আজ প্রথমেই বাংলা ক্লাস। হারান বাবুর। রোল কল করার সময় বিপদ দুবার উপস্থিত বলাতে স্যার ভুরু কোঁচকালেন ।
—- ” কিরে! দুবার উপস্থিত বললি কেন?” স্যারের প্রশ্ন ।
—- “প্রথমটায় ভাবলুম আপনি শুনতে পেলেন কিনা?” বিপদের চটজলদি উত্তর।
নাম ডাকা শেষ হতেই ব্ল্যাকবোর্ডে স্যার চক দিয়ে ‘গল্প রচনা’ লিখে বললেন, ” সবাই মন দিয়ে দ্যাখো, আর আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো।”
— ” তাহলে চোখ আর কান দিয়ে কী করবো সার?”
পিছন না ফিরেই স্যার বুঝলেন, ফুট টা বিপদেরই কাটা । গুরুত্ব দিলে পেয়ে বসবে। তাই ভ্রুক্ষেপই করলেন না। এবার ছাত্র ছাত্রীদের দিকে ফিরে বললেন,
” আজ প্রত্যেককে পনেরো মিনিট করে সময় দিলাম । অনধিক দুশো শব্দের মধ্যে গল্প রচনা করে দেখাও। সম্পূর্ণ সাধু ভাষায় । গল্পের বিষয় বস্তু ‘হাস্যরস’। সময় শুরু হচ্ছে এখন।
সবাই খাতা কলমে মন দিলো। শানুর পাশেই সুকান্ত । তারপর বিপদ। সুবীর পিছনে ।
স্যার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সবাইকে দেখছেন। পাঁচ মিনিটও হয়নি ।এর মধ্যে বিপদ দুবার উঠে দাঁড়িয়েছে । স্যার ভাবলেন কিছু বলবে সে। কিন্তু না। কলমটা কপালে ঠুকে আবার বসে পড়লো।
— ” কিরে ? অমন করছিস কেন? কৃমি হয়েছে, নাকি পেট ব্যাথা?”
—- ” ইউরেকা, সার থাঙ্কু। ক্লু দেবার জন্য ।”
স্যার অবাক হলেন । এ ব্যাটা বলে কি? কৃমি ওর গল্পের ক্লু? নাকি পেট ব্যথা! ওর দ্বারা সব কিছুই সম্ভব । ভয়ে ভয়ে আর কিছু বললেন না।
—- ” সার একটা কথা ছিলো।”
— ” বলে ফ্যাল ।”
— ” গল্পে কী রস থাকতেই হবে? “
— ” ওরে গাধা । হাস্যরস । মানে হাসি পায় যেন। আর নিজের তৈরি করা মানে মৌলিক হতে হবে । বুইচিস? “
বিপদ মাথা চুলকে ঘাড় দুলিয়ে এমন ইঙ্গিত করলো যার মানে হ্যাঁ, অথবা না দুইই হতে পারে।
—- ” আচছা তুই জিগ্যেস করছিস। কই বাকিদের তো কোনো প্রশ্ন নেই ! তারা তো দিব্বি লিখছে । তোর এতো প্রশ্ন কেনো?”
— ” সার, প্রশ্ন ওদেরও আছে। ওরা ভয়ে ভয়ে বলে না । আসলে সার বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে সবাই সাহস পায় না।”
স্যার আর কিছু বললেন না। কে জানে, উল্টো পাল্টা কিছু বলে বসবে । তার চেয়ে চুপ থাকা ভালো । গল্প লিখতে না পারলে তখন না হয় ক্লাসের বাইরে নীল ডাউন করে রাখা যাবে। যদিও আজ পর্যন্ত সে সুযোগ কোনো স্যার পাননি। শিক্ষক মহলে এই ইচ্ছাটা জারি আছে। আজ বোধহয় সেই সুযোগ পাওয়া যাবে । ভাবলেন স্যার ।
যথারীতি পনেরো মিনিট পার হলো।
— ” স্টপ রাইটিং ।” হারান বাবু বললেন।
— ” সার এটা বাংলা ক্লাস। যা বলবেন বাংলায় বলবেন ।”
—- ” তোর বাঁদরামি বের করছি। লিখেছিস? “
বিপদ সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়তেই ওর খাতাটা চেয়ে নিলেন। বললেন, ” সবাই কী লিখেছে তা পড়ে শোনাবে। তুই যাতে শুনে না লিখতে পারিস তার জন্য তোর খাতা জমা নিলাম । সবার শেষে তোরটা পড়া হবে।”
সবাই লেখা বন্ধ করলো। এবার স্যার একে একে সবাইকে পড়তে বললেন। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের থেকে শুরু করলেন । বেশিরভাগই চেনা গল্প লিখেছে। কেউ গোপাল ভাঁড়, কেউ বীরবল, কেউ মোল্লা নাসিরুদ্দিন টুকলি করেছে। আবার অনেকেই লিখেছে ঠিকই, কিন্তু হাসি নেই।তবুও স্যার খুশি। পারুক আর না পারুক চেষ্টা তো করেছে ।
সব শেষে বিপদ । মানে তার খাতা । খাতাটা ফিরত দিতে গিয়ে কী মনে করে একবার চোখ বুলালেন। এক লাইন দু লাইন করে পড়েই ফেললেন। খাতা আর ফিরত দেওয়া হলো না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস শেষের ঘন্টা বাজলো।
ক্লাসের সবাই অবাক হয়ে দেখলো, স্যার বিপদের খাতা সহ বেরিয়ে গেলেন । এই ঘটনার তিন মিনিট পর টিচার্স রুম থেকে বিপদের ডাক এলো। হেডস্যারের তলব। লক্ষীদির আগমনে সবাই বুঝলো বিপদ নিশ্চয়ই উল্টো পাল্টা কিছু লিখেছে খাতায়। নইলে সার কেন খাতা নিয়ে চলে যাবেন? আর বিপদেরই কেন ডাক পড়বে ?
