Bangla Premer Golpo
অপূর্ণ এক প্রেম কাহিনী
নিজের চেয়ে প্রায় চল্লিশ বছরের বড় মানুষের প্রেমে পড়েছেন কখনো? আমি পড়েছিলাম। সম্পূর্ণ না হওয়া একটা প্রেমের গল্প আজ শোনাবো আপনাদের।
সে প্রায় চব্বিশ – পঁচিশ বছর আগেকার ঘটনা। পাড়ার এক বাড়ি তে ছোটোবেলা থেকেই বেশ যাতায়াত ছিলো আমাদের পাড়ার প্রায় প্রত্যেক বাচ্চার। সেই বাড়ি তে আমার খুব আপন একজন মানুষ থাকতেন, তাকে আমরা প্রায় সকলেই পিসি বলে ডাকতাম। পারিবারিক সম্পর্কে তিনি যদিও আমার বা আমাদের কেউ ছিলেন না। কেন জানি না তাকে শুধু আমার নিজের রক্তের সম্পর্কের পিসি নয়, বরং নিজের মায়ের চেয়েও বেশি মনে হতো। আমার জীবনে যা কিছু শুভ, সবেরই তার কাছেই হাতেখড়ি।
Romantic Premer Golpo
যে মানুষটাকে নিয়ে আমার এই গল্প শুরু, সেই মানুষটার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল সেই পিসি বাড়িতে, এক রবীন্দ্র জয়ন্তীর সন্ধ্যায়। আমি তখন পুঁচকি একটা ছানা। ছয় বছর মোটে বয়স। ক্ষুদ্র হাতে হারমোনিয়ামের বেলো তে হাত পেতাম না ভালো করে। অনেকগুলো ছেলে মেয়ের মাঝে ঐ মানুষটাকে দেখলাম। পিসির বড়দা। তার বয়স তখন প্রায় ছেচল্লিশ। আমায় কোলে নিয়ে আদর করলেন। কত কথা বললেন। পিসি শিখিয়ে দিলেন ওনাকে মামা বলে ডাকতে। যদিও আজও আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে পিসির বড় ভাই কে মামা কোন হিসাবে ডেকেছিলাম! আসলে কিছু সম্পর্কের কোনও নাম হয় না।
ঐ ঘটনার পর কেটে গেল আরো সাত – আট বছর। অনেকগুলি বাচ্চা এবং আমি সেবার পিসির সাথে গেলাম বারুইপুর গরমের ছুটি তে। সেই মামার বাড়ি। কয়েকদিন খুব আনন্দে কাটলো।
হঠাৎ প্রেমের গল্প
তারপর কেটে গেল আরো পাঁচ – ছয় বছর। এর মধ্যে মাঝেমাঝেই মামা পিসির বাড়ি আসা যাওয়া করতেন। যখন আসতেন, আমার মনে আছে, আমি প্রত্যেকবার নাওয়া খাওয়া ভুলে ছুটে যেতাম মানুষটার সাথে দেখা করার জন্য। কি এক দুর্নিবার আকর্ষণ আমাকে বারবার টেনে নিয়ে যেত তার কাছে! তখনও মানুষটার আসল পরিচয় পাইনি। তখনও মানুষটার অন্তরের কোমলতার আভাস পাইনি, তখনও তার সাদামাটা জীবনের ভেতরকার আসল মানুষটার অসীম মনোবল ধরা পড়েনি আমার কাছে। তার আকাশের মতো অন্তহীন অথচ কঠিন চরিত্র তখনো বোঝা হয়নি আমার।
তখন আমি পূর্ণাঙ্গ যুবতী। সাথে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। মনের ভেতরে হঠাৎ করেই একরাশ ঠান্ডা হাওয়া দোলা দিয়ে উঠতো মাঝে মাঝে যখন শেক্সপিয়ার, মারভেল, শেলি, কিটস, ব্রাউনিং, ব্রন্টে পড়তাম। “To his coy mistress” পড়ে মনে হয়েছিল, আহা এমন পুরুষ মানুষও আছে পৃথিবীতে, যে হাজার হাজার বছর ধরে শুধুমাত্র নিজের প্রিয়তমার রূপের প্রশংসা করে তাকে অফুরান আদর – ভালোবাসা দিয়ে যেতে পারে! ব্যাপার টা অসম্ভব হলেও, এক পরিচিত মূর্তি ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিলো আমার মনের ভেতরে।
শ্রেষ্ঠ প্রেমের গল্প
একদিন শুনলাম মামা নিজের বারুইপুরের বাড়ি ছেড়ে এসে আমাদের বাড়ি থেকে খানিক দূরে তার নিজের পৈতৃক বাড়িতেই এখন থেকে পাকাপাকিভাবে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। সেই শুরু হলো আমার তার কাছে যাতায়াত। মামার সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়ে গেল তারপর। দুজন মুখোমুখি বসে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার কথা আলোচনা করতাম। আলোচনা বলা ভুল হবে, আমি তো শুধু গালে হাত দিয়ে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনতাম গভীর মনোযোগ দিয়ে। মামার গুণের কথা বলে শেষ কথা যাবে না। আর সত্যি বলতে তার গুণ বা জ্ঞান দুটোই পরিমাপ করা, আমার পক্ষে দুঃসাহসিকতার সামিল। তার লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ সবই পড়েছি আমি। সেগুলো সবই অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্যের অংশ। এটা কোনো গল্প নয়, সত্য ঘটনা। তাই এক বর্ণ ও বানিয়ে বলার অবকাশ নেই আমার।
