বৃষ্টিতে ভেজার বড় সাধ অরিজিৎ এর মানে অরির । কোলকাতার কাছাকাছি যে মফস্বল শহর এলাকায় অরি থাকে, সেখানকার স্থানীয় স্কুল কলেজেই পড়াশোনা ওর। যতই ওর দিল্লি মুম্বাই বেঙ্গালুরু যাওয়ার ইচ্ছা থাক তা ওর শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। ছোটবেলা থেকেই ওর স্মৃতি চিন্তা ভাবনা সবকিছু আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই মফস্বল শহরটি। ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও। অরির মনে হয় এই মফস্বল শহরে থেকে ওর জীবন বরবাদ হয়ে গেছে। বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করে জীবনটাকে চাকচিক্যময় করে তোলা এসব কিছুই করা হয়নি অরির । অথচ অন্য সব ছেলে দের দেখো। কেউ মুম্বাই কেউ বেঙ্গালুরু কেউ দিল্লি কেউ আরও দুরে। সব্বাই উড়ে বেড়াচ্ছে। আর জীবনটাকে নিঙড়ে উপভোগ করে নিচ্ছে। শুধু অরিই পড়ে থাকলো এই ধ্যাধধেড়ে গোবিন্দপুরে। আর কপালে ঐ স্থানীয় স্কুলের কেরানির চাকরি। জীবনে আর কিছু হোলনা ওর।
অরির জীবনে আরেকটা শখ আছে, তাহোল বৃষ্টিতে ভেজা । আগে ছাত্রাবস্থায় অনেক বৃষ্টিতে ভিজেছে অরি। একা একা। ইচ্ছে করে প্রবল বৃষ্টিতে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরেছে। প্রবল ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাইক চালিয়ে পাড়ি দিয়েছে মাইলের পর মাইল। কখনো বা ওদের শহরের বাইরের দিকটায় গাছগাছালি ঘেরা যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা আছে সেখানে বৃষ্টিতে ভিজে একা একাই ঘুরে বেরিয়েছে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেছে। নিজের পাশে কল্পনায় নিজের এক প্রেমিকা তৈরি করে কথা বলেছে তার সঙ্গেও। অরির একটা দীর্ঘদিনের সাধ ছিল সাইকেলে চেপে বৃষ্টিতে ভিজে প্রেম করার। সেটাও অবশ্য আর হয়ে ওঠেনি।
যখন কলেজে পড়তো ওদের কলেজে জয়া বলে একটা মেয়ে ছিল। অরির থেকে বছর খানেকের বড়। একদিন কলেজে থাকাকালীন তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হোল। সেদিন মনের সাধ মেটানোর জন্য কাউকে না পেয়ে জয়াকেই ধরে বসেছিল অরি,
” চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিই। আমার সাইকেল আছে। “
” কেনরে ? আমি বাসে যাব। এই বৃষ্টিতে তোর সাইকেলে উঠবো কেন ?”
” চলনা। বৃষ্টিতে ভিজে যেতে মজা লাগবে।”
ভ্রু কুঁচকে কি যেন একটু ভেবেছিল জয়া। তারপর ফুঁসে উঠেছিল,
” গালে টেনে এক চড় মারব। বেয়াদপ ছেলে। আমি তোর দিদির মতো রে। আর কোনদিন তুই আমার সঙ্গে কথা বলবিনা। জয়া দি বলে ডাকবি না। আমি কাকিমা কে বলব তোর এই কথাটা দাঁড়া।”
মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল অরির। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। আর গটমট করে চলে গিয়েছিল জয়া। পরে অবশ্য অরি বুঝেছিল অন্যায়টা হয়েছিল ওর
নিজেরই । ও যে অনুভূতি চেয়েছে তা জয়ার কাছে চাওয়া শুধু ওর অন্যায় নয় পাপ ও। কিন্তু তারপর থেকে জয়া আর কোনদিন ওর সঙ্গে কথা বলেনি।
যাইহোক অরির সেই স্বাদটাও শেষমেষ অপূর্ণ রয়ে গেছে। আসলে ওর জীবনটা এমনই। ও যখন যেটা চেয়েছে তখন সেটা পায়নি। পেলেও এমনভাবে পেয়েছে যেটা ওর সঙ্গে মাপে মাপে আঁটেনি। মানে ঠিক সেই সাইজে ছোট বা বেঢপ বড় জামা পড়ার মতো ব্যাপার। জীবনে প্রেম চেয়েছিল অরি কিন্তু পায়নি। সে যাকগে কি আর করা যাবে।
সেদিন স্কুল থেকে সবে বাড়ি ফিরেছে অরি, সঙ্গে সঙ্গে ওর মা এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
” এই মেয়েটার ছবিটা দেখ ।”
” এ কে মা ?”
