কলমে – নবনীতা সই
ফোনটা যখন আসলো তখন কথা বলার সময় ছিলো না তমার হাতে৷ পলাশ তখন বেরোবে , পাপড়ি স্কুলে যাবে৷ ফোনটা দুবার বেজে বেজে যখন কেটে গেলো তখন হাতে নিয়ে আননোন নাম্বার দেখে রেখে দিলো তমা৷
তোমার মানিব্যাগ , ফোন সব নিয়েছো৷
হ্যাঁ নিয়েছি৷ ও ফাইলটা দাও ৷ পাপড়ি মা ভালো মেয়ে হয়ে থাকবে বাবান দুদিন পরই চলে আসবে৷
আর আমাকে দীঘা নিয়ে যাবে, হুররে!
লক্ষী মা৷ আমরা সবাই যাবো৷ মা কে বিরক্ত করবে না৷
তাড়াতাড়ি আসবে বাবান৷
আচ্ছা আমি পাপড়ি কে ড্রপ করে সোজা এয়ারপোর্টে চলে যাবো৷
সাবধানে যেও৷ পৌছে ফোন কোরো৷
আজ পলাশ দুদিনের অফিস ট্যুরে যাচ্ছে৷ হঠাৎ ৷
পুরো ফ্ল্যাট টা ফাঁকা হয়ে যায় দুজনে বেরিয়ে গেলে৷ তবে তমার ভালোলাগে৷ কিছুক্ষণ নিজের জন্য সময় পাওয়া যায়৷
ফোনটা বেজে ওঠে আবার৷ ভাবনাটা ছিঁড়ে যায়৷
হ্যালো
হ্যালো
মনে হয় যেন অনেকে যুগের ওপার থেকে আওয়াজ টা আসছে৷ না তমা কিছু শুনতে পাচ্ছেনা৷
হ্যালো… তুমি কেমন আছো ?
ভালো৷ তুমি?
আছি৷ তুলি আমি আজ কোলকাতা এসেছি৷
কতদিন পর কানের ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো নামটা৷
তুলি, হ্যালো….
বলো শুনছি৷
তুলি আমি কাল চলে যাবো কানাডা৷ আজ তোমার সাথে একবার দেখা হতে পারে?? প্লিজ তুলি না কোরোনা৷
কেন আবার আমাকে…
কষ্ট দিচ্ছি ? তাইতো? তোমাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছু তো দিতে পারিনি তুলি ৷ আজ না হয় শেষবারের মতন সহ্য করলে৷
আসো৷
কোথায় কখন বলো?
বাড়িতে আসো ৷ ঠিকানা তো জানো৷
আমি ঠিক আলাদা করে দেখা করতে…
বাড়িতে পলাশ নেই , বাইরে গেছে৷ আর পাপড়ির আজ জন্মদিনের নিমন্ত্রণ আছে৷
ঠিক আছে ৷ আমি ছটা নাগাদ আসবো৷
ফোনটা রেখে, সোফায় ধপ করে বসে পড়ে তমা৷ হাসবে না কাঁদবে? চিৎকার করতে পারতো হয়ত তাহলে কিছুটা হাল্কা লাগতো৷ কেন কেন আবার জয় আমাকে কষ্ট দিচ্ছো ??
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে তমা উঠে পড়ে৷ নাহ্ হয়ত আর দেখা হবেনা আজ দিনটা স্মৃতির খাতায় জমা থাকবে৷
চটপট কাজ সারতে থাকে তমা ৷ কিন্ত মাঝে মাঝেই ভুল হয়ে যাচ্ছে ৷ কি যেন জয় খেতে ভালোবাসতো? পছন্দের রঙটা? ঘরটা সবসময় সুন্দর গোছানো থাকলেও তমা আর একটু সাজিয়ে নেয়৷ সে সুখী সেটা যেন জয়ের চোখে পড়ে৷ কয়েকটা জয়ের পছন্দের রান্না করে নেয় তারপর নিজেকে ছেড়ে দেয় শাওয়ারের নীচে৷ সব অনুভূতি গুলো যেন জলের সাথে ধুয়ে পা দিয়ে নেমে যাচ্ছে৷ রেডি হয়ে সোজা পার্লারে চলে যায়৷
স্পা করে অনেকদিন পর৷ বেরোতেই পলাশের ফোন৷
কি হলো ফোন করছি তুলছো না৷
আমি তো পাপড়ির স্কুলে এসেছি , খেয়াল করিনি৷
তুমি পৌছে গেছো?
