আজকে আর অফিস যেতে ভালো লাগছেনা অঙ্কিতের। কিন্তু সায়রার ডেলিভারির সময়তে দিন দশেকের মতো ছুটি নিতে হবে , তাই ইচ্ছে না থাকলেও আজ অফিস বেরোতেই হবে । সায়রা আর অঙ্কিতের ভালোবাসার কথা প্রথম যখন দুই পরিবারে জানাজানি হয় কেউ মেনে নেয়নি।দুই পরিবারের একটাই কথা ছিল হয় পরিবার নয় ভালোবাসা এই দুয়ের মধ্যে যেকোন একটা বেছে নাও, ওরা দ্বিতীয়টা বেছে নিয়েছিল।
– যেদিন ওরা বিয়ে করে সেদিন সকালে অঙ্কিত সায়রাকে শুধু একটা টেক্সট মেসেজ করেছিল। লিখেছিল ” সায়রা , বাকি জীবনটা যদি একসাথে বুড়ো-বুড়ি হতে চাও দুপুর ১টা তে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ অফিসের সামনে চলে এসো ” । সায়রা উত্তরে জানিয়েছিল ” শুধু যদি বুড়ো-বুড়ি হতে চাও আমি নেই , অন্য হাত খুঁজে নাও ,আর যদি বলো একসাথে দাদু-দিদা হতে চাও তাহলে এই সায়রার প্রতিটি নিশ্বাস শুধুই তার অঙ্কিতের জন্য তোলা রইলো।
– হ্যাঁ ওরা সেদিনই বিয়ে করেছিল। দুই পরিবারের কোথাও ওদের ঠাঁই হয়নি। প্রথমে ভাড়াবাড়ি তারপর ১ বছর পর দমদমের এই নতুন ফ্ল্যাট টা কিনে ওরা এখানে উঠে আসে। সায়রা কলকাতার একটি স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষিকা আর অঙ্কিত শিয়ালদা ডিভিশনের রেলের ইঞ্জিনিয়ার। আজ নমাস হল সায়রা প্রেগনেন্ট। ডাক্তার সামনের সপ্তাহে ডেলিভারির ডেট দিয়েছেন। অবশ্য বাড়িতে সারাদিন সায়রার দেখাশোনার জন্য একজন আয়া রেখেছে অঙ্কিত। কি ১টা জরুরী কাজের জন্য আজকে আয়া দিদিটা আসতে পারবেনা , সকালে ফোন করে অঙ্কিতকে জানিয়ে দেয়। সকালে জলখাবার করে সায়রাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো অঙ্কিত। দুপুরের জন্য পাতলা মাছের ঝোল আর ভাত রান্না করে সায়রাকে ঠিক সময়মতো খেয়ে নেওয়ার জন্য বলে অঙ্কিত অফিসের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হল।
– ওদের এই ফ্ল্যাটটা থেকে দমদম স্টেশন মিনিট দশেকের হাঁটা পথ ।অন্য সময় হলে এই হাঁটা পথটায় ১টা সিগারেট ধরাতো। কিন্তু সায়রা প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকে অঙ্কিত সিগারেটের নেশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে।স্টেশনে এসে যখন পৌছালো ৯.১০ এর ট্রেনটা মিস হয়ে গেছে , এরপরের ট্রেন ৯.৩০ তে এবার। অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। সময়টা কাটানোর জন্য পকেট থেকে ফোনটা বের করে অঙ্কিত ফেসবুকটা খুললো। নিউজ স্ক্ৰল করতে করতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল অঙ্কিতের। একি ! সে কি ঠিক দেখছে ? মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো অঙ্কিতের। সর্দার পাড়ার D1 ব্লকে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে পুরো ব্লকে আগুন লেগে গেছে। এই ব্লকেই তো অঙ্কিতের ফ্লাট , সায়রা তো এখন রুমের মধ্যে , না অঙ্কিত আর কিছু ভাবতে পারছেনা। স্টেশন থেকে দৌড় লাগালো। সায়রাকে ২বার ফোন করল ,ফোন রিং হয়ে কেটে গেল , সায়রা ধরলো না ।অঙ্কিত আরো জোরে দৌড় লাগালো।