” আমার ছোটবেলার বান্ধবী রমা। ওর মেয়ে বৃষ্টি।”
” ও।” বলে ছবিটা তে একবার কোন রকমে চোখ বুলিয়ে মাকে ফেরত দিল অরি। একেবারে সাধারণ চেহারার মেয়ে একটা। গায়ের রঙ ও কালো।
ছবিটা হাতে নিয়ে অরির মা সুমিতা দেবী জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন লাগলো ?”
” মোটামুটি। একেবারে সাধারণ চেহারা ।”
” চেহারা সাধারণ হোক। ও ভীষণ ভালো মেয়ে। ঐরকম গুনী মেয়ে পাওয়া ভার। আমি তোর ওর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। রমা কে আর ওর বর তমাল কে আমার কথা দেওয়া হয়ে গেছে। এই বিয়ে তোকে করতে হবে ব্যাস।”
” কি ? “
প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো অরি।
” আমার বিয়ে আর আমার পছন্দ অপছন্দের কোন দাম নেই। চিনিনা শুনিনা , কোনদিন দেখিনি তাকে বিয়ে করে ফেলবো ?”
” হ্যা করবি। দেখে শুনে বিয়ে করার দম যে তোর কত আছে আমার ভালোই জানা আছে। “
এরপর আর একটা কথাও না শুনে সুমিতা দেবী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
মনটা মারাত্মক রকমের ভেঙে গেল অরির। শুধু যে সুমিতা দেবী একটা অজানা অচেনা সাধারণ চেহারার মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছেন তার জন্য নয়, অরির মনখারাপ হোল আরও বিশেষ একটা কারনে । গত মাস দুয়েক আগে ওদের স্কুলের কাছাকাছি একটা বাড়িতে চন্দ্রানী বলে একটি মেয়ে এসেছে। ঠিক এসেছে নয় চন্দ্রানী ঐ পাড়ারই মেয়ে। ও যে বাড়িতে থাকে সেটাই ওর বাপের বাড়ি। চন্দ্রানীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে বিয়ে এখন ভাঙতে চলেছে। ডিভোর্সের মামলা চলছে কোর্টে । আর তাতেই আশার আলো দেখেছে অরি। অনেকদিন থেকেই অরির নজর চন্দ্রানীর দিকে। অরি যা চায় চন্দ্রানী ঠিক তাই। কিন্তু তখন চন্দ্রানীর হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অরি আর কিছু করে উঠতে পারেনি। কিন্তু এখন অরি আবার নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । চন্দ্রানী ও ওকে আগের থেকে বেশি পাত্তা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্পও করে দুজনে। চন্দ্রানী ডিভোর্স টা পেয়ে গেলেই অরি সুমিতার কাছে কথাটা পাড়ত। তার মধ্যেই এই দুর্ঘটনা । অর্থাৎ এক্ষেত্রে ও অরির বিধি বাম। মাঝখানে অরি একদিন বৃষ্টির দিনে চন্দ্রানী কে ঘুরিয়ে সাইকেলে চড়ে ঘোরার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু মিষ্টি হেসে এড়িয়ে গেছে চন্দ্রানী। যদিও প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত তাতে ভালোরকম ছিল।
