ঝিনুক কে স্কুলে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্যাক্সি ধরল চন্দ্রা । হাজার কাজের মধ্যে একটু সময় করে মেয়েটাকে স্কুলে দিয়ে যায় ও । খুব বায়না করে ছোট্ট ঝিনুক ওর বন্ধুদের মতো ও মায়ের সাথে আসবে । কিন্তু প্রতিদিন কি আর আসা সম্ভব । তাই সপ্তাহের এই একটা দিন সময় করে দিয়ে যায় চন্দ্রা । বাকি দিনগুলো স্কুল বাসেই যায় ও । আসলে চন্দ্রাও চায় অনেক ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে ঝিনুক কে । মাঝ রাস্তায় জ্যামে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ । উফ্ আজ আবার অফিসে লেট হয়ে যাবে । ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল চন্দ্রা ।
” এক্সকিউজ মি । আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি এই ট্যাক্সিতে যেতে পারি ?? সামনে স্টপেই নেমে যাবো । ” একটা খুব পরিচিত গলার স্বরে ঘুরে তাকালো চন্দ্রা । ” রুদ্র !!
তুই এতো বছর পর । ” একরাশ বিস্ময় ঝরে পরল চন্দ্রার গলায় ।
” আরে তুই , পিছন থেকে আমি চিনতেই পারিনি তোকে । ” দরজা খুলে ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে বলে উঠল রুদ্র ।
“তুই তো অনেক বদলে গেছিস রে । এখন শাড়ি !! বেশ ভালোই অভ্যস্ত হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে । “
” তুইও তো অনেক বদলেছিস রুদ্র , এখন কতো গোছালো হয়েছিস যে দেখছি । তারপর এতগুলো বছর কোথায় অজ্ঞাতবাসে গিয়েছিলিস । ” বলে হেসে উঠল চন্দ্রা । “সেই যে বলে গেলি এসব নিয়ম মাখিক জীবন আমার জন্য নয় বলে অন্তর্ধান হলি তারপর তো চার চারটে বছর আর তোকে খুঁজেই পাওয়া গেল না । “
” সত্যিই খুব খুঁজেছিলিস না !!” মৃদু হেসে শ্রান্ত স্বরে বলল রুদ্র ।
” হ্যাঁ , ওই আর কি , সব বন্ধুরা মিলে তোর মেসে খোঁজ করেছিলাম ওরা কিছুই বলতে পারেনি । তোর বাড়ির সবাই মানে তোর কাকা-কাকিমাও তো বলতে পারল না কিছু । “
” ওরা তো আমায় পরিবার বলে কোনোদিন ভাবেনি তাই ওরা আমার খবর রাখতে নারাজ ।
যাই হোক তোর খবর বল । কেমন আছিস তুই চন্দ্রা । “
খুব ভালো আছি রে । এই তো মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ফিরছি , এখন অফিসে যাচ্ছি । “
” বাব্বা চার বছরেই বিয়ে করে জমিয়ে সংসার শুরু করেছিস তো । “
” হ্যাঁ , চারবছর তো আর কম সময় নয় । “
যাক্ গে । তোর কথা বল । কোথায় পালিয়ে ছিলিস এতোদিন । কেমন আছিস এখন , আর তোর সেই ফটোগ্ৰাফিকের নেশা আছে নাকি , ছবি আঁকিস আর , দারুণ আঁকতিস তুই !! “
” না রে , আর সেই নেশা কে আটকে রাখিনি । মুক্ত করেছি । বুঝতে পেরেছি জীবনের সমস্ত নিয়ম গুলো যদি একবারে ঝেরে ফেলতে চাই , সমস্ত সম্পর্ক কে যদি অস্বীকার করি তাহলে নিজের পরিচয়টাই একদিন ভুলে যেতে হয় । “
” বাব্বা এখন তো খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারিস । যার জন্য এতো কিছু , যে নেশার জন্য দিল্লি পালিয়ে গেলি তাকেই শেষ পর্যন্ত ঝেড়ে ফেললি । “
চমকে ওঠে রুদ্র ” তার মানে তুই জানতিস আমি দিল্লি তে , তাহলে তো সবটাই জানিস !! “
” না সবটা না । তুই ঠিক আছিস শুধু এটা জেনেই খুশি হয়ে সরে গিয়েছিলাম অনেক দূরে । তোকে তোর মতো থাকতে দিয়েছিলাম । আসলে কি জানিস আমি নিজেকে একদম বিশ্বাস করতে পারি না । যদি আবার সেই রকম বোকা বোকা আবেগ নিয়ে অযাচিত ভাবে অনধিকার প্রবেশ করে ফেলতাম তোর ব্যক্তিগত লাইফে তাই আর সে দিকে পা বাড়ালাম না। “
” সেদিনের কথা এখনও ভুলিসনি না রে !!”
