একটানা গরমের পর একটু বৃষ্টির নিশ্বাস নিয়েছে শহরটা।সকাল থেকেই মুখ ভার হয়েছিল আকাশের…দুপুরের দিকটাই এসে সে হার মানল।সমস্ত আবেগ উপুড় করে ঢেলে দিল মহানগরীর উপর।উত্তর কোলকাতার এই প্রাচীন চুন-সুড়কির গাঁথনি দেওয়া লাল রঙের বাড়িটাই আজ কেউ নেই… লাবণ্য একা স্বার্থপরের মতো সুখ খুঁজে নিচ্ছিল বাইরের আকাশ থেকে… অবশ রেলিং টার উপর হাত রেখে কল্পনার জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে ফেলতে একটা সময় নিজের মনেই গুনগুন করতে লাগল,”সখী ভাবনা কাহারে বলে! সখী যাতনা কাহারে বলে! তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা- ভালোবাসা। সখী ভালোবাসা কারে কয়! সেকি কেবল ই যাতনাময়…”
গুনগুন করে গাইতে গাইতে একসময় খোলা গলায় নিজের ভালোবাসা নিঙড়ে দিল লাবণ্য.. বৃষ্টি তালে তালে ছন্দময় একটা সুর তুলে যেন একটা জলসাঘরের আসর জমিয়ে দিল..
মাঝেমাঝে নিজের জন্য গাইতে বেশ ভালো লাগে,লাবণ্য ভাবল,সে গান থেকে নিজেকে যতই দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করুক না কেন! গান কোনোদিনও তাকে ছেড়ে যায়নি। নিজের গলার নৈকট্য নিজেই অনুভব করল সে…
গানের সাথে তার সম্পর্ক টা সেই ছোটবেলার… তার মজ্জায় মজ্জায় যে মানুষ টা সাতটা সুর মিশিয়ে দিয়েছিল সে আর কেউ নয় ওর মা.. চোখ বন্ধ করলে এখনও আবছা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শৈশবের সন্ধ্যেবেলা গুলো। প্রতিমা চুলে রজনীগন্ধার মালা পড়তো.. একটা পছন্দের শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে হারমোনিয়াম টা টেনে নিতো কোলের কাছে। লাবণ্য মায়ের আঁচলের শেষ প্রান্ত টাকে এক হাতে চেপে ধরে চুপ করে বসে রেওয়াজ শুনতো..তেমন তো মনে নেই.. তবে এক আধদিন রবীন্দ্র সংগীতের সুরের সাথে দূর থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি মিশে যেত অবলীলায়।
“মা ওরা আজান দেয় কেন! “, লাবণ্যর মনে প্রশ্ন গুলো ছটফট করে।
“কারণ ওরা ওদের ঈশ্বরের কাছে ওদের প্রার্থনা পৌঁছে দিতে চায়। সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হওয়া যায় যে। এই আমরা যেমন সুর করে পাঁচালি পড়ি।ওরা তেমনি আজান দেয়। “, প্রতিমা হাসিমুখে বুঝিয়ে দেয় মেয়েকে।
“তাহলে মা আমিও গান করবো,আমিও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা পৌঁছে দেবো।”, পাঁচ বছরের লাবণ্য মনস্থির করে নেয়।
“আচ্ছা।বেশ বেশ। নে আমার সাথে গা তো দেখি… সা.. রে… গা…মা…”
🍂
কিন্তু সব প্রার্থনা হয়ত ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোয় না।
গাইতে গাইতে গানটা একসময় লাবণ্যর অনু পরমাণুর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল। কিন্তু ক্লাস সিক্সের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই লাবণ্য র গানওয়ালী বিদায় নিল।ফেলে রেখে গেল তার হারমোনিয়াম টা, কিছু গানের খাতা আর একরাশ স্মৃতি… লাবণ্যর জীবনে মা ই ছিল ওর গানের আধার,গানের শেকড়।
পাগলের মতো লাবণ্য কিছুদিন গান গাইলো..” ও তোতা পাখিরে, শেকল খুলে উড়িয়ে দেবো, মাকে যদি এনে দাও,আমার মাকে যদি এনে দাও। ঘুমিয়েছিলাম মায়ের কোলে, কখন যে মা গেলো চলে। সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে,খুঁজে নাও…”
ও তোতা পাখিরে.. যদি সত্যিই যারা তারা হয়ে যায় তাদের তুমি ফিরিয়ে আনতে পারতে তাহলে সবাই তোমার জন্য এই গান টা গাইতো..