দিন তো গড়িয়ে চললো। সুমিতা দেবী কে কিছুতেই নিজের মত থেকে টলানো গেলনা। অরির কোন প্রার্থণা ভগবান ও রক্ষা করলেন না। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেল।
বিয়ের দিন সেজেগুজে বৃষ্টিকে ভালোই লাগছিলো দেখতে। সে আর এমন কি ? সাজলে সবাইকেই ঐরকম সুন্দর লাগে। চন্দ্রানীর সামনে বৃষ্টি দাঁড়াতে পারেনা।
বৌভাতের দিন খেয়ে দেয়ে চলে যাবার সময় অরির বন্ধু অনল অরির কানেকানে ফিসফিস করে বলে গেল,
” একি বিয়ে করেছিস মাইরি। এতো একদম ক্লিওপেট্রা।”
একটু রেগে গেল অরি। বেয়াদপ ! কিভাবে কথা বলতে হয় জানেনা। হোলবা কয়েক দিনের জন্য। তবু তো অরির বিয়ে করা বউ। তার সম্মানটা রক্ষা করা অরির দায়িত্ব। এই অনলের
সঙ্গে আর মেলামেশা করা যাবেনা।
ফুলশয্যার রাতে অনেকক্ষণ একা ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় অরির জন্য অপেক্ষা করে বসে রইলো বৃষ্টি। শেষে অনেক রাতে প্রায় একটা নাগাদ ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে শোফায় শুয়ে পড়লো অরি।
” তুমি শুয়ে পড় । অনেক রাত হয়ে গেছে।”
অরি লক্ষ্য করলোনা চকচক করতে থাকা বৃষ্টির চোখ দুটো মূহুর্তে কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে গেল। আনন্দে ঝলমল করা মুখটা থেকে কে যেন এক লহমায় সমস্ত আলো শূষে নিল। অরি আজ খেয়াল করলনা দু’কাধ বেয়ে চুলের ঝর্ণা নেমে ছিল। খেয়াল করলনা দুটো বড় বড় টানা টানা চোখের কোলে দুটো মুক্ত টলটল করে উঠলো। কালো রঙের আড়ালে সব ঢাকা পড়ে গেল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের ধকলে ওরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো। একজন খাটে একজন শোফায়। সন্ধ্যা থেকেই যে আকাশের মুখ ভার হয়ে মেঘে কালো করে এসেছিল তা এদের দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। মাঝরাতে সেই ভার মুখ কোন রাগে ঘোর কালো হয়ে উঠে গুড়গুড় আওয়াজ করে ডেকে উঠলো। মেঘের ডাকের সাথে কোন অভিমানিনীর চোখের জলের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো, তা কেউ জানলো না।
ভোর চারটের সময় ঘুম ভাঙলো অরিজিৎ এর। তখন ও ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ঘরের বৃষ্টি কে ডেকে তুললো অরি। ধড়মড় করে উঠে বসলো বৃষ্টি।
” কি হোল ?”
” চল একটু বাইরে বেরোবো।”
” কোথায় ?”
