রূপকথার গল্প – ঠাকুরমার ঝুলি – Rupkothar Golpo
১
এক রাজপুত্র, এক মন্ত্রিপুত্র, এক সওদাগরের পুত্র আর এক কোটালের পুত্র-চার জনে
খুব ভাব।
কেহই কিছু করেন না, কেবল ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ান। দেখিয়া,
শুনিয়া রাজা, মন্ত্রী, সওদাগর, কোটাল, বিরক্ত হইয়া উঠিলেন; বলিয়া
দিলেন,-“ছেলেরা খাইতে আসিলে ভাতের বদলে ছাই দিও।”
মন্ত্রীর স্ত্রী,
সওদাগরের স্ত্রী, কোটালের স্ত্রী কি করেন? চোখের জল চোখে রাখিয়া, ছাই বাড়িয়া
দিলেন। ছেলেরা অবাক হইয়া উঠিয়া গেল। হাজার হ’ক পেটের ছেলে; তা’র সামনে কেমন
করিয়া ছাই দিবেন? রাণী তাহা পারিলেন না। রাণী পরমান্ন সাজাইয়া, থালার এক কোণে
একটু ছাইয়ের গুঁড়া রাখিয়া ছেলেকে খাইতে দিলেন।
সেরা রূপকথার গল্প
রাজপুত্র বলিলেন,-“মা, থালে ছাইয়ের গুঁড়া কেন?”
রাণী বলিলেন,-“ও কিছু নয় বাবা, অমনি পড়িয়াছে।”
রাজপুত্রের মন মানিল না; বলিলেন-“না, মা, না বলিলে আমি খাইব না।” রাণী কি
করেন? সকল কথা ছেলেকে খুলিয়া বলিলেন। শুনিয়া, রাজপুত্র মায়ের পায়ে প্রণাম
করিয়া, উঠিলেন।
চার বন্ধুতে রোজ যেখানে আসিয়া মিলেন, সেইখানে আসিয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন,
“আজ কে কেমন খাইয়াছ?
সকলেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তখন রাজপুত্র বলিলেন,-“ভাই, আর দেশে থাকিব না, চল
দেশ ছাড়িয়া যাই।”
“সেই ভাল!” চারিজনে চারি ঘোড়া ছুটাইয়া দিলেন।
২
ঘোড়া ছুটাইতে ছুটাইতে ছুটাইতে, চার বন্ধু এক তেপান্তরের মাঠের সীমায় আসিয়া
পৌঁছিলেন। মাঠের উপর দিয়া চার দিকে চার পথ।
কে কোন দিকে যাইবেন? ঠিক
হইল, -কোটালের দক্ষিণ, সওদাগরের উত্তর, মন্ত্রীর পশ্চিম আর রাজপুত্রের পূব। তখন
সকলে মাথার পাগড়ীর কাপড় ছিঁড়িয়া চার পথের মাঝখানে চার নিশান উড়াইয়া দিলেন, –
“যে-ই যখন ফিরুক অন্য বন্ধুদের জন্য এইখানে আসিয়া বসিয়া থাকিবে।” চার ঘোড়া চার
পথে ছুটিল।
সারা দিনমান চার জনে ঘোড়া ছুটাইলেন, কেহই কোথাও গ্রাম,
নগর, বন্দর, বাড়ী কিছুই দেখিলেন না; সন্ধ্যার পর আবার সকলেই কোন্ এক এক-ই
জায়গায় আসিয়া উপস্থিত!
সে মস্ত বন! রাজপুত্র বলিলেন,- “দেখ, আমরা
নিশ্চয় রাক্ষসের মায়ায় পড়িয়াছি; সাবধানে রাত জাগিতে হইবে! কিন্তু ক্ষুধায় শরীর
অবশ, দেখ কিছু খাবার পাওয়া যায় কি-না” সকলে ঘোড়া বাঁধিয়া খাবার সন্ধানে
গেলেন।
বনে একটিও ফল দেখা যায় না, কোনও জীবজন্তু দেখা যায় না, কেবল
পাথর কাঁকর আর বড় বড় বট পাকুড় তাল শিমুলের গাছ!