আরও কিছু পরে জেনেছিলাম মামা ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম মানুষ, যিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে একটা আন্দোলন শুরু করেছিলেন বহু বছর আগে, তাদের যোগ্য সম্মান যাতে তারা প্রত্যেকে পায়, সেই জন্য। মামার বাড়ি তে আমি তৃষা নামের এক রুপান্তরকামী দিদি কে দেখেছিলাম একটু বড় হয়ে, যার শরীর ছেলেদের মতো হলেও, দিদি টা মনের দিক থেকে মেয়ে ছিলো। দিদির মা বাবা তাকে ত্যাগ করলেও, মামা তৃষা দিদির ছেলে থেকে মেয়ে হওয়ার এই পুরো যাত্রাপথে সারাক্ষণ তাকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছিলো। এই দুটি বিষয় নিয়েই মামার নিজের লেখা কিছু বই ও আছে। যখন প্রথম এই আন্দোলন টা মামা শুরু করেছিলেন, তখন তিনি এদের সম্পর্কে আরও জানার জন্য প্রায়ই হিজড়ে দের এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। বিভিন্ন রুপান্তরকামী মানুষদের ঠিকানা জোগাড় করে তাদের সাথে যোগাযোগ করতেন। শুধু তাই না যৌনকর্মী দেয় জীবন, তাদের সুখ দুঃখ, তাদের এ পথে আসা, ইত্যাদি নিয়েও মামা আজীবন গবেষণা চালিয়ে গেছেন। মামার বহু পরিচিত লোকেরা তাকে ঐ পাড়া গুলো তে আবিষ্কার করেছেন। এর পরেই মামার বাড়ির পাড়ায় একটা বদনাম রটে যায় তার নামে। তাকে লোকে দুশ্চরিত্র, লম্পট ইত্যাদি আরও অনেক খারাপ ভাষায় ডাকতে শুরু করে। তার ফলে তার নিজের পরিবারের সাথেও তার কিছু মনোমালিন্য ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কিন্তু মামা এসবের জন্য কখনো দমে যায়নি। তার লক্ষ্য স্থির ছিলো। একটা সময়ে গ্যালিলিও কেও মানুষ পাগল বলেছিলো আর কিটস কে শুনতে হয়েছিল লম্পট বদনাম। কিন্তু সেই জন্য তারা কিন্তু কখনো নিজেদের কাজ থামিয়ে দেননি। লোকের কথার পরোয়া না করেই নিজেদের লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের মতো সাধারণ ছাপোষা মানুষরা যে কাজ গুলো করার কথা কল্পনাই করতে পারি না, মামা সেগুলো অবলীলায় করে ফেলতেন। তাও হাসি মুখে। কখনো তার মুখে হাসি ছাড়া দেখিনি।
আর আমার কথা কি বলবো? আমার লেখা প্রত্যেকটি কবিতার প্রথম পাঠক ও প্রুফ রিডার ছিলেন মামা। তার বাড়ি গেলেই আমার কাছে তার দুটো আবদার থাকতো – এক, তাকে চা করে দিতে হবে। দুই, গান শোনাতে হবে। আমি এই দুটি আবদারের জন্যই বেশি করে তার কাছে যেতাম। সারাক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতাম যেন মামা তার সামাজিক জীবনের এত বড় কর্মকাণ্ডের মাঝে থেকে আমাকে দু একটা দায়িত্ব দেন। মামা যখন তার নিজের লেখা পড়ে শোনাতেন, তখন দেখতাম তার গলা কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে, চোখ দিয়ে অনর্গল জলের ধারা বেয়ে দুই গাল ভাসিয়ে দিচ্ছে। অত্যন্ত ভাবুক ও আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। অথচ তাকে কখনো আবেগে ভেসে যেতে দেখিনি। খুব গুরুতর সময়েও তাকে দেখতাম সবসময় ভীষণ ঠান্ডা মাথায় যেকোন সিদ্ধান্ত নিতেন।
সত্যি প্রেমের গল্প