” চলইনা সাইকেলে করে যাব আর আসব।”
চুপচাপ খাট থেকে নেমে পড়ল বৃষ্টি । চুল ঠিক করল শাড়ি ঠিক করল তারপর বেরিয়ে পড়ল অরির সঙ্গে। বাড়ির কোন লোকের তখনও ঘুম ভাঙেনি। অরি সাইকেলের সামনে বসিয়ে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টিতে ভিজে বৃষ্টি কে নিয়ে চলে এল সেই গাছে ঘেরা জায়গাটা তে যেখানে সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নিজের কাল্পনিক প্রেমিকার সঙ্গে বহু প্রেম করেছে।
সাইকেল থেকে নামিয়ে সব থেকে ঘন গাছটার নিচে বৃষ্টিকে নিয়ে গেল অরি । গাছের নিচে ঘন ছায়ায় অরির বুকের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো আরও দুটো ঠোঁটের আশায়। কিন্তু সেই দুটো আর কাছে এলোনা।
কিন্তু কিন্তু করে কথাটা বৃষ্টিকে বলেই ফেলল অরি।
” দেখ বৃষ্টি আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারবোনা। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।”
” সেটা আমি কালকে বুঝতে পেরেছি। সেটা এতদিনে বলে দিলেই পারতে । তাহলে এত টাকা খরচ কোন তরফেই হোতনা।”
জোড়ে গিয়ে আর ফিরলনা বৃষ্টি। সব কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর তুমুল অশান্তি হোল দুই বাড়িতে। সুমিতা দেবী কথা বলা বন্ধ করে দিলেন অরির সঙ্গে। তারপর একদিন মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেল বৃষ্টি আর অরির।
বৃষ্টি চলে গিয়ে অরির চারপাশটা কেমন করে হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল। হঠাৎ করে চাকরি পেয়েই আবার চাকরিটা চলে গিয়ে বেকার হয়ে গেলে যেমন অনুভূতি হয় তেমনি মনে হতে লাগল অরির। কিন্তু কারন তো কিছু নেই। বৃষ্টির সঙ্গে তো বিয়ের আগে অরি মেলামেশা করেনি। বিয়ের পরেই বা বৃষ্টি কদিন ছিল এখানে। তবুও কেমন যেন লাগতে শুরু করলো অরির। অরি বুঝলো ও ভালো নেই। ও সুখে নেই। এই কদিন চন্দ্রানীর খবর নিতেও অরি যায়নি। ইচ্ছে করেনি।
শেষকালে একদিন বিকালে বাজারে চন্দ্রানীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অরির। চন্দ্রানী কে দেখে অরি এগিয়ে গেল,
” কি খবর ?”
চন্দ্রানী না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছিল। অরি দ্বিতীয় বার ডাকাতে ফিরে তাকালো।
” অনেক দিন দেখিনি যে।”
” আসলে কয়েকটা ব্যাপারে কিছুদিন কোলকাতার মাসির বাড়ি ছিলাম।”
” তা তুমি কেমন আছো চন্দ্রা ?”
” ভালো। তুমি ? তোমার তো বিয়ে হোল শুনলাম।”
” ঠিক শুনেছো। কিন্তু ওসব আমি চুকিয়ে বুকিয়ে দিয়েছি। মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে নিয়েছি ওর থেকে। তুমি তো জানো চন্দ্রা আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি ডিভোর্স পেলেই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তাই ওসব ঝামেলা আর রাখিনি। তোমার ডিভোর্স পেতে আর ক’দিন ?”