” কি যে বলিস , ওসব কথা কি সারা জীবন মনে রাখে কেউ । তখন তো বড্ড ছেলেমানুষ ছিলাম । এখন তো দেখছিসই কত ব্যস্ত । এখন কি আর সেইসব পুরনো কথা মনে রাখার দিন । ” জোর করে মুখে হাসি টেনে বলে ওঠে চন্দ্রা । ওর মুখের সুখী সুখী ভাবের দিকে তাকিয়ে একটা প্রশান্ত হাসি হাসে রুদ্র ।
কিছুক্ষণের নীরাবতা ভেঙে চন্দ্রাই বলে ওঠে ” তা আবার এই শহরে যে , কি করছিস এখন ?? “
” একটা প্রাইভেট জব । “
” বিয়ে করেছিস ? “
” হ্যাঁ “
রুদ্রের মুখে হ্যাঁ শব্দটা শুনে একটু আবাক হয় চন্দ্রা । মনে পড়ে যায় সেই সদ্য পড়াশোনা শেষ করা বেপরোয়া রুদ্রের কথা । যার কখনও কোনো সঠিক ঠিকানা ছিল না , যে নিজেকে উদ্বাস্তু বলে দাবি করত । যার কাছে ভালোবাসার মানে ছিল বোকা বোকা ইমোশন । যে কোনো সম্পর্কের মানে বুঝতে চাইত না । ওর কাছে জীবন মানে ছিল দুরন্ত । তবুও সেই অগোছালো বেপরোয়া ছেলেটাকে ভালো লাগতে লাগতে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছিল চন্দ্রা তা তো ও নিজেও টের পায়নি । বারবার কড়া হাতে নিজের মনকে দমন করে বলত তোমার এই আবেগী ভালোবাসা পচ্ছন্দ করে না তোমার ভালোবাসার মানুষটা । তবুও মন অবুঝের মতো বলে উঠত সেই ছেলেবেলা থেকে একাকীত্ত্ব ঘিরে রেখেছে তাকে , তাই তো সে ওরকম অবুঝ । যে ছোটোবেলায় চন্দ্রা ওর বাবা-মা র হাত ধরে ঘুরতে যেত সেই ছোটোবেলায় ও বাবা- মা ঝগড়া শুনে বিছানায় মুখ গুঁজে কাঁদত । যে ছেলেবেলায় চন্দ্রা মা বাবার মাঝে নরম বিছানায় শুয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাত সেই ছোটোবেলায় রুদ্র একলা ঘরে ভয়ে সিটিয়ে ঘুমহীন রাত কাটাত । ছোটোবেলা থেকে মা বাবা মধ্যে ঝামেলা দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ও কিন্তু সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল ওর যেদিন সবাই ওকে বলেছিল তোর বাবা মা আর কোনোদিন একসাথে থাকবে না , তোকেও ওরা কেউ নিয়ে যাবে না সাথে , তোকে একা একা থাকতে তোর কাকার কাছে । সেদিন খুব কেঁদেছিল ও , বারবার মা -বাবা র হাত ধরে বলেছিল তোমারা আমাকে ছেড়ে যেও না । সেদিন ওর কথা কারোর কাছে শ্রুতিগোচর হয়েছিল কিনা কে জানে হয়তো বা ওর কথা গুলো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম করে হৃদয়ে গিয়ে পোঁছায়নি ওর বাবা মা র তাই ওনারা ছোট্টো ছেলেটর হাত ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল নিজের নিজের রাস্তার বাঁকে । সেদিন সেই ছোট্টো ছেলেটার দুঃখে ওর কাকাই বোধহয় সমব্যথী ছিলেন তাই নিজের সংসারে নিয়ে এসেছিল , কিছুদিন ওর যত্নে কাটলেও বিধাতা বোধহয় ওর কপালে সুখের স্থায়ীত্ত্বটা ছোটো বয়স থেকই অনেক কম করে রেখেছিলেন তাই কাকু বিয়ে করে কাকিমাকে নিয়ে আসতেই কাকু ধীরে ধীরে আবিষ্কার করেছিল যে সে একটা বাড়তি বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছে রুদ্রর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে , তাই ধীরে ধীরে অযাচিত হয়ে যত্নে সাজানো বাগানের একপাশে বড়ো হওয়া বুনো ফুলের মতোই বেড়ে উঠল রুদ্র । রুদ্রর জীবনের ঘটনা গুলোর সাথে এই কঠিন , অগোছালো , বেপরোয়া স্বভাবটাকেও ভালোবেসে ফেলিছিল চন্দ্রা । ওর মন বারবার বলে উঠত ভালোবাসায় পাথরেও ফুল ফোঁটে আর রুদ্রর তো একটা অবুঝ পাগল ছেলে । ভালোবাসা দিয়ে ওর জীবনটা ঠিক ভরিয়ে তুলতে পারবে চন্দ্রা , ওকে ঠিক একদিন ভালোবাসার মানে, সম্পর্কের মানে গুলো বুঝিয়ে দিতে পারবে ।
ও চেয়েছিল ওর ভালোবাসা দিয়ে ওর দুঃখ টাকেও ভাগ করে নিতে ।
প্রথম যখন বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসার পথে হেঁটেছিল চন্দ্রা সেদিন রুদ্র ওর ভালোবাসার বদলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল ” তুই ও না চন্দ্রা , তুই এসব ন্যাকা ন্যাকা প্রেমে বিশ্বাস করিস চন্দ্রা , আমি তো ভাবতাম তুই এইসব ভালোবাসা টাসা বিশ্বাস করিস না । একটু চুপ করে গম্ভীর হয়ে বলেছিল ” ভালোবাসার আসলে কোনো অস্তিত্ত্বই নেই ।” তারপর একটু কি যেন চিন্তা করে হো হো করে কৃত্রিম হাসি হেসে উঠে বলেছিল ” ওও তার মানে তুই এতদিন বন্ধুত্বের নাম দিয়ে আমাকে যা যা হেল্প করতিস সব তোর ভালোবাসার জন্য ?? তুই ভালোবেসে দয়া করে আমার কলেজের টাকা টা দিয়ে দিতিস , তাই তুই দয়া করে আমার সাথে তোর টিউশনির নোটগুলো শেয়ার করতিস , ভালোবেসে দয়া করেই তুই আমার জন্য টিফিন নিয়ে আসতিস , আর তোর টিফিনটাও আমায় খাওয়া তিস , সবই আসলে তোর বন্ধুত্বের অভিনয়ের আড়ালে থাকা ভালোবাসার দয়ার জন্য । হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছিল রুদ্র , তারপর ঠান্ডা স্বরে কেটে কেটে উচ্চারণ “আসলে কি জানিস তুই ও আমাকে ঠকালি , বন্ধুত্বের অভিনয় করলি , আমার জীবনের গল্পটা জেনে তোর খুব ইচ্ছা হল আমার সাথে বন্ধুত্বের অভিনয় করে খেলার ” বলতে বলতে রুদ্রর অজান্তেই ওর চোখের কোল বেয়ে একফোঁটা জল বেরিয়ে এসেছিল তা ও খেয়াল না করলেও চন্দ্রার অগোচর ছিল না । এই চোখের জলটাই প্রমাণ করেছিল ঘৃণার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওর প্রতি রুদ্রের বিশ্বাস হয়তো বা ‘ বন্ধুত্বের ভালোবাসা ‘।
চলে যাওয়ার আগে ওর জন্মদিনে চন্দ্রার দেওয়া মোবাইল ফোনটা আছাড় মেরে ভেঙে দিয়ে বলেছিল ” বন্ধুর দেওয়া উপহার ভেবেছিলাম কিন্তু না এ সবই ছিল তোর দয়া , তোর ভালোবাসার দয়া । কোনো প্রয়োজন নেই তোর ভালোবাসার , দয়ার । “
