সকাল হতে তখন খানিকটা বাকি, বিছানা ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি, সোহম আমার বাম হাতটা আলতো করে টেনে ধরতেই, আমি বুবাইয়ের দিকে তাকালাম । ও তখনও ঘুমাচ্ছে, অবশ্য স্কুল থাকলে উঠে পড়ার চেষ্টা করে, তারপর আমি জোরে ধমক লাগালে, বিছানা ছেড়ে নীচে নামে । আজ শনিবার, স্কুলে যাবার তাড়া নেই, ছুটিটা ভালো করে উপভোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু বাবার মতন একটু ঘুমকাতুরেও বটে । সোহম বললো,
-“আজ আবার কি আছে ? এত তাড়াতাড়ি উঠছো ?”
-“কেন খাবার সময় কাল বললাম না ! বুবাইয়ের প্রিন্সিপাল ডেকেছে ।”
-“কেন কি ব্যাপারে ?”
-“কি করে বলবো বলো, জানোই তো ওদের স্কুলের ব্যাপার, পান থেকে চুন খসলেই হলো ।”
-“রিসেন্ট কোনো টেস্ট ফেস্ট হয়েছে নাকি, খারাপ রেজাল্ট ?”
-“না না সেরকম কিছু নয়, যাই না দেখা করতে, অফিস তো খোলা, যেতে বলেছে যখন ।”
-“আমার আজ গেলে ভালো হতো না ?”
-“সে তো হতোই, তুমি তো অনেক দিন যাও না ।”
-“আসলে কি বলোতো, আজ অফিস এ যেতেই হবে, একটা প্রেজেন্টশন তৈরি করে, সোমবার স্লাইড শো করতেই হবে, না হলে প্রজেক্টটা ক্যানসেল হয়ে যেতে পারে ।”
-“না, তাহলে তোমায় আমি জোর করবো না, আমি তো যাচ্ছি, আশা করছি, দুপুরের মধ্যেই চলে আসবো, তুমি একটা কাজ করো, অফিস বেরুবার আগে, একটু বুবাই কে বোলো, প্রফিট এন্ড লস এর অংকগুলো যেন কমপ্লিট করে ফেলে, বিকেলে আবার শুভ স্যার আসবে ।”
-“ঠিক আছে, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমি তো আছি ।”
স্কুল আমার বাড়ি থেকে, আধ ঘন্টার মতন লাগে, একটা বাস প্রায় ফাঁকাই পেয়ে গেলাম। যেতে যেতে একটা কথাই বার বার মনে হচ্ছে, বুবাই আমার ছেলে বলে বলছি না, খুব একটা সমস্যা ওর যদি না হয়, কোনোভাবেই রাগ দেখায় না । কাউকে সেরকম ভাবে কিছু বলা এখনো পর্যন্ত করে নি, জানি না আর স্কুল তো , সেখানে আর পাঁচটা ছেলের সাথে কি করে, তবে আহামরি কিছু করলে, আমাকে এসেই প্রথম বলতো । এখনও পর্যন্ত আমি আর সোহম ওর সাথে ভালোমতোই আন্ডারস্ট্যান্ডিং করি, এখন ক্লাস এইট , এরপর উঁচু ক্লাস এ উঠে গেলে জানি না, কতটা কিছু করতে পারবো ।”
স্কুলে ঢুকে দোতলায়, একটা বড়ো হলঘর মতন আছে, তারপর প্রিন্সিপাল এর ঘর, সামনে একজন বেয়ারা চেয়ার এ বসে, আমি দেখা করবো বলতেই, উনি জিগেস করলেন, এপয়েন্টমেন্ট আছে ? আমি ডায়েরিটা দেখাতেই, বসতে বললেন। সামনে একটা বড়ো বেঞ্চ, আমি ওখানে মিনিট পাঁচেক বসার পর, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ঘরে ডাকলেন ।
-“আসুন, আপনি ঋষিক এর মা না ?”
-“yes ম্যাডাম, আমিই ঋষিক এর মা ।”
-“আচ্ছা, আপনারা মানে আপনি আর ওর বাবা, বাড়িতে ওর সাথে ভালো করে কথাবার্তা, মানে behaviour টা ঠিকঠাক করেন তো ?”