অরির কথা শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলো চন্দ্রানী। তারপর আস্তে আস্তে বললো,
” দেখো অরি ডিভোর্স বোধহয় আমার হবেনা। সে কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছে সে আমাকে নিয়ে থাকতে চায়। জজ সাহেব আগামী শুনানি তে আমার জবাব শুনবেন। কালরাতে সে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজ করেছিল। কোথা থেকে নাম্বারটা পেল কে জানে। যে কদিন আমরা একসঙ্গে ছিলাম, পরে তিক্ততা হলেও আমরা একসঙ্গে অনেক সুখের মূহুর্তও কাটিয়েছি। মেসেজে সেই সবকথা সে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি হৃদয়হীনা নই অরি, যে তার এই আকুল আহ্বান ফিরিয়ে দেব। তুমি আমাকে ভুলে যাও।”
অরি কে হতভম্ব অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রেখে চন্দ্রানী চলে গেল। আবার সেই আনফিট ব্যাপার
স্যাপার।
আবার শুরু হোল রাস্তায় আর বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে অরির কল্পনার জাল বোনা আর কল্পিত প্রেমিকার সাথে কথা বলা । কিন্তু আজকাল সে বড় অবাধ্যতা করে। কথা বললে আগের মতো উত্তর দেয় না। অনেক সময় নিজের মনের মধ্যে অনেক হাতড়েও তাকে খুঁজে পায়না অরি। তার
সর্বক্ষণের সাথিটিও যে এইভাবে হারিয়ে যাবে ভাবেনি অরি।
এরমধ্যে অরির একটি সাফল্য এসেছে। পরীক্ষা দিয়ে নিজের স্কুলেই টিচার হয়েছে অরি। কিন্তু সুখী নয়, সে সুখী নয়। এ তার কেমন জীবন হোল। প্রতি নিয়ত কি এক অস্থিরতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল।
দেখতে দেখতে আবার বর্ষাকাল চলে এল। সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢেকে আর ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি । শহরের বিভিন্ন এলাকায় জল জমে গিয়েছে। অরির স্কুল সেদিন ছুটি হয়ে গিয়েছে তাড়াতাড়ি। দুপুর থেকে জানলার ধারে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আর পারলোনা অরি। সন্ধ্যা বেলায় মাকে বলে সাইকেল টা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল একা একা। কিছুদুর যাওয়ার পর বৃষ্টি এতো প্রবল হয়ে উঠল যে আর এগোনো অসম্ভব হয়ে পড়লো। সামনে একটা ঢাকা বাসস্ট্যান্ড দেখে তার ভেতরেই ঢুকে পড়ল অরি।
ওখানে ঢুকেই তাকে চমকে উঠতে হোল। বৃষ্টি ঐ
বাসস্ট্যান্ড এর ভেতরে এক বেঞ্চে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।
ওদিকে বৃষ্টিও অরি কে দেখেছিল। অরি কে দেখে ও অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু হঠাৎ অরির ভেতরে কি হয়ে গেল। এগিয়ে গেল বৃষ্টির দিকে।
” তুমি এখানে একা এই অন্ধকারে কি ব্যাপার ?”
নিজের গলায় এমন শাসনের শুর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল অরি । বৃষ্টি একটু থতমত খেয়ে গেল।
” পড়াতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আটকে গেছি। কিছু পাচ্ছিনা। “
বৃষ্টির বেগ তখনও বেশ বেশি। ভালো ছাট ও দিচ্ছে। অরি একবার বাইরের দিকটায় দেখে নিল।
” তোমার যদি বৃষ্টিতে অসুবিধা না হয়, আমার সঙ্গে সাইকেল আছে চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। “
” আমার বৃষ্টিতে অসুবিধা হয় না। ভিজতে মজা লাগে। এতক্ষণ কিছু পাইনি বলে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