সেদিন অঝরে কেঁদেছিল চন্দ্রা , নিজের মন বারবার ধিৎকার দিয়ে বলেছিল ” ভালোবাসার মানুষটাকে এতো কষ্ট দেওয়ার থেকে নিজের ভালোবাসা কে সারাজীবন গোপনে রাখাই শ্রেয় ছিল । কেন? কেন সে বুঝতে পারল না রুদ্রকে । তার নিজের ভালোবাসা কে বোঝা উচিত ছিল , উচিত ছিল এটা বোঝা নিজের ভালোবাসা জাহির করে নিজের মনে শান্তি পাওয়া যায় কিন্তু অপর দিকের মানুষটার ভালোলাগা – মন্দোলাগার দিক টাও দেখতে হয় । ” ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে বড়ো কষ্ট আর হতে পারে বলে মনে হয়নি ওর । না রুদ্রকে কখনই দোষারোপ করেনি ও , দোষারোপ করেছিল নিজেকে , নিজের বন্ধুত্বকে । এতোগুলো দিন তাকে ভালোবেসেও ও কেন বুঝে উঠেতে পারেনি রুদ্র ভালোলাগা মন্দলাগা গুলো । নিজের এই ভুলের জন্য বারবার নিজের প্রতি ঘৃণা হয়েছিল , ও তো আগেও দেখেছিল রুদ্র ভালোবাসার কথা শুনলেই কিভাবে রিয়াক্ট করত , বলত ভালোবাসা কে বিশ্বাস করে না , তবুও মানুষের মনে আশা মরে তাই হয়তো দুরুদুরু বুকে খারাপ চিন্তাগুলো গুরুত্ব না দিয়ে ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ও রুদ্রর সামনে । কিন্তু ওর ভাবনার ঠিক উল্টোটাই হল । এরপর এক সপ্তাহ কোনো খোঁজ পায়নি রুদ্রর । ও যে মেসে থাকত সেটাও ছেড়ে চলে গিয়েছিল রুদ্র কোনো ঠিকানা না রেখে । ফোনটাও নিজে হাতে ভেঙে দিয়েছিল ও । চন্দ্রা যে ওর কোন্ ক্ষতে আঘাত করে ফেলেছিল তা ভাবলেই নীচের মুখটাও আয়নায় দেখতে লজ্জা হচ্ছিল ওর । ওর খবর না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠছিল চন্দ্রা ।
এক সপ্তাহ পরেই রুদ্রের খোঁজ দিয়েছিল রাহুল । রুদ্র একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছে , সারাদিন কোথায় কোথায় যেন ঘুরে বেড়ায় শুধু সন্ধ্যায় বাড়ি এসে রাত্রিটা থাকে আবার সকালে বেরিয়ে যায় ।
পাগলটা ওর উপর রাগ করে নিজের কি ক্ষতি করতে বসল দেখার জন্য মনটা ছটপট করছিল ওর । এর মধ্যেই চন্দ্রার চাকরির খবর টা চলে এসেছিল । ও আর থাকতে পারেনি সেদিন । বরাবরের মতোই ওর কেরিয়ারের এতো ভালো খবরটা আগে রুদ্রকে দেবে বলে সেদিন সন্ধ্যা বেলায় ছুটে গিয়েছিল রুদ্রের বাড়ি । মন কে ধরে রাখতে পারেনি সেদিন । মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল এই সুযোগে রুদ্রর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেবে আর কথা দেবে সারা জীবন ওর বন্ধু হয়ে থাকার ।
কিন্তু সেদিন আবারও ভাগ্য পরিহাস করেছিল চন্দ্রার সাথে । সেদিন সন্ধ্যাবেলায় হাজারও চিন্তা নিয়ে গিয়েছিল রুদ্রর নতুন ঠিকানায় । ওকে দেখে চমকে উঠেছিলে রুদ্র । কিছুটা অস্বতিতে প্রকাশ পেয়েছিল ওর মুখে চোখে । অপ্রস্তুতিতে দ্রুত আড়াল করতে গিয়ে চন্দ্রার চোখের সামনে চলেই এসেছিল ওর হাতে ধরা সাদা ক্যানভাসের সারাটা আকাশ জুরে রুদ্রর হাতে আঁকা চন্দ্রার ছবিটা । চন্দ্রার চোখে পড়ে গেছে ছবিটা বুঝতে পেরেই রুদ্র কৃত্রিম ব্যস্ততা দেখিয়ে বলেছিল ” তুই এখানে কেন এসেছিস ? এখন আমি ব্যস্ত আছি তুই প্লিজ যা । “
চন্দ্রা একটু মৃদু হেসে বলেছিল ” সে তো দেখলামই তোর কত ব্যস্ততা । আমার ছবি আঁকার কাজটাও তাহলে তোর ব্যস্ততার মধ্যে পড়ে ?? আচ্ছা আমার ছবি আঁকার কারণটা কি জানতে পারি ? তাহলে তোর মনে একটু হলেও আমার জায়গাটা আছে তাই না !! ” বলতে বলতে কেঁপে গিয়েছিল চন্দ্রার গলাটা ।
