দিল্লীর বিকেল বেলা আর সন্ধ্যে বেলার ফারাকটা বোঝা বেশ দুস্কর।এখানে দিন গড়িয়ে রাতটা যেন ঝুপ করে শুরু হয়ে যায়।এইনিয়ে তিন মাস হলো অবনী বাবু দিল্লীতে এসেছেন।বাড়ী গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম হারাইপুরে।পেশায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক অবনীবাবু দিল্লী এসেছিলেন এইমস এ নিজের চিকিৎসা করানোর জন্য।দুমাসের চিকিৎসা শেষ করে ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন গুরগাঁও এ।এই গতমাস থেকে বেশ কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন।দিল্লীতে আসা অবধি জায়গাগুলো ঘুরে দেখা হয়নি,তাই আজ হটাৎ তার মনে হলো গুরগাঁও এর এদিক ওদিকটা একটু ঘুরে দেখার।
-“এই একটু সামনে থেকে ঘুরেই চলে আসবো” বলে নতুন ধুতিটা পরে বেরিয়ে পড়লেন অবনীবাবু।
আত্মীয়ের শতাধিক বারণ সত্ত্বেও ঠিক করলেন পায়ে হেটেই চারপাশটা দেখার।আসলে গ্রামের মানুষ তো,তাই পায়ে হেঁটে চার পাশটা না দেখলে মনটা ঠিক শান্তি পাইনা।
সেক্টর ২৯ থেকে ডানদিক ধরে বড় রাস্তার পাশের সার্ভিস লেনে আসতেই অবনীবাবুর চক্ষু চড়ক গাছ।ঝাঁ চকচকে বিশাল এক চওড়া রাস্তা আর তার দুপাশে সারিসারি আকাশ ছোঁয়া,তাক লাগানো বিল্ডিং।দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যাই।রকমারী দামী দামী গাড়ি চওড়া রাস্তার ওপর দিয়ে তীরের গতিতে ছুটছে।অবনীবাবুর মুহূর্তের জন্য মনে হলো তিনি যেন বিদেশে আছেন।সত্যি বিশ্বকর্মা ঠাকুর বিগত কয়েক দশক ধরে গুরগাঁও সাজাতে এতটাই ব্যাস্ত যে গ্রামবাংলায় নজর দেওয়ার সময়টা বোধহয় করে উঠতে পারেননি।
আরো যেটা চোখে পড়লো তার সেটা হলো এখানকার লোকজন।সবাই সুসজ্জিত, কেতাদুরস্ত, ঝকঝকে চেহারা।দেখলে মনে হয় যেন চলচিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রী।বেশীরভার লোকজনই আবার ইংরেজীতে কথা বলছে।
এইসব দেখতে দেখতে অবনী বাবুর চোখ পড়লো পাশেই দাঁড়ানো এক ভদ্রমহিলা আর তার বছর আটেকের ছেলের উপর।
-“Mom, why we only live on earth when there are many other planet in the solar system”
মা হেসে উত্তর দিলেন
-“Google it “
“GOOGLE IT!!!! সত্যি বাবা, বলিহারি জিনিস এই google,সব প্রশ্নের উত্তরই এর জানা।ভাগ্য ভালো আমার গন্ড গ্রামে google নামক বস্তুটি এখনো পৌঁছায়নি,নাহলে আমার মতো শিক্ষকদের চিরতরে ছুটি হয়ে যেত”: নিজের মনেই কথাগুলো বলে গেলেন অবনীবাবু।হটাৎ মুচকি হেসে মনে মনে বলতে লাগলেন
“হতচ্ছাড়া গুলো google এর নাম অবধি শুনেছে কিনা সন্দেহ, কিস্যু হবে না ওই গণ্ডগ্রামের গরু গুলোর।যা সব ছাত্র পাই,শুধু খিল্লি আর দস্যিপনা।পড়াশোনা করার নাম গন্ধ নেই।শুধু মিড ডে মিল টার জন্য সব স্কুলে আসে। হাভাতের দল সব। দীর্ঘ ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেও একটা ভালো ছাত্র পেলাম না।আমার গোয়াল ঘরে শুধুই গরুর দল…..এখানকার বাচ্চাদের দেখো ,কত কিউরিয়াস,কত অ্যাডভান্সড বাবা মা রা কত কেয়ারিং, এদেরই হবে।এদের জানার খিদেটাই আলাদা। আমার গোয়ালেও গরু গুলো প্রশ্ন করে, তবে সেটা নেহাত খিল্লি আর বাঁদরামির জন্য।সে সবের না আছে কোনো মাথামুন্ডু ,না আছে কোনো সেন্স।শুনলেই আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে”….নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে অবনী বাবুর আজ বছর কুড়ি আগেকার একটা ঘটনার কথা মনে পরে গেল………..
