বেশ কয়েকদিন ধরে নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন খেয়াল করছে সঞ্জয় । আজকাল যেন মহুয়া ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে । মহুয়া ওর বিবাহিত স্ত্রী । সপ্তাহ তিন হবে বিয়ে হয়েছে ওদের । কিন্তু বিয়েতে ঘোর আপত্তি ছিল সঞ্জয়ের । ওর মতে বিয়ে করা মানেই সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়া তার উপর আবার নারী চরিত্রের বেজায় জটিল মনোভাবকে বোঝা তো দুরস্ত তাদের মনের খবর হয়তো তারা নিজেরাই কোনো কালে বুঝে উঠতে পারে না তো ও কোন ছাড় । এমনি ধারণা ছিল ওর মনে তাই কিশোর বয়স থেকে যৌবনের পর্যায়েও, সর্বদা নারীদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলে । আর সবার মতো ছাত্র জীবনের পা পিছলে পড়া প্রথম প্রেমে প্রথম অনুভূতির কথা ও গল্পে পড়েছে , বন্ধুদের দেখেছে কিন্তু নিজের জীবনে তার অভিজ্ঞতা নেই ।
ওর প্রবল জেদ , একপ্রকার বলা চলে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা ছিল ও জীবনে বিয়ে করবে না এবং ওর সহজ , সরল শান্ত জীবনে কোনো জটিলতার অশান্ত কালবৈশাখী কিছুতেই নিয়ে আসবে না । কিন্তু যেমনটা ভাবা হয় তেমনটা কি আর সবসময় হয় । অনেক সময় বাধ্য হয়েই অনেক কিছু করতে হয় । ওর বিয়েটাও ঠিক সেই রকম । ওর মায়ের জেদাজেদিতে অবশেষে কান্নাকাটি থামাতে শেষমেষ বিবাহতে রাজি হয় ও । কিন্তু মনে ওর অটুট প্রতিজ্ঞা বজায় রেখেছে । কিছুতেই নিজেকে ওই অজানা নারীর হাতে সমর্পণ করবে না । তাই প্রথম দিনেই দেখতে গিয়ে মহুয়াকে বলেছিল ” দেখুন আমার এই বিয়েতে কোনোভাবেই মত ছিল না । নেহাত মা এর জোড়াজুড়িতে আমি এই বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি । এবার আপনার মতামত , আপনার যদি আপত্তি থাকে আমাকে বিয়ে করতে তাহলে বলতে পারেন । আমি আমার সম্পর্কে সবই জানালাম আপনাকে । “
কি আশ্চর্য , সঞ্জয়ের কথায় রেগে যাওয়ার বদলে একগাল মিষ্টি হাসি জ্ঞিজেস করছিল মেয়েটা ” আপনি নিশ্চয় কখনও কারোর প্রেমে পড়েননি , ভালোবিসেন নি এখনও পর্যন্ত কাউকে , তাই না ।”
– ” না তা বাসিনি কাউকে । কিন্তু কেন বলুন তো ? ” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁদাগঙ্গারামের মতো মুখ করে জ্ঞিজেস করল সঞ্জয় ।
– ” আচ্ছা আপনি ‘প্রথম দেখাতেই প্রেম’ এ বিশ্বাস করেন বা ধরুণ শৈশব প্রেমের প্রাপ্তবয়সে পূর্ণতা !! ” খুব স্বাভাবিক গলায় সাবলীল ভাবে পাল্টা প্রশ্ন করল মহুয়া ।
– ” না মানে সে ভাবে….” চুপ করে রইল সঞ্জয় ।
– ” বুঝেছি , করেন না তাই তো , জানেন আমি কিন্তু করি , প্রথম দেখাতেও প্রেম হয় আবার শৈশবের প্রেমও পরিণত বয়সে পূর্ণতা পায় । ঠিক যেমন অর্ধেক চাঁদ একদিন পূর্ণিমার পূর্ণ চন্দ্রে পরিণত হয়ে জোৎস্না ছড়ায় । ” বলতে বলতে কেমন উদাস হয়ে আকাশের দিকে আকায় মহুয়া । তখন গোধূলির অবসানে আকাশে আলো আঁধারের খেলা শুরু হয়েছে । সঞ্জয় দেখল শেষ হয়ে যাওয়া বিকালের নরম আলো তখন এসে রঙ মাখাচ্ছে মহুয়ার শান্ত স্নিগ্ধ মুখটাতে । সুন্দর একটা মায়াময় আলো খেলা জুড়েছে ওর মুখখানা ঘিরে। মেয়েটার উদাসী চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি নাড়া দিয়ে গেল সঞ্জয়ের মনটায় । এটাই কি তবে ” প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা ? “
