিন্তু দেখা পেলনা।বিকেলে তৈরী হয়ে পাড়ার মন্ডপে যেতেই দেখে সুতপা আর তিন্নি ওদের মায়েদের সাথে বসে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখছে।তবে সুতপাকে দেখে মনে হয়েছিল ও যেন বারবারই কারোকে খুঁজছে অথচ খুঁজে পাচ্ছে না।প্রিয়মকে দেখে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে সৌম্য দাঁড়িয়ে আছে,এরপর মঞ্চের দিকে কম পেছনের সারির দিকেই বেশিরভাগ সময়টা তাকিয়ে ছিল সুতপা।
সৌম্য বুঝেছিল ওর মনে ঠিক যেমন আগুন জ্বলছিল,সুতপার মনেও একইরকমের আগুন জ্বলছিল।অথচ দুজনের একজন ও এই আবেগ একে অপরের সামনে প্রকাশ করতে পারছিলনা।চোখের চাহনির এই মিষ্টি খেলায় তারা সারা সন্ধেটা কাটিয়ে দিল।সুতপা বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সময় পিছন ফিরে আর ও একবার তাকালো সৌম্যর দিকে।সেই মোহময়ী চাহনিতে কি জাদু ছিল তা কেউ জানেনা, সৌম্য ছাড়া।
পরের দিন মন্ডপে প্রচুর কাজ অঞ্জলি থেকে ভোগ, সন্ধিপূজা ও সবশেষে আরতি প্রতিযোগিতা, তাই পূজা কমিটির কর্মকর্তারা পাড়ার যুবকদের ঘাড়ের ওপর যথেষ্ট দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। সৌম্য-প্রিয়ম দুজনের কেউ বাদ পরেনি এর থেকে।
***********************************************
মহাষ্টমীর ভোর; নীলাকাশে লাল রঙ ঢেলে দিয়েছে রাঙা সূর্য।আজ অনেক সকালে সৌম্য ঘুম থেকে উঠেছে।সকাল সকাল হাতে ব্রাশ নিয়ে সৌম্য মন্ডপে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আর মায়ের দিকে তাকিয়ে কি যেন মনে মনে প্রার্থনা করে।মা তার প্রার্থনা শুনবে কিনা কে জানে।
দেবী প্রতিমার সামনে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারনের সাথে সাথেই বাকিরাও ফুল হাতে সেই মন্ত্র বলতে বলতে মায়ের পায়ে অঞ্জলি নিবেদন করে।সৌম্য অনেক চেষ্টা করে সুতপার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেওয়ার সুযোগ পায়।তবে অঞ্জলির ফুল বেলপাতা সবই সে নিবেদন করে সুতপার মাথায়।সুতপা এসব বুঝেই তিন্নিকে ইশারায় সবটাই দেখায়।তিন্নি একটু চোখ পাকিয়ে সৌম্যকে দেখলে সে লজ্জা পেয়ে যায়, তবে সুতপার মুচকি হাসি তাকে সব ভুলিয়ে দেয়।
অঞ্জলির শেষে সৌম্য একটু সুযোগ করে সুতপার পাশে দাঁড়িয়ে বলে -“তোমার নাচটা সেদিন খুব ভালো হয়েছিল।তোমাকে খুব ভালো লাগছিল।মানে,ভালো লাগে সবসময়ই।কিছু মনে করলে না তো সু-ত-পা।”
-“(সলজ্জ ভাবে, চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ দেখছে কিনা তারপর বলল)না, থ্যাংকস।আমার নাম জানলে কি করে?”
-“কাল জেনেছি, না না তার আগের দিন।(প্রচণ্ড টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা সৌম্যর)”
-“ও আচ্ছা।”
-“আমার নাম সৌম্য, আমার নাম ও তোমার মত এস দিয়ে শুরু।দারুন ব্যাপার না।”
-“হ্যাঁ।”
-“আমি মেডিকেল নিয়ে পড়ছি,এই সেকেন্ড ইয়ারে।তুমি?”
-“আমি টুয়েল্ভে।”
-“এরপর কি পড়বে?”
-“জিওগ্ৰাফি নিয়ে পড়ব আমার মায়ের মত।”
-“মেডিকেল নিয়ে পড়লে হেল্প করতে পারতাম।”
-“ও আচ্ছা।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর দুজনেই একসাথে বলে উঠল-“কাল এভাবে দেখছিলে কেন?”দুজনের কেউই উত্তর দিতে পারেনি শুধুই হেসেছিল।
এরপর ভোগ বিতরণ অনুষ্ঠানে আবার দুজনের দেখা হয়।চাটনি আর পায়েস একটু বেশি করেই দিয়েছিল সৌম্য সুতপার পাতে।সুতপা মুখ নীচু করে হেসেছিল তার এমন কান্ড দেখে, এদিকে তার মা যে সামনে তাই তিন্নিকে ও কিছু বলতে পারছিলনা।খাওয়া হয়ে গেলে সুতপা তিন্নিকে নিয়ে একটু সাহস করে সৌম্যর দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু সৌম্যর দাদা সামনে থাকায় সে ঐ জায়গা থেকে চুপচাপ সরে পরে, সুতপাদের বুঝতে ও দেয় না।
সন্ধ্যায় আরতি প্রতিযোগিতায় প্রচুর ছেলেমেয়েদের নাম নথিভুক্ত হয়।দর্শকের আসন ও ভরে গেছে।সুতপা তিন্নি দুজনেই নাম দেয় এই প্রতিযোগিতায়।প্রিয়ম স্টপক্লক চালানোর দায়িত্বে ছিল।তিন্নি সুতপাদের থেকেও সৌম্যর টেনশনটা বেশি ছিল।প্রতিযোগিতার শুরু থেকেই খুব টেনশন করছিল আর ভগবানের কাছে চাইছিল যেন সুতপা এইবার প্রাইজটা পায়।সুতপার আরতির পর সে মঞ্চের পেছনে গিয়ে সৌম্যর হাত চেপে ধরে বলে -“বোকা রাম আমার আরতি শেষ,আর টেনশন করে লাভ নেই।৪বছর ধরে শুধু আড়চোখেই দেখে গেলে আমাকে।বোকা নাম্বার ওয়ান।কাল থাকবোনা সকাল থেকে পিসেমশাই মানে তিন্নির বাবা ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে,তোমাকে খুব মিস করব,তুমিও নিশ্চই মিস করবে অথচ জানি মুখ ফুটে বলতে পারবে না।এই টুকু সাহস ও নেই।আমাকে এসেই বলতে হল।উফ এমন ফ্যালফ্যাল করে দেখবে নাকি কিছু বলবে।”
-“কিছু বলার নেই, সব তুমি তো বলে দিলে।তুমি খুব স্মার্ট,তুমি খুব সুন্দর, তুমি আমার থেকে অনেক গুনী।আমাকে তোমার ভালোলাগে?”