নিজের মন কে গোপনে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে চন্দ্রার কথায় তা বুঝতে পেরেছিল রুদ্র । মানুষের শত চেষ্টাও যখন বিফল হয়ে যায় তখন সমস্ত ব্যর্থতা একজোট হয়ে কঠিন করে তোলে মানুষটাকে । তার নিজের অজান্তেই কখন যে সে তার প্রিয় মানুষটাকে সবচেয়ে বড়ো আঘাত করে ফেলে তা হয়তো সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না । তাই চন্দ্রা সেদিন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তার তাকেও ভালোবাসে রুদ্র হয়তো বা নিজেও সেটা বোঝে না । খুশী মনে ওর চাকরির খবর টা রুদ্র কে দিতেই ও একটা শুকনো ম্লান হাসি মুখে নিয়ে বলেছিল ” বাঃ খুব ভালো খবর । কিন্তু এই খবরটা আমাকে দিয়ে তুই আমার ব্যর্থতা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে এসেছিস তাই না ? আমি একটা ছোট্টো স্টুডিও তে কাজ করি আর তুই আমার সহপাঠি হয়েও এতো তাড়াতাড়ি একটা ভালো মাইনের চাকরি পেয়েছিস তাই , তাই এসেছিস আমাকে শোনাতে । আমি যে অপদার্থ সেটা প্রমাণ করতে । চন্দ্রার কাছে এসে খুব ঠান্ডা গলায় ধীরে ধীরে বলেছিল ও ” আর কতো চন্দ্রা , আর কত বার আমায় অপমান করলে শান্তি পাবি তুই , এতোদিন তো তোর দয়ায় থেকে নিজের ব্যর্থতা খুব কাছ থেকে দেখলাম আবার কেন এসেছিস তুই ??
চন্দ্রা শত অভিযোগেও চুপ করে শুনেছিল সব অবাক চোখে তাকিয়ে রুদ্র স্থির হওয়া গভীর চোখের ভিতর প্রাণপনে খুঁজতে চেয়েছিল এক চিলতে অব্যক্ত ভালোবাসা , যা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অচেনা রুদ্রর বলা প্রতিটা কথা মিথ্যে করে ওর আগাগোড়া মুখোশের আড়াল ভেঙে বের করে দেবে সেই চেনা রুদ্রকে যে ইকোনমিক্সের কঠিন চ্যাপ্টার গুলো সহজ করে বুঝিয়ে দিত , যে এক্সামের দিন ভোরে ফোন করে বলত ” তাড়তাড়ি উঠে ইনপর্টেন্ট নোট গুলোতে চোখ বুলিয়ে নে , যে সরস্বতী পূজোর দিনে শাড়িতে অনভ্যস্ত চন্দ্রার দশটা হোঁচোট খাওয়া থেকে বাঁচাতে হাতটা ধরে বলত “সামলাতে পারিস না তো পড়িস কেনো , মা সরস্বতী কি বলে দিয়েছেন শাড়ি না পড়লে এইবছর ফাস্ট ডিভিশন হবে না , নাকি চুড়িদারে ওনার এলার্জি ? ” যে ঝালে লাল হয়ে যাওয়া ফুচকাটার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বলত খেয়ে ঝাল ঝাল বলে চেঁচালে কিন্তু আমি আইসক্রিম খেতে দেবে না আর চন্দ্রা ওর অবাধ্য মনর মনোযোগকে ফুচকা র থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে বলত ” আইসক্রিমই সই ” । ” খুব ইচ্ছা করছিল সেই রুদ্রকে ফিরে পেতে , খুব ইচ্ছা করছিল ক্যানভাসে ওই ছবিটা আঁকার যে কারণটা ও ভাবছিল সেটাই সত্যি হোক সবকিছুকে মিথ্যা করে ।