হ্যাঁ৷অনেক আগে৷ আমার লাঞ্চ হয়ে গেছে৷ শোনো সন্ধ্যার সময় মিটিং য়ে থাকবো হয়ত ফোন অফ থাকবে৷ রাতে ফোন করবো৷
আচ্ছা ঠিক আছে৷ সাবধানে থেকো৷
পাপড়ি কে নিয়ে চলে যেও বাড়ি৷ আর হ্যাঁ লক ভালো করে কোরো৷
চিন্তা কোরোনা৷ একা থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে৷
তমা বোঝার চেষ্টা করো কাজ তো করতেই হবে৷
হ্যাঁ জানি৷
বলেছি তো ফিরেই উইক এন্ডে তোমাদের দীঘা নিয়ে যাবো৷
ঠিক আছে রাখো৷
হ্যাঁ বাই৷
মানুষ যে কখন কি চায় আর চায়না সেটা নিজেও জানেনা৷ কয়েকঘন্টা আগে তমার খুব রাগ হচ্ছিলো পলাশের হট করে এই অফিস ট্যুরে যাবার জন্য৷ আর এখন মনে হচ্ছে আশীর্বাদ ৷ ভালো হলো ৷
ফোনটা ব্যাগে রেখে তমা পাপড়ি কে আনতে গেলো৷
মা মা আজ রুবাই য়ের জন্মদিন তুমি যাবেনা?
না মা৷ রুবাই য়ের মা গাড়ি পাঠাবে সবাই কে নিতে৷ তুমি ঝটপট রেডি হয়ে নাও তো৷
আমি লাল ফ্রকটা পড়বো৷
আচ্ছা ৷
গাড়ি আসলে পাপড়ি কে আরও দুজন বাচ্ছার সাথে বসিয়ে দিয়ে তমা চলে আসে৷
হ্যালো
হ্যাঁ পাপড়ি আসছে তো?
হ্যাঁ তোমাদের গাড়ি স্নেহা , টুবলু আর পাপড়ি কে নিয়ে গেলো৷ দেখো মেয়ে তো একা ছাড়িনা৷
তুমি চিন্তা কোরোনা৷ ঠিক দশটায় আবার ওদের সাথে পৌছে যাবে৷ তুমি আসলে আরও ভালো হতো৷
না গো শরীর টা ভালো না৷ আর তুমি তো বাচ্ছাদের জন্যই পার্টিটা থ্রো করেছো৷
হ্যাঁ গো গার্জেন থাকলে ওরা ভালো এনজয় করতে পারেনা৷ আর চিন্তা কোরোনা এখানে সবাই আছে৷ ঘরের ভিতর তো কোনো সমস্যা নেই ৷
হ্যাঁ সে জানি দুমিনিটের তো পথ তোমাদের আবাসন৷
রাখি?
হ্যাঁ হ্যাঁ আর রুবাই এর জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো জন্মদিনের ৷
মনটা কেমন উদাস হয়ে আছে৷ আবার অনমনা মনে প্রশ্ন হাজার৷ থেকে থেকে স্মৃতি গুলো তমাকে টেনে নিয়ে অতীতে ফেলে দিচ্ছে৷ একসাথে তো পড়তো জয় আর তমা৷ ইউনিভার্সিটির দিন গুলো ছিলো লাগামছাড়া ভালোবাসার দিন৷
কখনও গড়ের মাঠ, কখনও ভিক্টোরিয়া৷ অবাধ্য দুটো ঠোঁটের দুষ্টুমি আর ভালোবাসার আবদার৷ কোনদিন ভাবেনি জীবনে আর কেউ আসতে পারে৷ জয় , জয়ন্ত ব্যানার্জী আর তমা তমলিকা মূখার্জী ৷ দুজনে মনে করেছিলো জীবনে শুধু ভালোবাসা থাকবে৷ উত্তাল প্রেম যৌনতা আর বাধা নিষেধের গণ্ডি পেরিয়ে তখন অনেকদুর৷
খুব ভালো ছাত্র জয়ের প্রেমে সুন্দরী তমলিকার হাবুডুবু অবস্থা ৷সবাই বলতো লাভবার্ড৷
বেল বাজার শব্দে তমা চমকে গেলো পৌনে ছটা বাজে৷ তাড়াতাড়ি আসলো??