-“ধুররর,বোকা, ভালোলাগে মানে আবার কি?তোমার জন্যই তো প্রতি বছর আসি পিসির বাড়িতে।এটাও বোঝোনি!!!!তুমি যে কোনো দিন ও বলতে পারবেনা সে আমি জানতাম তাই অগত্যা এই কাজটা করতে হল।”
-“আমার জন্য, মানে আমার জন্য আসো।আমি তো জানতাম না।আমি সত্যিই বোকা।”
-“তিন্নির আরতি হয়ে গেছে, মনে হয় ,ও আবার এদিকে চলে আসবে।আমি চলি বোকা রাম।আর এই দিকে একটু নীচু হও,যা লম্বা তুমি ,এদিকে হ্যাঁ, আ্যএএইইইই , আই লাভ ইউ।”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সৌম্য ঐখানেই বসে পরে।আর উঠতে পারেনা।প্রতিযোগিতার শেষে প্রিয়ম এসে বলে -“এবার ও ওরা দুজনের কেউ জিততে পারেনি।আর তোর টেনশন কমেছে?”
-“ভাই,কেল্লা ফতে,ভাই এই আমার হাত ও ধরেছিল,আর দেখ ভাই এই গালে ও চুমু দিয়ে গেল।আই লাভ ইউ বলল।আমি পাগল হয়ে যাব!!!!”
-“তুই স্বপ্ন দেখছিস,ভাগ,একটা মেয়ে এসে ওকে এত কিছু করল আর ও দেখল ,ছাড়তো স্বপ্ন দেখা।বাস্তবে আয় ফিরে।চল প্যাকেট দেবে আমাদের, খাব ক্ষিদে পেয়েছে।”
-“যা তো ,বিশ্বাস করবিনা যখন তুই যা।ও কাল আসবেনা ,দশমীর দিন প্রমাণ করে তোকে দেখিয়ে দেব।”
-“আরে বাওয়া রাগ করে না এত।চল খেয়ে নিবি।”
************************************************
নবমীর সকাল থেকেই মনটা খুশি খুশি থাকলেও প্রেয়সীর দেখা না পেয়ে খানিকটা দুঃখিত ও ছিল।শুধু দশমীর অপেক্ষা ছিল তার, ঐদিন যে আবার দেখা হবে।দেখা হলে কি সৌম্য ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিতে পারবে? ওকেও কি চুমু দিতে পারবে?অনেক কিছুই তো বলার ছিল, বলতে পারবেকি সব?নানা প্রশ্নের ঝড় ওঠে ওর মনে।
দশমীর সকালে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো, প্রিয়মকে সাথে নিয়ে নিল।মন্ডপে তখন এও স্ত্রীদের ভিড় ,মায়ের বরণের সাথে সাথেই চলছে সিঁদুর খেলার ধুম।ওদের মা- মাসি,থেকে পাড়ার পিসি-জেঠিমা, দিদি-বৌদিরা সবাই সিঁদুর খেলায় মেতেছে।সুতপা ও তিন্নি ও এসেছে ওদের মায়েদের সঙ্গে।ওদের ও অনেকে সিঁদুর দিয়ে টিকা দিয়ে যাচ্ছিল।দূর থেকে সৌম্য এসব দেখে আবার নানা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।সুতপা ওকে দেখে ভয়ডর না করে ভিড়ের মাঝে এসে ওর কপালে সিঁদুর লাগিয়ে হাসতে হাসতে ছুটে পালায়।প্রিয়ম হা করে সব দেখে, আর বলে-” ওরে বাওয়া, এতো চিজ সাধারণ না, অসাধারণ।পাকা মেয়ে বহুত।”
.
***********************************************
বিসর্জনের পর যে যার বাড়িতে চলে যায়।সৌম্যর মনটা খুব খারাপ, পূজা শেষ, আর দেখা পাবেনা সুতপার।ধুর ধুর , এত কিছুর মধ্যে ওর ফোন নম্বরটা ও নেওয়া হয়নি।আফশোস করছে সে ফাকা মন্ডপে বসে, তখন প্রিয়ম এসে বলে -“কয়ি বাত নাহি উস্তাদ, এই বছরটা ঐ চুমুর আবেশ নিয়ে থাক,আগের বছর গুলোতো এটাও ছিল না।যা হবার ভালোই হবে।আসছে বছর আবার হবে।আসছে বছর আবার হবে।”
-“সাহি বোলা ভাই,(তারপর চিৎকার করে বলে ওঠে) আই লাভ ইউ সুতপা, লাভ ইউ সো মাচ!!!”
**********************************************