Reunion – রিইউনিয়ন – Bangla Golpo – Bengali Story

Bongconnection Original Published
19 Min Read


    Reunion – রিইউনিয়ন – Bangla Golpo – Bengali Story

 

Reunion%2BGolpo 6488
Loading...

রি- ইউনিয়ন 

Loading...
        
   ” বাবাআআআ,ও বাবা—দেখোনা একটু বাইরে এসে।এই কাকু টা তোমাকে
খুঁজছে।”
        ফুচকা গুলো ভেজে ভেজে ঝুড়ির মধ্যে সাজিয়ে
রাখছিলো সুবল।এই সময়ে তার আর মলিনার নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। দেড়টার মধ্যে
দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে দুজনে মিলে বেছে নিয়েছে এই ঘন্টা তিনেক সময়।মলিনা
একদিকে বেলতে থাকে —আর চটপট ভেজে ফেলে সুবল।তারপর আবার আছে পুর তৈরি করার
হ্যাপা।ওটা অবশ্য পুরোপুরি মলিনার ডিপার্টমেন্ট।সুবল ঐ ব্যাপারে মাথা ঘামায়
না।আলুসেদ্ধ,কুঁচোনো পেঁয়াজ,সেদ্মমটর,লঙ্কাকুচি , ধনেপাতা,নারকেলের টুকরো দিয়ে
মলিনা এমন অসাধারণ একটা পুর তৈরি করে যে ছোট ছোট মেয়েগুলো একটু বেশী করে পুর
দেওয়ার কথা বারবার বলতে থাকে।বলতে গেলে এই স্পেশাল পুরের জন্যই সুবলের ফুচকার এ
তল্লাটে এতো নাম ডাক।তাও তো মাঝ দিয়ে এই ফুচকার ভ্যান লাগানো বন্ধ হয়েই
গেছিলো।2020- র এপ্রিল থেকে পুরো বছরটা যে কিভাবে কেটেছে,ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে
হয়।তাও এই আনলক শুরু হওয়ার পর ভগবান আবার একটু মুখ তুলে তাকিয়েছেন।সাড়ে পাঁচটার
মধ্যে তে- মাথার মোড়ে ফুচকার ঠেলাটা নিয়ে যে করেই হোক পৌঁছতে হয়।বারবার মলিনাকে
তাড়া দিতে থাকে সুবল।কিন্তু এই সময়ে মেয়েটা আবার চীৎকার করে কেন?—-” কি রে
মা?ডাকছিস কেন? কে খুঁজছে আমাকে?”
” নিজে এসেই দেখে যাও না বাপু।আমি এখন খেলা ছেড়ে ভেতরে যেতে পারবো না “—-চটপট
জবাব ভেসে আসে পিঙ্কির।
  অগত্যা উঠতেই হয় সুবল কে।তারে মেলা গামছা টা গায়ে জড়িয়ে বাইরে এসে
দাঁড়ায়–” দেখি ভর দুপুরে কোন সুমুদ্দির পো আমাকে খুঁজতে এলো।”
    কিন্তু বাইরে এসে সুবলের অবাক হবার পালা।পোস্ট অফিসের পিয়ন বাবু
দাঁড়িয়ে আছেন চিঠির ব্যাগ হাতে নিয়ে—” আপনিই তো সুবল ব্যানার্জি? আপনার নামে
একটা রেজিস্ট্রি চিঠি আছে।আপনার ঘর খুঁজে বের করতেই আমার আধঘণ্টা চলে
গেল।নিন,তাড়াতাড়ি সই করুন দেখি।”

   অবাক হয় সুবল।ইহলোকে এমন কে মানুষ আছে ,যে তাকে রেজিস্ট্রি ডাকে
চিঠি পাঠাবে?থাকার মধ্যে আছে তো এক দিদি।সে অবশ্য মাঝে মধ্যে ফোনে খবর টবর
নেয়।আর আছে মলিনার বাপের বাড়ির লোকজন।তারা অন্তত এমন খরচ করে চিঠি পাঠানোর কথা
মাথাতেও আনবে না।