মামার মন টা যত টা রঙীন ছিল, ততটাই ছেলেমানুষ ছিলো তার মন টা। পাড়ার যত ঠিকে ঝি, মুচি, মেথর, কারখানার শ্রমিক বা রান্নার লোকেদের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা, যাদের কেউ ভালোবাসে না, সবসময় যারা ভদ্দর লোকের সমাজে অবাঞ্ছিত ও অবহেলিত , তারা ছিলো মামার বন্ধু। আর বাচ্চাগুলো ও দাদু বলতে অজ্ঞান ছিলো। এই বাচ্চাগুলোকে সামান্য একটু আনন্দ দেওয়ার জন্য মামা নিজের বাড়িটাকেই ‘খেলাঘর’ বানিয়ে নিলেন, যেখানে কোনো বাচ্চার মধ্যে ভেদাভেদ থাকবে না, প্রত্যেক বাচ্চা এখানে সমান। মামার এই আইডিয়া টায় পাড়ার বড়লোক শ্রেণীর একদল খেপে গেল। “আমার বাচ্চা খেলা করবে একটা মেথরের ছেলের সাথে!” – এটা তারা মেনে নিতে পারলো না। কিন্তু তাতে মামার বয়েই গেল! এই ঘটনাটা ছিল সূত্রপাত তার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রের।
আরো পড়ুন,
মামার বাড়িতে প্রচুর গাছপালা ছিলো। এর বেশিরভাগ টাই মামার নিজের হাতে লাগানো। কখনো ভোরবেলা মামার বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকলেই দেখা যেত মামা টবে গাছ লাগাচ্ছেন। আবার কখনো টবের গাছ বদলাচ্ছে, টবে নতুন মাটি দিয়ে চারাগাছ লাগাচ্ছেন। আমিও কয়েকবার সকালে মামার সাথে গাছ লাগিয়েছি, আগাছা পরিষ্কার করেছি। তারপর দুজনে একসাথে বাগানে বসে চা খেয়েছি। এইভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর।
Premer Golpo Love Story
তখন আমি সদ্য অনার্স পাশ করে চাকরির চেষ্টা করছি। তার পাশাপাশি টিউশন ও পড়াচ্ছি। একদিন সকালে একটা বাচ্চা কে পড়ানোর সময় পিসির ফোন এলো আমার কাছে। ফোনের ওপ্রান্তে তখন যা যা শুনলাম, সেগুলো শোনার পর পাথরের মতো বসে রইলাম কিছুক্ষণ। মনে হলো যেন নড়াচড়া করার শক্তি নেই শরীরে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিধ্বস্ত মন টাকে এবার এক ঝটকায় গুটিয়ে নিয়ে হনহন করে রওনা হলাম মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। মামার বাড়ির বাইরে তখন লোকে গিজগিজ করছে। আমার হৃৎপিন্ড টা যেন গলার কাছে উঠে এসেছে। তার ধুকপুকুনি যে কেউ শুনতে পাবে এক মাইল দূর থেকে।
ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। মামা মেঝের উপর শুয়ে আছে, যেন এখুনি ডাক দিলেই উঠে আসবে, একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য। কাছে গিয়ে বসলাম। মামার চামড়া কুচকানো বলিরেখা যুক্ত হাত টা নিজের হাতে নিলাম। বরফের মতো ঠান্ডা ও নিষ্প্রাণ। সেই মূহুর্তে অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করছিলো, অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছিলো সেই মানুষটাকে যাকে আমি বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম এতগুলো বছরে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিলো। আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিলো, “এই চল্লিশ টা বছরের ব্যবধান কমিয়ে ফেলা যেত না? কেন তুমি আর চল্লিশ টা বছর পরে জন্মালে না, বা কেন আমি আর চল্লিশ টা বছর আগে জন্মালাম না?” চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিলো, “তুমি কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে? এখনো তো আমার এই সংসারের অনেক কিছুই জানা হলো না। কত কিছু শেখা বাকি রয়ে গেল আমার!”
আরো পড়ুন,
ডাক্তার হার্ট অ্যাটাক বলেছিল। কিন্তু আমার আজও বিশ্বাস হয় না। তবে, সেকথা আজ নয়, অন্য একদিন বলবো।
পিসি সেদিন খুব কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেছিল অনেকবার। হয়তো আমার মতোই অব্যক্ত এমন অনেক কথা পিসির ও জানানো বাকি ছিলো তার বড়দা কে। হয়তো সবথেকে বেশি কষ্ট আমরা দুজন পেয়েছিলাম। বা হয়তো আমাদের মতোই আরো অনেক মানুষ এই দুর্দমনীয় অসাধারণ, পাগল মানুষটিকে ভালোবেসে নিজেদের জীবনকে তার সাথে একাত্ম করে নিয়েছিল। আর সত্যিই তো, এমন অসম্ভব দুর্ধর্ষ চরিত্রের মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায়!
এবার আপনারাই বলুন, এমন প্রেম কাহিনী কখনো শুনেছেন?
(সমাপ্ত)
আরো পড়ুন,
হঠাৎ প্রেমের গল্প – মনের মানুষ