হঠাৎ দেখেন, একটু
দূরে এক হরিণের মাথা পড়িয়া রহিয়াছে। সকলের আনন্দের সীমা রহিল না; কোটালের পুত্র
পাঠ কুড়াইতে গেলেন, সওদাগরের পুত্র জল আনিতে গেলেন, মন্ত্রিপুত্র আগুনের
চেষ্টায় গেলেন, রাজপুত্র একটা গাছের শিকড়ে মাথা রাখিয়া গা ছাড়াইয়া শুইয়া
পড়িলেন।
রাজপুত্র ঘুমে। কাঠ নিয়া আসিয়া কোটাল দেখেন, আর বন্ধুরা আসে
নাই। কাঠ রাখিয়া কোটাল হরিণের মাথাটি কাটিতে গেলেন।
তরোয়াল
ছোঁয়াইয়াছেন-আর অমনি হরিণের মাথার ভিতর হইতে এক বিকটমূর্তি রাক্ষসী বাহির হইয়া
কোটাল আর কোটালের ঘোড়াটিকে খাইয়া, আবার যেমন হরিণের মাথা তেমনি হরিণের মাথা
হইয়া পড়িয়া রহিল।
জল আনিয়া সওদাগর দেখেন, কাঠ রাখিয়া কোটাল-বন্ধু
কোথায় গিয়াছে। সওদাগর হরিণের মাথা কাটিতে গেলেন। সওদাগর, সওদাগরের ঘোড়া
রাক্ষসীর পেটে গেল।
মন্ত্রি আসিয়া দেখেন, জল আসিয়াছে, কাঠ আসিয়াছে,
বন্ধুরা কোথায়? “আচ্ছা, মাংসটা বানাইয়া রাখি।”
“বাঁচাও বাঁচাও!-
বন্ধু, কোথায় তোমরা
-জন্মের মত গেলাম!” মন্ত্রিপুত্রের চীৎকারে রাজপুত্র
ধড়্মড়্ করিয়া উঠিয়া বসিলেন। দেখেন, -কি সর্বনাশ,-রাক্ষসী !!! রাক্ষসী
মন্ত্রিপুত্র আর মন্ত্রিপুত্রের ঘোড়া খাইয়া রাজপুত্রের ঘোড়াকে ধরিল। তরোয়াল
খুলিয়া রাজপুত্র দাঁড়াইলেন; রাজপুত্রের পক্ষিরাজ চেঁচাইয়া বলিল,- “রাজপুত্র,
পলাও, পলাও, আর রক্ষা নাই!!” রাজপুত্র বলিলেন,- “পলাইব না- বন্ধুদের খাইয়াছে,
রাক্ষসী মারিব!” রাজপুত্র তরোয়াল উঠাইলেন,- চোখ আঁধার, হাত অবশ। রাক্ষসী
আসিয়া,- “রাজপুত্র, পলাও, পলাও!” তখন রাজপুত্র, দিশা হারাইয়া, যে দিকে চক্ষু
যায়, দৌড়াইতে লাগিলেন।
রাজপুত্র এক রাজার রাজ্য ছাড়িয়া আর এক রাজার
রাজ্যে,-তবু রাক্ষসী পিছন ছাড়ে না। তখন নিরুপায় হইয়া রাজপুত্র সামনে এক আমগাছ
দেখিয়া বলিলেন,-“হে আমগাছ! যদি তুমি সত্যকালের বৃক্ষ হও, রাক্ষসীর হাত হইতে
আমাকে রক্ষা কর।” আমগাছ দু’ফাঁক হইয়া গেল, রাজপুত্র তাহার মধ্যে গিয়া হাঁফ
ছাড়িলেন।
রাক্ষসী গাছকে কত অনুনয় বিনয় করিল, কত ভয় দেখাইল, গাছ
কিছুই শুনিল না। তখন রাক্ষসী এক রূপসী মূর্তি ধরিয়া সেই গাছের তলায় বসিয়া
কাঁদিতে লাগিল। সেই দেশের রাজা, বনে শিকার করিতে আসিয়াছেন। কান্না শুনিয়া রাজা
বলিলেন,- “দেখ তো, বনের মধ্যে কে কাঁদে?” লোকজন আসিয়া দেখে, আমগাছের নীচে এক
পরমা সুন্দরী মেয়ে।