Bangla Golpo

   চিন্তা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাওয়াতে খাওয়াতেই সই করে চিঠিটা হাতে
নিলো সুবল। বেশ লম্বা সুদৃশ্য একটা খাম।বাঁ দিকে মনোগ্রাম করে লেখা—”
পুনর্মিলন উৎসব কমিটি,1990 হায়ার সেকেন্ডারি ব্যাচ,ভুবনডাঙা উচ্চ মাধ্যমিক
বিদ্যালয়, মেমারি,বর্ধমান। ডান দিকে গোটা গোটা হরফে তো তারই নাম লেখা। 
   ” চশমা টা দাও তো দেখি “—-চিঠিখানার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো
সুবল।বাংলায় টাইপ করে পুরো চিঠিটা লেখা।আগামী সতেরো ই জানুয়ারি  ( রবিবার)
কলকাতার ইকো পার্কে 1990 এর হায়ার সেকেন্ডারি ব্যাচের সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের
পুনর্মিলন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।সে এবং তার পরিবারের সদস্যরা যেন অতি অবশ্যই
আসে।মাস্ক এবং স্যানিটাইজার সঙ্গে আনা বাধ্যতামূলক।
    এক ধাক্কায় পিছোতে পিছোতে একেবারে 1983/84 তে পৌঁছে গেলো
সুবল।মনে পড়ে গেল, স্কুলের গেটের পাশে সেই বাহারি ঝুমকোলতা গাছ।ওপরে সাদা
বোর্ডের ওপর নীল হরফে লেখা—-
   ” ভুবনডাঙা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, Estd–1942।
পঞ্চাশ বছরের বিবর্ণ, মরচে পড়া সুবল হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগলো সেই বারো তেরো
বছরের কিশোর সুবলকে।সেই রংচটা একটা স্কুল ব্যাগ আর হাফ দাম দিয়ে কেনা বই নিয়ে
টিকে তো ঐ স্কুলে—সাত আট বছর।বাবার হাত ধরে যেদিন প্রথম এসেছিলো স্কুলে সেই
দিনের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সুবলের।কেমন যেন চোরের মতো মুখ করে গেট পর্যন্ত
এসেছিলো বাবা।ছেলের শত কাকুতি মিনতিতেও ভেতরে যাওয়ার স্পর্ধা দেখায়নি।একটু
উঁচুতে উঠে বুঝেছিল সুবল–কেন বাবা ভেতরে ঢুকতে চায় নি।ভ্যান চালক বাবাদের কি
আর ভেতরে ঢোকা মানায়?ওখানে তো ঢুকবে কেউকেটা গার্জেন রা।চুপচাপ ক্লাস ফাইভের
রুমে ঢুকে পেছনের বেঞ্চে বসে পড়েছিলো সুবল।প্রথম ক্লাস শুরু হতে ব্যাগ থেকে
ধীরে ধীরে বের করেছিল খাতা আর পেন।
পাশ থেকে একটা মুচকি হাসি ভেসে এসেছিলো।সাথে একটা কথা—” বাঁধানো খাতা কিনতে
পারিস না?এইসব কাগজ সেলাই করা খাতা আজকাল কেউ আনে?
   সুবল কোন উত্তর দেয়নি।উত্তর দেওয়ার মতো কিছু ছিলোও না তার
হাতে।ক্লাসে পড়ানোর দিকে মন দিতে চেয়েছিলো।
   হঠাৎই বাংলার স্যার একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ছিলেন ক্লাসের দিকে—”
শর শব্দটা নিশ্চয়ই শোনা আছে তোমাদের।বলোতো এর মানে কি?

