সুজন আর অহনার দু ছেলে আর এক মেয়ে। বড়ো ছেলে রূপম, চেন্নাইতে, টেলিকম কোম্পানিতে রিজিওনাল ম্যানেজার , স্ত্রী অনু আর মেয়ে ইভানা। ছোট ছেলে নীল , অস্ট্রেলিয়াতে থাকে স্ত্রী জেন আর ছেলে স্টিভ এর সাথে। মেয়ে হীনা, ডিভোর্সি; কলকাতায়, একটা রিটেল কোম্পানির ফ্লোর ম্যানেজার।
মাঝে মাঝেই সুজন কিডনি স্টোন নিয়ে ভুগতেন খুব। যখনই কিডনিতে স্টোনের ব্যথা হতো, অসহ্য যন্ত্রনায় কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতো শরীরটা , ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গেলেই ইঞ্জেকশন দিয়ে দিতেন উনি, ব্যথা কমে যেত , আবার ওষুধ খেয়ে ঠিক হয়ে যেতেন সুজন । আবার কয়েক মাস বা বছরখানেক পরে স্টোনের ব্যথার বাড়াবাড়ি। অহনা অনেকবার বলেছিলো অপারেশন করিয়ে নিতে , কিন্তু ওনার ভীষণ ভয় ছুরি কাঁচির ! এভাবেই চলছিল অনেক দিন।
হঠাৎ করেই শরীরে দানা বাঁধে কর্কট রোগ, শুরু হয় কিডনি থেকেই , ধীরে ধীরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সেটা। কেমো নিয়ে বেশ কিছুদিন ভালো ছিলেন উনি , আবার কয়েকবছর পরে হানা দেয় রাজরোগ। এতো বড়ো ছয় ফিটের চেহারাটা একেবারে ভেঙে পড়ে , শেষের দিকে আর নিজের পায়ে হাঁটতে পারতেন না উনি , মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো হামা দিয়ে এঘর ওঘর করতেন সুজন। চোখে জল নিয়ে একবার বলেই ফেললেন অহনাকে , ” তোমাদের আমি খুব জ্বালাচ্ছি গো , তখন যদি তোমার কথা শুনে অপারেশন টা করিয়ে নিতাম !
সাতাত্তর বছর বয়সে, একদিন সকালে উঠে অহনা দেখলো সুজনের সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে , বরফের থেকেও বেশি শীতল হয়তো। হঠাৎ করে সুজনের মারা যাওয়ার খবরে, সব ভাই বোন এসে হাজির হয়, মুক্তাঙ্গণে ; ওদের বাড়িতে।
সব কাজকর্ম শেষ হওয়ার পরে, এক দুপুরে তিন ভাই-বোন একসাথে ছাদে উঠে গল্প করছে, অহনা বাচ্চাগুলোর সাথে নিচে খেলছে। অনু আর জেন, সামনের বাগানে নিজেদের মধ্যে গল্পে ব্যস্ত। বিভিন্ন কথার মাঝে, মায়ের কথা উঠে আসে।
হীনা বলে ওঠে, ” তোরা কিছু ভাবলি? এবার মায়ের কি হবে? “
নীল, “সেটাই তো । মা কি এখানে একা থাকবে? এতদিন তো বাবাকে ছাড়া ….”
রূপম, “আমি একটা কথা ভেবেছি। কেমন হয়, মা যদি চার মাস করে আমাদের এক একজনের কাছে থাকে? তাহলে মা ও আমাদের সাথে থাকতে পারবে, নাতি-নাতনিরা ও ওদের ঠাম্মিকে সাথে পাবে। কি বলিস ?”
নীল, ” কিন্তু দাদা, অস্ট্রেলিয়াতে যেতে গেলে, মায়ের পাসপোর্ট, ভিসা , তারপর অতক্ষনের প্লেন জার্নির ধকল ! এই বয়সে, এতো ধকল?”
হীনা, “আমিও তো একা থাকি, আর কাজের জন্য ঘরে ঢোকার কোনো ঠিক থাকে না , মাঝে মাঝেই বেরোতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এছাড়া আমার লিভ ইন পার্টনার, তাকে মা মেনে নেবে কিনা ! “
রূপম, “তাহলে ? কি হবে তাহলে ? সবাই শুধু নিজেদেরটাই দেখছিস ! মায়ের কথা ভাব একটু। “
নীল, ” দাঁড়া দাদা, আমরা কেউ স্বার্থপর নই , শুধু সবাই আমরা বিভিন্ন জায়গাতে ছড়িয়ে পড়েছি , আমাদের সবার অনেক রকম সুবিধে অসুবিধে আছে, সেগুলো তো মানতে হবে ! কেমন হয় , যদি আমরা এই বাড়িটা বিক্রি করে মাকে একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রমে রাখি ? বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে ফান্ড তৈরী করে , সেই ফান্ড থেকে মায়ের খরচ চলে যাবে ! একদম ফাইভ স্টার ট্রিটমেন্ট পাবে আমাদের মা। কি বলিস !”