লাবণ্য প্রার্থনা পৌঁছলোনা.. অতদূর।।
অনেক দিন নিজেকে সরিয়ে রাখল সে, ওই হারমোনিয়াম থেকে,ওই গানের খাতা গুলো থেকে,গান থেকে.. এক একটা সময় ভীষণ গান করতে ইচ্ছে হতো, কিন্তু বালিশে মুখ গুঁজে সে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিল আর কোনোদিন গান গাইবে না সে,গান মিথ্যে…সব মিথ্যে..
এক আষাঢ় পেরোতে না পেরোতেই সেই প্রতিজ্ঞা ভেঙে দিল সে। স্রেফ বাবা একদিন রাত্রিবেলায় লাবণ্য মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল,”তোর মা চেয়েছিল তুই অনেক বড়ো গায়িকা হ। তুই গান ছেড়ে দিলে প্রতিমা খুব কষ্ট পাবে রে।”
লাবণ্যর মনে হল সে খুব স্বার্থপর। সে কেবল নিজের কথাই ভাবে… একবারও সে মায়ের কথা ভাবেনি,একবারও না। সে শুধু নিজের দুঃখ নিয়ে ভাবছিল..মা ও তো নিশ্চয় অনেক দুঃখ পেয়েছে..আর কাঁদাবে না সে মাকে..
আবার সুর গুলোকে বুকে টেনে নিল লাবণ্য। সত্যপ্রকাশ বাগচীর কাছে গানের ক্লাস নিতে শুরু করলো। বিভিন্ন জায়গায় গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিল। অনেক পুরস্কার ও পেলো… সেই পুরস্কার গুলো সযত্নে স্থান পেলো মায়ের ছবির পাশে।
🍂
অনেক বাধ-বিরোধ,আলোচনা-পর্যালোচনার পরে উচ্চমাধ্যমিক শেষ হয়ে গেলে সে বিশ্বভারতী তে মিউজিক নিয়ে ভর্তি হল। কলেজের এই তিনটে বছর তার জীবনের সবথেকে সুন্দর তিনটে বছর। শান্তিনিকেতন তাকে অনেক গান দিল,অনেক সুর দিল, অনেক শান্তি দিল… আর মৌসুমি বায়ুর মতো তার জীবনে এক আগন্তুক কে পাঠালো… সায়ন। সেও বিশ্বভারতীর এক ছাত্র। বাংলা অনার্স। ছিপছিপে গড়ন। চাপ দাড়ি। মাঝারি লম্বা।চোখে চশমা আর হাতে সবসময় একটা ডায়েরি। তাতে হিজিবিজি করে লেখা কিছু কবিতা,কিছু গান।
নবীন বরণের অনুষ্ঠানে লাবণ্য গেয়েছিল,”তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম।তুমি রবে নীরবে…”। গান শুনে মুগ্ধ সায়ন এগিয়ে এসে বলেছিল,”ভারি মিষ্টি গলা তো তোমার। যার কাছ থেকেই সুর গুলো পেয়েছো,সে খুব যত্ন নিয়ে চারাগাছ টা পুঁতেছে।”
“আমার মা। মায়ের কাছ থেকেই সবকিছু পাওয়া।”,লাবণ্য হেসেছিল।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সায়ন, লাবণ্যর জীবনের অন্তরা হয়ে উঠল। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা এলো গানের হাত ধরে।সায়নের পড়াশোনা মুগ্ধ করতো লাবণ্য কে। এরই মধ্যে ছেলেটা রবীন্দ্রনাথ থেকে শেক্সপিয়র,দস্তাভস্কি থেকে কিটস সব গুলে খেয়েছে। কোপাই এর পাড়ে বসে নির্বাক শ্রোতা হয়ে লাবণ্য শুনে যেতো, বিভিন্ন লেখার কথা। কখনও নামীদামী লেখকের,কখনও সায়নের নিজের। পরিবর্তে লাবণ্য তাকে গান শোনাতো।সায়নের পছন্দের গান গুলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসতো কোপাই এ।