-“ম্যাডাম, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।”
-“আপনার ছেলে পরশু দিন, কম্পিউটার ম্যাডাম- এর সাথে খুব রুড বিহেভিয়ার করেছে, ওর আগেও অনেকে করেছে, আমি সিরিয়াসলি নিই নি । কিন্তু সেদিন যা হয়েছে, খুব খারাপ, আমি কল্পনা করতে পারছি না, এই ধরণের খারাপ ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলা, আপনি কি মোনামী ম্যাম এর সাথে একবার দেখা করবেন ? তাহলে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে পারবেন ।”
-“ঠিক বলেছেন, আমি ওনার সাথে কথা বলতে চাই ।”
একটু জোরে, সামনে বসে থাকা বেয়ারা সম্ভবত, ওর নাম রাজ্, ম্যাডাম বলে উঠলেন,
-“এই রাজ্, একটু মোনামী কে ডাকতো , সেভেন বি-র একটা স্পেশাল ক্লাস নিচ্ছে ।”
-“ডাকছি ম্যাডাম ।”
ও চলে যেতেই খানিকক্ষণ একটু চুপচাপ থাকার পর, প্রায় মিনিট দশেক, পর ওই মোনামী ম্যাডাম এসেই আমার দিকে একটু কটমট করে তাকালেন । খুব একটা বয়স নয়, কত হবে, তিরিশ, কিন্তু ব্যক্তিত্ব দেখে মনে হয়, কাউকেই খুব একটা পরোয়া করে না ।
-“এই যে, আপনি বোধহয় some ঋষিক এর মা না, ও কিন্তু প্রচন্ড রুড, ইন্ডিসিপ্লিনড । এভাবে আমার পক্ষে পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না, আপনারা তো কিছু বোঝেন না, বাড়িতে একরকম থাকে, স্কুলে এলেই হাতির পাঁচ পা গজায় ।”
আমি খুব শান্ত হয়ে, ওনাকে জিগেস করলাম,
–“প্লিজ একটু বলুন না, ব্যাপারটা কি হয়েছে ?”
-“সামনের উইকে আমি ক্লাসে একটা সারপ্রাইজ টেস্ট নিয়েছিলাম, আপনার ছেলের দুটো কোশ্চেন-এর আনসার একদম ঠিক মনে হয় নি, আমি জাস্ট বললাম এইসব ছাতার মাথা কি লিখেছো, ও আমার সাথে তর্ক করতে শুরু করলো। কেন ম্যাম, আমি তো ঠিকই লিখেছি, আপনারা যে বই রেফার করেছেন, আমি তো সেখান থেকেই পড়ে আনসার দিয়েছি, আমি তারপর যেই বললাম, দেখো, এটা ঠিক আনসার নয়, উল্টে আমাকে বলে কিনা, এই বইতে যিনি লিখেছেন তিনিও থাহলে ঠিক নন । শুনুন কথা ।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তখন, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“আচ্ছা আপনার ছেলে কি একটু বেয়ারা টাইপের হয়ে যাচ্ছে, আপনারা এখন কার বাবা-মারা ঠিক ছেলেমেয়েদের গাইড করতে পারেন না, আজ থেকে বছর পনেরো কুড়ি আগে হলে দেখতাম কি হয় ।”
আমি করুন সুরে বলে উঠলাম,
-“প্লিজ আপনারা বিশ্বাস করুন, আমার ছেলে এরকম নয় ।”
এরপর দুজনেই আমাকে প্রায় চেপে ধরলেন,
–“তাহলে কি আমরা ভুলভাল বলছি, এজন্যই তো আপনাদের ছেলেরা এরকম ভাবে আন্টিদের মুখের উপর কথা বলে, আপনারাই তো ঠিক নন ।”
চোখ দিয়ে জল চলে এলো, ওনারা বললেন, “যান আপনি এখন বাড়ি যান, ওর বাবা, ওকে সময় দিতে পারে তো ? না উনিও বাইরেই থাকেন, দুজনে মিলে বসুন, ওনাকে বোঝান, এভাবে চলতে পারে না, সামনে দুবছর পর কলেজ যাবে, তখন তো একটা আনসোশাল তৈরি হয়ে যাবে, আপনাদের কি আমাদের স্কুলের ই তো সবাই বদনাম করবে ।”
ওদের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে, হাঁফ ছেড়ে বাচলাম । আজ তো সোহম-ই আসতো, কি কেলেঙ্কারি যে হতো, ভাবতে পারছি না, হয়তো বলতো আপনি TC দিন, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি, দরকার নেই এরকম স্কুলের । যাক বাবা ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন, স্কুল থেকে বেরিয়েই যে অন্য স্কুল এ ভর্তি করতে পারবো সেরকম কি কোনো গ্যারান্টি আছে !