Bangla Golpo Lyrics

     পুরো ক্লাস নিশ্চুপ।এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।সামনের
বেঞ্চে বসা বৃত্তি পাওয়া ছেলে– কিংশুক, শৌভিক—-সবাই চুপ।হঠাৎই পেছনের বেঞ্চে
বসা সুবল উঠে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে—” স্যার, শর মানে হলো তীর।
ক্লাসের সব চোখগুলো ঘুরে গেল সুবলের দিকে।লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো
সুবল।
     তারিফ ঝরে পড়লো বাংলা শিক্ষকের গলায়—-
—” বাহহহ,ভেরি গুড।আচ্ছা এই একই উচ্চারণে ভিন্ন শব্দ,এবং তাদের অর্থ– তোমার
জানা আছে কি?”
” হ্যাঁ স্যার “—-ধীর গলায় উত্তর দিয়েছিলো সুবল—” স্বর মানে গলার আওয়াজ আর
সর মানে দুধের সর।”
” বাহহহ,দারুণ উত্তর দিয়েছো বাবা, কি নাম তোমার?”—অমল বাবুর গলায় তারিফ ঝরে
পড়ে।
” তুই তো ছুপা রুস্তম রে”—পাশ থেকে আবার আওয়াজ ভেসে এসেছিলো—” আজ থেকে আমি
তোর বন্ধু হয়ে গেলাম।আমার নাম মিহির সরখেল।অবশ্য সব টীচাররা আমাকে ” পুরোনো
পাপী” বলে ডাকেন।কারণ এই ক্লাসেই তো দু বছর ধরে রয়ে গেছি।একটা ভালোবাসা জন্মে
গেছে বুঝলি?এবার অবশ্য তোর সাথে ঝুলে পড়লাম।পারলে একটু উতরে দিস ভাই।”
পাশ ফিরে দেখেছিলো সুবল।একটা বেশ ষন্ডা মার্কা ছেলে বসে আছে।গলার স্বরে বেশ
একটা ভাঙা ভাঙা ভাব।বন্ধুত্ব হতে দেরী হয়নি।

   টিফিন পিরিয়ডে এগিয়ে এসেছিলো চশমা পরা একটা ছেলে—” আমাকে চিনে
রাখ,আমার নাম কিংশুক মজুমদার।তুই যতই আজ টপাটপ উত্তর দিস–ফার্স্ট কিন্তু আমিই
হবো।এই সব বই খাতা নিয়ে তুই আমাদের সাথে কম্পিটিশন করার চেষ্টা করিস না।”
মুখ না তুলেই উত্তর দিয়েছিলো সুবল–” না না,আমি কখনোই তোমাদের সাথে পারবো না।আজ
হঠাৎ উত্তর গুলো জানা ছিল বলে বলতে পারলাম। তোমরাও নিশ্চয়ই পারতে।”
   কিন্তু ছাই দিয়ে কখনোই আগুন কে চেপে রাখা যায় না।ফাঁক ফোকর দিয়ে
সে মাথা তোলার চেষ্টা করবেই।তাই সবাইকে অবাক করেই স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষায়
সুবল হলো সেকেন্ড।কিংশুক অবশ্য এগারো নাম্বার বেশী পেয়ে ফার্স্ট হলো।
   সারা স্কুলে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক হইচই পড়ে গেলো।কোথাকার কোন
অখ্যাত ছেলে—যে কিনা টিফিনে লুকিয়ে লুকিয়ে গুড় দিয়ে শুকনো রুটি খায়,যার কিনা
নতুন বই কেনার সামর্থ্য নেই—সে হবে সেকেন্ড!!ক্লাসের এলিট সম্প্রদায়ের ছেলেরা
সেটা মানবে কেন?তাই প্রতিটি ক্লাসেই নানাভাবে তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা শুরু
হলো।
     কোন কথাই অবশ্য গায়ে মাখতো না সুবল।তার একটাই অস্ত্র
ছিলো—-নীরবতা।শত উপহাসের জবাব সে তার এই অস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ করার চেষ্টা
করতো।পাশে পেয়েছিলো মিহির কে।দুজনে ছিল ছায়াসঙ্গী।একটা ভালো ছেলের সান্নিধ্যে
এসে মিহির ও আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো নিজেকে বদলে ফেলতে। ক্লাস এইটের শুরুতেই
মিহির একদিন সকালেই সুবলের বাড়িতে হাজির।হাতে বেশ বড়সড় একটা ব্যাগ।একগাদা দামী
খাতা আর সব নতুন নতুন সিলেবাসের বই নিয়ে এসেছিল সুবলের জন্য———–” নে রে
সুবলা, ভাবিস না এগুলো তোকে দান করলাম।খাতাগুলো অবশ্য আমার টিফিনের পয়সা
বাঁচিয়ে কেনা।বইগুলো কিন্তু আমার।আমার কাছে থাকলে তো শুধু শুধু ধূলো জমবে।তার
থেকে তুইই রাখ।তুই পড়লেই আমার পড়া।