মেয়েটিকে রাজা রাজপুরীতে নিয়া গেলেন।
মজার মজার রূপকথার গল্প
৩
রাজা সেই বনের মেয়েকে বিবাহ করিলেন। রাণী হইয়া রাক্ষসী ভাবিল,-“সেই রাজপুত্রকে
কেমন করিয়া খাই!” ভাবিয়া রাক্ষসী, সাত বাসি পান্তা, চৌদ্দ বাসি তেঁতুলের অম্বল
খাইয়া অসুখ বানাইয়া বসিল। তাহার পর রাক্ষসী বিছানার নীচে শোলাকাটি পাতিল।
পাতিয়া সেই বিছানায় শুইয়া রঙ্গীমুখ ভঙ্গী করিয়া চোখের তারা কপালে তুলিয়া, একবার
ফিরে এ-পাশ, একবার ফিরে ও-পাশ।
রাজা আসিয়া দেখেন, রাণী খান না, দান
না, শুক্ন ঘরে জল ঢালিয়া চাঁচর চুলে আঁচড় কাটিয়া, রাণী শুইয়া আছেন। দেখিয়া
রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন,- “এ কি রাণী! কি হইয়াছে?”
কথা কি ফোটে?
‘কোঁকাইয়া কোঁকইয়া’ কত কষ্টে রাণী বলিল,- “আমার হাড়মুড়্মুড়ীর ব্যারাম হইয়াছে।”
রাণীর গড়াগড়িতে বিছানার নীচের শোলাকাটিগুলা মুড়্ মুড়্ করিয়া ভাঙ্গিতেছিল
কি-না? রাজা ভাবিলেন,- “তাই তো? রাণীর গায়ের হাড়গুলা মুড়্ মুড়্ করিতেছে!-হায়
কি হইবে!”
কত ওষুধ, কত চিকিৎসা; রাণীর কি যে-সে অসুখ? অসুখ সারিল
না! শেষে রাণী বলিল,- “ওষুধে তো কিছু হইবে না, বনের সেই আমগাছ কাটিয়া তাহার
তক্তার ধোঁয়া ঘরে দিলে তবে আমার ব্যারাম সারিবে।”
রাজাজ্ঞা, অমনি
হাজার হাজার ছুতোর গিয়া আমগাছকে কুড়ুল মারিল! গাছের ভিতরে রাজপুত্র বলিলেন,-
“হে বৃক্ষ, যদি সত্যকালের বৃক্ষ হও, তো আমাকে একটি আমের মধ্যে করিয়া ঐ পুকুরের
জলে ফেলিয়া দাও।” অমনি গাছ হইতে একটি আম টুব্ করিয়া পুকুরের জলে পড়িল; তখনি এক
রাঘব বোয়াল সেটিকে খাবার মনে করিয়া এক হাঁয়ে গিলিয়া ফেলিল।
ছুতোরেরা
আমগাছটি কাটিয়া লইয়া গিয়া তাহার তক্তা করিয়া রাণীর ঘরের চারিদিকে খুব করিয়া
ধোঁয়া দিতেছে! কিন্তু রাণী সব জানিতে পারিল; বলিল,- “নাঃ, এতেও কিছু হইল না। সে
পুকুরে যে রাঘব বোয়াল আছে, তাহার পেটে একটি আম, সেই আমটি খাইলে আমার অসুখ
সারিবে।”
সিঙ্গী জাল, ধিঙ্গী জাল, সব জাল নিয়া জেলেরা পুকুরে ফেলিল;
রাঘব বোয়াল ধরা পড়িল। পেটের ভিতর আম, আমের ভিতর রাজপুত্র বলিলেন,-“হে বোয়াল,
যদি তুমি সত্যিকারের বোয়াল হও, তো আমাকে একটি শামুক করিয়া ফেলিয়া দাও।” বোয়াল
রাজপুত্রকে শামুক করিয়া ফেলিয়া দিল। জেলেরা বোয়াল আনিয়া পেট চিরিয়া কিছুই পাইল
না। রাজা ভাবিলেন,- “আর রাণীর অসুখ সারিল না!”