আারে মিসেস চৌধুরী আপনি ?
হ্যাঁ ভাই বিরক্ত করলাম ৷ বলছি কি রুবাই য়ের পার্টিতে পাপড়ি গেছে??
হ্যাঁ এই তো গেলো৷
আচ্ছা আমার মেয়ে সোনালী গেছে৷ তুমি আনতে যাবে?
না রুবাই য়ের মা বললো পৌছে দেবে৷
বেশ বেশ ৷ ভালো হলো৷ দ্যাখোনা টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে ৷
চিন্তা করবেন না৷ ঘরের ভিতরে তো অসুবিধা হবেনা৷ আগেরবার ও সুন্দর পার্টি হয়েছিলো৷
আচ্ছা ৷
দরজা বন্ধ করে ধানি রঙের পিওর সিল্কটা পড়ে নিলো তমা৷ চুলে কিছুটা ফুল৷ চোখে গভীর কাজল৷ ব্যলকনি তে কটা মোমবাতি আর ধূপ ধরিয়ে ঘরের আলো গুলো মৃদু করে নিজের হৃপিণ্ডের আর ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে লাগলো৷
বাইরে বৃষ্টি আর মনে?? স্মৃতির বরষা৷
বেল বাজতেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো৷
মেয়ের বয়স প্রায় দশ ছুঁইছুঁই , অনেকদিন পর মনে হলো যেন সেই যুবতী তমার হৃদপিন্ড৷
কেমন আছো ?
ভিতরে এসো৷
হাতে একগাদা রজনীগন্ধা নিয়ে যে মানুষ টা দাঁড়িয়ে আছে তাকে চেনা যায়না৷ অর্থ সম্পদ আর বয়েস তাকে সৌম্যতা দিয়েছে৷ সেই দামালপনা দৃষ্টি আজ ভারী হয়ে গেছে চশমার তলায়৷
তুমি বললে না তো কেমন আছো ?
সব প্রশ্নের উত্তর এককথায় হয়না জয়৷ বসো৷
নিজেকে সোফায় ছেড়ে দিয়ে জয় আরাম করে বসে৷ নীলাভ সার্টে আরও সুন্দর লাগছে৷
কি দেখছো?
চুল পাকিয়ে ফেলেছো?
হ্যাঁ কাজের চাপ৷ বিভিন্ন জায়গার খাওয়া আর কালো রইলোনা৷ কালো করিনা চুলের রঙটা বস বস ভাব দেয়৷
ভালো৷
তুমি কিন্তু এক রকম আছো৷
ধুর মুটিয়ে গেছি৷
আমি তোমায় চিনি তমা৷ তোমার সবকিছু ..
চা খাবে?
হ্যাঁ খাবো৷ আগে একটু ফ্রেস হবো৷
বাথরুম ঐ দিকে৷
জয় বাথরুমে গেলে নিজের ঘেমো তালুটা মুছে নেয় তমা৷ বুকটা কেমন যেন দুরুদুরু করছে৷
দাও চা দাও ৷
চলো৷
কোথায়?
ব্যলকনি তে৷
দুটো ধূমায়িত চায়ের কাপ, দুটো বোবা দৃষ্টি আর টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ৷
বুকের হাতুড়ি পিটানোর আওয়াজ টি শোনা যাচ্ছে ? তমা গলা পরিস্কার করে বলে, কবে আসলে?
তুলি, তুমি ভালো আছো?
তুমি ভালো আছো?
জানিনা৷ তবে তুমি ভালো আছো কিনা জানতে চাই৷
আজ আর ভালো মন্দের চিন্তা করিনা৷ আছি৷ পলাশ ভালো মানুষ ৷ আর পাপড়ি জীবনের সব অপূর্ণাকে মুছে দিয়েছে৷ তুমি কেমন আছো ?