সেবার গরমের ছুটি সদ্য শেষ হয়েছে।যদিও গরম তখনও শেষ হয়নি।গরমে প্রায় সেদ্ধ হয়ে ক্লাসে ঢুকেই গলা খেঁকিয়ে ক্লাসকে শান্ত করলেন অবনীবাবু।আজ আরবেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার।আর ইচ্ছা করলেই বা কি?শোনে এরা?…
রাশ ভারী গলায় বললেন :
-“সবাই আজ গরুর রচনা লেখ,কেও কারো খাতা দেখবি না,কথা বলবি না।না হলে পেঁদিয়ে পিঠের ছাল তুলে দেব”
সবাই লেখার প্রস্তুতি করছে দেখে অবনী বাবু ভাবলেন একটু জিরিয়ে নেবেন।যা গরম পড়েছে।
হটাৎ একজন ছাত্র হাত তুলে “স্যার” বলে দাঁড়িয়ে পড়লো।
সদ্য আসা ঘুমটা নিমেষে কেটে গেল কর্কশ আওয়াজটাই।
চোখ খুলে অবনী বাবু দেখলেন শানু দাঁড়িয়ে আছে হাত তুলে।
শানু হলো ক্লাসের প্রশ্নবিচিত্রা।পড়াশোনা বাদ দিয়ে শুধু আবোল তাবোল প্রশ্ন।গন্ডগোলের নিধিরাম সর্দার।মুখটা দেখলেই মনে হয় “দি ঘা কতক”।যা মনে আসে তাই ফস করে জিগ্যেস করে। কিছুদিন আগেই ক্লাসে অবনী বাবু যখন রুই মাছের chapter টা পড়াচ্ছিলেন শানু প্রশ্ন করেছিল -“স্যার,মাছেদের কি জল তেষ্টা পাই? মাছেরা কি কাঁদে কখনো, আর কাঁদলে কি করে বুঝবো কাঁদছে কিনা?”।আরেকদিন অবনী বাবু যখন সদ্য পড়া ভ্রমণ কাহিনী থেকে আফ্রিকান হাতির কথা বলছিলেন,শানু প্রশ্ন করেছিল “আচ্ছা, আফ্রিকান হাতি যদি আমেরিকায় চলে আসে,তাহলে কি তাকে আফ্রিকান আমেরিকান হাতি বলা যাবে?”
…….আজও শয়তানটা হাত তুলেছে,নিশ্চয় কিছু ফালতু প্রশ্ন করার জন্য।
অবনী বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন-
“গরু নিয়ে রচনা লেখাতে কি প্রশ্ন থাকতে পারে শুনি?”
-না স্যার, মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায় গরু ছেলে না মেয়ে?
-“মানে?????”