৪
এক গৃহস্থের বৌ নাইতে গিয়াছে, রাজপুত্র শামুক তাহার পায়ে ঠেকিল। গৃহস্থের বৌ
শামুকটি তুলিয়া আছাড় দিয়া ভাঙ্গিতেই ভিতর হইতে রাজপুত্র বাহির হইল। গৃহস্থের বৌ
ভয়ে জড়সড়। রাজপুত্র বলিলেন,- “বৌ, ভয় করিও না, আমি মানুষ,- রাক্ষসের ভয়ে
শামুকের মধ্যে রহিয়াছি। তুমি আমার প্রাণ দিয়াছ, আজ হইতে তুমি আমার হাসন
সখী।”
রাজপুত্র হাসন সখীর বাড়ীতে আছেন।
রাণী সব জানিল; রাজাকে
বলিল,- “আমার অসুখ তো আর কিছুতেই সারিবে না, আমার বাপের দেশে হাসন চাঁপা নাটন
কাটি, চিরণ দাঁতের চিকন পাটি, আর বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি আছে, সেইগুলি
আনাইলে আমার অসুখ সারিবে।”
“কে আনিবে, কে আনিবে?”
“অমুক
গৃহস্থের বাড়ী এক রাজপুত্র আছে, সে-ই আনিবে।”
অমনি হাজার হাজার পাইক
ছুটিল।
চারিদিকে রাজার পাইক; হাসন সখী ভয়ে অস্থির। রাজপুত্র
বলিলেন,- “হাসন সখী আমারি জন্যে তোমাদের বিপদ, আমি দেশ ছাড়িয়া যাই।”
বাহির
হইতেই, পাইকেরা- রাজপুত্রকে ধরিয়া লইয়া গেল! রাজার কাছে যাইতে রাজপুত্র
বলিলেন,-“মহারাজ! রাণী আপনার রাক্ষসী;-রাক্ষসীর হাত হইতে আমাকে বাঁচান।”
শুনিয়া
রাজা বলিলেন,-“মিথ্যা কথা।–তাহা হইবে না, রাণীর বাপের দেশে হাসন চাঁপা নাটন
কাটি, চিরণ দাঁতের চিকণ পাটি, আর বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি আছে, সেই সব
তোমাকে আনিতে হইবে।” রাজা এক পত্র দিয়া রাজপুত্রকে পাঠাইয়া দিলেন।
ঠাকুরমার ঝুলি রাক্ষসের গল্প
৫
কি করিবেন, রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন। কোথায় সে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, কোথায় বারো
হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি- কোথায় সে রাণীর বাপের দেশ?-রাজপুত্র ভাবিলেন-“হায়!