Bangla Golpo Love Story

কোন আপত্তিই শোনেনি মিহির।একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলো সুবলের বাবা আর মা।সামনে আসার
মতো সামর্থ্য ছিলো না।
   তখন ক্লাস নাইন।সেবারের হাফ–ইয়ার্লি পরীক্ষায় সুবল থার্ড
হয়েছে।খুব কষ্ট পেয়েছিলো মিহির—” কি রে সুবলা?বড্ড অহংকার হয়ে গেলো নাকি
তোর?আর যাই হোক–ঐ কিংশুক, শৌভিক দের মতো হোস না রে।ওরা ভালো স্টুডেন্ট–কিন্তু
ভালো মানুষ নয়।আমাকে বড্ড হ্যাটা করতো ওরা। কথায় কথায় ফেলটু বলে প্যাঁক
দিতো।তুই ওদের মুখের ওপর ঝামা ঘষে দিয়েছিস।তোর ওপর আমার বড্ড আশা রে।এখন তুই
যদি এভাবে পিছিয়ে পড়িস,আমি কাকে নিয়ে ফাইট করবো রে?
   সেদিন অঙ্ক ক্লাস চলছে।পাটিগণিতের একটা অঙ্ক বোর্ডে দিয়ে অসিত
বাবু ডেকে নিলেন কিংশুক কে—-” এসো তুমি, চটপট অঙ্কটা সল্ভ করো দেখি।”
সারা শরীরে অহংকার জড়িয়ে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো কিংশুক।ফিরেও এলো তাড়াতাড়ি
মুখ চুন করে।
অসিতবাবু অবাক—” এটা তোমার পারা উচিত ছিল কিংশুক।আর কি কেউ আসতে চাও বোর্ডে?”
চট করে উঠে দাঁড়ালো শৌভিক–” স্যার, সুবল অবশ্যই পারবে।ও এখন দারুণ অঙ্ক করে।”
” তুমি পারবে কি?”—অসিতবাবুর গম্ভীর মুখ–
” অন্যের কাছা ধরে না টেনে,নিজের ওপর নজর দাও শৌভিক।”
   মিহির পাশ দিয়ে ঠেলেই চলেছে সুবলকে—” যা না তুই।আমি জানি ওটা
তুই পারবি।”  
       উঠলো সুবল।বোর্ডের কাছে গিয়ে অঙ্কটার দিকে মিনিট
খানেক তাকিয়ে রইলো।তারপর তুলে নিলো চকটা।অঙ্কটা শেষ করে সুবল যখন ফিরছে,
অসিতবাবু তার পিঠ চাপড়ে দিলেন—” ভগবান তোমার ভালো করুক বাবা, একটা ভালো
ভবিষ্যত অবশ্যই পাবে তুমি। ”
   কিন্তু ভালো ভবিষ্যত অপেক্ষা করে ছিল না সুবলের জন্য।মাধ্যমিক আর
উচ্চ মাধ্যমিকে স্কুল থেকে প্রথম হয়েছিলো সে।স্কুল থেকে যেদিন আউট গোয়িং
ছাত্রদের ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়,সেদিন ছাত্রদের তরফে কিংশুক বলতে উঠেছিলো।উঠে
প্রথমেই সে ডেকে নিয়েছিলো সুবলকে–” বলতে দ্বিধা নেই যে এই ছেলেটাকে আমি প্রথম
দিন থেকেই তাচ্ছিল্য করে এসেছি।কিন্তু আজ সব কিছুতেই ও আমাকে হারিয়ে দিয়েছে।তবে
এই হেরে গিয়ে আমি বড্ড আনন্দ পেয়েছি।মানুষ হিসেবে আমি যে কতোটা পিছনে ছিলাম
সেটা সুবল আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে।এরপর আমরা ছড়িয়ে পড়বো বিভিন্ন দিকে।আমি আশা
করবো আমাদের সবার আগামী জীবন খুব সুন্দর হোক।”


