শ্রেয়সী গালে হাত দিয়ে বসে আছে।রজত এখনো ফিরছেনা।সেই কোন দুপুরে বেরিয়েছে।তার উপরে আজ ন্যাশনাল হলিডে। অন্যদের হাজবেন্ড রা নিশ্চয় এখন বাড়িতে কিম্বা কোনো স্পটে ফ্যামিলির সাথে সময় কাটাচ্ছে।আজ ওর ও মন চাইছিল রজতের সাথে কোথাও একটু ঘুরে আসবে। পরশু রাতে ঘুমোনোর সময় রজতের বুকের উপর হাত রেখে কত আশা নিয়ে বলেছিল,”পরশু তো সব্বার ছুটি চলোনা ঘুরে আসি কোথাও একটা থেকে।কতদিন তোমার সাথে ঘুরতে যাওয়া হয়নি।” রজত স্ত্রীর দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিল,”ছুটি নেই গো। পরে কোনোদিন যায়!” মাঝে মাঝে শ্রেয়সীর খুব অসহায় লাগে। তার বিবাহিত জীবনে এমনিতে কোনোকিছুর অভাব নেই। অর্থের অভাব নেই।প্রাচুর্যের অভাব নেই। কিন্তু যে জিনিস টার বড্ড অভাব সেটা বোধহয় সব পাওয়াকেই ঢেকে দেয়। সময়ের..।। রজত পেশায় ডাক্তার।ভীষণ ব্যস্ত শিডিউল। হাসপাতাল, চেম্বার সামলানোর পর এমারজেন্সি কল এলেও যেতে হয়।সারাদিনের খাটাখাটনির পর যখন বাড়ি ফেরে তখন ওর মুখের দিকে তাকালে ভীষণ মায়া হয়। কিছু বলতেও ইচ্ছে করেনা। যখন নাইট ডিউটি তে সারারাতের জন্য রজতকে হাসপাতালে থাকতে হয় শ্রেয়সী বিছানায় এপাশওপাশ করে।ঘুম আসেনা কিছুতেই।মাঝেমাঝে ওর কান্না পেয়ে যায়।এত অর্থ, এত বিশ্রাম সে কোনোদিন চায়নি।সে খুব সাধারণ একটা জীবন চেয়েছিল।রাতে স্বামীর পাশে নিশ্চিন্তে একটা ঘুম, হঠাৎ করেই কোনো একদিন সিনেমা দেখতে চলে যাওয়া,কিম্বা কোনো রেস্টুরেন্ট এ খেতে যাওয়া। ওর জীবনে হঠাৎ করে কোনোকিছুই হয়না। এক সপ্তাহ আগে থেকে প্ল্যান করতে হয়,সে সিনেমা দেখতে যাওয়াই হোক বা কোথাও ঘুরতে।তাও কতদিন তো প্ল্যান করেও ক্যানসেল করে দিতে হয়েছে। সেই রজত কে কি ই বা বলবে,মানুষটাকে চোখের সামনে সারাক্ষণ পরিশ্রম করতে দেখে সে। তার প্রতি ইচ্ছাকৃত তো অবহেলা করেনি কোনোদিনও।
বারান্দায় বসে বসে এটা ওটা ভাবছিল শ্রেয়সী। ঘরে নাইট বাল্বটা জ্বালানো আছে।তার ক্ষীণ নীল আলো ছিটকে আসছে বাইরে।দু একবার ফোনে ট্রাই করেছে সে রজত কে। তোলেনি। এমনি তে ব্যস্ত থাকলে তোলেনা অনেকসময়। পরে কলব্যাক করে নেয় ওকে। আজ তাও করেনি। হয়ত একটার পর একটা কেস এসেছে।বেচারি হয়ত টিফিন খাওয়ার ও সময় পায়নি। হঠাৎ হাতে ধরা ফোন টা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে চোখ পড়তে দেখল,সরকার দা। সরকার দা ওয়ার্ড মাস্টার। রজতের সাথে খুব ভালো পরিচয়। তাদের বাড়িও গিয়েছে সে একবার। কলটা রিসিভ করে শ্রেয়সী বলল,”হ্যাঁ সরকার দা বলুন।”
“হ্যাঁ শ্রেয়সী দি আপনি কোথায় আছেন?”