রাক্ষসীর হাত হইতে কিসে এড়াই!” রাজপুত্র, যেদিকে চক্ষু যায় চলিতে লাগিলেন।
কত
দিন কত রাত চলিতে চলিতে, এক জায়গায় আসিয়া রাজপুত্র দেখেন, এক মস্ত পুরী।
রাজপুত্র বলিলেন,-“আহা! এতদিনে আশ্রয় পাইলাম।”
পুরীর মধ্যে দিয়া
মানুষ জন কিছু দেখিতে পান না,-খুঁজিতে খুঁজিতে এক ঘরে দেখেন, সোনার খাটে গা
রূপার খাটে পা এক রাজকন্যা শুইয়া আছেন। রাজপুত্র ডাকাডাকি করিলেন,- রাজকন্যা
উঠিলেন না! তখন রাজপুত্র দেখেন, বিছানার দুইদিকে দুইটি কাটি- শিয়রের কাটিটি
রূপার, পায়ের দিকের কাটিটি সোনার। রাজপুত্র শিয়রের কাটি পায়ের দিকে নিলেন,
পায়ের দিকের কাটি শিয়রে নিলেন! রাজকন্যা উঠিয়া বসিলেন।–“কে আপনি!- দেব না
দৈত্য, দানব না মানব,-এখানে কেমন করিয়া আসিলেন?- পলাইয়া যান,-পলাইয়া যান,-এ
রাক্ষসের পুরী।”
রাজপুত্রের প্রাণ শুকাইয়া গেল।–“এক রাক্ষসের হাত
হইতে আসিলাম, এখানেও রাক্ষস!- রাজকন্যা, আমি কোথায় যাই?”
রাজকন্যা
বলিলেন,-“আচ্ছা, আপনি কে আগে বলুন।”
রাজপুত্র সকল কথা বলিলেন, তারপর
বলিলেন-“আমি তো সেই রাক্ষসী রাণীর হাত আজও এড়াইতে পারিলাম না, তা এ রাক্ষসের
পুরীতে এমন এক রাজকন্যা কেন?”
রাজকন্যা বলিলেন,-“এই পুরী আমার
বাপের; রাক্ষসেরা আমার বাপ-মা রাজ-রাজত্ব খাইয়াছে, কেবল আমাকে রাখিয়াছে। যদি
আমি পলাইয়া যাই সেই জন্য বাহিরে যাইবার সময় রাক্ষসেরা সোনার কাটি রূপার কাটি
দিয়া আমাকে মারিয়া রাখিয়া যায়।” শুনিয়া রাজপুত্র ভাবিতে লাগিলেন, কি করিয়া
দুইজনে রাক্ষসের হাত হইতে এড়াইবেন।
“আঁই লোঁ মাঁই লোঁ, মাঁনুষের
গঁন্ধ পাঁই লোঁ।
ধঁরে ধঁরে খাঁই লো!-”
সেই সময় চারিদিক হইতে
রাক্ষসেরা শব্দ করিয়া আসিতে লাগিল। রাজকন্যা বলিলেন,-“রাজপুত্র,
রাজপুত্র-শীগ্গির আমাকে মারিয়া ঐ যে শিব-মন্দির আছে, ওরি মাঝে ফুল-বেলপাতার
নীচে গিয়া লুকাইয়া থাকুন।”
“আঁই লোঁ মাঁই লোঁ’ করিয়া রাক্ষসেরা
আসিল। বুড়ী রাক্ষসী রাজকন্যাকে বাঁচাইয়া, বলিল;-
“নাঁত্নি লোঁ নাঁত্নি!
মাঁনুষ মাঁনুষ গঁন্ধ কঁয়-
মাঁনুষ আঁবার কোঁথায় রঁয়?”