এরপর আর সেভাবে কথা হয়নি বিয়ের আগে । কেমন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা নিশব্দে জাল বিছিয়ে রেখেছিল সঞ্জয়ের মনে । বাড়ি ফিরেও যেন কিছুতেই সেই ভালো লাগার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি ও । রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে খোলা জানালা দিয়ে যখন স্নিগ্ধ চাঁদের আলো এসে পড়ছিল সঞ্জয়ের ঘরে তখন সেই চাঁদের স্নিগ্ধতা বারবার ওকে মনে করাচ্ছিল সেই মুখ । মিষ্টি হাসি আর ঐ বড়ো বড়ো চোখের সরল দৃষ্টিতে ,কাজলের হালকা টানে যেন এক প্রকার বাঁধা পড়েই গিয়েছিল সঞ্জয় । না , নিজের মনের অবস্থা নিজেই টের পাচ্ছিল ও , তাই হয়তো বিয়ে নামক ভয়ংকর ব্যাপারটায় ওর যে সহজাত ভয় থেকে আপত্তির সৃষ্টি হয়েছিল তা আর দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয়নি সঞ্জয়ের মুখে । এরপর এক ফাল্গুনী সন্ধ্যায় সাত পাকে বাঁধা পরেই গেল সঞ্জয় মহুয়ার সঙ্গে । ঝলমলে মায়াবী সন্ধ্যায় আবার সেই সরল চোখের মায়াময় দৃষ্টি ।
বাড়িতে মহুয়া আসার পর থেকেই ওর সব কিছুই যেন ভালো লাগতে শুরু করেছে সঞ্জয়ের । প্রথম দিন বধূবরণের পর যখন মহুয়া দুধে-আলতায় পা ডুবিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিল তখন মেঝেতে পাতা সাদা কাপড়ে ওর পায়ের ছাপ গুলো দেখতে দেখতে ছোটোবেলা থেকে দেখে আসা মায়ের হাতে আঁকা লক্ষ্মীর পায়ের কথাই বারবার মাথায় আসছিল ওর । মা বলেছিল মহুয়া আমাদের বাড়ির লক্ষ্মী । সেদিন ওই আলতা পায়ের ছাপগুলো যেন বারবার সে কথাই প্রমাণ করছিল ।
এরপর থেকে ওর প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহুর্ত যেন একটু একটু করে জড়িয়ে যাচ্ছিল মহুয়ার সঙ্গে । সকালে ঘুম ভাঙত মহুয়ার ভেজা চুলের গন্ধে , ওর চুরিগুলো পরস্পরের সাথে এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠে টুংটুং শব্দে তুলে যেন সঞ্জয়ের সমস্ত মনটাকে বেঁধে নিত ওদের ছন্দে , ওর নুপূরের রিনরিন শব্দ যেন ওর প্রতিটা পদক্ষেপকে সুরেলা ছন্দে বাঁধতে ব্যস্ত । কেমন একটা উদাস হয়ে যেত সঞ্জয়। ধীরে ধীরে ও অনুভব করল প্রতিটা সকালে ও যেন অপেক্ষায় থাকে মহুয়ার এই উপস্থিতিটার জন্য । সেই অপেক্ষার প্রতিটা মুহুর্ত যেন এক একটা যুগের সমান লাগত ওর কাছে।