-মানে গরু দুধ দেয়,তার বাচ্চা হয়,তাহলে তো মেয়ে হওয়া উচিৎ, কিন্তু আপনি যে বলেন আমি গরু,আমার বাবা বলে দোকানে নাকি তিনি গরুর মতোন খাটেন।তা আমি ,বাবা আমরা তো ছেলে তাহলে গরু হলাম কি করে,তাই ঠিক বুঝতে পারছিনা …
মুহূর্তের মধ্যে শান্ত ক্লাসটা হাসির আওয়াজে ফেটে পড়লো।
অবনীবাবুর মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
হাতের সামনের খাঁজকাটা বেতটা নিয়ে অবনী বাবু শানুর পিঠে সপাটে চালাতে লাগলেন। চুলের মুঠি ধরে হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে পেনসিল গুঁজে আঙ্গুলগুলো চেপে দিয়ে চিৎকার করে বললেন
“গরু হল মেয়ে,আর তুই আর তোর বাপ হলি বলদ, বুঝলি?”
ব্যাথায়, যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠল শানু।রুক্ষ শুষ্ক ঝাঁকড়া চুলের শানুর ছেড়া ফাটা জামাটা বেত্রাঘাতে আরো ছিড়ে গেছে।পিঠে বেতের দাগ লাল রেখার আকার নিচ্ছে। গালের ওপর চোখের জল নেমে আসছে।
তাতেও শান্ত হলেন না অবনী বাবু।ক্লাস থেকে শানু কে বের করে দিয়ে কাঠফাটা রোদে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
সেই শেষবারের মতো শানু কে দেখেছিলেন তিনি।এরপর শানু র বাবার কি একটা বড় অসুখ হওয়ায় ওরা গ্রামের বাড়ি জমি বিক্রি করে প্রায় নিঃস্ব হয়ে শহরে বাবাকে নিয়ে চলে আসে চিকিৎসার জন্য।
গরিব ঘরের বখাটে ছেলেটার কথা ভেবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে অবনী বাবুর। মায়া হয়।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে সার্ভিস রোড ছড়িয়ে ফ্লাইওভারে উঠেপড়েছেন খেয়াল করেননি।সম্বিৎ ফেরে তার প্রায় পাশ ছুঁয়ে দ্রুত গতিতে পেরিয়ে যাওয়া গাড়ির আওয়াজে।
ভুল রাস্তায় চলে এসেছেন,এতো পথচারীদের রাস্তা নয়।একটুর জন্য বেঁচে গেলেন।গাড়ির ড্রাইভার গাড়িটাকে একটু আগে দাঁড় করিয়ে মুখ বের করে চিৎকার করলো অবনী বাবুর দিকে:
“সুইসাইড করনা হ্যায় কিয়া আঙ্কেল?”
ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে অবনী বাবু ভাবছেন কি বলবেন আর কি করবেন।এমন জায়গায় এসে পড়েছেন পেছনে ফেরাও মুশকিল।শত শত গাড়ি হাই স্পীডে পেরিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির ড্রাইভার গাড়িথেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে দিল।চকচকে নীলচে কালো গাড়িটার পিছনে একটা লাফানো চিতা বাঘের লোগো। তার নিচে লেখা আছে Jaguar XJ।গাড়ির পিছনের সিট থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো এক সুটেড বুটেড যুবক।গাড়ির পিছনের দরজাটা বন্ধ করে অবনী বাবুর দিকে এগোতে লাগলো সুদর্শন সুপুরুষ যুবক টি।তার বাম হাতের rado ঘড়িটায় যেন সূর্যের আলো পরে অবনী বাবুর চোখে ছটা মারছে।কাছে এগিয়ে এসে তরুণ যুবকের হাত এগিয়ে আসে অবনী বাবুর দিকে।চোখ বন্ধ করে নেন অবনী বাবু….মারবে বোধহয় ভেবে।