উপহারে কোনোদিন ফুল দেয়নি সায়ন। কোনোদিন দামী কোনো রেস্টুরেন্ট এ খাওয়াতে নিয়ে যায়নি। খুব সাধারণ জীবন পছন্দ ছিল,তার।ও বরাবর একটা কথায় বলতো,”ভালোবাসার গভীরতা কিন্তু প্রাচুর্যে নয়,সবার সামনে প্রকাশে নয়, বরং নিজের ভেতর থেকে উপলব্ধির মাধ্যমেই একমাত্র ভালোবাসাকে বোঝা যায়। আমার সাথে থাকতে চাইলে হয়ত বিলাসবহুল জীবন পাবিনা,তবে নিজের মতো করে তোকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো। অন্তত ভিতর থেকে কোনোদিনও শূন্যতা অনুভব করতে দেবোনা।”
লাবণ্য সায়নের কাঁধে মাথা রেখে উত্তর দিত,”সবাই ওই বিলাসবহুল জীবন চায়না। কেউ কেউ স্রেফ ভালো জীবনসঙ্গী চায়। তুই যেমন, তেমন ই আমার প্রিয়।তুই আমার জীবনের অন্তরা।”
সায়ন অবশ্য সুযোগ পেলেই অনেক বই উপহার দিত লাবণ্য কে। “ন হন্যতে “, “শেষের কবিতা”,নকসি কাঁথার মাঠ”,”হাঁসুলি বাঁকের উপকথা”..
লাবণ্য অন্তর থেকে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করতো। আর একটু হলেই যেন উপচে পড়বে।তার আধার পাল্টে গেছে। মায়ের স্মৃতি আবছা হয়ে গেছে।সে জায়গা টা নিয়েছে ছিপছিপে গড়নের একটা ছেলে। যাকে সে সারাজীবন তার গানের মধ্যে বেঁধে রাখতে চায়।
🍂
সন্ধ্যে নেমে এলে, বৃষ্টি টাও একটু ধরল। এখনও বাড়িতে কেউ আসেনি। সঞ্জয়ের আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। কালো মেঘের আড়ালে চাঁদ টা এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল। এবার একফালি আলো তাদের বুক চিড়ে এসে পড়ল বাড়িটার উপর। ছাদে যাওয়া যেতে পারে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। পুরোনো দিনের সিমেন্টের সিঁড়ি গুলো টপকে ছাদে এলো লাবণ্য। বৃষ্টি এলে মনটা ভার হয়ে আসে। আসলে মেঘ জমলে স্মৃতিরা ভিড় করে আসে। স্মৃতিরা খুব যন্ত্রণা দেয়।
থার্ড ইয়ারের পর অনেক বছর গান গায়নি লাবণ্য। যে প্রিয় জিনিস গুলোকে সে গান দিয়ে, জীবন দিয়ে বাঁধতে চেয়েছে তারা প্রত্যেকেই তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে।প্রথমে তার মা। তারপর সায়ন। সায়নের অ্যাক্সিডেন্ট টা লাবণ্য কে জীবনের একটা সত্যি চিনিয়ে দিয়েছিল। কাউকেই সশরীরে বেঁধে রাখা যায় না।যার যাওয়ার, তাকে যেতে দিতেই হবে। তবে আর গান নয়। অনেক হয়েছে। গান তাকে শুধু যন্ত্রণা দিয়েছে,গান শুধু তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে…