আজকাল তো চায়ের কাপটা মহুয়ার হাত থেকে না এলে যেন খেতেই ইচ্ছে করে না সঞ্জয়ের । কোথায় যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল সঞ্জয় , সেই প্রশ্নটা নিজের মনের মুখোমুখী হয়ে জিজ্ঞেস করতেই উত্তরটা পেয়েছিল সঞ্জয় ” ভালোবেসে ফেলেছে ও মহুয়া কে ।” কিন্তু বলা বাহুল্য যে এই তিন সপ্তাহে ওর সাথে মহুয়ার তেমন সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। সেটা হয়তো ওর জন্যই । ওর বিয়ের আগে সেদিন ওইভাবে কথা বলা উচিত হয়নি । হয়তো তাই নিজেকে সরিয়ে রেখেছে মহুয়া। কথা হয় অবশ্য মহুয়ার সঙ্গে কিন্তু তা নিতান্তই অল্প কথা । কখনও কোনো প্রয়োজনে অথবা মহুয়ার সুবিধে অসুবিধের , ভালো মন্দের খোঁজ খবর নিতে । এতে আর যাই হোক ওদের বন্ধুত্বটা গড়ে ওঠেনি । আর সঞ্জয়ও লক্ষ্য করেছে মহুয়াও নিজেকে কেমন সরিয়ে রাখে দূরে দূরে ।
“ধুর !!এইসব কিছুই হয়েছে তোর নিজের স্বভাবে । বিয়ের প্রতি এতো ভয় কিসের ? কি দরকার ছিল প্রথম দিন ওকে ওভাবে বলার , না জানি কি ভেবে দূরে সরে আছে ও । ” অফিসে বসে নিজের মনে মনেই গজগজ করছে সঞ্জয় । ওর এখন ইচ্ছে করছে নিজেকে নিজে চড় মারতে । মা ঠিকই বলে , ছোটোবেলা থেকে ওর মাথায় বুদ্ধি বলে কিছু নেই সবই গোবর পোড়া । ওর মাথায় এখন একটাই চিন্তা ,ও যে মহুয়াকে ভালোবাসে সেটা জানাবে কি করে আর কদিন আগেও যে বিয়ে নিয়ে অনিহা জানিয়ে লম্বা চওড়া জ্ঞান দিচ্ছিল সে এতো তাড়াতাড়ি ভালোবেসে ফেলল একটা মেয়েকে । যদি মহুয়া করে বসে প্রশ্নটা তখন কি উত্তর দেবে ও । ও তো আর নিজের হৃদয় খুলে দেখাতে পারবে না মহুয়ার প্রতি ওর অনুভূতিগুলো কিভাবে তিলেতিলে গড়ে উঠেছে আর ও হৃদয়ের কোন্ গোপন কুঠুরিতে অতি যত্নে সাজিয়ে রেখেছে সেই অনুভূতিগুলোর মালা গেঁথে । এর মধ্যেই প্রতিদিন অফিসে ওর কলিক বন্ধুদের সহধর্মীনিদের সহিত ওদের ভালোবাসা মান অভিমানের গল্প হাঁঁ করে শুনতে শুনতে নিজের বিবাহিত জীবনের একটা সুন্দর সুখস্বপ্ন সাজিয়ে বসে আছে ও । মনে মনে ভাবে হয়তো যেদিন ও মনের কথা জানিয়ে দিতে পারবে মহুয়াকে সেদিন থেকেই ওদের সম্পর্কটাও এই রকম রঙ বেরঙে রঙিন হয়ে উঠবে ।
নাহ্ আজ বলেই দেবে ও মহুয়াকে । মহুয়া যা ভাবার ভাবুক , তিরোস্কার করার হলে করুক তবুও মনের কথা মনে চেপে রেখে গুমরে মরতে পারবে না ও । অফিসের কাজে সকাল থেকেই মন বসাতে পারেনি সঞ্জয় । শেষমেশ সব দ্বিধা দ্বন্দ্বকে পিছনে ফেলে বাড়ির পথে হাঁটা দিয়েছিল ও । ফিরতেই দরজা খুলে মা বলল ” আর একটু আগে এলেই মহুয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারতিস , এই মাত্র বেরিয়ে গেল মেয়েটা ।”
” বেরিয়ে গেল মানে , কোথায় গেল ? ” হতাশার সুরে জিজ্ঞেস করল সঞ্জয় ।
“আর বলিস না সকাল থেকে মন খারাপ করে বসেছিল মেয়েটা , মা বাবা ভাই য়ের জন্য খুব মনখারাপ বলল । তাই বললাম কটা দিন ঘুরেই এসো । ওর ভাই কে ফোন করে ডাকলাম , মেয়েটা মুখ কালো বসে থাকবে তাই পাঠিয়ে দিলাম । বাড়ির জন্য মন খারাপ তো করবেই , অনেকদিন তো হল মেয়েটা মা বাবা কে ছেড়ে আছে । “
বুকের ভিতরটা মুছরে উঠল সঞ্জয়ের ।বাড়ির জন্য এতোই মন খারাপ যে যাওয়ার সময় একটা বারের জন্য ফোন করেও জানাল না । একরাশ হতাশা আর অভিমান নিয়ে ঘরে গেল ও ।
বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ঘরটা মহুয়া কে ছাড়া । পড়ার টেবিলে গিয়ে বসল সঞ্জয়। প্রতিদিন অফিস ফেরত সঞ্জয়ের জন্য এখানে বসেই অপেক্ষা করত মহুয়া । আর হাতে থাকত শরৎ উপন্যাস । কখনও উদাসী চোখে তাকিয়ে থাকত জানলার বাইরে । সঞ্জয় অফিস থেকে ফিরে যখন ঘরে ঢুকত তখন মৃদু হেসে চোখ দুটো তুলে তাকাত মহুয়া ।
“উফ্ , মেয়েদের কেন যে এতো ঘনঘন মন খারাপ করে বাপের বাড়ির জন্য ?? এই তো কয়েকদিন আগেই অষ্টমঙ্গলাতে ঘুরে এল ওরা ও বাড়ি থেকে । ” কাঁদো কাঁদো মুখ করে মনে মনে বলল সঞ্জয় । মনখারাপ নিয়ে টেবিলের বই গুলোতে হাত রাখল ও । যেন প্রাণভরে নিতে চায় মহুয়ার সবটুকু স্পর্শ। অনুভব করতে চায় মহুয়ার চুলের গন্ধ, হাতের ছোঁয়া ।
রাত একটু একটু করে গভীর হয়ে ওঠে । ঘুমন্ত পৃথিবীর এক কোণে একা জেগে অধীর আগ্ৰহে অপেক্ষা করছে সঞ্জয় । অপেক্ষা করছে মহুয়ার একটা ফোনের জন্য । কোনো এক অজানা বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে ওর ” আজ মহুয়া ফোন করবেই “। কিন্তু রাত বেড়ে চলার সাথে সাথেই ওর আশাহত বুকে একটা অব্যক্ত কষ্ট দলা পাকাচ্ছে সঙ্গে একটা গাঢ় অভিমান ।
পরের দিন অফিসে সবার গল্পের মাঝেই আনমনা হয়ে বসে আছে সঞ্জয়। রণিত ওর গায়ে থেলা দিয়ে বলল ” মন খারাপ করে বসে থেকে কি করবি , যা শ্বশুড় বাড়ি গিয়ে নিয়ে আয় বউকে ।”
অয়ন দা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল “তাহলে ,আমাদের বিবাহ বিরোধী সঞ্জয়ও শেষমেশ বউয়ের আঁচলে বাঁধা পড়ল । এখন তো বউকে ছাড়া ওর এক মুহুর্তও চলছে না দেখছি । একেবারে বউ পাগল !! ” সবাই এক সাথে হো হো করে হেসে ওঠে ।
উত্তম বাবু নিজের বিবাহিত জীবনের রসিক গল্প শোনাতে এবার বেশ নড়েচড়ে বসে বললেন ” শোনো তাহলে , আমার বিয়ের একসপ্তাহ পর আমার বউ য়ের সাথে বেশ একটা তুমুল ঝগড়া বেঁধেছিলো । হানিমুনে সমুদ্র না পাহাড় কোথায় যাওয়া হবে সেই নিয়ে। ওর ইচ্ছে পাহাড় আর আমার সমুদ্র।সেই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চড়মে । ব্যাস!! একমাস দুজনে দুজনের সঙ্গে কথা বন্ধ । তবে কি জানো প্রতিটা সময় আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারতাম , আসলে কথা বন্ধ করে ও ও কষ্টেই ছিল ,তবু জেদ কথা বলবে না । এরপরও ও সবসময় আমার পাশে থাকত । অফিসে বেরোনোর সময় আমার অলক্ষ্যে সব গুছিয়ে দিত । স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখতাম জামা কাপড় থেকে জুতো সব নিজের নিজের জায়গায় গুছিয়ে রাখা । যেন কেউ সযত্নে তৈরী করে রেখেছে সব আমার জন্য । অথচ আমার গিন্নির মুখেল ভাবখানা এমন যেন ওর বয়েই গেছে আমার জন্য জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে , যেন অগোছালো জিনিসগুলো নেহাত আমার অফিস বেরোনোর তাড়ায় নিজের নিজের এলোমেলো জয়গা ছেড়ে আপনা আপনি সস্থানে পরিপাটি হয়ে গুছিয়ে বসে আছে । সব কিছুর মধ্যে ওর হাতের ছোঁয়া ওর গায়ের গন্ধ স্পষ্ট অনুভব করতাম । “