– ফ্ল্যাটের সামনে এসে দেখলো অনেক লোকের ভিড়। সবাই আগুন নেভানোর আর উদ্ধার করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অঙ্কিত আর কিছু না ভেবে সিঁড়ির কাছে এলো। সিঁড়ির এক সাইডটায় আগুন লেগে গেছে।কোনোরকমে আগুন বাঁচিয়ে ৩ তলায় উঠলো অঙ্কিত। তার ফ্ল্যাটের দরজার একটা অংশে আগুন লেগে গেছে। দ্রুত আগুনের শিখা বাড়ছে। অঙ্কিত দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। সায়রা বিছানায় শুয়ে খুব জোরে জোরে চিৎকার করছে। সায়রার পেন উঠেছে , তারসাথে আগুনের ধোঁয়াতে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অঙ্কিত সায়রাকে বিছানা থেকে তুলতে যাবে এমন সময় খুব জোরে একটা শব্দ হলো ,অঙ্কিত ঘুরে তাকিয়ে দেখলো দরজাটা পড়ে গেছে। সাথে রুম থেকে বের হওয়ার পুরো পথটাই আগুনে জ্বলছে। অঙ্কিত বসে পড়লো , সে আর কিছু ভাবতে পারছেনা।
– সায়রা , অঙ্কিতের হাতটা আলতো করে ধরে বললো, “অঙ্কিত তুমি জানলার পাশের পাইপ টা ধরে নিচে নেমে যাও ” অঙ্কিত সায়রার চোখের দিকে তাকালো , সায়রার দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সায়রার চোখের জলটা মুছে দিয়ে অঙ্কিত বলে উঠলো “মনে পড়ে তোমায় একদিন বলেছিলাম বুড়ো -বুড়ি হবে একসাথে? তোমাকে আর আমাদের সন্তানকে ফেলে রেখে আমি একা কি করে চলে যেতে পারি? আগুনের পুরো গ্রাস আমাকে পুড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমার প্রতিটা নিশ্বাস শুধুই তোমার জন্য”। সায়রার চোখ দিয়ে এখনো জল পড়ছে। তাদের ৩ জনের হাতে যে আর বেশি সময় নেই সেটা সায়রা বুঝতে পারছে।
-তাদের সন্তানটা আর পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেনা। কত স্বপ্ন ছিল তার আর অঙ্কিতের এই সন্তান কে নিয়ে।যেদিন অঙ্কিতকে সায়রা তার প্রেগনেন্ট হওয়ার কথা বলেছিলো সেদিনই তারা মনস্থির করে ফেলেছিলো তাদের এই সন্তানের না থাকবে কোনো পদবী আর না থাকবে কোনো ধর্ম। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাদের সন্তান নিজেই মনস্থির করবে তার পদবি ও ধর্ম কি হবে, নাকি কোনো ধর্ম ছাড়াই সারাজীবন কাটাবে।এই একমুহূর্তে তাদের সব স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।
– অঙ্কিত আলতো করে তার ঠোঁটটা সায়রার ঠোঁটে রাখলো , মৃত্যুর আগে তাদের জীবনের শেষ চুম্বন। চুম্বন শেষে সায়রা অঙ্কিতের দিকে তাকালো , অঙ্কিতেরও চোখ দিয়ে জল পড়ছে। অঙ্কিত আস্তে করে বলে উঠলো “সায়রা , কেউ সারাজীবন বেঁচে থাকে শুধুমাত্র একটা বিশেষ মুহূর্ত কবে আসবে সেই অপেক্ষায় , আর কেউ কেউ ওই একটা বিশেষ মুহূর্তের মধ্যে তার সারাটা জীবন বেঁচে নেয়। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে সেই সারাজীবনের মুহূর্তটা আমি এখন বেঁচে নিচ্ছি “।সায়রা কোনো উত্তর দিতে পারলোনা , শুধু একবার তার ঠোঁটটা কেঁপে উঠলো।
– না সিনেমার মতো তিনতলা বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ দিয়ে এখানে অঙ্কিত, সায়রা আর গর্ভে থাকা সন্তান বাঁচতে পারলোনা।আগুনের শিখায় ৩টি প্রাণশেষ হয়ে গেলো, শুধু শেষ হয়েও শেষ হলো না অঙ্কিত সায়রার ভালোবাসাটা। সেটা বেঁচে থাকলো সমাজের আরো অঙ্কিত – সায়রাদের জন্য , শুধু আগুনের সাথে পুড়ে ওই ধর্ম গুলো শেষ হয়ে গেলো ওই ধর্ম গুলো।