হটাৎ তার পায়ের কাছে হাতের স্পর্শ অনুভব করেন।চোখ খুলে দেখেন সপ্রতিভ যুবক টি তাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করছে।একগাল অনাবিল হাসি হেসে যুবকটি অবনী বাবুকে বলেন
“চিনতে পারলেন স্যার?আমি শান্তনু….মানে শানু।হারাইপুর এ আপনার কাছে পড়তাম।আমি কিন্তু দেখেই চিনে ফেলেছিলাম আপনাকে।কিন্তু আপনি এখানে স্যার?কবে এসেছেন?শরীর ভালো আছে তো? আসুন আসুন স্যার।আমি ছেড়ে দিচ্ছি।এই রাস্তায় গাড়ি দাঁড়াতে দেয় না।”
একনিস্বাসে কথা গুলো বলে শানু অবনী বাবুরহাত ধরে তাকে গাড়িতে চাপালো।
অবনী বাবু বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।কিছুতেই চেনা হিসাব মেলাতে পারছেন না।
গাড়ির ভেতর শানু সেই ছোট বেলার মতো অনর্গল অনেক কিছু বলে গেল।শানুর কথা গুলো অবনী বাবুর কানে ঢুকেও মগজে রেজিস্টার করছে না।মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে তার।অনেক প্রশ্ন ঘুর পাক খাচ্ছে।কি করলো এমন বখাটে ছেলেটা?কোনো খারাপ পাল্লায় পরেনি তো?টাকা রোজকার করার জন্য অসামাজিক কিছু করছে না তো?সাহস করে জিজ্ঞেস করলেন..
“কি করছিস তুই এখন?”
-“ওই একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করি স্যার”
সেক্টর ২৯ এ অবনী বাবুর আত্মীয়ের বাড়ির কাছে ড্রপ করার সময় শানু একটা কার্ড অবনী বাবুর হাতে দিয়ে বললো
“স্যার এটা আমার ভিসিটিং কার্ড।আমার মোবাইল নম্বর আছে এতে।যেকোনোরকম দরকারে নির্দ্বিধায় ফোন করবেন ।খুব খুব ভালো লাগলো ।আবার দেখা হবে।শরীরের খেয়াল রাখবেন স্যার।”
শানুর দামি গাড়িটা হুশ করে চোখের আড়ালে চলে গেল।ভিসিটিং কার্ডটা সামনে ধরতেই অবনী বাবু দেখলেন তাতে লেখা আছে
Shantanu Chatterjee
Strategy Head Global
Google
একনিমিষে অবনীবাবু আত্মগ্লানিতে তলিয়ে পড়লেন।
এতদিন যে সত্যি উপলব্ধি করতে পারেননি আজ তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন।
“কোনো ছাত্রই খারাপ হয় না।খারাপ হয় আমার মতো মানসিকতার মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষক,যারা ফুলের মতো ছোট্ট কচি কাচাদের পিটিয়ে গরু করে ফেলে।এরা সবাই আসে আমাদের বাগানে,নিজের মতো বর্ণ, গন্ধ নিয়ে। সার মাটি দিয়ে ফুলের বাগান করার পরিবর্তে আমরা তাদের উপহার দি গোয়াল।প্রতিনিয়ত গলা টিপে হত্যা করি ওদের প্রতিভাবান সত্তা গুলোকে,ওদের inquisitiveness কে।আজ থেকে আমার গোয়াল ঘরে গরু পেটানোর শিক্ষকতা বন্ধ।নতুন উদ্দামে শুরু করবো ফুলের বাগান যেখানে শানুর মতো মিষ্টি ফুলগুলোকে চোখের জল ফেলতে হবে না,তারা হাসবে,খেলবে,মন খুলে প্রশ্ন করবে আর দুনিয়ার দরবারে গ্রামবাংলার নামকে উজ্জ্বল করবে।”
শানুর গাড়ির ভেতর শোনা “তারে জমীন পর” এর গানের কথাগুলো এখনো অবনীবাবু র কানে বেজে বেজে উঠছে:
“ইয়ে তো হে, সর্দি মে, ধুপ কি কিরণে…
উতরে জো,আঙ্গন কো সুনেহেরা সা করণে।।
মন কি অন্ধেরোকো রওশন সা কর দে…
খো না যায়ে ইয়ে তারে জমীন পর।।।।।।