কিন্তু সুবলের আগামী জীবন সুন্দর হয়নি।অঙ্কে অনার্স নিয়ে বর্ধমান রাজ কলেজে
ভর্তি হয়েছিলো সে।খরচা বাঁচানোর জন্য হস্টেল নেয়নি–রোজ যাতায়াত করতো।কিন্তু
তার বাবার শরীর তখন ভেঙ্গে পড়েছে।পাঁজরা গুলো গোণা যায় বাইরে থেকে।ঘরে দুবেলা
খাওয়া দাওয়ার যোগান দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়লো।সুবল একবার ভেবেছিল মিহিরের কাছে গিয়ে
দাঁড়াবে।কিন্তু সেও তখন ফার্মাসি নিয়ে পড়তে চলে গেছে বাইরে।তাই একদিন সকালে আর
বর্ধমানের উদ্দেশ্যে রওনা হলোনা সুবল।ভুবনডাঙা হাইস্কুলের ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র
সুবলের পড়াশোনায় এখানেই ইতি।নিজের ভবিষ্যত
কে গলা টিপে মেরে সুবল সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিলো।তার বাবা লজ্জায় একমাস
তার সামনে আসতে পারেনি।পড়ায় ইতি টানলেও চেষ্টায় ইতি টানলো না সুবল।আপ্রাণ
চেষ্টা করেছিলো একটা চাকরি পেতে।কিন্তু চাকরি পাওয়ার জন্য শুধু মেধা থাকলেই
হয়না।প্রোপার গাইডেন্স থাকা দরকার, পকেটের জোর থাকা দরকার।এগুলো সুবলের কোনটাই
ছিলো না।তিন চার বছর লড়াই করে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল সুবল।বাবা তখন
শয্যাশায়ী।রাস্তায় বাটি নিয়ে বসার মতো অবস্থা।টিউশনি শুরু করলো সুবল।পসার ও
জমিয়ে ফেললো কিছুদিনে।মাধ্যমিক পর্যন্ত সায়েন্স গ্রুপ আর হায়ার সেকেন্ডারির
অঙ্ক—– টিউশনের বাজারে সুবল মাস্টার ধীরে ধীরে পরিচিত মুখ হয়ে উঠলো।এরপর দু
বছরের মধ্যে এক এক করে চলে গেলো বাবা আর মা।সুবল তখন পুরোপুরি একা।নিজের এক
পছন্দের ছাত্রী কে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো সুবল।মলিনার মা বাবা আপত্তি
করেনি।ঘরে এসেছিলো মলিনা।সেও ছিলো নিতান্তই এক গরীবের মেয়ে।তাই আর এক গরীব
মানুষের সাথে মানিয়ে নিতে তার কোন অসুবিধা হয়নি।মেয়ে জন্মানোর পর দায়িত্ব আর
চাপ দুটোই বাড়লো সুবলের।কিন্তু টিউশনের বাজার চিরদিন এক রকম চলে না।নতুন মুখ
উঠে আসে।পুরোনো কে ধীরে ধীরে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে হয়।আস্তে আস্তে পসার
কমতে থাকলো সুবলের।দিশেহারা হয়ে পড়লো সুবল। শেষমেশ মলিনাই বুদ্ধিটা দিলো,কোন
একটা ব্যাবসা করার।কিন্তু অতো মূলধন কোথায় সুবলের?এমন একটা ব্যাবসার কথা চিন্তা
করতে শুরু করলো দুজনে–যাতে মূলধন কম লাগে কিন্তু পসার জমতে দেরী হয়না।সমাধান
করে দিলো সুবলের বেটি।তার তখন সবে আধো আধো বোল ফুটেছে।সে একদিন বাপের গলা জড়িয়ে
আদুরে গলায় আবদার করে বসলো যে সে ফুক্কা খাবে।
   সুবল পড়লো আকাশ থেকে।সে অনেক খাবারের নাম শুনেছে।কিন্তু ফুক্কার
নাম জীবনে শোনেনি।শেষে মলিনাই সমাধান করলো সমস্যার—” ও মনেহয় ফুচকার কথা বলছে
গো।সেদিন ওকে নিয়ে বিকেলে একটু বেরিয়েছিলাম।পাড়ার মোড়ে কয়েকজন কে ফুচকা খেতে
দেখেছে।সেই থেকে ও ক্রমাগত ফুচকার বায়না ধরেছে।”
  আলো দেখতে পেলো সুবল—” তোকে নিজের হাতেই ফুচকা তৈরি করে খাওয়াবো রে মা
“–বলেই লেগে পড়লো দুজনে।
  সেই থেকে সুবল মাস্টার হয়ে গেলো স্বাধীন ব্যবসায়ী।প্রথম প্রথম খুব লজ্জা
লাগতো।তার নিজের পরিচিত রা যখন তার দোকানে এসে দাঁড়াতো—লজ্জায় কুঁকড়ে যেতো
সুবল।সেই সময় তার পাশে ছায়ার মত সেঁটে ছিলো মলিনা।মানসিক জোর দিয়ে গেছিলো
সবসময়।সুবলও বুঝেছিল–পেটের জ্বালা লজ্জা শরম মানে না।
” কার চিঠি গো?হঠাৎ এমন চুপ মেরে গেলে কেন?”—মলিনার কথায় আবার বর্তমানে ফিরে
এলো সুবল।
” ছাড়ো তো চিঠির কথা।ও কিছু না।ওই চিঠি নিয়ে পড়ে থাকলে পেট চলবে না।তুমি বরং
কাজে মন দাও।এদিকে সাড়ে তিনটে বাজতে চললো।”
কিন্তু মলিনার জেদাজেদি তে সব খুলে বলতেই হলো সুবলকে।তাদের ভুবনডাঙা স্কুলের
কথা।তার ছাত্রজীবনের কথা।এই পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের কথা..
……কিচ্ছু বাদ গেল না।
      সব শোনার পর মলিনা শুধু একটা কথাই বলেছিলো—” আমরা
যাবো।আজ বারো তারিখ।তুমি এরমধ্যে কিভাবে যেতে হবে তার খোঁজ নাও।”