দূর থেকে একটা ট্রাম কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভীষণ চাপতে ইচ্ছা করলো। আগে বাবা-মার সাথে প্রায় প্রতি ছুটির দিন, ট্রাম চড়তাম, আমার ভীষণ প্রিয়ও, কি সুন্দর টিং টিং করতে করতে এগিয়ে যায়, সবার সামনে দিয়ে নিজের রাস্তাটা দিয়ে চলতে চলতে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। একবার তো একটা ঠেলাওলা সামনে পরে গেছিলো, আর ও পাস কাটাতে গিয়ে প্রায় বড়ো বড়ো দুটো বস্তা ট্রাম লাইন এর উপর পড়ে যায়, সে এক কেলেঙ্কারি অবস্থা, প্রায় ঘন্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে ।
টিকিট কাটা হয়ে গেছে, আর বাড়িও তখন অনেক দূর, আমার মন খারাপ দেখে, বাবা নিচে নেমে যা চাইছি, চানাচুর, লজেন্স, ফুচকা কিনে দিচ্ছিলো । কি সুন্দর যে ছবির মতো ওই সব দিন ছিল, আজ হঠাৎ মনে পরে গেলো ।
বাড়িতে পৌঁছতেই বুবাই জোরে চিৎকার করতে করতে আমার কাছে এলো,
-“মা কি বললো ওরা ?”
-“আগে বলো বাবা কখন অফিস গেলো ?”
-“সাড়ে দশটা হবে । বলোনা কি বললো ওরা ?”
-“কি আর বলবে, তোমার দিন দিন খারাপ ব্যবহারে ওনারা বিরক্ত হয়ে গেছেন, বাড়িতে স্ট্রিক্ট অ্যাকশন নিতে বলেছে, আসুক আজ বাবা, সিরিয়াসলি কথা বলতে হবে ।”
বুবাই খানিকটা মুষড়ে পড়লো মনে হলো, মাথায় হাত দিয়ে শান্ত হয়ে জিগেস করলাম,
-“চান হয়ে গেছে ?”
-“হয়ে গেছে ।”
-“আর খাওয়া দাওয়া ?”
-“শনিবার তো আমি তোমার সাথে খাই ।”
-“এই তো গুড বয়, ঠিক এখন যে ভাবে কথা বলছো, এরকম ভাবে সবসময় বলতে পারো না । তাহলে তো লোকজনদের কাছে এরকম কমপ্লেইন শুনতে হয় না ।”
-“মা, আমি কার সাথে এরকম ভাবে কথা বলেছি বলো ?”
-“বলছি, তুমি তার আগে আমাকে বলোতো, স্কুল এ কোন টিচারকে তোমার সব থেকে ভালো লাগে ?”
-“আমার(খানিকটা ভেবে নিয়ে ) দীপক স্যার কে ভালো লাগে ।”
-“কে যিনি ম্যাথ পড়ান ?”
-“যিনি ম্যাথ পড়ান, তাকেই আমার সবথেকে ভালো লাগে ।”
-“কেন তাকে তোমার সবথেকে ভালো লাগে ?”
-“উনি ভীষণ ফ্রেন্ডলি, আমাদের উনি বুঝতেই দেন না যা, উনি একজন ম্যাথ টিচার। খুব কমপ্লিকেটেড প্রব্লেমগুলো যেভাবে সল্ভ করান, আমরা কোনো ভুল করলে, এতো সুন্দর কথা বলে ব্যবহার করেন, আমরা কখনওই ইনসিকিওর ফীল করি না, তাছাড়া ওনার শাস্তিও ভীষণ মজাদার, জানোতো সেদিন কৌশিক একটা অংক ভুল করেছে, অনেক বার বোঝানোর পর যখন ও সল্ভ করতে পারছে না, স্যার বললেন ঠিক আছে, তোমার মুখ থেকে আমি পরের দিন, একটা জোকস শুনতে চাই, যদি না পারো, তখন দেখবে কি করি, এই কথাটা জানো মা উনি এমনভাবে উনি বললেন, যেন আমরা ওনার বন্ধু ।”
-“আচ্ছা আর কোনো টিচার যাকে তোমার খুব ভালো লাগে ?”