রাজকন্যা
বলিলেন,-“মানুষ আবার-থাকিবে কোথায়; আমিই আছি, আমাকে খাইয়া ফেল।”
বুড়ী
বলিল,- “উঁ হু হুঁ নাঁত্নি লোঁ, তাঁ’ কিঁ পাঁরি!-এঁই নে নাঁত্নি তোঁর জঁন্যে
কঁত খাঁবার এঁনেচি।” নাত্নিকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া, বুড়ী আর সকল রাক্ষস, নাকে
কানে হাঁড়ি হাঁড়ি সরষের তৈল ঢালিয়া নাক ডাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল। রাজকন্যা, আয়ীর
মাথার পাকা চুল তোলেন আর ডেলা ডেলা এক এক উকুন দুই পাথরের চাপ দিয়া কটাস্
কটাস্ করিয়া মারেন।
রাজকন্যার রাত এই ভাবে যায়।
পরদিন আবার রাজকন্যাকে
মারিয়া রাখিয়া রাক্ষসেরা চলিয়া গেল। রাজপুত্র বাহির হইয়া আসিয়া রাজকন্যাকে
জীয়াইলেন, দুইজনে স্নান খাওয়া দাওয়া করিলেন। রাজপুত্র বলিলেন,-“রাজকন্যা, এ
ভাবে কতদিন থাকিব? আজ যখন বুড়ী আসিবে, তখন দুই কথা ছল ভাণ করিয়া, ওদের মরণ কিসে
আছে, তাই জিজ্ঞাসা করিও।”
আবার রাক্ষসেরা আসিলে, রাজপুত্র
শিবমন্দিরে গিয়া লুকাইলেন। রাজকন্যাকে খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া বুড়ী খাটের উপর বসিল।
–রাজকন্যা বলিলেন,-“আয়ি, লো আয়ি, কত রাজ্য ঘুরিয়া হাঁপাইয়া হুঁপাইয়া আইলি, আয়
একটু বাতাস করি, পাকা চুল দু’গাছ তুলিয়া দি!”
“ও মা লো মা লক্ষ্মি!”
বুড়ী হাসিয়া চোখ দুইটা কপালে তুলিয়া বলিল,- “হ্যা লো হ্যা নাত্নি, পা-টা তো
কট্ কট্হ কচ্ছে। একটু টিঁপিয়া দিবি?”
“তা আর দিব না আয়ীমা?” হাঁড়ি
ভরা সরষের তৈল আয়ীর পায়ের ফাটলে দিয়া, রাজকন্যা আয়ীর পা টিপিতে বসিলেন।
পা
টিপিতে বসিয়া রাজকন্যা চোখে তেল দিয়া কাঁদেন,- এক ফোঁটা চোখের জল বুড়ীর পায়ে
পড়িল। চমকিয়া উঠিয়া জলফোঁটা আঙ্গুলের আগায় করিয়া নিয়া জিভে দিয়া লোণা লাগিল,
বুড়ী বলিল,- “নাত্নি তুই কাদছিস্-কেন লো, কেন লো? তোর আবার দুঃখু কিসের?”
রাজকন্যা বলিলেন,- “কাঁদি আয়ীমা, কবে বা তুই মরিয়া যাইবি, আর সকল রাক্ষসে আমাকে
খাইয়া ফেলিবে।”
কুলার মত কান নাড়িয়া মূলার মত দাঁত বাহির করিয়া
হাসিয়া আয়ী বলিল,- “ ওঁরে আঁমার সোঁনার নাঁত্নী, মোঁদের কিঁ মঁরণ আঁছে যেঁ
মঁরিব? এ পিঁত্থিমির মোঁদের কিঁচ্ছুতে মঁরণ নাঁই! – কেঁবল ঐ পুঁকুরে যেঁ
ফঁটিকস্তঁম্ভ আঁছে, তাঁর মঁধ্যে এঁক সাঁতফণা সাঁপ আঁছে; এঁক নিঁঃশ্বাসে উঁঠিয়া
ঐ সোঁনার তাঁলগাঁছের তাঁলপত্র খাঁড়া পাঁড়িয়া যঁদি কোঁন রাঁজপুত্র ফঁটিকস্তঁম্ভ
ভাঁঙ্গিয়া সাঁপ বাঁহির কঁরিয়া বুঁকের উঁপর রাঁখিয়া কাঁটিতে পাঁরে, তঁবেই, তঁবেই
মোঁদের মঁরণ।– তাঁ মাঁটিতে যঁদি এঁক ফোঁটা রঁক্ত পঁড়ে, তোঁ এঁক এঁক ফোঁটায় সাঁত
সাঁত হাঁজার কঁরিয়া রাঁক্ষস জঁন্ম নিঁবে!”