ভারী অস্বস্তিতে উঠে দাঁড়ায় সঞ্জয় । গল্প শোনানো হচ্ছে না হাতি । একে তো বলে একেবারে ওর কাটা ঘা-য়ে নুনের ছিটে দেওয়া চলছে । নিজের বিবাহিত জীবনের সুখ -দুঃখের গল্প রসিয়ে রসিয়ে বলতে বলতে উত্তম বাবু সঞ্জয়ের দুঃখটা কতটা পরিমাণ বারিয়ে দিলেন তা আর কিভাবে বোঝাবে ও সবাই কে । আরে ঝগড়াই হোক আর যাই হোক না কেন উত্তম বাবুর স্ত্রী তো তবু ওনার কাছাকাছিই ছিলেন ,সবসময় চোখের সামনে দেখতে পেতেন আর ওর মহুয়া তো ওকে ছেড়ে ওর চোখের অন্তরালে আছে তাও এই দুদিনে কোনো ফোন ও করেনি ।ওর যন্ত্রণাটা স্বাভাবিক ভাবেই বেশি ।
সঞ্জয় উঠে পড়েছে দেখে উত্তম বাবু বলে উঠলেন “আরে উঠলে যে শোনো শোনো শেষটা শুনে যাও । ” জোর করেই ওকে আবার আসরে বসালেন উত্তম বাবু । সঞ্জয়ের অনিচ্ছাতেই কানের মধ্যে ঢুকতে লাগল উত্তম বাবুর কথাগুলো । উনি বলতে থাকলেন ” বুঝলে তো আমার গিন্নির ভীষণ জেদ । ভাঙবে তবু মচকাবে না । তাই আমিই ওর মুখে কথা ফোটানোর জন্য একটা মোক্ষম চাল দিলুম । সেদিন ছিল দোল । যথারীতি সকালেই গিন্নি স্নান সেরে নিয়েছে । আর আমিও আমার প্ল্যান নিয়ে রেডি ।
ওর রান্না করার সময় রান্নাঘরে ঢুকেই মাখিয়ে দিলাম বাদুড়ে রঙ । রঙ মেখে নিজের ভূতের মতো অবস্হা দেখে গিন্নি আবার আমার সাথে ঝগড়া করতে শুরু করল। তারপর আমাকেও বাদুড়ে রঙ মাখিয়ে ভূত করেছিল । ব্যাস আবার ঝগড়া থেকে আড়ি ভাব শুরু । শেষে গিন্নির মুখের বাদুড়ে রঙ তুলতে আমাকেই সাহায্য করতে হল ,তাই আবার ভাবও হয়ে গেলে । ” সবাই হেসে চলেছে উত্তম বাবুর কথায় , সঙ্গে উত্তম বাবুও হোহো করে হেসে চলেছেন। কিন্তু সঞ্জয়ের মুখ ভার । উত্তম বাবু সঞ্জয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন ” কি ভাবছ ? কালই তো দোল । তা কাল তুমিও মাখিয়ে দাও বাদুড়ে রঙ । ওই বাদুড়ে রঙই সব ঠিক করে দেবে । ” সত্যিই তো । এতক্ষণ তো খেয়ালই ছিল না ওর । কালই তো দোল । ইসস্ ! যদি মহুয়াটা এই সময় বাড়িতে থাকত তাহলে দোলের দিন প্রথম রঙটা ওই মাখাতে পারত । কিন্তু ও তো এখনও বাপের বাড়িতে ।
মন খারাপ নিয়ে ঘরে বসে আছে সঞ্জয়। প্রত্যেকটা মুহুর্ত বড্ড শূন্য করে দিয়ে গেছে মেয়েটা । একবার ওর মনে হয়েছিল ওই ফোন করে মহুয়া কে । পরক্ষণেই অভিমানী মন বাধা দিয়ে বলে উঠেছে “কেন ওকেই আগে করতে হবে? মহুয়া যে একটি বারও ওকে না জানিয়ে চলে গেল , তার বেলায় ?? ওর কি অভিমান থাকতে নেই ?? তারপর থেকে এক বারও ফোনও করল না যে ? রোজ অপেক্ষায় থাকে সঞ্জয় মহুয়ার একটা ফোনের জন্য । কিন্তু কোথায় কি ?তাহলে কি শুধু সঞ্জয়ের মনই খারাপ করছে মহুয়ার জন্য ওর নয় । ” কথা গুলো ভাবতে ভাবতে বাচ্ছাদের মতো ঠোঁঁট ফুলিয়ে উঠল সঞ্জয় । কাল দোল আর কালও একা একাই কাটাতে হবে ওকে ।
পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মা এসে বলে গেল মহুয়ার মা ফোন করেছিলেন । মহুয়ার শরীরটা খারাপ করেছে তাই ওখানে আরোও কটা দিন থাকবে । বুকটা মুছরে উঠল সঞ্জয়ের । নাহ্ আর না । এবার ওকে মহুয়ার কাছে যেতেই হবে , এই বিরহ পর্বের সমাপ্তি ঘটাতে ওকেই এগিয়ে যেতে হবে । তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও মহুয়ার বাড়ির উদ্দেশ্য ।