Bangla Golpo PDF Download

হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো সুবল—” পাগল হয়েছো নাকি মলিনা?ওরা মেধাবী ছাত্র সুবলকে
ডেকেছে।ফুচকা ব্যবসায়ী সুবলকে তো ওরা চেনে না।টুকটাক যা খবর পাই তাতে আমার
ব্যাচের সবাই ভালো ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত।কিংশুক তো শুনেছি কোন নামী কলেজের
প্রফেসর।শৌভিক ডাক্তারিতে ভালো নাম করেছে।আমিও দারুণ নাম করেছি মলিনা,তাই
না??আমার তৈরি ফুচকা খেয়ে লোকে বাহবা দেয় “—হঠাৎই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে
সুবল—” ওদের মাঝে তুমি আমাকে যেতে বোলোনা গো।এই বিবর্ণ, ফ্যাকাশে সুবলকে দেখে
ওরা অপ্রস্তুত হয়ে যাবে।হয়তো ওদের আনন্দ অনুষ্ঠানটাই মাটি হয়ে যাবে।তার থেকে এই
আমরা বেশ ভাল আছি মলিনা।ভগবানের দয়ায় দুবেলা দু মুঠো তো জুটে যাচ্ছে।”
    কিন্তু যেতেই হলো সুবলকে।মলিনা কোন কথা শোনেনি।তার স্বামীর
অতীতকে ফিরে দেখার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায়নি।
    হাওড়া স্টেশনে নেমে একটু চিন্তায় পড়ে গেছিলো মলিনা।এই প্রথম তার
কপালেও একটু ভাঁজ পড়লো।যাচ্ছে তো বটে,কিন্তু এই চেহারা নিয়ে ওইসব বড়লোক
গিন্নিদের সামনে দাঁড়াতে পারবে?পাশের বাড়ির বউটার থেকে কিছু মানানসই গয়না যদিও
নিয়েছে,কিন্তু গয়না পরার জন্য যে ঝকমকে চেহারা দরকার সেটা তার কোথায়?চোখের নীচে
কালো দাগ।গালে মেচেতার ছোপ।চিন্তায় ঘামতে লাগলো মলিনা।
নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো সুবল।তিরিশ বছর আগের মুখগুলো
কে কি আর চিনতে পারবে?ধীর পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকলো তিনজনে।


বেশ বড় করে একটা ব্যানার টাঙানো হয়েছে যাতে তাদের স্কুলের নাম লেখা।অনেক চেয়ার
এখানে ওখানে পাতা।বড় বড় শতরঞ্চিতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।ভালো ভালো খাবারের
গন্ধ ভেসে আসছে।সাউন্ডবক্সে মৃদু লয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে।