একদৃষ্টি তাকিয়ে ছিল চন্দ্রা ওই ক্যানভাসের দিকে , ওর পচ্ছন্দের সেই সোনালি চুড়িদার টাই পড়িয়েছে রুদ্র ওকে ছবিতে । ওর দৃষ্টি অনুসরণ রুদ্র ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে বলেছিল ” জানতে চাস কারণটা কেন আমি এঁকে রেখেছি তোকে ? কারণ আমি তার ছবিটা সারাজীবন মনে রাখতে চাই যাকে বিশ্বাস করে বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছিলাম আর সে আমাকে ঠকিয়ে গেল । আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল তুই , সবচেয়ে বড়ো বাধা তুই , তোর জন্যই আজও আমি অকর্মণ্য, ব্যর্থ । শুধু তোর জন্য । তাই তোর ছবি এঁকে রেখেছি যে আমার সাথে এতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ।
কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গিয়েছিল চন্দ্রা রুদ্রর ঘর থেকে । যাওয়ার আগে রুদ্র ওক বলেছিল ” পারলে আর কখনও খোঁজার চেষ্টা করবি না আমাকে , আমার এই উপকার করে দে, দয়া কর ।”
চোখে টলটলে জলের ধারাগুলো অতিকষ্টে আটকে রেখে চন্দ্রা বলেছিল কথা দিলাম , ” আর তোর বাধা হয়ে দাঁড়াব না আমি কখনও । “
” কি রে কি ভাবছিস । তোর বরের কথা কিছুই বললি না তো । ” রুদ্রর কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বর্তমানে ফিরল চন্দ্রা । একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা আপনি ওর গলা থেকে বেরিয়ে এল ।
মুখে একটা সুখীসুখী হাসি নিয়ে উত্তর দিল ” বলার তেমন কিছুই নেই । ও বিজনেসে ব্যস্ত। তাও যতটা পারে সময় দেয় । খুব কেয়ারিং ও । তবে তিন মাস হল ও কাজে মুম্বাই য়ে । আর তুই তো জানিসই কলকাতা ছেড়ে আমি কখনই থাকি না । তার উপর আমার চাকরি তো আছেই । তাই আমার যাওয়া তেমন নেই ।
তা তোর ওয়াইফের কথা কিছু বল । সময় দিস তাকে ?”
” হ্যাঁ , সে তো গুছিয়ে সংসার করছে , খুব সংসারী। একদম যাকে বলে সুখী সুখী গৃহিণী । আর সময়ের কথা বলছিস , তারই সংসারের কাজে সময় বার করা মুশকিল । তবে সে কোখনও ভুল বুঝবে না আমায় । আমাদের সম্পর্কটা যে বিশ্বাসে তৈরী । আসলে জানিস জীবনের একটা সময়ের পর একা একা থাকাই খুব কঠিন । তাই মনের মতো জীবনসাথী খুঁজে বিয়েটা করেই ফেললাম ।”
– ” বাঃ । তাহলে সম্পর্ক গুলোর সমীকরণ বুঝিস এখন । বিশ্বাস ভালোবাসার মূল্য দিস । শুনেও ভালো লাগল । আমি তো এটাই কতবার বোঝাতে চাইতাম তুই তো বড্ড অবুঝ ছিলিস । তোর বউ য়ের ক্ষমতা আছে বলতে হবে !! কত সুন্দর বুঝদার করে তুলেছে এই চার বছরে । আর বেশ গোছালোও তো করেছে !! প্রপার শার্ট , টাই । আগে তো এসব পড়তেই চাইতিস না । ” হেসে ওঠে দুজনেই ।
এরপর দুজনের কলেজ লাইফের হাজারও স্মৃতি তুলে ধরে একের পর এক । কত বন্ধুরা মিলে আড্ডা , গান , হইহুল্লোড় , গল্প, কলেজ বাঙ্ক । এক একটা সুন্দর , খুশীর মুহুর্ত গুলো একে অপরকে মনে করিয়ে দেয় , হেসে ওঠে ।
কিছুক্ষণ পর রুদ্র বলে ওঠে এবার আসি রে । আমার স্টপ এসে গেছে ।
– ” এখানেই !! “