পৌঁছাতেই মহুয়ার মা দরজা খুলে হাসি মুখে ঘরে নিয়ে এল । সঞ্জয় প্রণাম করে সবার কুশল সংবাদ জেনে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেসই করে ফেলল ” মহুয়া কোথায় ? ওর শরীর কি খুব খারাপ ? “
মহুয়ার মা হেসে বললেন ” যাও না ওর ঘরে গিয়েই দেখো । ও ঘরেই আছে । আমি তোমাদের জলখাবারের ব্যবস্থা করছি । “
সঞ্জয় পা বাড়াল মহুয়ার ঘরের দিকে । দোতলার বারান্দা লাগোয়া ঘরটা ফাঁকা । আগেও ঢুকেছে সঞ্জয় এই ঘরটায়। আগের থেকে অনেক কিছুই পাল্টেছে । এখন যেন ঘরটা একটু বেশীই রঙীন হয়ে উঠেছে । টেবিলে রাখা ফুলদানির রজনী গন্ধাগুলো গোটা ঘরটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার মনোরম গন্ধে । কিন্তু মহুয়া কোথায় ঘর তো ফাঁকা। ” মা যে বলল…” ভাবতে ভাবতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল মহুয়াকে । এদিক ওদিক তাকাতেই ঘরের মধ্যে এখন যে জিনিস টার উপর সঞ্জয়ের চোখের পলকহীন দৃষ্টি স্থির হয়েছে সেটা দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি ।
দুটো বাচ্ছা ছেলের মেয়ে। বছর সাতেকের হবে । মেয়েটা হাতে একমুঠো লাল আবির নিয়ে ছেলেটার মুখ রঙে ভরিয়ে দিচ্ছে । খুব চেনা এই স্মৃতিটা সঞ্জয়ের । মনে আছে এখনও ওর । সঞ্জয়রা দূর্গাপুরে থাকতো তখন । সেবার দোলের দিন সকাল থেকেই মন খারাপ করে বসেছিল সঞ্জয় । ওর দোল খেলার কোনো সঙ্গীই ছিল না তাই মুখভার করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেদিন । শেষে মা জোড় করায় মা বাবার হাত ধরেই গিয়েছিল রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে পূজো দিতে । কিন্তু সেখানে গিয়েও মন খারাপ ছিল ওর । শেষে ছেলের সঙ্গ ছেড়ে দিয়েই মা ঢুকেছিল মন্দিরে পূজো দিতে আর বাবা ঘুরে বেড়াচ্ছিল মন্দিরের এদিক ওদিক ।মুখভার করে দাঁড়িয়ে ছিল ও মন্দিরের সামনের চাতালের এক কোণায় । হঠাৎ একটা সাদা জামা পড়া পুতুল পুতুল দেখতে ওর বয়সী মেয়ে এসে বলল ” তুমি এখানে একলা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন , তোমার কি মন খারাপ ? ” ছোট্টো সঞ্জয় মুখ তুলে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছিল ।মেয়েটার জামা আর এতটুকু অংশও বাকি নেই রঙ দেওয়ার মতো । সাদা জামাটা যে রঙে রঙে রঙীন করার উদ্দেশ্যেই পড়া সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারল ও । ” কি হল বললে না তো ” জামা রঙে ভূত করলেও মেয়েটা নিজের মুখটা রঙে ভূত করার হাত থেকে বেশ ভালোই বাঁচিয়ে রেখেছে আর মিষ্টি মুখের মাঝে বড়ো বড়ো উজ্জ্বল চোখ গুলো নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে ।
