Durgapuja In Bengali – দুর্গাপূজার ইতিহাস, রচনা – Durga Puja In Kolkata,
Paragraph
Durgapuja In Bengali 2021
চৈত্র মাসে হয়ে থাকে। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের
দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। তবে বাসন্তী পূজার থেকে শারদীয়া
পূজার জনপ্রিয়তা বেশি।
একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়। দুর্গাপূজা ভারতের
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মণিপুর ও
ওড়িশা রাজ্যে বেশ মহাসমারোহ ভাবে পালিত হয়ে থাকে। এমনকি ২০০৬ সালে গ্রেট
বিটেনের রাজধানী লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে “ভয়েসেস অফ বেঙ্গল”
মরসুম নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসাবে স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীরা ও
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এক বিরাট দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত (পাঁচ
দিন)শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচ দিন হল “দুর্গাষষ্ঠী”,
“মহাসপ্তমী”, “মহাষ্ঠমী”, “মহানবমী” ও
“বিজয়াদশমী” নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয়
“দেবিপক্ষ”। আর এই দেবিপক্ষের সূচনা হয় মহালয়ার দিন থেকে।
দূর্গা পূজার ইতিহাস
আবির্ভাবের ইতিহাস কি? কে এবং কারা প্রথম মর্ত্যে দুর্গাপূজার প্রচলন
করেছিলেন? তা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা নেই। তবে দুর্গাপূজার আবির্ভাব নিয়ে
বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।যেমন-
*ডাঃ চমনলাল গৌতম তার বিষ্ণুরহস্য বই এর ১৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছে-“ঋষিগণ মুর্তি
পূজার প্রচলন করেছে”।
*খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দী হতে বাংলায় কিছু কিছু অঞ্চলে কালীপূজা শুরু হয়। ১৭৬৮
সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায়
কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়।
মনে করা হয়।
*হিন্দুদের বিদ্যার দেবী সরস্বতী। সরস্বতী শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থে
‘সরস্+বতু’ স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রতয় যুক্ত যোগে ‘সরস্বতী’। ‘সতত রসে
সমৃদ্ধা’। বীণা-রঞ্জিত পুস্তক হস্তে অর্থাৎ এক হাতে বীণা ও অন্য হাতে সরস্বতী
পূজা বেশি করে। পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগরে দেবী সরস্বতীর
পূজা হত। বৌদ্ধ সরস্বতীর তিন মুখ ও ছয় হাত। বৌদ্ধ জগতে বাগ্মীশ্বর শক্তি
সরস্বতী।
*”মূল বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গা পূজার কোন অস্তিত্ব নাই। মোগল যুগের কবি
তুলসিদাসের “রামচরিতমাস”। সেখানেও রাম কর্তিক দুর্গা পূজার কোন উল্লেখ নেই।
মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি কৃতিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ন বাংলা
করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের ততকালীন সমাজে প্রচলিত অনেক গল্প বাংলা রামায়নে
ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রবেশ করিয়েছে। তার এই অনুবাদকৃত রামায়ণ পরিচিত পায় কৃতিবাসী
রামায়ন নামে। সেখানে সে কালিকা পুরানের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের
দুর্গাপূজা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
*১৭৪২ সালে মারাঠা বর্গিরা যখন ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আক্রমন
করেছিল, তখন তারাও কাটোয়ার কাছে দাইহাটায় দুর্গাপুজা করেছিল।
*বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ার ১৮শতকের মঠ বারিয়ার নবরত্ন মন্দিরে
(১৭৬৩সালে) দুর্গাপূজা হত বলে লোক্মুখে শোনা যায়।
Durga Puja In Kolkata
মতে প্রথম দুর্গাপূজা আয়োজন করে তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ন ১৪৮০সালে
(৮৮৭বঙ্গব্দে) শরৎ কালে। অনেকের মতে ১৬০৬ সালে নদিয়ার ভবনানন্দ মজুমদার
দুর্গাপূজার প্রবর্তক।
দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হিন্দু বাঙালি জমিদারদের
কাছে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ এ কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়েছে।
বিভিন্ন দেবদেবীরা কিভাবে দুর্গাপূজা করেছিলেন, তার একটি তালিকা এই পুরাণে
পাওয়া যায়। তবে এই প্রসঙ্গে কোনো পৌরাণিক গল্পের বিস্তারিত বর্ণনা এই পুরাণে
দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে-
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা চ।
তুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা।।
অর্থাৎ, সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুন্ঠের আদি-বৃন্দাবনের
মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে
ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এই অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ
করতে করতে শিব বিপদে পড়ে তৃতীয় দুর্গাপূজা আয়োজন করেছিলেন। দুর্বাসা মুনির
অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ
দুর্গাপূজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষেরা নানা
দেশে নানা সময়ে দুর্গাপুজা করে আসছে।
দেবীভাগবত পুরাণঃ শাক্তধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ অন্যসারে,
ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে দুর্গার মাটির
মূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। এই সময় তিনি “বাগভব” বীজ জপ করতেন এবং আহার ও
শ্বাস গ্রহণ ত্যাগ করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে একশো বছর ধরে ঘোর তপস্যা করেন। এর ফলে
তিনি শীর্ণ হয়ে পড়লেও, কাম ও ক্রোধ জয় করতে সক্ষম হন এবং দুর্গানাম চিন্তা
করতে করতে সমাধির প্রভাবে স্থাবরে পরিণত হন। তখন দুর্গা প্রীত হয়ে তাঁকে বর
দিতে আসেন। মনু তখন দেবতাদের দুর্লভ একটি বর চাইলেন। দুর্গা সেই প্রার্থনা
রক্ষা করেন। সেই সঙ্গে দুর্গা তাঁর রাজ্যশাসনের পথ নিষ্কণ্টক করে। এবং মনুকে
পুত্রলাভের বরও দেন।
দেবীমাহাত্ম্যমঃ দুর্গা ও দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে, তার
মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম-এ।
এই গল্পটি হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাঠ দুর্গাপূজার একটি
অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। দেবীমাহাত্ম্যম আসলে ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’- এর একটি
নির্বাচিত অংশ। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতাশোটি শ্লোক আছে। এই বইতে দুর্গাকে
নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প ও দুর্গাপূজা প্রচলনের একটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি
গল্পে দুর্গাই কেন্দ্রীয় চরিত্র।
দূর্গা পূজা রচনা বাংলা
ও যোগসূত্র। সুরথ ছিলেন পৃথিবীর রাজা। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে তাঁর যথেষ্ট
খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে এক যবন জাতির হাতে তাঁর পরাজয় ঘটে। সেই
সুযোগে তাঁর মন্ত্রী ও সভাসদেরা তাঁর ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। সুরথ
মনের দুঃখে বনে চলে আসেন। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধা নামে এক ঋষির
আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা রাজাকে সমাদর করে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন।
কিন্তু বনে থেকেও রাজার মনে সুখ ছিল না। সব সময় তিনি তাঁর হারানো রাজ্যের
ভালোমন্দের কথা ভেবে শঙ্কিত হন। এমন সময় একদিন বনের মধ্যে রাজা সুরথ সমাধি
নামে এক বৈশ্যের দেখা পেলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে সুরথ জানতে পারলেন, সমাধির
স্ত্রী ও ছেলেরা তাঁর সব টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাঁকে বাড়ি
থেকে তারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাও তিনি সবসময় নিজের স্ত্রী ও ছেলেদের কল্যাণ
ও অকল্যাণের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগল, যারা
তাঁদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, তাদের প্রতি তাঁদের রাগ হচ্ছে না কেন? কেনই বা
তাঁরা সেই সব লোকেদের ভালোমন্দের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হচ্ছেন? দুজনে মেধা
ঋষিকে এই কথা জিজ্ঞাসা করলে, তিনি একে একে তাঁকে তিনটি গল্প বলেন এই
গল্পগুলিই শ্রীশ্রীচণ্ডী- র মূল আলোচ্য বিষয়। বইয়ের শেষে দেখা যায়, মেধার
গল্প শুনে সুরথ ও সমাধি নদীর তীরে তিন বছর কঠিন তপস্যা ও দুর্গাপূজা করলেন
এবং শেষে দুর্গা তাঁদের দেখা দিয়ে সুরথকে হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন এবং
বৈশ্যকে তত্ত্বজ্ঞান দিলেন।
পৌরাণিক কাহিনী মতে দুর্গাপূজার ইতিহাস
বর্ণিত হয়েছে, প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট সমুদ্রে পরিণত হলে বিষ্ণু সেই
সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। এই সময় বিষ্ণুর
কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত
ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। ভীত হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করার জন্য তাঁর
নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রার স্তব করতে লাগলেন। এই স্তবটি গ্রন্থে উল্লেখিত চারটি
প্রধান স্তবমন্ত্রের অন্যতম। এই স্তবে সন্তুষ্টা দেবী বিষ্ণুকে জাগরিত করলে
তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সঙ্গে মহাসংগ্রামে রত হলেন। মহামায়া
শেষে ওই দূর অসুরকে বিমোহিত করলে তারা বিষ্ণুকে বলে বসে, “আপনার সঙ্গে যুদ্ধ
করে আমরা প্রীত; তাই আপনার হাতে মৃত্যু হবে আমাদের শ্লাঘার বিষয়। পৃথিবীর যে
স্থান জলপ্লাবিত নয়, সেখানে আপনি আমাদের উভয়কে বিনাশ করতে পারেন” বিষ্ণু
বললেন, “তথাস্তু”। এবং অসুরদ্বয়ের মাথা নিজের জঙ্ঘার উপর রেখে তাদের বধ
করলেন।
মহিষাসুরের কাহিনীঃ শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনীগুলির মধ্যে
সর্বাধিক জনপ্রিয় আবার গ্রন্থের মধ্যম চরিত্র বা দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লেখিত
‘মহিষাসুর’ বধের কাহিনীটি। এই কাহিনী অনুসারে, পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে
একশতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতারিত
দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পড়ে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের
সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনি শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই
অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমণ্ডল ভীষণাকার ধারণ করল।
প্রথমে বিষ্ণু ও পড়ে শিব ও ব্রহ্মার মুখমণ্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হল। সেই
সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই
মহাতেজে নির্গত হল। সু-উচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট
তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত
হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। অন্য সূত্র থেকে জানা যায়,
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন;
শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে
দেবী মহিষাসুর বধ করেন।
যাই হোক, এক এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল। প্রত্যেক দেবতা
তাঁদের আয়ূধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তাঁর বাহন সিংকে দান
করলেন। এই দেবীই অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা
করলেন (শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে, মহালক্ষ্মী দেবী মহিষাসুর বধ করেন। ইনিই
দুর্গা। তবে বাঙালিরা এঁকে দশভূজারূপে পূজা করে থাকেন)। দেবী ও তাঁর বাহনের
সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে লাগল।
মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে
শুরু করলেন। দেবী ও তাঁর বাহন সিংহ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে একে সকল
যোদ্ধা ও অসুরসেনাকে বিনিষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ
শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রাজালিক মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত
বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন; কিন্তু দেবী সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ
করে দিলেন। তখন অসুর অহংকারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করলেন। দেবী বললেন, “গর্জ
গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম। ময়া ত্বয়ি হতেহত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু
দেবতাঃ”।। – রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুওয়ান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি
তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।।
এই বলে দেবী লম্ফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে তাঁর কন্ঠে পা দিয়ে শূলদ্বারা
বক্ষ বিদীর্ণ করে তাকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে পলায়ন করল এবং
দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন।
শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনিঃ দেবীমাহাত্ম্যম এ বর্ণিত দেবী দুর্গা সংক্রান্ত তৃতীয় ও সর্বশেষ
কাহিনিটি হল শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনি। গ্রন্থের উত্তর চরিত্র বা তৃতীয়
খণ্ডে বিধৃত পঞ্চম থেকে একাদশ অধ্যায়ে এই কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। শুম্ভ ও
নিশুম্ভ নামে দুই অসুর ভ্রাতা স্বর্গ ও দেবতাদের যজ্ঞভাগ অধিকার করে নিলে
দেবগণ হিমালয়ে গিয়ে বৈষ্ণবী শক্তি মহাদেবীকে স্তব করতে লাহলেন (পঞ্চম অধ্যায়ে
উল্লেখিত এই স্তবটি অপরাজিত স্তব নামে পরিচিত; এটি হিন্দুদের নিকট অতিপবিত্র
ও নিত্যপাঠ্য একটি স্তবমন্ত্র; “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরুপেণ সংহিতা” ও
সমরুপ মন্ত্র গুলি এই স্তবের অন্তর্গত)। এমন সময় সেই স্থানে পার্বতী
গঙ্গাস্নানে উপস্থিত হলে, আদ্যাদেবী ইন্দ্রাদি দেবতার স্তবে প্রবুদ্ধা হয়ে
তাঁর দেহকোশ থেকে নির্গত হলেন। এই দেবী কৌশিকী নামে আখ্যাত হলেন ও শুম্ভ ও
নিশুম্ভ বধের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। শুম্ভ-নিশুম্ভের চর চণ্ড ও মুণ্ড তাঁকে
দেখতে পেয়ে নিজ প্রভুদ্বয়কে বললেন যে এমন স্ত্রীলোক আপনাদেরই ভোগ্যা হবার
যোগ্য। ভণ্ড-মুণ্ডের কথায় শুম্ভ-নিশুম্ভ মহাসুর সুগ্রীবকে দৌত্যকর্মে নিযুক্ত
করে দেবীর নিকট প্রেরণ করলেন। সুগ্রীব দেবীর কাছে শুম্ভ-নিশুম্ভের কুপ্রস্থাব
মধুর ভাবে ব্যক্ত করল। দেবী মৃদু হেসে বিনীত স্বরে বললেন, “তুমি সঠিক বলেছ।
এই বিশ্বে শুম্ভ-নিশুম্ভের মতো বীর কে আছে? তবে আমি পূর্বে অল্পবুদ্ধিবশতঃ
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে আমাকে যুদ্ধে পরাভূত করতে পারবে, কেবলমাত্র তাকেই আমি
বিবাহ করব। এখন আমি প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করি কি করে! তুমি বরং মহাসুর শুম্ভ বা
নিশুম্ভকে বল, তাঁরা যেন এখানে এসে আমাকে পরাস্ত করে শীঘ্র আমার জল গ্রহণ
করেন আর বিলম্বে কি প্রয়োজন?” সুগ্রীব ক্রোধান্বিত হয়ে দেবীকে নিরস্ত হতে
পরামর্শ দিল। কিন্তু দেবী নিজ বাক্যে স্থির থেকে তাকে শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে
প্রেরণ করলেন।
দেবীর কথায় কুপিত হয়ে অসুররাজ শুম্ভ তাঁকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে
দৈত্যসেনাপতি ধূম্রলোচনকে প্রেরণ করলেন। ধূম্রলোচনের সন্মগে দেবীর ভয়ানক
যুদ্ধ হল ও সেই যুদ্ধে ধূম্রলোচন পরাজিত ও নিহিত হল। এই সংবাদ পেয়ে শুম্ভ
চণ্ড-মুণ্ড ও অন্যান্য অসুরসৈন্যদের প্রেরণ করলেন। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার
জন্য দেবী নিজ দেহ থেকে কালীর সৃষ্টি করলেন। ভামুণ্ডা ভীষণ যুদ্ধের পর
চণ্ড-মুন্ডকে বধ করলেন। তখন দেবী দুর্গা তাঁকে চামুণ্ডা আখ্যায় ভূষিত
করলেন।
চণ্ড-মুণ্ডের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সকল দৈত্যসেনাকে সুসজ্জিত করে প্রেরণ করলেন