আমার চলে যাচ্ছে ৷ বিদেশে ডিগ্রি নিলাম৷ ফিরে দেখলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে৷ কানাডায় গিয়ে স্টেলাকে বিয়ে করলাম ৷ ছেলে আছে৷ ব্যস্ত থাকি৷
চায়ে চুমুক দিয়ে জয় আরও অবাক হয়ে বলে, আজও আমার পছন্দ তোমার মনে আছে?
আমি তো তোমাকে ভুলিনি৷
হুম সেজন্যই এই শাড়ি, ফুল৷
লজ্জা পেয়ে তমা বললো, জানো অনেক ভেবেছি৷ কেন দেখা করবো? কিন্ত পরে ভাবলাম জীবনে সব কেনোর উত্তর হয়না৷ উত্তর পেতে নেই ৷
তোমার ফ্ল্যাটের ব্যলকনি টা সুন্দর ৷ ওগুলো বেলফুল না? কি সুন্দর গন্ধ ৷
হালকা ছাঁটে ভেজা ব্যলকনি তে বসে দুজনে যেন সেই পুরানো দিনে হারিয়ে যায়৷ কতকিছু মনে পড়ে৷ এমন বরষায় হাত ধরে গঙ্গার ধারে চুপ করে তাকিয়ে থেকে ভেজা৷ বা ললিত দের বাড়িতে সিঁড়ির কাছে এমন বরষায় দুজন দুজনের ঠোঁটে হারিয়ে যাওয়া৷
কিছু ভাবছো?
না ৷ হঠাৎ দেখা করতে চাইলে?
মা চলে গেছেন তুলি৷
ওমা কবে?
বছর খানেক আগে ৷ আসিনি তখন৷ মা রাগ করে সবাই কে বলে গিয়েছিলেন আমাকে না জানাতে৷ আমি এবার জানলাম৷ আমাদের বাড়িতে আমার অংশটুকু ছোটো বোনটাকে লিখে দিলাম ৷ আর বাবার ব্যবসার অংশটা দুই দাদাকে দিয়ে দিলাম৷ আর আসবো না৷ সব পাওনা যখন মিটিয়ে দিলাম ভাবলাম তোমার কাছে ক্ষমা টুকু ফেলে রাখি কেন? সেটুকু নিয়ে যাই৷
ক্ষমা হয় সবকিছুর ?
না হয়না৷ তবে আমি জানি তুমি আমায় অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছো৷
কি করে জানলে?
তোমার চোখ দেখে৷ আজও তোমার চোখ কথা বলে তুলি৷
ভালোই তো ৷ তাহলে মিটে গেলো৷
মুখে বলে দাও তুলি৷
হট করে হাতটা ধরে নেয় জয়৷
তুলির ভিতর অবধি কেঁপে যায়৷ বলে, ছাড়ো৷ তোমার উপর রাগ আমি করিনি৷ সে সময়ে তোমার কিছু করার ছিলো না৷ বিদেশে পড়ার অত বড় সুযোগ আর এদিকে বাবা চলে গেলেন আমার৷ তবে তুমি বলে যেতে পারতে৷ আমি তোমার অপেক্ষা করতাম ৷
আমি ভুল করেছি তুলি৷ আমি সেসময়ে স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম ৷ এতবড় সুযোগ৷ আমার পিসির ছেলে মেয়ে নেই ৷ তিনি বাবা কে বললেন দাদা তোর তিনছেলে আমাকে ছোটোকে দে ৷
বিদেশে পিসি পিসে মশাই য়ের সবকিছু আমাকে দিয়ে গেছেন৷ ব্যবসা , বাড়ি৷ আমি বড় লোভী হয়ে গিয়েছিলাম ৷ দুই দাদা তখন বাবার ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে৷ দুজনেই বিবাহিত , বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে কেউ যেতে চাইলো না৷
আর আমি তো কেউ ছিলাম না? না বৌ না …
আমায় ক্ষমা কোরো তুলি৷
করে দিয়েছি ৷ ভালোবাসা পাবার নাম না৷ তোমার উন্নতি তোমার জীবনের সাফর্ল্য সবকিছুতে আমি বাঁধা হয়নি৷
চলো খেয়ে নাও ৷
নিশ্চই আমার জন্য তুমি পনির রান্না করেছো?