বাকি জীবন টা একা থাকবো ভেবেও থাকা হয়নি লাবণ্যর।দুর্ভাগ্য বশত অনেক মানুষই নিজের জন্য বাঁচতে পারেনা। অন্যদের আনন্দের কাছে,নিজের ইচ্ছে গুলো এত মৃদু হয়ে আসে যে মানুষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়..ঠিক যেমনি বাবার কথা ভেবে সঞ্জয় কে বিয়ে করতে হয়েছে লাবণ্যকে। সঞ্জয় ছেলে হিসেবে খারাপ নয়।বরং আর পাঁচজনের থেকে ভালো। লাবণ্যকে ভালোবাসায় ত্রুটি রাখেনি এতটুকুও। কিন্তু কারোর শূন্যতাই অন্য কেউ পূরণ করতে পারেনা। অনেক গুলো বছর পেরোলে মানুষের দুঃখ গুলো গানের রেশের মতোই পাতলা হতে শুরু করে। যে জিনিস গুলো মানুষের একান্ত নিজের কেবল সেগুলোকেই মানুষ মৃত্যুর আগে অবধি কখনও ছেড়ে দিতে পারেনা। লাবণ্য ভাবতো সে মায়ের জন্য গান করতো,সায়নের জন্য গান করতো… কিন্তু বিয়ের তিন বছর পর হঠাৎ যেদিন রান্নাঘরে রাঁধতে রাঁধতে অজান্তেই দুকলি গেয়ে ফেলে লাবণ্য ,তখন বুঝতে পারলো এতদিন সে নিতান্তই নিজের জন্যই গেয়েছে। গান টা তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। গান কে সে কখনও নিজের থেকে আলাদা করতে পারবেনা।
সায়নের একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল লাবণ্যর। মৃত্যুঞ্জয় কবিতা টা পড়ে লাবণ্য তার কাছে জানতে চেয়েছিল,”আচ্ছা ঠাকুর এই কথাটা কেন বলেছেন,যত বড়ো হও /তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড়ো নও,/আমি,মৃত্যুর চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে/যাবো আমি চলে।…”
“এতগুলো মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার পরও ঠাকুর অবিচল ছিলেন। তিনি তার সমস্ত যন্ত্রণা তার কলমে, তার সৃষ্টির মধ্যে তুলে ধরেছিলেন। সৃষ্টি মৃত্যুর ও ঊর্ধ্বে, মানুষ তার সৃষ্টির মাধ্যমে অমর হয়ে থাকে।যেমন তিনি আজও আছেন। তোর জীবনেও যত কষ্ট আসুক,গান টাকে কোনোদিন ছাড়িস না।গানের মধ্যে দিয়ে তুই তোর যন্ত্রণা গুলোকে তুলে ধরিস। যতদিন বেঁচে থাকবি শিল্পের মধ্যে বেঁচে থাকিস,তোর প্রিয়জন দের বাঁচিয়ে রাখিস।”
আজ সেই কথাগুলো লাবণ্য উপলব্ধি করছে তার সবকিছু দিয়ে…জীবন আর গান কিভাবে পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে।কিভাবে সত্যি সত্যিই বন্দনা করার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা পৌঁছে দেওয়া যায়। সে তার গানের মাধ্যমে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে তার প্রিয়মানুষ গুলোকে.. তার মাকে,সায়ন কে…. নিজেকে…
একবুক প্রশ্বাস টেনে নিয়ে লাবণ্য গলা মেলল,
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার
গানের ওপারে।
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি
পাই নে তোমারে।
বাতাস বহে মরি মরি
আর বেঁধে রেখো না তরী,
এসো এসো পার হয়ে মোর
হৃদয়-মাঝারে।
তোমার সাথে গানের খেলা
দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায়
সকল বেলা যে।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি
বাজাবে গো আপনি আসি,
আনন্দময় নীরব রাতের
নিবিড় আঁধারে।