ঐ বৃষ্টিতেই বৃষ্টি কে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অরি । সাইকেল চেপে। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ভিজে একশা দুজনে ।
অরি কে জোর করে ভেতরে টেনে নিয়ে গেল বৃষ্টি। ওকে দেখে তমাল বাবু বিরক্ত হলেন। কিন্তু মুখে কিছু না বলে দোতলায় নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আলমারি থেকে যখন অরির জন্য শুকনো জামা কাপড় বের করছিল তখন রমা দেবী এসে বৃষ্টি কে ধরলেন।
” ওকে জুটিয়ে এনেছিস কেন ? শয়তান মেয়ে ।”
” আঃ মা আস্তে ও শুনতে পাবে।”
” শুনুক। যে তোর জীবনে শুধু শুধু একটা দাগ ফেলে দিল তাকে আমি ক্ষমা করবনা।”
“আমি রাস্তায় আটকে পড়েছিলাম। তাই তো ও আমাকে পৌঁছে দিতে এসেছে।”
সব কথাই শুনতে পেল অরি। ভেতরে ভেতরে একটু যে রাগ ওর হোলনা এমন নয়। একটু পরে বৃষ্টি ওকে শুকনো জামা কাপড় এনে দিল।
” নাও এগুলো পড়।”
” আমার গায়ের জামা তো এত তাড়াতাড়ি শুকোবেনা। এগুলোর দরকার নেই। আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি । এগুলো পড়লে তো আবার ফেরত দিতে আসতে হবে।”
” ফেরত দিতে আসতে হবে না। এগুলো তোমারই । তোমার প্রথম জামাই ষষ্ঠীর জন্য আমাদের বিয়ের সময়ই বাবা কিনে রেখেছিল। তুমি কাপড় জামা ছেড়ে একটু বোসো , আমি তোমার চা নিয়ে আসি। বৃষ্টি না থামলে যেওনা।”
সেদিন বৃষ্টি কে প্রথম বার ভালো করে দেখল অরি। অনলটা ঠিক বলেছিল বৃষ্টি সত্যিই ক্লিওপেট্রা।
সেদিনের পর কয়েক দিন চলে গেল। মামুলি ভাবেই কেটে গেল অরির কয়েকদিন। তারপর একদিন ঘনিয়ে এলো ঘোরতর নিম্নচাপ। সকাল থেকেই প্রবল ঝড় আর বৃষ্টি। অরির কল্পনায় আজ সে এসে ধরা দিল। ঝরঝর বৃষ্টিতে এক ছাতার তলায় দুজনে, সারা অঙ্গ জলে ভেজা, একটা মাত্র কাপে গরম চা, কাপের দুধারে দু জোড়া ঠোঁট।
বিকেল হতেই আর পারলোনা অরি সেই দূর্যোগেই সাইকেলে চেপে রওনা দিল।
দরজা খুলে অরি কে দেখে চমকে উঠলো বৃষ্টি।
” আরে তুমি ?”
” চল এই বৃষ্টিতে সাইকেলে চেপে একটু ঘুরে আসি। ভালো লাগবে।”
” কি করবে এখন বাইরে গিয়ে ?”
” কিছুনা। ভিজতে ভিজতে গিয়ে একটা চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা খাব। খেয়েই চলে আসবো।”
” আমি দুদিন বৃষ্টিতে ভিজে তোমার সঙ্গে ঘুরেছি আজকে এই বৃষ্টিতে আমি পারবোনা। তাছাড়া আমি যাবোই বা কেন তোমার সঙ্গে ?”
অরি এবার অধৈর্য্য হয়ে বৃষ্টির হাত ধরে টানে ।
” চলো।”
” আরে কি করছো কি ? হাত ছাড়ো । মা এসে পড়লে যাচ্ছেতাই বলবে কিন্তু।”
” মুখ আমারও আছে। আমিও দু কথা শোনাতে জানি। “
” কি শোনাবে আমার মাকে শুনি ?”
” আমার বউ কে আমি নিয়ে বেরোবো তাতে ওনার কি ?”
” তাই বুঝি ? আহা।”
রমা দেবী অনেকক্ষণ থেকেই আড়াল থেকে এদের কথা শুনতে শুনতে রেগে উঠছিলেন। শয়তান মেয়েটার ভীষণ লজ্জাশরম কম। সুমিতার ছেলেটাও তাই।
কিন্তু এবার রাগতে গিয়ে হেসে ফেললেন। তারপর একটু গলা বাড়িয়ে বললেন,
” বৃষ্টি ওকে ভেতরে আসতে বল। আজ দূর্যোগ আরও বাড়বে। তোর সঙ্গে ঘরে বসে যতখুশি চা খাক আর গল্প করুক। সন্ধ্যা বেলায় লুচি আলুভাজা করে দেব। রাতে ফুলকপি দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল আর ভাবছি কালকের চিকেনটাও রান্না করে ফেলবো। আমি সুমিতা কে ফোন করে দেব। আজ যা দূর্যোগ ওকে বাড়ি ফিরতে হবে না।”
এইবারে বোধহয় অরির মাপটা ফিট করলো।