সঞ্জয় মুখ নীচু করে বলল ” তুমি কি সুন্দর রঙ মেখেছো , আমার সাথে রঙ খেলার কেউ নেই । ” মেয়েটা হিহি করে হেসে বলল ” এই কথা । কে বলেছে কেউ নেই । আমি তো আছি , আমি তোমার বন্ধু । আমি তোমাকে এবার রঙ মাখাবো ” বলেই হাতের মুঠোয় ধরা লাল আবিরটা নিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিল সঞ্জয়ের মুখ। আর তখনই মেয়েটার বাবা এসে ক্যামেরায় তুলেছিল ছবিটা । সঞ্জয়ও আবির নিয়ে ওকে মাখাতে গেলে ও প্রতিবাদ করে বলেছিল ” মুখে মাখাবে না , আমার ভূত সাজতে ভালো লাগে না ।আমার জামায় রঙ দাও ।”
সঞ্জয় মিষ্টি হেসে বলেছির ” জমা তো তুমি আগেই রঙ লাগিয়ে ভূত করে রেখেছ আমিও যদি ওই জামাতেই রঙ লাগাই তাহলে তো আমার রঙও অন্যদের লাগানো রঙের সঙ্গে মিশে যাবে , তাহলে তোমার আমাকে মনে থাকবে কি করে? তুমি না বললে আমি তোমার বন্ধু । আমি তোমার গালেই রঙ লাগাবো । “
মেয়েটা গালে হাত দিয়ে একটু সময় কি যেন একটা ভেবে নিয়ে মিষ্টি হেসে বলেছিল ” বেশ , তাই হোক ।” সঞ্জয় হাতের অাঙুলে অল্প গোলাপী আবির তুলে নিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিল মেয়েটার গালে ।
মেয়েটা এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে বলেছিল “রাধাকৃষ্ণও কি এইভাবেই রঙ খেলেছিল ? ” সঞ্জয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই হঠাৎ আর একটা বাচ্চা মেয়ে এসে ওই মেয়েটার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে যেতে যেতে বলছিল “তোর মা তোকে ডাকছে , তোর বাবা বলল তুই এখানে , চল বাড়ি ফিরতে হবে ।” মেয়েটা যেতে সঞ্জয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলেছিল “বন্ধু !!!তোমাকে মনে রাখব । আবার রঙ মাখাবো তোমায় ।”
তারপর আর দেখা হয়নি সেই মেয়েটার সাথে । ওরা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল আর একবছরের মধ্যেই দূর্গাপুর ছেড়ে চলে এসেছিল বালিগঞ্জে । সময়ের সাথেই স্মৃতির পাতা ধূলো জমেছে, উল্টেছে স্মৃতির পাতাও । আজ আবার মনে পড়ল সেই দিনটার রঙিন মুহুর্তটা।
মুখে একটা হালকা হাসির রেখা দেখা দিল ওর । কিন্তু এই ছবিটা এখানে কেন এটা ভাবতে শুরু করেছে সঞ্জয় এমন সময় কোথা থেকে এক মুঠো গোলাপী আবির এসে পড়ল সঞ্জয়ের মুখে । এই রকম অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েই নিজেকে সামলে নিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল মহুয়া হাসি হাসি মুখে দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে , দুহাতের মুঠো ভর্তি আবির । ওর দিকে তাকিয়ে মিঠিমিঠি হেসে বলল ” কি, বলেছিলাম না , তোমায় আবার রঙ মাখাবো । মনে পড়ল সে কথা । আজ আবার রাঙালাম তোমায় আর আজ বলছি এবার থেকে সারাজীবন এভাবেই রাঙাবো তোমায় । “
সঞ্জয় হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ক্যাবলার মতো মুখ করে বলল ” তুমি কি করে জানলে ? না মানে তুমিই সেই ছোট্টো মেয়েটা , আজকের মহুয়া , এতোবড়ো হয়ে গেছ !!” চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে সঞ্জয় ।
মহুয়া ফিক হেসে বলল ” আর তুমি বুঝি সেই ছোট্টো ছেলেটা হয়ে আছো ??