খুব বেশি অপ্রস্তুত লাগছিল সুবলের।হঠাৎ চমক ভাঙলো হইহই চীৎকারে—” বার করুন
তো দেখি সুবলদা আপনার সেই বিখ্যাত ফুচকা।” সুবল তাকিয়ে দেখে তিন চারজন
ভদ্রমহিলা একসাথে দৌড়ে আসছে তার দিকে।হঠাৎ তার মধ্যে একজন হাত ধরে টেনে নিলো
মলিনা কে তাদের মধ্যে।একজন তাদের মেয়েকে কোলে তুলে নিলো।আমতা আমতা করছিলো
সুবল।কি বলবে সে? ফুচকা তো সে আনেনি।
  এগিয়ে এলো এক ঝকঝকে মহিলা–” অদ্ভুত মানুষ তো আপনি সুবলদা।আপনি তো
জানতেন যে এখানে আপনার সব বন্ধুদের বউই থাকবে।আর মহিলাদের ফুচকা প্রেম
সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে?তাও আপনি আমাদের জন্য ফুচকা আনেন নি?সেই
সকাল থেকে আমরা বসে আছি আপনার হাতের ফুচকা খাবো বলে।আপনি না একটা যাচ্ছেতাই
মানুষ। ”
অবাক হচ্ছিল সুবল।মলিনাও বুঝতে পারছিলো না কিছুই।সে যে ফুচকার ব্যাবসা করে তা
এরা জানলো কি করে?মুখে কোনো কথা আসছিলো না তার।
এগিয়ে এসেছিলো একটা হারিয়ে যাওয়া মুখ–
— ” কি রে সুবলা? চিনতে পারছিস আমাকে?শৌভিক রে আমি।”—বলেই বুকে টেনে
নিয়েছিলো সুবলকে—” আজ যার জন্য তোকে খুঁজে পেলাম তাকে আগে ডেকে নিতে দে।কি
রে মিহির?এবার তো কাছে আয় বাপ।”
এরপর শৌভিকের থেকেই সব শুনেছিলো সুবল—” পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের চিন্তা ভাবনা
শুরু হওয়ার পর প্রথমেই আমরা স্কুলের রেজিস্টার থেকে সবার নাম আর ঠিকানা জোগাড়
করি।কিন্তু তোর কোন স্থায়ী ঠিকানা পাচ্ছিলাম না।এখানেই অসাধ্য সাধন করে
মিহির।অনেক খেটেখুটে ওই তোর ঠিকানা জোগাড় করে।তুই এখন কি করিস তাও ওর কাছেই
শোনা।এমনকি ও একদিন লুকিয়ে তোর দোকানের সামনে দিয়ে ঘুরেও এসেছে।আর ওর মোবাইল
ফোনে তোর ছবিও তুলে এনেছে।তাই পুরো ধন্যবাদ টা মিহিরের প্রাপ্য।
   কেমন যেন মিশে যাচ্ছিলো সুবল ওদের সাথে।কোন জড়তা খুঁজে পাচ্ছিলো
না নিজের মধ্যে।মলিনাও হারিয়ে গেছিলো মহিলাদের দঙ্গলে।খাওয়ার সময় কথাটা
তুলেছিলো কিংশুক।প্রফেসর সুলভ গাম্ভীর্য পূর্ণ কথা—” সুবল,আজ কিছু কথা আমি
তোকে বলতে চাই।এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করার পর যখন তোর সব খবর শুনলাম, তখনই আমরা
কয়েকজন মিলে এই সিদ্ধান্ত নি।এই সিদ্ধান্তটাই আজ তোকে শোনাবো।আর এতে তোর বা
তোর বউয়ের কোন বারণ আমরা শুনবো না।প্রথমেই তোকে বলি যে কোন কাজই ছোট নয়।তাই
তোর এই বর্তমান অবস্থা নিয়ে কখনোই তুই ভেঙ্গে পড়িস না।সবাই সৌভাগ্য নিয়ে
জন্মায় না রে।ভেবে নে তুই সেই দুর্ভাগ্যের শিকার।কিন্তু এতগুলো আঙ্কেল থাকতে
তোর মেয়েকে তো আর আমরা দুর্ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।তাই আমরা কজন মিলে
সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এরপর থেকে তোর মেয়ের সব পড়াশোনার দায়িত্ব আমাদের।ও যতদূর
পড়তে চায় নিশ্চিন্তে পড়বে।তোদের দুজনকে নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই।কিন্তু
মেয়েটা তো আমাদের সেই সুবলার, তাই না?প্লিজ এই ব্যাপারে তুই কোন মতামত দিস
না।আর দিলেও অবশ্য আমরা শুনবো না।স্কুল লাইফে অনেক হেরেছি রে তোর কাছে।আজ এই
বন্ধুদের একবার অন্তত জিততে দে।”
কিছুই বলতে পারছিলো না সুবল।শুধু তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটা গুলো
খাবারের সাথে মিশে, খাবারের স্বাদটা কেমন নোনতা করে দিচ্ছিলো …………

Share This Article