শুনিয়া রাজকন্যা
বলিলেন,-“তবে আর কী আয়ীমা! তা, কেউ পারিবে না, তোরাও মরিবি না; – আমারও আর
ভাবনা নাই। আচ্ছা আয়ীমা! অমুক দেশের রাজার রাণী যে রাক্ষসী তা’র আয়ু কিসে
আয়ীমা? আর হাসন চাঁপা নাটন কাটি চিরণ দাঁতের চিরণ পাটি, বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো
হাত বিচি কোথায় পাওয়া যায় আয়ীমা?”
আয়ী বলিল, “আছে লো নাত্নি আছে!
যে ঘরে তোর বাপ থাকত সেই ঘরে আছে, আর সে ঘরে যে এক শুক, তাঁরি মঁধ্যে আঁমার
মেঁয়ে সেঁই রাঁণীর প্রাঁণ! কাঁউকে যেঁন কঁস্ নেঁ নাঁত্নি, সঁব তোঁ আঁমি
তোঁকেই দোঁবো।”
পরদিন বুড়ী সকল রাক্ষস নিয়া বাহির হইল; বলিয়া গেল,-
“নাঁত্নি লোঁ, আঁজ আঁমরা এঁই কাঁছেই থাঁকিব।” যে দিন, রাক্ষসেরা দূরের কথা
বলে, সে দিন কাছে কাছে থাকে, যে দিন কাছের কথা বলে, সে দিন খুব দূরে দূরে যায়।
রাক্ষসেরা চলিয়া গেলে রাজপুত্র আসিয়া রাজকন্যাকে বাঁচাইয়া সকল কথা শুনিলেন।
তখনি, স্নান-টান করিয়া, কাপড়চোপড় ছাড়িয়া শিবমন্দিরে ফুল –বেলপাতা অঞ্জলি দিয়া,
রাজপুত্র নিশ্বাস বন্ধ করিয়া তালগাছে উঠিয়া তালপত্র খাঁড়া পড়িলেন। তারপর পুকুরে
নামিয়া স্ফটিকস্তম্ভ ভাঙ্গিয়া দেখেন, সাতফণা সাপ। রাজপুত্র সাপ নিয়া উপরে
আসিলেন। পৃথিবীর সকল রাক্ষসের মাথা টন্টন্ করিয়া উঠিল;- যে যেখানে ছিল
রাক্ষসেরা ছুটিয়া আসিতে লাগিল।– আলুথালু চুল, এ-ই লম্বা লম্বা পা ছুঁড়িতে
ছুঁড়িতে বুড়ী সকলের আগে ছুটিয়া আসে-
“আঁই লোঁ মাঁই লোঁ, নাঁত্নি
লোঁ নাঁত্নি লোঁ,-
তোঁর মঁনে এঁই ছিঁল লোঁ।
তোঁর মুঁণ্ডুটা চিঁবিয়া
খাঁই লোঁ!”