-“অরিন্দম স্যার, উনি ফিজিক্স স্যার ।”
-“ওনাকে তোমার কেন ভালো লাগে ?”
-“উনি ভীষণ সাপোর্টিভ। “
-“কি রকম ?”
-“যদি আমাদের কোনো কিছু প্রব্লেম হয়, উনি নিজের হাতে তাকে ছুটির পরে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুব সুন্দর করে একা বোঝান, আর তাছাড়া উনি একদম আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না । ওনার মতন স্যার-ই হয় না । রেজাল্ট খারাপ হলে, উনি বলেন যে একবার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তো কি হয়েছে, আবার তোরা খেটে পর, দেখবি পরের বার ভালো হবে, তখন আর আগের কথা কিছু মনেই থাকবে না ।”
-“আর মোনামী ম্যাম ?”
-“ওরে বাবা, উনি তো প্রথম দিন থেকেই আমাদের উপর খাপ্পা, আমাকে, আর কিংশুক কে তো একদমই দেখতে পারেন না ।”
-“কেন উনি তোমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন ?”
-“আসলে মা, উনি প্রাইভেট টিউশন দেন, আর উনি চান যে আমরা সবাই যেন ওনার কাছে টিউশন নিই। যারা এখনো পর্যন্ত টিউশনি ই না, তাদের উপর উনি সব সময় খারাপ ব্যবহার করেন । উনি টিউশন এ যেরকম নোটস দেন, ঠিক সেই রকম ভাবেই লিখতে হবে । অন্য কোনো বই, বা রেফারেন্স বই দেখে পরে লিখেলে, উনি কেটে দেবেন। একদিন আমাদের ক্লাস এ সাত জন স্টুডেন্ট কে, প্রায় পুরো ক্লাস বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, আর প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কে তো সব সময় ই আমাদের নামে যা তা কমপ্লেইন করেন । জানো তো মা, রবি বলছিলো, উনি স্কুল ম্যানেজমেন্ট এর খুব কাছের লোক, তাই ওনার নাম কেউ যদি কিছু বলে, উনি একদম পাত্তাই দেন না ।”
এতক্ষন আমার সামনে যে কুয়াশাটা ছিল, আসতে আসতে কেটে যেতে লাগলো, আমি দুপুরবেলা যখন শুলাম, বুবাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে বোঝালাম যে, আর তো মাত্র দুটো বছর বাবা, তারপর তোমায় অন্য স্কুলে ভর্তি করে দেব, আর এই স্কুলে রাখবো না, তুমি আর দুটো বছর লক্ষ্মী হয়ে থেকো, দেখো উনি তো আফটার অল তোমার ম্যাডাম, চেষ্টা কোরো এমন কিছু না বলতে যাতে ওনার রেস্পেক্ট নষ্ট হয় কেমন ।
দেখলাম বুবাই ও লক্ষ্মী ছাত্রের মতো বুঝতে চেষ্টা করছে ব্যাপারটা ।
তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, যখন উঠলাম, ঘড়িটা প্রায় পাঁচটা বাজে। এখুনি ওর ম্যাথ স্যার আসবেন, চা করতে করতে একটা স্বপ্নের কথা মনে করলাম যেটা একটু আগে দেখছিলাম,
প্রচন্ড বৃষ্টিতে সারা রাস্তাঘাট জলে ভরে গেছে, কোথাও পা দেওয়ার জায়গা নেই, আমি বেড়িয়েছি, চুড়িদারটা দুটো হাত দিয়ে অল্প একটু তুলে হাঁটার চেষ্টা করছি, সামনে দেখলাম একটু উঁচু মতন জায়গা, মনে হলো পা রাখতে পারবো, একটা বড়ো টিনের মতন জায়গায় পা রাখতে যাচ্ছি, কে যেন কোথা থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, দিদি ওখানে পা রাখবেন না, ওটা উঁচু পাঁক, পা রাখলেই নর্দমার জলে কোথায় যে ভেসে যাবেন, কেউ তার কোনো ঠিকানা খুঁজে পাবে না, আমি চমকে উঠলাম, আর তখনই হটাৎ আমার ঘুম টা ভেঙে গেল।