“বাড়িতেই।”
“একবার হসপিটালে আসতে পারবেন।”,কণ্ঠস্বর টা গম্ভীর শোনালো।
শ্রেয়সীর কপালে ভাঁজ দেখা দিল।রজতের কোনো ফোন নেই। সরকার দা ফোন করে আসতে বলছে।সে দ্বিধা ভরেই প্রশ্ন করল,”কি ব্যাপার বলুন তো!”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো উত্তর এলোনা।কয়েক সেকেন্ড পরে সরকার বাবু বললেন,”আসলে একটা পেসেন্ট পার্টির সাথে একটু ঝামেলা হয়েছে। স্যার মাথায় একটু চোট পেয়েছেন। আপনি পারলে তাড়াতাড়ি করে একবার আসুন।”
শ্রেয়সীর পায়ের তলা ঠান্ডা হয়ে গেল। রজতের মাথায় লেগেছে! মন টা কু ডাকছিল সন্ধে থেকেই। তারপর এই ফোন। শ্রেয়সী চেয়ার ছেড়ে উঠে তড়িঘড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। রজত গাড়ি নিয়ে গেছে। আর সমীর দাকে এখন ফোন করে এখানে গাড়ি আনতে বলার প্রশ্ন ওঠেনা। সে একটা অটোতে উঠে পড়ল।
এই টুকুতেই শরীর ঘেমে উঠেছে ওর। বুকের ভিতরটাও কেমন মোচড় দিয়ে উঠছে। রজতের সিরিয়াস কিছু হয়নি তো আবার।রজতকে সে যতদূর চেনে, নিজের কাজ সম্পর্কে সে ভীষণ ভাবে সতর্ক। শুধু সতর্ক ই নয়, কাজটা তার মনের সাথেও জড়িয়ে। কোনোদিন কোনো অপারেশন সাক্সেসফুল হলে বাড়িতে এসে ওকে গল্প বলে ও।কিভাবে রোগীর আত্মীয় স্বজন তার হাত ছাড়তেই চাইছিলনা। কিভাবে এক আধদিন এক আধজন পায়ে ধরে প্রণাম করতে চলে আসে। রজত এই গল্প গুলো যখন ওকে বলে ওর চোখ থেকে তৃপ্তি ঝরে পড়ে। আবার কোনোদিন কোনো পেসেন্ট মারা গেলে ওর মুখ ভার হয়ে থাকে।শ্রেয়সী বুঝতে পারে। যখন রাতে ফিরে মাঝেমাঝে রজত কিছু খেতে চায়না,বাইরের দিকে শূন্য দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকে।শ্রেয়সী ওর মন ভালো করার চেষ্টা করে,”কি হয়েছে!”
“কিছু নাগো ভালো লাগছেনা।”
“কি হয়েছে বলোনা।”
“ছেলেটার বয়েস কতই বা ছিল, চব্বিশ কি পঁচিশ। বাইক অ্যাক্সিডেন্ট। খুব সিরিয়াস কন্ডিশন ছিল। ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়ে গিয়েছিল,রিবস ভেঙে লাঙসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।আমার কিছু করার ছিলনা।”
“সেটাই তো তুমি কি করবে বলো।তুমি তো চেষ্টা করেছো।”,শ্রেয়সী সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।
“জানি। কিন্তু ভালো লাগছেনা তাও। এত অল্প বয়েস ছেলেটার।”
শ্রেয়সী ভেবে পায়না কি বলবে। বিয়ের আগে অবধি ওর ধারণা ছিল, ডাক্তার রা এত মৃত্যু দেখে যে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।মৃত্যু ওদের সেভাবে নাড়া দেয়না। কিন্তু রজতকে সে যত জেনেছে, ওর মনে হয়েছে সেটা সর্বৈব ভুল। মৃত্যু ওদের ও আঘাত দেয়। সত্যি বলতে শ্রেয়সীর ভালো লেগেছিল..ওর মনে হয়েছিল, প্রফেশন যাই হোক ওরা মানুষ ই তো। যেমন রজত। ভাবতে ভাবতে শ্রেয়সীর চোখ ছলছল করে উঠল। নিজেকে বকা দিল,’তুমি না ডাক্তারের বউ।এত সহজে ভেঙে পড়লে হবে? রজত জানলে খুব দুঃখ পাবে।’
অটোর ভাড়া মিটিয়ে শ্রেয়সী সোজা ছুটল ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের দিকে। গেটের বাইরে কিছু পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। আর বাদবাকি চিত্র রোজের মতোই। ভিতর থেকে রোগীদের,আত্মীয়দের চিৎকার ভেসে আসছে। কর্মীরা নিজেদের মতো কাজে ব্যস্ত। সরকার বাবু ওয়ার্ড মাস্টার অফিসেই বসে ছিলেন। শ্রেয়সী কে দেখে বেরিয়ে এলেন। শ্রেয়সী চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,”ও কোথায়?”
