গৃহবধূ থেকে বেশ্যা হওয়ার গল্প – গৃহবধূ থেকে বেশ্যা
মা ভালোবেসে নাম রেখেছিল সুমিত্রা। তারপরে যা হয়, কিশোরী বয়েসে প্রেমের
জালে পা দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিবেশী ছেলেটার হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া আর শেষে এখানে
এসে ঠাঁই পাওয়া। ১৭ বছরের সুমিত্রা হয়ে গেছিল শিউলি। সেই শিউলি আজ ত্রিশের
কোঠায়।
যে ছেলেটির হাত ধরে নিজের বাড়ি ছেড়েছিল সুমিত্রা, সে অবশ্য এখানে আসার আগে একটি
হোটেলের ঘরে সুমিত্রার থেকে নিজের প্রেমের অধিকার বুঝে নিয়েছিল। পতিতালয়ে আসার
নয় মাসের মাথায় একটি পুত্র সন্তান প্রসব করে শিউলি ওরফে সুমিত্রা। এই পরিবেশে
ছেলেকে সে বড় করতে চায়নি, তাই তাকে ছয় বছর বয়েসে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেয়
ও। এমনিতে শিউলির রোজগার ভালই, কাস্টমারদের বেশিরভাগ ভিড় জমায় ওর ঘরে। ও যে খুব
রূপসী, তা নয়, তবে ওর শরীরী আবেদন নাকি খুব আকর্ষণীয়, এই কারণে ওর কাছে সবসময়
কাস্টমারদের আনাগোনা থাকে।
বাড়ির বউ থেকে বেশ্যা হওয়ার গল্প
বছর কয়েক আগে ওর একতলার ঘরের জানলার নিচে একটা শিউলি গাছ লাগিয়েছিল শিউলি। সেই
গাছটা লাগানো আর ওর ছেলের বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার দিনটা একই। সকালে উঠে মা ছেলে
মিলে শিউলি গাছটা পুঁতেছিল, তারপরে গাড়ি ধরে রওয়ানা হয়েছিল বোর্ডিং স্কুলের
জন্য। ওখানে অবশ্য শিউলি কে সকলে সুমিত্রা নামে চেনে আর সবাই জানে কলকাতায় ওর
বিউটি পার্লার আছে, বিধবা মহিলা, ছেলে কে দেখাশোনা করার কেউ নেই, ব্যবসা নিয়ে
ব্যস্ত, এসব কারণ দেখিয়েছিল অর্ণব কে বোর্ডিং স্কুলে দেওয়ার।
ভরে ঘুম থেকে উঠে চান করে যখন শিউলি গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল কুড়োয়, তখন গাছটাও
জানান দেয় ও যে শিউলির সবচেয়ে কাছের মিতা। পুজোর সময় ছেলে অর্ণবকে হোস্টেল থেকে
নিয়ে আসে শিউলি, মাসির সঙ্গে কথা বলা আছে পুজোর পাঁচটা দিন ও কোনো কাস্টমার নেয়
না, বা ওই বাড়িতেও থাকে না। দালালের সঙ্গে কথা বলা আছে বেহালার দিকে একটা
ফ্ল্যাটে থাকে ওই কটা দিন ছেলেকে নিয়ে। পুজোর সময় ঠাকুর দেখা, খাওয়া দাওয়া ঘুরে
বেড়ানো ছেলের হাত ধরে, এসব নিয়েই কেটে যায় পুজোর দিনগুলো। একাদশীর দিন
আবার ছেলেকে হোস্টেলে রেখে আসে। আগে অনেক প্রশ্ন করত অর্ণব, ওর তো এখনও প্রায়
মাসখানেক ছুটি আছে স্কুলে, কেন এখনি ও আবার বোর্ডিংয়ে ফিরে যাবে। কিন্তু গত বছর
থেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করছে না অর্ণব, চুপচাপ একাদশীর দিন হোস্টেলে ফিরে যায়।
শিউলির বুক কাঁপে, ছেলেটা কিছু বুঝতে পেরেছে নাকি মায়ের ব্যাপারে!
