রাঙিয়ে নিয়ে যাও
– সাগরিকা ভঞ্জ
—“কি হয়েছেটা কি সাতসকালে?”–রূপম চোখ ঘষতে ঘষতে বেলা দশটার সময় ঘুম থেকে উঠে
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল মায়ের দিকে।
—-“দেখে যা, দেখে যা তোর বউয়ের দিকে,সাত সকালে রঙ মেখে বসে আছে।”
—“কি?’ –জিজ্ঞেস করতে করতে এসে দেখে তার স্ত্রীর সারা মাথা ভরা আবির,মুখ
পুরো রঙে ঢাকা।গলায়,শাড়িতে আবির ঝরে ঝরে পড়ছে।
ছুট্টে এসে বউয়ের চুলের মুঠি ধরে বললো,—“কে, কে মাখালো রঙ তোকে? বল।কোনো
ছোঁড়া নয়তো?”
—-“নয়তো আবার কি? বিমলার দাদাটা এসেছিল তো সাথে…।”
কাঁদতে কাঁদতে শিউলি বলে উঠলো,—“মিথ্যে কথা বলবেননা মা।সে আমার সামনে পর্যন্ত
আসেনি দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল।বিমলাই…।”
—-“দেখলি দেখলি রূপু মুখে মুখে কেমন চোপা।…এমনি করে,এমনি করে আমাকে
সারাদিন। তোরা তো থাকিসনা।কি করে জানবি কি অলুক্ষুনে মেয়ে… আমার তো কোনো কথাই
শোনেনা।তারপর আবার কিছু বলতে গেলেই মুখ করে।”—বলেই মিছি মিছি কাঁদতে থাকলো
রূপুর মা।
রূপম রাগে গরগর করতে করতে বলে,—-“ওই ওই, আমার মায়ের মুখের ওপর কথা বলিস? কার
গিলিস রে?গিলে গিলে গতরটা তো বেশ বাগিয়েছিস। আমি ছুঁয়েও দেখিনা।কার পূজায়
লাগে?”
—-“বাজে কথা বলবেনা একেবারে।”
—“এই এই তেজ দেখাচ্ছিস তেজ..।সালি তোকে আজ কে রক্ষা করবে…।”
বলেই একরকম ছুঁড়ে ফেলে দেয় বউকে কুঁয়াতলে।আর এলোপাথাড়ি মারতে থাকে চড়
ঘুষি,লাথি।
—-“আবার রঙ মাখা হয়েছে,রঙ।”
চিৎকার করে আর্তনাদ করে কাঁদছে শিউলি।না ওকে বাঁচানোর কেউ নেই। এটা এদের নিত্য
দিনের ব্যাপার। যে বাধা দিতে যাবে,সেই গাল খাবে।
—-“আর নয় আর নয় রূপু,এবার মরে যাবে।মরে গেলে পুলিশ কেস হবে,ছাড়।”
বসন্তের ছোট গল্প
আজ একবছর আগে রূপুর যখন বিয়ে হয়,এমনি সুন্দর মেয়ে তবুও রূপুর পছন্দ
হয়নি,কারণ পাড়ায় এক দুই বাচ্চার মা বিধবার সাথে তার অনেকদিনের সম্পর্ক।কিন্তু
লোকে কি বলবে বলে মা বোঝায়,—“এই মেয়েটা সুন্দর। অনেক টাকাও দেবে।বিয়েটা কর।”
—“ওকে আমি কোনোদিন মেনে নিতে পারবোনা মা।”
—-“দেখ তোর বাবা তোর এইসব বেলেল্লাপনা দেখে অসুস্থ হয়ে গেল।এখন যদি মরে
যায়,একটা দুঃখ রয়ে যাবে…তাছাড়া তোকে মানতে কে বলেছে? ঘরে তো একটা বিনে পয়সার
কাজের লোক চাই তো নাকি।”
রাজি হয়েছিল রূপম।কিন্তু ফুলসজ্জার দিনও সে সেই বিধবার বাড়িতে রাত কাটিয়ে আসে।
মামাতো বোন লতা রূপুদেের ঘরেই মানুষ। এখান থেকেই পড়াশোনা করে। শুধুমাত্র ওর
সাথেই শিউলির মধুর সম্পর্ক,তবে চুপিচুপি। বাপের বাড়ি যেতে দেয়না। অনেক কষ্টে
একবার গিয়েছিল। যাহোক করে একরাত কাটিয়েই বউকে নিয়ে ফিরেছিল রূপম।
ভয় দেখায়, এবার বাপের বাড়ি গেলে আর আনতে যাবেনা কেউ।ওখানেই থাকবি।শিউলি ভয় পায়
ওই তো গরিব বাবা,রূপের জোরে বড়বাড়িতে বিয়ে হয়েছে বলে তার কত গরব,পাড়ায় পাড়ায়
বলে বেড়ায়।
বরকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় জানেনা সে।সেই ভয়ানক দৃষ্টির সামনে সে
ভীতসন্ত্রস্ত।
শ্বশুর খেয়াল রাখে তার।মেয়ের মতো কাছে বসিয়ে ছেলেমানুষী গল্প শোনে শিউলির।