রকার বাবু আশ্বাস দিলেন,”চিন্তা করবেন না। স্যার এখন ঠিক আছেন। ওনাকে ডক্টরস কেবিনে শিফট করা হয়েছে। আপনি ওখানে চলে যান। দেখতে পাবেন।”
শ্রেয়সী রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেল। ডক্টরস কেবিন তিনতলায়। ডাক্তার বা নার্স দের জন্য আলাদা কেবিন থাকে। কেউ অসুস্থ হলে তাদের সেখানেই রাখা হয়। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল ও। রজত শুয়েছিল একটা বেডের উপরে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা।স্যালাইন চলছে। শ্রেয়সী যেতেই চোখ মেলল রজত। মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল,”তুমি চলে এলে!”
“চলে এলে মানে? সরকার দা ফোন করে ভাগ্যিস বলল।তুমি তো বলতেও না।”,শ্রেয়সী ঝাঁঝিয়ে উঠল।
“আরে তেমন সিরিয়াস কিছুনা।তুমি না এলেও পারতে। “
“চুপ করো। বেশি বকোনা। কিভাবে হল এসব? মারপিট হয়েছে শুনলাম।”
“হ্যাঁ ওই আর কি। পেসেন্টের খুব সিরিয়াস কন্ডিশন ছিল। এখানে আসতে আসতে এক্সপায়ার করে গেছিল।রিলেটিভস রা কিছুতেই মানতে চাইছিলনা। তখনি একজন..”
“গার্ড ছিল না?”
” গার্ড আর কি করবে ওখানে? অত গুলো লোক।”
“তুমি এদের জন্য জীবন দাও কেন? যাদের কাছে তোমার জীবনের কোনো মূল্য নেই!”, শ্রেয়সীর গা রাগে শিরশির করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে সে অদৃশ্য কিছু মানুষকে লক্ষ্য করে নিজের রাগ উগরে দিতে লাগলো ।
“কি করবো বলো! প্রফেশন টাই এরকম। কাছের লোক মারা গেলে মানুষ মাথার ঠিক রাখতে পারেনা।”,রজত হাসার চেষ্টা করল।
“থামো তো তুমি। ওইসব হুলিগানস দের ফরে কথা বলছো কেন? বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ নেই যাদের মধ্যে। আচ্ছা মানুষ কি সারাজীবন বেঁচে থাকবে বলো। একদিন তো মরতেই হবে। তোমাদের পক্ষে যদি সম্ভব হতো তোমরা নিশ্চয় বাঁচাতে।এইটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই ওদের?”, শ্রেয়সীর অসম্ভব রাগ হচ্ছে।
“মানুষ তো!”, রজত কথাটা যেন নিজেকেই বলল।
“ও ওরা মানুষ আর তোমরা মানুষ নও বুঝি? তোমাদের পরিবার নেই? তোমাদের যন্ত্রণা নেই। আজ তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো! তার দায়িত্ব নিত ওরা? ফালতু কথা বলোনা। এসব মানুষদের চিকিৎসা ই করতে নেই। দুদিন কাজ বন্ধ করে রাখো,দেখো যখন নিজেরা মরতে বসবে তখন টনক নড়বে। তখন বুঝবে তোমাদের ভ্যালু কতটা।”
রজত শ্রেয়সী হাতের উপর নিজের হাত টা রাখলো। ঠোঁটে একরাশ হাসি টেনে এনে বললো,কি করবো বলো আমরা ভগবান তো নই
।মানুষ ই। সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হলে নিশ্চয় বাঁচাতাম।
br />
শ্রেয়সী কেঁদে ফেলল, কি করে মানুষ টা এরকম একটা জায়গায় এরকম একটা কথা বলতে পারে! কি করে! সত্যি কি মানুষ এরা! কিছু লোক অকারণে মেরে ওর মাথা ফাটিয়ে দিল, সেটা নিয়ে ওর কোনো চিন্তাই নেই। উপরন্তু কোন এক মৃত্যুপথযাত্রী বাঁচাতে না পারার আপশোস নিয়ে গুমরে গুমরে মরছে। এরা কেউ মানুষ হতেই পারেনা।
এরা ডাক্তার। এরা অ-মানুষ !!