দেবীর বিরুদ্ধে। তখন তাঁকে সহায়তার প্রত্যেক দেবতার শক্তি রূপ ধারণ করে
রণক্ষত্রে উপস্থিত হলেন। এই দেবীরা হলেন ব্রাহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী,
বৈষ্ণবী, বারাহী, নারসিংহী, ঐন্দ্রী প্রমুখ। এঁরা প্রচণ্ড যুদ্ধে
দৈত্যসেনাদের পরাভূত ও নিহত করতে লাগলেন। এই সময় রক্তবীজ দৈত্য সংগ্রাম স্থলে
উপস্থিত হল। তার রক্ত একফোঁটা মাটিতে পড়লে তা থেকে লক্ষ লক্ষ রক্তবীজ দৈত্য
সৃষ্টি হয়। এই কারণে দুর্গা কালীর সহায়তায় রক্তবীজকে বধ করলেন। কালী
রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়তে না দিয়ে নিজে পান করে নেন।
এরপর শুম্ভ আপন ভ্রাতা নিশুম্ভকে যুদ্ধে প্রেরণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর
দেবী দুর্গা নিশুম্ভকে বধ করলেন। প্রাণপ্রতিম ভাইয়ের মৃত্যর শোকে আকুল হয়ে
শুম্ভ দেবীকে বলল “তুমি গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই যুদ্ধে
জয়লাভ করেছ”। তখন দেবী বললেন, একৈবাহং জগত্যত্র কা মামপরা। পশ্যৈতা দুষ্টু
মধ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।
-একা আমিই এ জগতে বিরাজিত। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আছে? রে দুষ্ট, এই সকল দেবী
আমারই বিভূতি। দ্যাখ এরা আমার দেহে বিলীন হচ্ছে।
তখন অন্যান্য সকল দেবী দুর্গার দেহে মিলিত হয়ে গেলেন। দেবীর সঙ্গে শুম্ভের
ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হল। যুদ্ধান্তে দেবী শুম্ভকে শূলে গ্রথিত করে বধ করলেন।
দেবতারা পুনরাই স্বর্গের অধিকার ফিরে পেলেন।
কৃত্তিবাসি রামায়নঃ বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কোনো বিবরণ নেই। কিন্তু রামায়ণের
পদ্যানুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস ওঝা “কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ” এর কাহিনি
কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে সংযোজিত করেছেন। কৃত্তিবাসি রামায়ন অনুসারে, রাবণ ছিলেন
শিব ভক্ত। শিব তাঁকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন, শিবের
স্ত্রী দুর্গার পূজা করে তাঁকে তুষ্ট করতে। তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে
সহজসাধ্য হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম কল্পারম্ভ করেন। তারপর সন্ধ্যায় বোধন,
চণ্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম
কল্পারম্ভ করেন। তারপর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী,
মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮ টি নীল পদ্ম
দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাঁকে ১০৮ টি পদ্ম জোগাড় করে দেন।
দুর্গা রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। একটি পদ্ম না পেয়ে
পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলে, দুর্গা আবির্ভূত
হয়ে রামকে কাঙ্কখিত বর দেন। তবে সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে কৃত্তিবাস ওঝা
যে কাহিনি সংকলন করেছেন, তা রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনি বাল্মিকী রামায়নণে বা
রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদসমূহ যেমন, তুলসিদাস রচিত হিন্দি “রামচরিতমানস”,
তামিলভাষায় “কাম্ব রামায়ণ”, কন্নড় ভাষায় “কুমুদেন্দু রামায়ণ”, অসমিয়া ভাষায়
“কথা রামায়ণ”, ওড়িয়া ভাষায় “জগমোহন রামায়ণ”, মারাঠি ভাষায় “ভাবার্থ রামায়ণ”,
উর্দু ভাষায় “পুথি রামায়ণ” প্রভৃতিতে উল্লেখিত হয়নি। এছাড়াও যোগবিশিষ্ট
রামায়ণে উক্ত হয়নি।
মূর্তিতত্ত্বঃ বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সরাচর দেখা যায় সেটি পরিবার সমন্বিতা বা
সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও
মহিষাসুরমর্দিনী; তাঁর মুকুটের উপরে শিবের ছোট মুখ, দেবীর ডানপাশে উপরে দেবী
লক্ষ্মী ও নীচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নীচে কার্তিকেয়। কলকাতায়
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে এই স্পরিবার দুর্গার প্রচলন করেন। তাঁরা
কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদার পুত্রের, যা তৎপূর্ব ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের
আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে। এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর- সংলগ্ন অঞ্চলে
দেবী দুর্গার এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গনেশ ও
নীচে লক্ষ্মী, বামপাশের উপরে কার্তিকেয় ও নীচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে
নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া
অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গনেশকে সরস্বতী
ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও দুর্গাকে
শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী
দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা
কাঠামোবিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলায় দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দেবী
দুর্গা সপরিবারে পূজিতা হন। এই সঙ্গে স্বামী প্রমেয়ানন্দের উক্তিটি স্মরণীয়ঃ
…ধনদাত্রী লক্ষ্মী, বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী, শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্তিকেয়,
সিদ্ধিদাতা গনেশ ও তাঁদের বাহন- সকলের মূর্তিসহ মহামহিমময়ী দুর্গামূর্তির
পরিকল্পনা ও পূজা বাংলার নিজস্ব।
Essay On Durga Puja In Bengali
উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ভদ্রাকালী ও দশভূজা দুর্গারূপে।
মহিষাসুরের অনুরোধে মহিষাসুর দুর্গার উক্ত তিন ধরনের মূর্তির সাথে পূজিত
হয়ে থাকেন।
সতী রূপ : [সৎ +ঈ (ঙীপ)। স্ত্রীলিঙ্গ।]
বিভিন্ন পুরাণ মতে– এই দেবী দক্ষের কন্যা হিসাবে সতী নামে পরিচিতা। কালিকা
পুরাণ মতে– দক্ষ মহামায়াকে [দুর্গা] কন্যারূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা
করেন। দক্ষের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহামায়া দক্ষকে বলেন, –তিনি অবিলম্বে তাঁর
(দক্ষের) পত্নীর গর্ভে তাঁর কন্যারূপ জন্মগ্রহণ করবেন এবং মহাদেব-এর স্ত্রী
হবেন। তবে তাঁকে (দুর্গাকে) যথাযথ সমাদর না করলে তিনি দেহত্যাগ করবেন। এরপর
দক্ষ অসিক্লী-কে বিবাহ করেন। বীরিণী’র গর্ভে মহামায়া জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষ
এঁর নাম রাখেন সতী। [১-৪৪। অষ্টমোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]
সতী যৌবনে পদার্পণ করলে, মহাদেব-এর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু
মহাদেব দক্ষকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন না করায় ইনি ক্রমে ক্রমে মহাদেবের
প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেন। বিবাহের এক বৎসর পর, দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন।
এই যজ্ঞে দক্ষ মহাদেব ও সতী কাউকেই নিমন্ত্রণ করলেন না। সতী নারদের মুখে এই
যজ্ঞের কথা জানতে পেরে অযাচিতভাবে যজ্ঞে যাবার উদ্যোগ নেন। মহাদেব এই
যাত্রায় সতীকে বাধা দেন। এতে সতী ক্রুদ্ধ হয়ে– তাঁর মহামায়ার দশটি রূপ
প্রদর্শন করে মহাদেবকে বিভ্রান্ত করেন। এর দশটি রূপ ছিল– কালী, তারা,
রাজ-রাজেশ্বরী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামূখী, মাতঙ্গী ও
মহালক্ষ্মী। মহাদেব শেষ পর্যন্ত সতীকে দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে যাবার অনুমতি
প্রদান করেন। কিন্তু যজ্ঞস্থলে দক্ষ মহাদেবের নিন্দা করলে– সতী পতি নিন্দা
সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। সতীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ মহাদেব
নিজের জটা ছিন্ন করলে, বীরভদ্র জন্মলাভ করেন। পরে বীরভদ্র দক্ষের যজ্ঞ পণ্ড
করে মুণ্ডুচ্ছেদ করেন।
এরপর মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। এর ফলে সৃষ্টি
ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হলে, বিষ্ণু তাঁর চক্র দিয়ে সতীদেহকে একান্নভাগে বিভক্ত
করে দেন। এই ৫১টি খণ্ড ভারতের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়। ফলে পতিত প্রতিটি খণ্ড