হুম৷
আমি ঘরে ঢুকেই গন্ধ পেয়েছি৷ একটা কথা বলবো তুলি?
বলো?
সেই আগের মতন খাইয়ে দেবে?
বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো৷ ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে শাড়ি, মুখে পড়ছে জলের ঝাপটা৷
“আজ শহরে বৃষ্টি নেমেছে, কোথাও আকুল হয়ে ভালোবাসা কাঁদছে৷ “
লাইন দুটি মনে মনে বলে তমা বলে চলো ঘরে৷
না ভালো লাগছে ভিজতে৷ তোমার মোমগুলো গলে গেলো৷ ধূপকাঠি গুলো ফুরিয়ে গেছে৷
কিন্ত গন্ধ রয়ে যাবে জয়৷ ধূপ জ্বলে যায় গন্ধ রেখে যায়৷
তোমার দুটো কবিতা পড়বে তুলি?
খাবেনা?
আচ্ছা চলো খেয়ে নি৷ মেয়ে কখন আসবে?
দশটা৷
দুজনে বেশকিছু টুকটাক কথা বলতে বলতে খাওয়া সারে৷ সাড়ে নটা বাজে৷ রুবাই য়ের মা ফোন করেছে ,বাচ্ছারা সব ভালো আছে৷ খেলা করছে৷ ফিরতে দেরী হবে৷ বাইরে বৃষ্টি ৷
তমা ঠিক আছে বলে ফোনটা রাখে৷ যদিও রুবাই দের বাড়ি তিতলি আগেও থেকেছে তবুও আজকে যদি বাড়ি না আসে? তমা পারবে তো নিজেকে সামলাতে? প্রেমের টান যে বড় অঘোম৷
কিছু ভাবছো?
না ৷ মেয়ের আসতে দেরী হবে৷
চলো কবিতা শোনাও৷
আমি আর লিখিনা জয়৷
কেন তুলি? কত সুন্দর তো লিখতে৷
সব মুছে গেছে৷ গান , কবিতা সব৷
পুরানো শোনাও৷
চলো ব্যলকনি তে বসি৷
চলো৷
সঞ্চয়িতা আনবো? ওটা আমি সবসময় পড়ি৷ আজ তোমার কিছু শুনি৷ কিছু মোম ধরিয়ে আর ধূপ জ্বালিয়ে তমা বলে দেখি খুঁজে পাই কিনা৷
শাড়িটা খুলে একটা হালকা সুতির শাড়ি পড়ে তমা ব্যলকনি তে আসে৷ চুলগুলো মুছে খুলে দিয়েছে ৷ বড় একটা মোমের কাছে ডাইরিটা রেখে পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকে৷
কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো৷
নোনাধরা দেয়ালের গা বেয়ে, পিচ ভেজানো বৃষ্টি৷
জলের ছাঁটে শরীরের খাঁজে জমেছিলো বাহানা৷
বেহিসাবী বাদশার মতন বাতাসরা নিজেদের করেছিলো খরচ৷
শামুকের গতি নিয়ে বাড়ছিলো রাত৷
একটি বৃষ্টিতে ভেজা ভেজা রাতের অলৌকিক আবেদন,
নিবিড় করে চেয়েছিলো উড়ন্ত খেয়াল গুলো কে৷
ভেজা চুলের ইন্দুপতনে হৃদপিন্ডের শব্দকে করেছিলো দ্রুত৷
তোর কল্পনা কে জড়িয়ে সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো শরীরী উত্তাপ ৷
তোকে বলা হয়নি কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো৷
বাহ্ অসাধারণ ৷ তোমার লেখা আজও কত সুন্দর ৷ খুব ভালো লাগলো ৷
আজকের লেখা তো নয়৷ তুমি যখন বিদেশ গেলে তখনের৷ আর একটা শোনাবে৷
এসেছো নীলাঞ্জন ?