যখন শ্বশুর বাড়িতে থাকে বোঝাই যায়না এত অত্যাচারিত শিউলি।স্বামী বেশীরভাগ দিন
মধ্যরাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরলে দরজা বন্ধ করে মারে ওকে।
সেদিন বাড়িতে ছিলনা শ্বশুর মশাই। ব্যবসার কাজে উড়িস্যা যেতে হয়েছিল তাকে।লতাকে
বলে গিয়েছিল, -“বৌমাকে দেখবি।”
কিন্তু লতা যাবেনা যাবেনা করেও শেষে শিউলির কথাতেই চলে গিয়েছিল কলেজের বসন্ত
উৎসবে।
আর সেই সুযোগটা হাতছাড়া করতে পারলোনা রূপুর মা।শিউলিকে নিয়ে যে তার কিসের এত
জ্বালা বুঝিনা।এমন লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো মেয়ে মুখ বন্ধ করে সারাদিন কাজ শুধু কাজ
করে যায়।
মনে কি তার ফাগুন হাওয়া বয়নি। বয়।আজকাল তো প্রতিনিয়ত বয়।সেই ভালোলাগাতেই তো তার
কাজের ইচ্ছে বাড়ে।
ছ’মাস আগে পূজার চাঁদা চাইতে এসেছিল পাড়ার আর ক’জন ছেলের সাথে
অঙ্কিত।অঙ্কিত মিলিটারি চাকরি করে। থাকে দিল্লিতে।এসে কলিং বেল বাজাতেই দরজা
খুলেছিল শিউলি।বউটির রূপ দেখার সাথে সাথে মুখ ঝামটাও সেদিন শুনেছিল।
—-“কানের মাথা কি গেছে? কলিংবেল বাজছে,শুনতে পাচ্ছোনা।কালার বেটি কোথা থেকে
এসে জুটেছে আমার কপালে,জ্বলিয়ে খেল একেবারে। ”
—-“যাই মা।এই হাতটা ধুয়েই যাচ্ছি।”
—“হাত আর ধুতে হবেনা, ওই বাম হাতেই খোলো।”
আটা মাখছিল শিউলি। সেই হাতেই খুলে দিল।
খুলেই চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেল সে। তার কপালে, কপালের কাছে চুলে, ডান হাতে আটা
মাখা।
—-“চাঁদাটা।”
—-“মাকে ডেকে দিচ্ছি। “
বসন্তের প্রেমের গল্প
সেদিন বাড়ি ফিরে বিমলার মুখে শুনেছিল সব,—“শিউলি বৌদির তুই শুধু
রূপটাই দেখলি,ওর দুঃখটা যদি শুনিস,পাষাণও গলে যাবে।”
সেদিন অঙ্কিত সব শুনেছিল।শিউলি লুকিয়ে লুকিয়ে বিমলার ফোন থেকে
বাপেরবড়িতে ফোন করতো।ফোন করে বলতো সে ভালো আছে।আর তার বাপের বাড়ির কারো এখানে
আসার দরকার নেই। এরা পছন্দ করেনা।লতা ছিল বিমলার প্রিয় বন্ধু। তারপর একদিন
বিমলার আর লতার সাথে শিউলির কয়েকটা সেলফি দেখে অঙ্কিত।সেখান থেকেই তার
পূর্বরাগের সূচনা অথবা রাক্ষস পুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করার চেস্টাও
বলতে পারো।
ক্রমে শিউলিও জেনে গিয়েছিল। সেও মনে মনে… কিন্তু প্রকাশ হয়নি
কোনোদিন। দুজন দুজনকে বুঝতো।খোঁজ খবর চলতো তবে সবই গোপনে।
আবার হোলির ছুটিতে এলো অঙ্কিত। বিমলা গত পরশু লতার কাছে আসার ছলে শিউলি
বৌদির কাছে গিয়ে কানে কানে বলেছে,—“দাদা এসেছে কিন্তু,… তোমাকে রঙ মাখাবে।”
সারা শরীর জুড়ে শিহরণ জেগেছিল শিউলির।
—-“আমার বয়েই গেছে রঙ মাখতে।”
—“সত্যি আসবে গো,মিথ্যে বলিনি।”
একটু ভয় পেয়ে যায় শিউলি।ভয়ে বলে ওঠে,—“না না তাহলে এরা…।”
—“ও…ওই যুটিলা,আর আয়ান ঘোষ কিচ্ছুটি করতে পারবেনা আমার দাদার।আমার দাদা
মিলিটারি ম্যান আছে…।”
না সে রঙ লাগায়নি কোথাও।সত্যিই সে দূরে ছিল দাঁড়িয়ে। বিমলা দিয়েছিল রঙ,
আর সে দূর থেকে দেখেছিল তার রঙিন লাজুক রাইকিশোরীকে।
অসুস্থ হয়ে প্রায় অজ্ঞানের মতোই পড়ে রইল শিউলি।লতা সেই সময়
ফিরছিল কলেজ থেকে,
—-“একি! একি! বৌদি এখানে পড়ে কেন?”