প্রথম দিনই যখন তুমি আমাদের বাড়ি এসেছিলে , সেদিনই তোমার ফোনের স্ক্রিনে লাগানো তোমার ছেলেবেলার ছবিটা দেখেই চিনতে পেরেছিলাম তোমায় । ছোটো বেলার সেই দিনটা থেকে তোমার ছবি এতদিন আমার চোখের সামনেই ছিল তাই এক দেখাতেই চিনতে একটুও ভুল হয়নি । ছোটোবেলার সেই হঠাৎ হওয়া বন্ধুত্বটাকে বড়ো হওয়ার সাথে সাথে ভালোবেসেছি যে আমি। তাই তো একদিনের জন্যও ভুলিনি তোমায়। তাই সেদিন তোমায় বলেছিলাম শৈশবের প্রেমও পূর্ণতা পায় ।” সঞ্জয় কপট রাগ দেখিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল ” আর এই সবকিছু এতো দিন আমার থেকে লুকিয়ে রাখলে আবার এতোদিন আমাকে ছেড়ে চলে এসে কষ্ট দিলে । “
মহুয়া মিষ্টি হেসে বলল ” আমি ঠিক করেছিলাম যেদিন তুমিও আমাকে ভালোবেসে আমার কাছে আসবে সেদিনই জানাবো তোমায় । আর তোমাকে জানানোর জন্য আজকের দিনটাই শ্রেষ্ঠ দিন । আর সেই জন্যই মাকে দিয়ে ফোন করালাম আমার শরীর খারাপের কথা বলে । “
“তার মানে মা ও সব জানে ?” হাঁ করে দাঁঁড়িয়ে আছে সঞ্জয়।
মহুয়া মুচকি হেসে সঞ্জয়ের হাঁ করা মুখে হাতের মুঠোর আবিরটা ওর মুখে মাখাতে মাখাতে সারাজীবন তোমায় রঙে রঙে রাঙিয়ে তোলার অধিকারটা শুধু আমারই রইল সেই ছোটোবেলা থেকে আজও ,জীবনের শেষ বেলাতেও থাকবে ।
সঞ্জয় মহুয়ার হাতটা ধরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে নিজের গালের আবিরটা মহুয়ার গালে লাগিয়ে বলল ” আর আমি আমার রঙে রাঙাবো তোমায় সারাটা জীবন , প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহুর্ত এমনই রঙে রঙে রঙিন করে তুলব তোমাকে , কথা দিলাম ।”
গোলাপী আবিরের আদুরে রঙকে কে হার মানিয়ে মহুয়ার গালে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে লালের লাজুক ছোঁয়া । মহুয়ার চোখ নামানো লাজুক হাসিতে ওর গালে লালচে আবিরের হঠাৎ উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ভালোবাসার রঙ বুঝি এমনই লাজুক হয় !!।
বসন্ত তখন তার রঙিন তুলির ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দিয়েছে পৃথিবী । সেই ছোঁয়াচে রঙেই বুঝি রঙিন হয়েছে দুটো হৃদয় । বসন্ত তার রঙের খেলার ছলে চুপিসারে ছুঁইয়ে দিয়েছে তার সোনার কাঠি আর সেই সোনার কাঠির ছোঁয়ায় সারা জগতের সাথে সাথে ভালোবাসার দোলা লেগেছে দুটি মনেও ।