সেই কবে তুমি গিয়েছিলে ভোরের আবছা আলোয়, কুয়াশা মেখে৷
অনেক জমানো কবিতা আর একটুকরো সোনালী মন, কে ফেলে৷
জানো নীলাঞ্জন আজও তোমার নামে চিঠি লেখে প্রতিদিন ,লুকানো কথারা৷
ভাবনায় বোনে কল্পনা, হতাশার সাথেই রাত জাগে না পাওয়ার ব্যথারা৷
ভিজে বালিশ আর কিছু নালিশ রোজ নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়৷
নিজের ব্যর্থতা কে বিবেক নিজেই বহুবার প্রশ্ন কোরে, নিজেকেই হারায়৷
নীলাঞ্জন সত্যিই কি খুবই কম ভালোবেসে ছিলাম
আমি তোমাকে????
যদি একবার আমার দোষের বহরটা আমাকে তুমি জানাতে৷
হয়ত তাহলে আজও তুমি আমার পাশেই রোদ মেখে চোখ মেলতে৷
অলস দিনে, রঙিন জোছনায় , মায়াবী ভাবনায় আমার সাথেই চলতে৷
বড্ড বোকা আমি পারিনি তোমায় ধরে রাখতে এই নিঃস্ব হৃদয়ে লুকিয়ে৷
তাই ফেলে গিয়েছিলে স্মৃতিটুকু ফেলে বাকি সব পার্থিব দাম চুকিয়ে৷
আবার এসেছো নীলাঞ্জন? তুমি আবার হয়ত ফেরার পথের পথিক৷
কিন্তু নীলাঞ্জন তুমি আজও ভুল করছো , আবার ভুল হয়েছে দিক৷
আজ এখানে নেই তোমার বনলতা সেন, সে তো কবেই গিয়েছে হারিয়ে৷
তোমার দুবাহুর , আর ভালোবাসার সকল সীমানার গন্ডি ছাড়িয়ে৷
হ্যাঁ রেখে গেছে কিছু ঝরাফুল আর বেদনার ইনিবিনির ইতিহাস৷
বনলতা আজ পারিজাত হয়ে লাল বাজারে দেহের মাঝে করে বাস৷
তোমার হাতটা দেবে?
আলতো করে ছুঁয়ে দেয় জয় তমার হাতটা৷
তমা চাইছিলো রাতটা যেন না ফুরায়৷ এই বৃষ্টি, গলে যাওয়া মোমের আলো৷ সবকিছু যেন বড় মন আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছিলো৷
অনেক কথা জয় বলে যাচ্ছিলো৷ কতগুলো কানে যাচ্ছে কতগুলো বৃষ্টির শব্দে ধুয়ে যাচ্ছিলো৷ তমা গভীর ভাবে চেয়েছিলো জয়ের দিকে৷ কত না বলা কথা জমে আছে৷ থাক কিছু বলবো না৷ ওগুলো জমে থাক৷ খরচ করলে জীবনটা যেন ফাঁকা হয়ে যাবে৷ বৃষ্টির বেগের সাথে বাড়তে থাকে রাত৷
জয় বলে, আসি তমা৷
তমার যেন সম্বিৎ ফেরে৷
চলে যাবে?
হ্যাঁ রাত হয়েছে ৷ আর থাকা ঠিক না ৷ তোমার মেয়ে আসবে৷
হুম৷
খুব ভালো লাগলো জানো৷ আজ কতবছর বাদে মনটা শান্তি পেলো৷ তোমাকে দেখলাম ৷ তুমি ভালো থেকো৷ কখনও দরকার হলে জানিও ৷
হুম৷ তুমিও ভালো থেকো৷
সারারাত তমা ব্যলকনি তে কাটিয়ে দেয়৷ মেয়ে রয়ে গেছে রুবাই দের বাড়িতে ৷ তমা জয়ের চলে যাওয়া , বৃষ্টি আর কিছু ধূপের পুড়ে যাওয়া গন্ধের মাঝে বসে থাকে৷ ভালোবাসা কোনদিন ফুরায় না , বেঁচে থাকে , কখনও রাগে, অভিমানে কখনও এমন বৃষ্টি ভেজা রাতে৷ ।