কী লিখেছে বিপদ ? সেটা জানতে আমাদের যেতে হবে টিচার্স রুমে ।
টিচার্স রুম । গম্ভীর হয়ে বসে আছেন সবাই । বিপদ বার দুই অবাধ্য প্যান্টকে কোমরে তোলার চেষ্টা করেছে ।
—- ” এসব কী লিখেছিস বিপদ?”
হেডস্যারের কথায় অবাক হয়ে বিপদ বলল, ” কী লেখার কথা বলছেন সার?”
—- ” বাংলা ক্লাসে হাস্যরসের গল্প রচনায় কী লিখেছিস?”
— ” কেন সার ! গল্প লিখেছি । “
—- ” হুম। পড়ে শোনা তোর গল্প । দিন, খাতাটা ওকে দিন ।”
অগত্যা । নিজের লেখা গল্প নিজেই পড়তে লাগলো বিপদ । গুরুচণ্ডালি ভাষায় এক বেআক্কেলের গল্প ——
‘একগেলাস ইক্ষু রস মদিরার সহিত মিশাইয়া তাহা পান করিবার সাড়ে সপ্তম মিনিট অতিক্রান্ত হইবার পর ঝন্টুদার উদর কামড়াইতে লাগিলো । তাহারপর পশ্চাদ চুলকাইতেই ‘পেটে কৃমি নাকি’, ভাবিয়া ছুট্টে ঘরে গিয়া সরিষা তৈল লইয়া পশ্চাদে লাগাইতেই চুলকানি বন্ধ হইলো, শুরু হইলো জ্বালা। তাহারপরই দু নম্বর বেগ অনুভব করিতেই ছুটিলো পুকুর পাড় স্থিত বাগানে । সন্ধ্যা হইলেও বাগান নিকষ কালো অন্ধকার । হাগা মানে না বাঘার ভয়। সেইসময় সেইখানে একটি বেতো কচ্ছপও পুকুর পাড়ে পটি করিতে আসিয়াছিলো। ঝন্টুদা বেখেয়ালে না দেখিয়া ওই কচ্ছপের পৃষ্ঠদেশে পটি করিল। উষ্ণ গরম পটির ছোঁয়া স্পর্শে কচ্ছপ বমাল সমেত চলিতে শুরু করিল। এদিকে ঝন্টুদা নিজের ব্যস্ত সমস্ত পটিকে চলিতে দেখিয়া আনন্দিত এবং গর্বিত হইয়া মনস্থির করিলো যে তাহার পটি যথেষ্ট সাবালক হইয়াছে , সুতরাং সে আর কদাপি বাহিরে পটি করিয়া সময় নষ্ট করিবে না। অদ্য হইতে ঘরেই করিবে। পরের দিবস সে যথারীতি ঘরেই পটি করিলো। কিন্তু পটি চলিতেছে না দেখিয়া ভয়ানক রাগিয়া একখানি লাঠি লইয়া সপাং করিয়া পটিকে প্রহার করিলো। তবুও পটি নড়িল না । তখন ক্রোধে অন্ধ হইয়া ঝন্টুদা লাঠি দিয়া পটির উপর বারংবার মারিতে মারিতে বলিতে লাগিলো, ” চল পটি চল।” তারপরেও পটিকে স্থির দেখিয়া ভয়ানক রাগ করিয়া ঝন্টুদা লাঠির অন্তিম আঘাত হানিয়া বলিল, ‘ দুর হ, হতচ্ছাড়া পটি । আভি নিকাল যাও।’ লাঠির আঘাতে পটি দেওয়ালে মুখ লুকাইলো ।….
বিপদকে আর পড়তে দিলেন না হেডস্যার । হেনা ম্যাডাম ততক্ষণে ‘ওরে বাবারে,কী কান্ড ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠেছেন । সুভাষ সার বললেন, ” হরিবল ।” অমল বাবু বললেন, ” কী ভয়ানক! “
—- ” আর এমন গল্প লিখিসনে বাবা। এগুলো অশ্লীল শব্দ । যা, ক্লাসে যা।” হেডস্যার বললেন ।
বিপদ অবাক হলেও তেল গড়ানো চুল সহ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ধীরভাবে ক্লাসের দিকে এগুলো।।