আর মুণ্ডু খাওয়া! রাজকন্যা বলিলেন,- “রাজপুত্র, শীগ্গির
সাপ কাটিয়া ফেল!” বুকের উপর রাখিয়া তালপত্র খাঁড়া দিয়া রাজপুত্র সাপের গলা
কাটিয়া ফেলিলেন। এক ফোঁটা রক্তও পড়িতে দিলেন না। সব ফুরাইল, যত রাক্ষস পুকুর
পাড়ে আসিতে আসিতেই মুণ্ডু খসিয়া পড়িয়া গেল।
রাজপুত্র রাজকন্যা হাঁপ
ছাড়িয়া ঘরে গেলেন। এক কুঠরীতে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, চিরণ দাঁতের চিকন পাটি, সব
রহিয়াছে, আর এক শুক পাখী ছট্ফট্ করিয়া চেঁচাইতেছে। সব লইয়া রাজপুত্র বলিলেন,-
“রাজকন্যা, আমার দেশে চল।”
রূপকথার রাজকন্যার গল্প
রাজকন্যাকে একখানে রাখিয়া, রাজপুত্র, রাণীর ওষুধ আর শুকটি নিয়া রাজার কাছে
গেলেন,- “মহারাজ, আর একবার সভা করিবেন, আমি রাণীর অসুখ সারাইব।”
ভারী খুশী হইয়া রাজা সভা করিয়া বসিলেন। রাজপুত্র কাটি, পাটি, চাঁপা, কাঁকুড়
সভায় রাখিলেন। সকলে দেখে, কি আশ্চর্য! রাজপুত্র বলিলেন, -“মহারাজ, রাণীকে
নিজে আসিয়া এইগুলি নিতে হইবে।”
রাণীর তো ওদিকে হাড়মুড়্মুড়ি গিয়া কল্জে-ধড়্ফড়ি ব্যারাম হইয়াছে-“ছেলেটা তো
তবে সব নাশ করিয়া আসিয়াছে! আজ ওকে খা’ব! রাজ্য খা’ব!!”-
রাজ্য খা!-সভার দুয়ারে রাণী পা দিয়াছে, আর রাজপুত্র বলিলেন,- “ও রাক্ষসী,
আমাকে খা’বি?- এই দ্যাখ্!”- রাজপুত্র খাঁচা হইতে শুকটিকে বাহির করিয়া এক
টানে শুকের গলা ছিঁড়েন আর কি!-রাক্ষসী বলিল- “খাঁব না, খাঁব না, রাঁখ্
রাখ্!! তোঁর পাঁয়ে পঁড়ি!”-রাণীর মূর্তি কোথায়, দাঁত-বিকটী রাক্ষসী!!-
রাজা, সভার সকলে থরথর কাঁপেন।
রাজপুত্র বলিলেন,-“দে, আমার কোটালবন্ধু দে, কোটাল-বন্ধুর ঘোড়া দে! দে, আমার
সওদাগরবন্ধু দে, সওদাগরবন্ধুর ঘোড়া দে! মন্ত্রিবন্ধু, মন্ত্রিবন্ধুর ঘোড়া দে,
আমার ঘোড়া দে!”
রাক্ষসী হোয়াক্ হায়াক্ করিয়া একে একে সব উগ্রিয়া দিল! তখন রাজপুত্র
বলিলেন,-“মহারাজ, দেখিলেন, রাণী রাক্ষসী কিনা?”-
-“এইবার রাক্ষসী-নিপাত যাও!!”
শুকের গলা ছিঁড়িল-রাক্ষসী গ্যাঁ গ্যাঁ করিয়া পড়িয়া মরিয়া গেল! রাক্ষসীর
মরণ,- মরিতে-মরিতেও মরণকাম্ড়ি- রাজার সিংহাসন ধরিয়া টান মারে আর কি!-সার্
সার্ করিয়া রাজা বাঁচিয়া গেলেন।
ঘাম দিয়া সকলের জ্বর ছাড়িল। রাজা বলিলেন,-“ধন্য তুমি কোথাকার রাজপুত্র! যত
ধন চাও, ভাণ্ডার খুলিয়া দিয়া যাও।”
রাজপুত্র বলিলেন,- “আমি কিছুই চাই না,-এতদিনে রাক্ষসীর হাত হইতে সকলে
বাঁচিলাম,-এখন আমরা দেশে যাইব।” রাজা শুনিলেন না, ভাণ্ডার খুলিয়া সকল ধন রত্ন
বাহির করিয়া দিলেন।
Tags –
Rupkothar Golpo,
Thakurmar Jhuli,
Bangla Golpo