– ” হ্যাঁ , ভালো থাকিস । জমিয়ে সংসার করিস । মেয়েকে আর বর কে নিয়ে ভালো থাকিস ।”
-” তুই ও ভালো থাকিস । ” হেসে ওঠে চন্দ্রা । বউটাকে একটু টাইম দিস , যত্ন নিস । “
হাজার কথা , হাসি , স্মৃতির মাঝে রয়ে যায় কিছু নীরাবতা । আর নীরবতাতেই থেকে যায় চন্দ্রার অব্যক্ত কথা গুলো ” …. তুই আমাকে আজও চিনলি না রুদ্র । আমার শুধু সন্তানটাই আছে তার বাবার জায়গাটায় যে আজও কাউকে ভাবতেও পারি না । অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে করালেও একটা কথা তোকে মনে করাই নি রুদ্র । তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম আমার ইচ্ছাটা আমার মনের মানুষটাকে না পেলে আমি বিয়ে করব না কোনোদিনই , আমার খুব ইচ্ছা একটা ছোট্টো পরীর মতো মেয়ে । তাকে অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসে তার মা হয়ে উঠব , মা – মেয়ে নতুন কাহিনি আর আমার নতুন পরিচয়ে কাটিয়ে জীবনের দিনগুলো একটা একটা করে । তোকে মনে করাই নি সে কথা রুদ্র কারণ আমি একাই পথ চলতে চাই আর আজও আগের মতোই একই ভাবে চাই তুই ভালো থাক ।ভালো থাকিস রুদ্র ভালো থাকিস ।
রুদ্র চলে যাচ্ছে একটু একটু করে দূরে । একটা শ্রান্ত নরম হাসি ফুটে ওঠে চন্দ্রার মুখে । মনে তখন একটা খুব প্রিয় কবিতার চেনা দুটো লাইন ভেসে উঠল
” দেখা হল বছর চারেক পর
তুই এখন অন্য কারোর ঘর , অন্য কারোর বর …..। “
সুখী বিবাহিত জীবনের নিখুঁত অভিনয়টা শেষ করে চন্দ্রার চোখের সীমানা থেকে বেরিয়ে এসে চোখের কোণের বিন্দু গুলোকে অভ্যস্ত হাতে খুব সহজেই মুছে নিল রুদ্র । মনে মনে বলে উঠল সেদিনের মতো আজও দক্ষ অভিনয় করলাম আমি চন্দ্রা । আমি আজ সবথেকে সফল, সুখীও বটে । তোকে সুখী দেখতে চেয়েছিলাম । সে সুখ তুই আমার মতো একাকীত্ব গ্ৰাস করা , আত্মকেন্দ্রিক মানুষের থেকে কখনই পেতিস না । তুই সুখী আজ , স্বামী সন্তান নিয়ে সম্পূর্ণা । সেদিন যেমন আমার আঁকা তোর ছবিটার কারণটা খুব দক্ষতায় লুকিয়ে রেখেছিলাম আজও তেমন তোর সামনে আমার হ্যাপি ম্যারেড লাইফের মিথ্যে ছবিগুলো এঁকে দিয়ে লুকিয়ে রাখলাম ভালোবাসা ।
রুদ্রও চন্দ্রার মতোই লিখে রাখল সেই চেনা কবিতার লাইন গুলো
ওর মনের কোণে সর্বদা বিরাজ করা চন্দ্রা ছবির পাশে
” দেখা হল বছর চারেক পর
তুই এখন অন্যকারো ঘর
তুই এখন বড্ড ভীষণ পর “
তবে একটা কথা আজও অব্যক্ত সারা পৃথিবীর কাছে
সেটা রুদ্রর নিভৃত মনের কোণে লেখা রয়েছে
” তুই আজও আমার একার ঘর …..”
অবুঝ দুটো মনে না বলা কথা গুলো গোপনে রেখে তারা দুজনেই ভাবে তারা জিতে গেছে , কিন্তু তারা নিজের অজান্তেই একে অপরের কাছে হেরে বসে আছে । কি জানি জীবনের কোনো এক অধ্যায়ে এসে হয়তো এক হতেও পারে আবার দুটো মন…..
( সমাপ্ত)
( * কবিতার লাইন গুলো সৃজা ঘোষের জনপ্রিয় কবিতা “বছর চারেক পর ” থেকে নেওয়া)
আরও পড়ুন,
ভালোবাসা
অপেক্ষার শেষ প্রহরে
অল্প কথা
Leave a review
Leave a review