রাত দশটা। ঢালাও জ্যোৎস্না এসে পড়েছে ছাদে।অনিমেষ বসে আছেন একটা মাদুর পেতে।তার ঠিক পাশটাতেই পা ছড়িয়ে বসে আছেন তার স্ত্রী মাধবীলতা।দূর থেকে একটা মনমোহিনী গানের সুর ভেসে আসছে।অনিমেষ তার স্ত্রী কে ডাকলেন,”লতা,বুক টা জ্বালা করছে বুঝলে।”
“অত রিচ খাবার খেতে গেলে কেন?”
“বৌমা অত শখ করে আলুর দম টা করেছিল,আর তাছাড়া আমারও খুব খেতে ইচ্ছে করছিল।তাই…একটু বেশি ই হয়ে গেছে।”
“তোমার তো একটু বুঝে শুনে খাওয়া উচিৎ। অনেক বয়েস হয়েছে।”
“জানি।আর কদিনই বা বাঁচবো!”
“খুব ভালো কথা।”,মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়ে বসলেন।
“আ! রাগ করছো কেন? মরতে কি হবে না বলো!”,অনিমেষ স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন।
“ভালো লাগছে না।যাও।”
“আচ্ছা বাবা আচ্ছা।বলবোনা মরার কথা।”,অনিমেষ হাসলেন।
“আজ সকালে অত ভারী বাজারের ব্যাগটা বয়ে আনতে গেলে কেন? বাবু তো বাড়িতে ছিলই।ওকে পাঠাতে পারতে।”,মাধবীলতার অনুযোগের ডালি যেন শেষ হয়না।
“ও তো সারা সপ্তাহ কাজ করে।এই রবিবারটাই যা একটু বিশ্রাম নেয়।ছেলেটাকে পাঠাতে মায়া হচ্ছিল।আর আমি কি ই বা করি বলো! সারাদিন তো সেই ঘরেই বসে থাকি। “,অনিমেষ স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
“তোমাকে এই বয়েসে কেউ বাহাদুরি করতে বলেনি।নিজের একটু খেয়াল নাও এবার।আমি আর কতদিন বলবো!”
“তুমি আছো বলেই তো ভরসা পাই।আর কে বলেছে আমি বুড়ো হয়ে গেছি!”,অনিমেষ দুষ্টু দুষ্টু চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে।
“হ্যাঁ তুমি তো এখনও ছাব্বিশ বছরের ছোকরা আছো!”,মাধবীলতা মুখ বেঁকালেন।
“আচ্ছা লতা তোমার মনে পড়ে স্কটিশের সেই দিনটা, তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম?”
“মনে থাকবেনা আবার।তোমার তখন নতুন রঙ,রাজনীতিতে নেমেছো।নতুন নতুন ডানা গজিয়েছে।”
“আমার রাজনীতিতে নামা নিয়ে তোমার মনে কোনোদিন দ্বন্দ্ব হয়েছিল?”
“নাহ।আমার বিশ্বাস ছিল তোমার উপর!এমনকি তুমি যখন জলপাইগুড়ি তে ছিলে মাসের পর মাস,আমি কোলকাতায় প্রতিদিন তোমার চিঠির অপেক্ষা করেছি।তোমার চিঠি গুলো পড়ে কেমন যেন তোমার গন্ধ পেতাম।তারপর শান্তিনিকেতনের সেই রাত…তোমার উপর যদি ভরসা না থাকতো তাহলে অর্ককে নিয়ে অতটা ঝক্কি সামলাতে পারতাম না।”
“তোমার প্রেগনেন্সির সময় খুব অসুবিধা হয়েছিল বলো।ঘর থেকে, হোস্টেল থেকে সরে এসে বস্তিতে থাকা।আমি যে ফিরবোই তারও তো কোনো ঠিক ছিলনা..”,অনিমেষ এর চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে এল।
“আমি জানতাম তুমি ফিরবে।”,মাধবীলতা খুব ছোট্ট একটা উত্তর দিলেন।
“কি করে জানতে?”
“মেয়েদের মনে অনেক টেলিপ্যাথির থেকেও বেশি জোর থাকে।আমরা অনেক কিছুই আবেশে বুঝতে পারি।আর তাছাড়া আমি যখন মন থেকে কিছু চাই,সেটা আমি পাই ই”
অনিমেষ স্ত্রীর দিকে তাকালেন।তার মাধবীলতা। সেই মেয়েটা যে তাকে একদিন বলেছিল,”লতা বড়ো জড়িয়ে ধরে,বিরক্তি আসবে না তো কখনো!” কত যুগ পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতে।তার ঠাকুরদা সরিৎশেখর,পিতা মহীতোশ এরা সবাই ধীরেধীরে পাড়ি দিলেন মহাকালের পথে…এবার তার পালা।ছেলে অর্ক সংসারের হাল ধরেছে।তার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে,জলপাইগুড়ি থেকে আসা সেই ছেলেটা কিভাবে কোলকাতায় এসে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মাসের পর মাস কাটিয়েছিল। তার বাংলা নিয়ে স্কটিশচার্চে ভর্তি হওয়া।বন্ধু পরমহংসের সাথে আলাপ।তার রাজনীতি তে নামা।মাধবীলতাকে আবিষ্কার করা।তারপর নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া।ধরা পড়ে জেলে যাওয়া।পুলিশের অত্যাচার। হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে মাধবীলতা আর অর্কর সাথে সেই বস্তিতে ফিরে আসা।
তারপর মাধবীলতাদের নিয়ে জলপাইগুড়িতে যাওয়া… বাবা…ছোট মা, সবার কথা মনে পড়ে অনিমেষের। সময়ের হাওয়া ঝাপটা মারলে ঝড়ের গতিতে বেলা পেরিয়ে যায়।রাতের বেলায় পৌঁছে মনে হয় দিনটা কি তাড়াতাড়ি কেটে গেল।এই শেষ বয়েসে এসে অতীতচারণা করেই অর্ধেক সময় কেটে যায়।
ছাদের দরজাটা খোলার আওয়াজে অনিমেষ এর চেতনা ফিরল।অর্ক মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলো,”বাবা নীচে নামবে না?”
অনিমেষ জবাব দিলেন,”এই আসছি, আর পাঁচ মিনিট। “
অর্ক বলল,”বেশ।আমি তোমার বৌমাকে বলছি বিছানাটা পেতে দিতে।”
অনিমেষ ঘাড় নাড়লেন।অর্ক নেমে গেল।মাধবীলতা তার দিকে ফিরে বললেন,”এবার যাও নীচে।”
“হুম যাচ্ছি।”,অনিমেষ বললেন ঠিকই কিন্তু তার নীচে যেতে ইচ্ছে করছিল না।রাতের এই সময় টাই তিনি একান্তে তার স্ত্রীর সাথে একটু সময় কাটান।মাধবীলতার এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই এটা তার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে।রাতে একা সময় পেলেই তিনি ফিরে পান তার “লতা” কে।চোখ দিয়ে দেখতে পান।অন্তর দিয়ে অনুভব করেন।খুব গোপনে ভালোলাগার চাষ করেন।
মাধবীলতা অনিমেষের কাছে মুখ এনে বললেন,”তুমি এসো।আমি আবার কাল রাতে আসবো।”
অনিমেষ হাসলেন…আর কত রাত!😊
[সমরেশ মজুমদার কে বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য ]