থেকে এক একটি মহাপীঠ উৎপন্ন হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতিটি মহাপীঠকে
পবিত্র তীর্থস্থান হিসাবে বিবেচনা করেন। দেখুন :
পীঠস্থান
কালিকা পুরাণের মতে: ব্রহ্মা, বিষ্ণু শনি যোগবলে সতীর দেহে ঢুকে এই দেহকে বিভাজিত করেন। এই
বিভাজিত অংশগুলির মধ্যে– দেবীকূটে পদযুগল, ঊড্ডীয়ানে উরুযুগল, কামপর্বতে
যোনিমণ্ডল, এর পূর্বভাগে নাভিমণ্ডল, জলন্ধরে সুবর্ণহার শোভিত স্তনযুগল,
পূর্ণগিরিতে স্কন্ধ ও গ্রীবা এবং কামরূপের শেষভাগে মস্তক। সতীর অন্যান্য
দেহাংশ খণ্ড খণ্ড করে দেবতারা আকাশগঙ্গায় নিয়ে যান। [৪০-৪৬। অষ্টাদশোহধ্যায়,
কালিকাপুরাণ]
পার্বতী রূপ : দুর্গার একপর্ণিকা, অপর্ণা, উমা, গৌরী নামপ্রাপ্তি
দেহত্যাগের পর সতী মহাদেব-এর পত্নী হওয়ার কামনায় হিমালয়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ
করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এরপর যথাসময়ে ইনি হিমালয়ের ঔরসে মেনকার গর্ভে
জন্মগ্রহণ করলেন। হিমালয় পর্বতের কন্যা বলে ইনি পার্বতী নামে অভিহিত হন।
অচলের (পর্বতের) কন্যা বলেই তাঁর অপর নাম অচলকন্যা। একই অর্থে এঁর অপরাপর
নাম– অগত্মাজা, অচলনন্দিনী, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, অদ্রিনন্দিনী।
পূর্বজন্মে ইনি দক্ষের কন্যা ছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল সতী এবং তাঁর স্বামী
ছিলেন শিব বা মহাদেব। এই জন্মে ইনি মহাদেবকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য
তপস্যা শুরু করেন। তপস্যার জন্য এই সময় মহাদেব হিমালয়ে এলে, পার্বতী মহাদেবের
পূজা আরম্ভ করেন। মহাদেব এই সময় ধ্যানে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, পার্বতীর এই
পূজাকে উপলদ্ধি করতে পারলেন না। এদিকে তারকাসুর দেবতা ও মানবকুলের উপর
অত্যাচার শুরু করলে, সকলে মিলে এর প্রতিকারের জন্য ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন।
ব্রহ্মা তাদের জানলেন যে, একমাত্র মহাদেবের পুত্র এই অসুরকে হত্যা করতে
পারবেন। সে কারণে, মহাদেবের সাথে পার্বতীর বিবাহ হওয়া প্রয়োজন। ব্রহ্মার
ভবিষ্যৎ-বাণী অনুসারে দেবতারা মহাদেবের ধ্যানভঙ্গের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন এবং
প্রেমের দেবতা মদনদেবকে [কামদেব] মহাদেবের কাছে পাঠালেন। কামদেব কামবাণ
নিক্ষেপ করে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ করলে, মহাদেবের তৃতীয় নয়নের তেজ দ্বারা ইনি
ভষ্মীভূত হন। এরপর মহাদেব আরাধনার জন্য অনত্র্য চলে যান। এরপর গভীর দুঃখে
পার্বতী কাতর হয়ে পড়লে নারদ এসে পার্বতীকে জানালেন যে, তপস্যার দ্বারা
মহাদেবের পূজা করলেই ইনি তাঁকে লাভ করবেন।
Durga Puja Paragraph Bengali
এরপর মহাদেবকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য ইনি কঠোর তপস্যা শুরু করেন।
গ্রীষ্মের কঠোর উত্তাপ ও শীতকালের প্রচণ্ড শীতকে বরণ করে আত্মপীড়নের মধ্যে
এই সাধনা অব্যাহত রাখেন। তপস্যাকালে ইনি খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেন।
একসময় তিনি শুধুমাত্র গাছের পাতা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতে থাকেন। এই কারণে,
পার্বতী একপর্ণিকা নামে অভিহিত হন। এরপরও পার্বতী মহাদেবকে স্বামী হিসাবে
পেলেন না। এরপর ইনি গলিতপত্র পর্যন্ত গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত করলেন। তখন ইনি
অপর্ণা নামে পরিচিতি লাভ করেন। এই কঠোর তপস্যা দেখে তাঁর মা মেনকা বলেছিলেন-
উ (হে পার্বতী) মা (না, তপস্যা কোরো না)। সেই থেকে ইনি উমা নামে পরিচিত
হন।পরে তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে পার্বতীর কাছে
উপস্থিত হয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন। পার্বতী বৃদ্ধকে স্নান করে এসে আহার
গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন। বৃদ্ধবেশী মহাদেব গঙ্গায় স্নান করতে গেলে একটি মকর
(পৌরাণিক মৎস্য বা কুমির) আক্রমণ করে। বৃদ্ধ উমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা
করলে– পার্বতী বৃদ্ধকে রক্ষা করার জন্য অগ্রসর হন। এই সময় মহাদেব তাঁর
স্বমূর্তি ধারণ করে পার্বতীর হাত ধরেন। পার্বতী বিষয়টি তাঁর পিতা হিমালয়কে
জানালে– হিমালয় পার্বতীকে মহাদেবের হাতে সমর্পণ করেন। তপস্যার দ্বারা ইনি
মহাদেবকে প্রসন্ন করেন বলে– এঁর অপর নাম গৌরী।বিবাহের পর এঁরা হিমালয়ের
কৈলাশ, মন্দর প্রভৃতি পর্বতে আমোদ-প্রমোদে রত ছিলেন। একবার অন্ধক নামক অসুর
এখানে উপস্থিত হলে– মহাদেব শূলের আঘাতে অন্ধককে হত্যা করেন। মহাদেবের তৃতীয়
নয়নের উৎপত্তি নিয়ে একটি গল্প আছে। পার্বতী একবার পরিহাস ছলে শিবের দুই চোখ
হাত দিয়ে আবৃত করলে– সমগ্র চরাচর অন্ধকার হয়ে যায়। জগতকে আলোকিত করার জন্য
তাঁর তৃতীয় নয়নের উদ্ভব ঘটে। এই তৃতীয় নয়নের জ্যোতিতে হিমালয় ধ্বংস হয়ে
গেলে– পার্বতীর অনুরোধে তা আবার পুনস্থাপিত হয়। তবে এটি প্রক্ষিপ্ত কাহিনী
বলেই মনে হয়। কারণ– পার্বতীর সাথে শিবের বিবাহের পূর্বেই তাঁর তৃতীয় নয়নের
তেজে কামদেব ভস্মীভূত হন।
কালিকা পুরাণ মতে: দুন্দুভি নামক জনৈক দৈতরাজ, ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে– দেবতাদের পরাজিত
করেছিলেন। কৈলাসে মহাদেব ও পার্বতীকে [দুর্গা] একত্রে ভ্রমণ করার সময়
পার্বতীকে দেখে মোহিত হন, এবং তাঁকে অধিকার করার চেষ্টা করলে- মহাদেবের
অগ্নিদৃষ্টিতে ইনি ভস্মীভূত করেন। [চতুর্থোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]
দুর্গার বিভিন্ন রূপ ও নাম তালিকা
অগসূতা, অগাত্মজা, অতসীপুষ্পবর্ণাভা, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, অনন্তা, অনাদ্যা,
অন্নদা, অন্নপূর্ণা, অপরাজিতা, অপর্ণা, অব্যয়া, অভয়া, অমোঘা, অম্বা,
অম্বালা, অম্বালিকা, অক্বিকা, অষ্টভুজা, অসুরনাশিনী, আদিদেবী, আদিভুতা,
আদ্যা, আদ্যাশক্তি, আনন্দময়ী, আর্যা, ঈশানী, ঈশ্বরী, উমা, কপর্দিনী,
কাত্যায়নী, কাণ্ডবারিণী, কামাক্ষী, কৈলাশবাসিনী, কৌশিকী, ঈশানী, গিরিকুমারী,
গিরিজা, গিরিনন্দিনী, গিরিবালা, চণ্ডবতী, জগদক্বা, জগদ্ধাত্রী, জগন্ময়ী,
জগন্মাতা, জয়ন্তী, জয়া, গিরিসূতা, গৌতমী, গৌরী, চণ্ডী, চামুণ্ডা, জগজ্জননী,
জগদ্গৌরী, জ্বালমালিনী, তারিণী, ত্রিগুণা, ত্রিনয়না, ত্রিনয়নী ত্রিশূলধারিণী,
ত্রিশূলিনী, দক্ষকন্যা, দক্ষজা, দশভুজা, দাক্ষায়ণী, দনুজদলনী, দানবদলনী,
দুর্গা, নগনন্দিনী, নন্দা, নিস্তারিণী,পরমাপ্রকৃতি, পরমেশ্বরী, পর্বতদুহিতা,
পর্বতসূতা, পার্বতী, প্রকৃতি, বভ্রবী, বাভ্রবী, বাসন্তী, বিজয়া,
বিন্ধ্যবাসিনী, বিশ্বেশ্বরী, ভগবতী, ভদ্রকালী, ভদ্রাণী, ভবতারিণী, ভাস্বতী,
মঙ্গলা, মহাদেবী, মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহাশক্তি, মঙ্গলচণ্ডী,
মহিষাসুরমর্দিনী, মহেশানী, মহেশী, মোক্ষদা, যোগমায়া, রাজরাজেশ্বরী,
রুদ্রাণী, সতী, সর্বজ্ঞা, সাবিত্রী, শঙ্করী, শরণ্যা, শর্বাণী, শাকক্ভরী,
শারদা, শিবপত্নী, শিবপ্রিয়া, শিবা, শিবানী, শুভঙ্করী, শুভচণ্ডী, শূলিনী,
শৈলজা, শৈলসূতা, শৈলেয়ী, সনাতনী, সর্বজয়া, সর্বমঙ্গলা, সর্বাণী,
সর্বার্থসাধিকা, সাত্তি্বকী, সিংহবাহিনী, সুরেশ্বরী, হিমালয়নন্দিনী,
হৈমবতী।
দুর্গার দশ মহাবিদ্যা : কমলা, কালী, ছিন্নমস্তা, তারা, ধূমাবতী, বগলা, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী,
মাতঙ্গী, ও ষোড়শী।
দুর্গার ত্রিশক্তি : কালী, তারা ও ত্রিপুরা।
দুর্গার নয়টি মূর্তি : কাত্যায়নী, কালরাত্রি, কুষ্মাণ্ডা, চন্দ্রঘণ্টা, পার্বতী,
ব্রহ্মচারিণী, মহাগৌরী, সিদ্ধিদা ও স্কন্দমাতা।
দূর্গা পূজার মন্ত্র
সংস্কৃত মন্ত্রগুলি। দূর্গা পূজার মন্ত্র গুলি সাধারণত শ্রী শ্রী চণ্ডি
থেকে পাঠ করা হয়। ঢাক-ঢোল, খোল করতাল, সুগন্ধী আগর বাতি তার সাথে এই
সংস্কৃত মন্ত্রগুলি এক পবিত্র পরিবেশের জন্ম দেয়।
দূর্গা পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার মন্ত্র
ঔঁ জয়ন্তি মঙ্গলা কালী,
ভদ্র কালী কপালিনী,
দূর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী,
স্বাহা স্বধা নমস্তুতে।
দূর্গা প্রণাম মন্ত্র
শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে
Durga Puja,
Bengali Festival,
Kolkata