অহনা ছাদের দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে এলো, “আমি তোদের খুঁজতে এসে, তোদের কথা শুনতে পেলাম। তোদের বাবা হঠাৎ মারা গিয়ে, সবাইকে খুব বিপদে ফেলে দিলো, তাই না ? “
সবাই কিছু একটা বলতে গেলো, অহনা সবাইকে ইশারায় চুপ করিয়ে দিয়ে বললো : “আমাকে নিয়ে তোরা ভাবিস না। এই পুরো বাড়ি, এর সম্পত্তি, তোদের বাবা, আমার নামে লিখে গেছে। আমি অনেকবার বলেছিলাম আমার নামে কেন লিখে দিয়ে যাচ্ছ ? তিন ছেলে মেয়ে আছে, ওদের নামে সমান ভাবে ভাগ করে দাও। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে হাসতো তোদের বাবা তখন। মনে হয় বুঝে গিয়েছিলো একটা কথা, আসলে আমরা সব মানুষেরাই ভীষণ একা ! সবাই কয়েকদিনের জন্য এই পৃথিবীতে আসি, একে অপরের সাথে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ি , তারপরে একদিন সব ছেড়ে, সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতেই হয় ! “
সবাই মিলে চেঁচিয়ে ওঠে :” মা, আমরা ওরকম কিছু বলতে চাই নি , বিশ্বাস করো ! “
“তোরা কি বলতে চাইছিস বা চেপে যাচ্ছিস, সেটা আমাকে বোঝাস না তোরা ! প্লিজ ! আসলে ঠিকই তো, সবাই তোরা যে যার জায়গাতে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত , আমার পেছনে এতো সময় দিলে কি করে চলবে ! তোরা জানিস , আমিও তো অপরাধী, তোদের মতো , বা হয়তো তোদের থেকেও বেশি। “
সবাই অবাক হয়ে এর ওর মুখের দিকে তাকায় , হীনা এগিয়ে এসে মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলে ওঠে, “কি সব বলছো মা , তুমি কেন অপরাধী হতে যাবে ? এসব কি বলছো ? “
অহনা ওদের সবার দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে হেসে বলে ওঠে ! “শেষ কয়েকমাস ধরে বার বার হসপিটাল আর বাড়ি এইসব করে করে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম রে ! যখন তোদের বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে, আর শেষের দিকে যখন ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেয় , তোদের বাবাও কেমন যেন মেনে নিয়েছিল ভবিতব্যকে। শেষের দিকে কিরকম চুপ হয়ে গিয়েছিলো। সুজন, যে সারাক্ষন ঘর দাপিয়ে বেড়াতো, পাড়ার প্রত্যেকের ভালোমন্দে পাশে গিয়ে দাঁড়াতো, সাইকেলে করে বাজারে চলে যেত ঘরের প্রয়োজনীয় – অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনতে , সেই সুজন, মাত্র কয়েক মাসেই কিরকম শুকিয়ে গিয়েছিলো। এতো লম্বা চওড়া মানুষটা কিরকম দুমড়ে মুচড়ে ছোট্ট হয়ে গিয়েছিলো। খুব কষ্ট হতো, আমি রাতের পর রাত জেগে কেঁদেছি, তার ওপর চিকিৎসার এতো খরচ , আজ কেমো তো কাল টেস্ট, তো পরের দিন আই সি ইউ। আর সারাক্ষন মনের মধ্যে ভয়, এই বুঝি মানুষটা চলে গেলো আমাকে ছেড়ে, আমাকে একা করে দিয়ে ! কিভাবে যে শেষ কিছুদিন কেটেছিল, সে শুধু আমিই জানি। মাঝে মাঝে মনে হতো , না না মনে হতো না , আমি প্রার্থনা করতাম ঈশ্বরের কাছে, এতো কষ্ট না দিয়ে নিয়ে যাও ওকে তোমার কাছে ! শেষ করে দাও সুজনকে। “
সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে ওঠে ” মা ? “
অহনা চোখের জল মুছে বলে ওঠে, “তোরা চিন্তা করিস না, আমি , আমার কিছু হবে না ! এই বাড়ি আমি বিক্রি করে দেবো, বিক্রি করে ,বিক্রির পনেরো শতাংশ করে তোদের সবাইকে দিয়ে দেবো আমি, বাকি পঞ্চান্ন শতাংশ আমি ব্যাংকে রেখে চলে যাবো কোনো বৃদ্ধাশ্রমে ! এছাড়া আমিও স্কুলের চাকরি করে যা কামিয়েছি, আর পেনশন এর টাকায়, ঠিক চলে যাবে আমার। তোদের আমাকে কিছু পাঠাতে হবে না। শুধু মাঝে মাঝে, বুড়ি মায়ের কথা মনে এলে, একটু দেখতে আসিস। জানি, তোরা সবাই ভীষণ ব্যস্ত , অনেক দূরে থাকিস। তবুও ! নাতি নাতনীগুলোকে দেখতে ইচ্ছে করে তো খুব !
এবার ছাদ থেকে নেমে, ঘুমোতে যা তো তোরা ! বেলা প্রায় পড়ে এলো। ”
অহনা নিচে নেমে, সুজনের হাসি মাখা ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে ; “আমাদের ভালোবাসা , আমাদের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ ! তুমি কি করে জেনে গিয়েছিলে এতো আগে থেকে ? সবাই সন্তানদের আশাতে বসে থাকে শেষ বয়সে, আর আজ ওদের আমাদের জন্য কোনো সময় নেই। আমাদের জন্য, ভালোবাসা নেই গো , আজ আর ভালোবাসা নেই। আমিও তো তোমার মৃত্যু কামনা করেছি শেষের দিকে। আমাকে ক্ষমা করতে পারবে তুমি ? বলোনা !
কান্না আসছে ভেতর থেকে, ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আজ।
তোলা থাক সেই কান্না – একা অহনার জন্য !