সেটা জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু অর্ণব খুব রুক্ষ ভাবে উত্তর দিয়েছিল, এবারে ও বাড়ি
যাবে না আর ওকে যেন আনতে না আসে। দুঃখ পেয়েছিল শিউলি খুব, কিন্তু মুখে কিছু
বলতে পারেনি। আড়াল থেকে পতিতালয়ের মাসি শুনেছিল শিউলির কান্না, বুঝতে পেরেছিল
ছেলের সামনে রাখা পর্দা খসে পড়ে শিউলির আসল চেহারা বোধহয় প্রকট হয়েছিল আর তাই
হয়ত অর্নবের এই ব্যবহার।
হয়েছে, নিচে একটা কাঠপিঁপড়ের ঢিবিও হয়েছে। গাছের খুব ক্ষতি হয়েছে, পোকার ওষুধ
দিয়ে পিঁপড়ের ঢিবি পুড়িয়ে কোনোরকমে রক্ষা করেছিল ওকে শিউলি। প্রিয় বন্ধুর মত
বন্ধুর অসুখে খুব সেবা করেছিল। কিন্তু অর্ণবের সাথে সম্পর্কে ঘুন ধরেছিল
শিউলির, হয়ত শিউলি গাছটাও কিছু আঁচ করতে পেরেছিল, হাজার হলেও গাছেরও প্রাণ আছে!
অনেকক্ষণ ধাক্কানোর পরেও দরজা খোলে না শিউলি। সন্দেহ হওয়াতে ও গিয়ে মাসি আর
রাজু কে ডেকে আনে। দরজা ভেঙ্গে দেখে সিলিং ফ্যান থেকে শাড়ির ফাঁস দিয়ে ঝুলছে
শিউলি। বিছানার উপরে একটা চিঠি।
সত্যিই তো সমাজে কি আমাদের পরিচয় দেওয়া যায়? আমি তোর ভাল মা হতে চেয়েছিলাম তাই
তোকে এখানকার পরিবেশ থেকে আলাদা করেছিলাম, হয়ত সেটা ভুল ছিল। কাছে থাকলে চোখের
সামনে আমার কষ্ট হয়ত বুঝতে পারতিস, আমি নিজেও তো তোর প্রতি অন্যায় করেছি তোকে
আমার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করে অত দূরে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে। তবে আমার তো আর কোনো
উপায় ছিল না রে। এখানে তোকে কিভাবে মানুষ করতাম !
আমি জানি না আমার মরার খবর পেয়ে তুই আসবি কিনা, তাও তোকে জানিয়ে দি, তোর স্কুল
কলেজ পড়া কোনোদিন আটকাবে না। একজন উকিলকে দিয়ে আমার যা টাকা পয়সা ছিল সব তোর
নামে বীমা করিয়ে রেখেছি। সময় মত উকিল বাবু তোকে সব জানিয়ে দেবেন। যদি পরের জন্ম
বলে কিছু থাকে, তবে সেই জন্মেও তোর মা হতে চাই, কিন্তু বেশ্যা মা নয়, ভাল
মা, তোর বাকি বন্ধুদের মায়েদের মত।
পরেও মনে হত তোর বন্ধুত্বের জোরেই হয়ত বেঁচে আছি। মাসি আজ আর তোমার প্রতি কোনো
অভিমান, রাগ নেই আর। ১২ বছর আগে তবু এখানে একটা আশ্রয় তো দিয়েছিলে তুমি, হোক না
শরীরের বিনিময়ে। বুঝতে পারি, তুমিও হয়ত এটা চাওনা কিন্তু করতে হয় এই পেটের
জন্য। তোমরা সবাই ভাল থেকো। আমার ঘরের বাইরে আমার মিতা আছে – আমার প্রিয় শিউলি
গাছ, ওকে তোমরা সকলে দেখো।
পেল মাসি। রানী চোখের জল মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে শিউলির ঘরের
পিছনে দিকে গেল রানী, ওর গাছটা দেখতে। শিউলির প্রিয় গাছে তখন অসংখ্য পোকা
লেগেছে, পিঁপড়ের ঢিবিতে গাছের চারপাশ ভরে গেছে, অকালে ঝরে পড়ছে পাতা আর
ফুলগুলো। শিউলি মারা যাওয়ার মাত্র সাত দিনের মাথায় ওর প্রিয় শিউলি গাছটাও মারা
গেল। দুই মিতা বোধহয় মরণের ওপারে আবার মিলিত হল। মানুষ আর গাছের বন্ধুত্ব অনেক
প্রাচীন, জীবনের ঝরা পাতায় লেখা থাকল দুই বন্ধুর বন্ধুত্বের কাহিনী।
———- সমাপ্ত ———-