অসুর তখন মেরে হাঁপিয়ে পাড়ার দিকে রঙ নিয়ে চলে গেছে।
—-“পিসি! বৌদির কি হয়েছে?”
চিৎকার করে কেঁদে বললো, —“কেউ আছো? এসোনা একবার…।”
—-“কি হয়েছে লতা? আমি তো কিছু জানিনা…এমা! বৌমা এখানে পড়ে কেন?তাহলে রূপুর
সাথে কিছু ঝগড়া হয়েছে মনে হয়।”
শিউলিকে উঠিয়ে বসালো লতা।আসেপাশের বাড়ির কিছুজন এলো তখন। ওরা জানে এদের বাড়ির
মা-ছেলের সব কাণ্ড কারখানা। তাই কথা না বাড়িয়ে ভর্তি করে দিল হাসপাতালে।
—-“এমা! কিভাবে মেরেছে বৌটাকে।…ওই মা-বেটাকে জেলে ঢোকানো উচিত।”
খবর যখন অঙ্কিতের কাছে গেল তখন শিউলি হাসপাতালে।ছুটেছে সে বোনের সাথে।
আবির মাখা অবশ শরীর তখন হাসপাতালের বেডে।অঙ্কিত বসলো গিয়ে পাশে।শিউলি তাকালো
একবার, তারপর আলতো হাসলো। অঙ্কিত বললো,
—-“আর কতদিন? কতদিন এভাবে চলবে?”
উত্তর দিলনা শিউলি।মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।অঙ্কিত বললো,—” কাল আগে
থানাতে নিয়ে যাবো।”
শিউলি তেমনি মৃদু হাসিতে ওর দিকে তাকিয়েই রইল।
—-“এখনোও তোমার হাসি বেরোচ্ছে?… দেখো আমি শেষ কথা বলে দিলাম,কাল সকালে আগে
তোমায় থানাতে নিয়ে যাবো,আর তারপর…। ”
—“তারপর? তারপর কি?”
—-“এখন তো বলবোনা।পরে দেখতে পাবে কি করি।”
—-“তোমার তো কালই ফিরে যাওয়ার টিকিট তাইতো?”
—-“হ্যাঁ।”
—-“তাহলে আর কি…আবার কবে আসবে?”
—-“কথা দিতে পারো পরে যেদিন ফিরে আসবো,জীবিত থাকবে?”
—-“নিশ্চয়ই।”
—“কিন্তু আমি আর তোমাকে বিশ্বাস করিনা।এবার আমি যা করার করবো,তোমাকে মানতে
হবে।… আচ্ছা আমি তো তোমাকে রঙ মাখাইনি তবে কেন এই অত্যাচার। কাল সুস্থ হয়ে
ওঠো মিথ্যে অপবাদ সত্যি করে দেবো তোমাকে রঙিন করে।”
রূপমের খবর আর আমি জানিনা।তবে পরেরদিন চারদিকে রটে গিয়েছিল
ঘোষালদের বাড়ির ছেলেটার সাথে রূপমের বউ পালিয়েছে।পাড়ার সবাই যে শুনেছে
সেই বলেছে,–” ঠিক করেছে।”
——————