Lojja By Taslima Nasrin (লজ্জা পর্ব – 3) Lajja PDF
পর্ব – ৩
০২ক .
সুরঞ্জনের বন্ধুদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। অবশ্য ওদের মুসলমান বলাওঁ ঠিক নয়। ওরা ধর্মন্টর্ম তেমন মানে না। আর মানলেও সুরঞ্জনকে কাছের মানুষ ভাবতে ওরা কোনও দ্বিধা করেনি। কামাল তো গত বছর বাড়িসুদ্ধ নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। পুলক, কাজল, অসীম, জয়দেবও সুরঞ্জনের বন্ধু কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বেশি কামাল, হায়দার, বেলাল বা রবিউলের সঙ্গে। সুরঞ্জনের যে কোনও বিপদে কাজল অসীমের চেয়ে কাছে এসেছে হায়দার কামাল বেলালই। সুধাময়কে একবার সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ভর্তি করবার প্রয়োজন পড়েছিল, রাত দেড়টা বাজে তখন। হরিপদ ডাক্তার বললেন, ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান, এক্ষুনি হাসপাতালে নাও।‘ সুরঞ্জন কাজলকে খবরটি জানালে কাজল হাই তুলে বলল, ‘এত রাতে কি করে শিফট করবে, সকাল হোক, একটা ব্যবস্থা করা যাবে।‘ অথচ খবরটি জানবার পরই গাড়ি নিয়ে ছুটে এল বেলাল। নিজে দৌড়াদৌড়ি করে ভর্তি করাল, বারবার সুধাময়কে বলল, ‘কাকাবাবু, আপনি একটুও দুশ্চিন্তা করবেন না, আমাকে আপনি নিজের ছেলেই মনে করবেন।’ সুরঞ্জনের মন ভরে গেছে দেখে। যতদিন হাসপাতালে ছিলেন সুধাময়, বেলাল খোঁজ নিয়েছে, চেনা ডাত্মারদের বলে এসেছে কেয়ার নিতে, সময় পেলেই দেখতে গিয়েছে, হাসপাতালে যাওয়া আশর জন্য গাড়ি দিয়েছে। কে করে এত? পয়সা তো কাজলেরও আছে, সে কি এমন হৃদঙ্গবন হতে পারে সুরঞ্জনের জন্য? চিকিৎসার খরচ প্রায় পুরোটাই দিয়েছে। রবিউল। একদিন টিকাটুলির বাড়িতে হঠাৎ উপস্থিত রবিউল, বলল, ‘তোর বাবা নাকি হাসপাতালে?’ সুরঞ্জন হ্যাঁ না কিছু বলবার আগেই টেবিলের ওপর একটি খাম রেখে রবিটল বলল, ‘এত পর ভাবিস না বন্ধুদের।’ বলে যেমন দমকা এসেছিল, দমকা চলেণ্ড গেল। সুরঞ্জন খাম খুলে দেখে পাঁচ হাজার টাকা। কেবল সাহায্য করে বলে নয়, ওদের সঙ্গে মনে ও মননেও বড় মেলে তার। রবিউল কামাল হায়দারকে যত আপন করে পেয়েছে সুরঞ্জন, অসীম কাজল জয়দেবকে ততটা পায়নি। শুধু তা-ই নয় পারভিনকে সে যতন্ত্র ভালবেসেছিল, সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় না কোনও অর্চনা, দীপ্তি, গীতা বা সুনন্দাকে সে ততটা ভালবাসতে পারবে।
সম্প্রদায়ের ভেদ সুরঞ্জন নিজে কখনও করতে শেখেনি। ছোটবেলায় সে জানোতই না যে সে হিন্দু। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পড়ে, খ্রি-ফোরে হবে হয়ত, খালেদ নামের এক ছাত্রের সঙ্গে ক্লাসের পড়া নিয়ে তার খুব তর্ক হচ্ছিল। তর্ক একসময় তুঙ্গে উঠলে খালেদ তাকে গাল দেয়। কুকুরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা এমন গাল। উল্টে সুরঞ্জনও খালেদকে গাল ফিরিয়ে দিচ্ছিল। খালেদ বলে ‘কুকুরের বাচ্চা, সুরঞ্জনও বলে ‘তুই কুকুরের বাচ্চা’। ‘ খালেদ বলে ‘হিন্দু।’ সুরঞ্জন পাল্ট বলে ‘তুই হিন্দু ৷ ‘ সে ভেবেছিল কুকুরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চার মত হিন্দুও এক ধরনের গাল। সে অনেককাল ভেবেছিল হিন্দু বোধহয় তুচ্ছাৰ্থে ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত কোনও শব্দ। পরে আরও বড় হয়ে সুরঞ্জন বুঝেছে হিন্দু একটি সম্প্রদায়ের নাম এবং সে এই সম্প্রদায়ের মানুষ। আরও পরে তার যে বোধ জন্ম নিয়েছে তা হল সে আসলে মানব সম্প্রদায়ের মানুষ এবং সে জাতিতে বাঙালি। কোনও ধর্ম এই জাতিকে তৈরি করেনি। বাঙালিকে সে অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজয়বাদী জাতি হিসেবেই মানতে চায়। বাঙালি শব্দটি একটি বিভাজন বিরোধী শব্দ এর কথা সে বিশ্বাস করে। কিন্তু স্বধৰ্মীয় বিদেশিকে আপনি এবং অন্য ধমাবলম্বীকে পরজাতি বলে বাঙালি বারবারই মনে করছে, এই বিভ্ৰান্তিকর ধারণা, বোধ, বিশ্বাস বাঙালিকে হিন্দু মুসলমানে বিভক্ত করেছে।
Lajja By Taslima Nasrin
আজি ডিসেম্বরের আট তারিখ। সারাদেশে হরতাল। হরতাল ডেকেছে৷ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মাঝখান থেকে জামাতে ইসলামি জানায় তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। হরতাল হচ্ছে, সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ে, একবার ঘুরে আসা যাক। প্রিয় শহরটির মুখ দেখে না। সে আজ দু দিন। ওঘরে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। কিরণময়ী। সুধাময়ের মনে কোনও শঙ্কা আছে কি না। সুরঞ্জন ঠিক বুঝতে পাত্রে না। বাড়িতে এবার সে জানিয়ে দিয়েছে কোথাও যাবে না লুকোতে। মরলে মরে যাবে। মুসলমানেরা যদি বাড়ির সবাইকে কেটে রেখে চলে যায়, যাবে। তৰু বাড়ি থেকে এক পা-ও নড়বে না। সুরঞ্জন। মায়া নিজ দায়িত্বে গেছে, যাক। বাঁচবার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে মুসলমানের ঘরে সে আশ্রয় নিয়েছে। দুই-একজন পারুল রিফাতের ছাতার তলে সে প্রাণ বাঁচাতে চাইছে। বেচারা মায়া।
দুদিন টানা শুয়ে থেকে সুরঞ্জন যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়, দেখে কিরণময়ী চমকে উঠে বলেন–কোথায় যাচ্ছিস?
—দেখি শহরের অবস্থা কী। হরতাল কেমন হচ্ছে দেখে আসি।
—বাইরে যাস নে সুরো। কী হয় বলা যায় না।
—যা হয় হবে। মরতে তো একদিন হবেই। আর এত ভয় পেও না তো। তোমাদের ভয় দেখলে আমার রাগ ধরে। চুলে সিঁথি কাটতে কাটতে সুরঞ্জন বলে।
কিরণময়ী কেঁপে ওঠেন। তিনি ছুটে এসে সুরঞ্জনের হাত থেকে চিরুনি কেড়ে নেন। –কথা শোন সুরঞ্জন। একটু সাবধান হ। হরতালের মধ্যেই শুনছি দোকান ভাঙছে, মন্দির পোড়াচ্ছে। ঘরে বসে থাক। শহরের অবস্থা দেখার কোনও দরকার নেই।
সুরঞ্জন চিরকালের অবাধ্য ছেলে। সে কিরণময়ীর কথা মানবে কেন? বাধা ডিঙিয়ে চলে যায় সে। বাইরের ঘরে সুধাময় একা বসেছিলেন। তিনিও অবাক তাকিয়ে থাকেন। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে। ঘরের বাইরে বেরোতেই বিকেলের স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে খাঁ খাঁ নির্জনতা আর ভূতুড়ে স্তব্ধতা তার গায়ে বেঁধে। একটু কি ভয় ভয় লাগে তার!! লাগেই মনে হয়। তবু সুরঞ্জন ভেবেছে যখন আজ সে শহর ঘুরবে, ঘুরবেই। এবার তাদের নিতে বা দেখতে কেউ আসেনি। না বেলাল, কামাল, না কেউ। ওরা এলেও সুরঞ্জন যেত না, যাবে কেন? ক’দিন পর পরই হামলা হবে। আর তল্পিতল্পা সহ ছোটাছুটি, ছিঃ! নেহাত গর্দভ ছিল বলে গত বছর গিয়েছিল কামালের বাড়িতে। এবার এলে দিব্যি সে বলে বসন্ত ‘তোমরা মারবেও আবার দয়াও করবে, এ কেমন কথা। তার চেয়ে সকলে মিলে একটি কাজ কর। যত হিন্দু আছে দেশে, ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে মারো। মরে গেলে তোমাদের ঝামেলা চুকবে। মারতেও হবে না, আবার কায়দা করে বাঁচাতেও হবে না।’ সুরঞ্জন রাস্তায় উঠতেই একদল ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, চেচিয়ে ওঠে ‘ধর ধর, হিন্দু ধর বলে। এই ছেলেগুলো পাড়ারই। বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে সাত বছর এদের দেখছে সে। সুরঞ্জন চেনেও দু-একজনকে। আলম নামের ছেলেটি প্রায়ই আসে। চাঁদা চাইতে। পাড়ায় একটি ক্লাব আছে। এদের। ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় সুরঞ্জন গানও গায়। কিছু ছেলেকে ডি এল রায় আর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান শেখাবে ভেবেছিল সে। এরা প্রায়ই দাদা এটা করে দিন ওটা শিখিয়ে দিন বলে কাজে-অকাজে বাড়িতে ভিড় করে। এদেরই পাড়ার লোক বলে সুধাময় ফ্রি চিকিৎসা করছেন দীর্ঘদিন। আর এরাই ওই যে হিন্দু যায়, হিন্দু ধর’ বলে সুরঞ্জনকে ধরে পেটাবার ইঙ্গিত করে। সুরঞ্জন উল্টো পথে দ্রুত হেঁটে যায়, ভয়ে নয়, লজ্জায়; পাড়ার এই চেনা ছেলেগুলো তাকে ধরে পেটাবে ভাবলে নিজেরই লজ্জা হয়। নিজে মারি খাচ্ছে সে কারণে নয়, লজ্জা যারা পেটাবে তাদের জন্যই। লজ্জা বুঝি অত্যাচারিতের জন্য হয়, লজ্জা তো হয় অত্যাচারীর জন্য, দুৰ্বত্তের জন্য।
সুরঞ্জন হাঁটতে হাঁটতে শাপলা চত্বরের কাছে এসে থামে। থমথমে চারদিক। কোথাও কোথাও মানুষের জটিল। রাস্তায় ইটের টুকরো, পোড়া কাঠ, ভাঙা কাচ ছড়ানো, বোঝা হ্যায় এইমাত্র ভীষণ এক তাণ্ডব ঘটে গেছে। দু-একজন যুবক এদিক-ওদিক দৌড়োচ্ছে। কিছু নেড়ি কুকুর মধ্য রাস্তা বরাবর ছুটছে। টিংটিং বেল বাজিয়ে সামান্য কটি রিক্সা চলে যাচ্ছে ডানে বাঁয়ে। সে কিছু বুঝতে পারছে না কোথায় কী ঘটেছে। কুকুরগুলোর কীের্ণ ভয় নেই। জাতের ভয় নেই। তারা যে দৌড়োচ্ছে, সুরঞ্জন অনুমান করে খালি রাষ্ট্ৰী পাওয়ার আনন্দেই দৌড়োচ্ছে। সুরঞ্জনেরও ইচ্ছে করে দৌড়োতে। মতিঝিলের ব্যস্ত রাস্তা এতদিনে খালি পেয়ে সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে ছোটবেলার মত জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল শোিণত, অথবা খড়ির স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট। এরকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখে পড়ে বাঁকে একটি ঘর পোড়া। সাইনবোর্ড দরজা জানোলা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটি ইপিন এয়ারলাইনসেক্স অফিস। কিছু লোক পােড়া অফিসটি দেখছে দাঁড়িয়ে, হাসছে। সুরঙ্গসুন্দর দিকে কেউ কি লুকুঁচকে তাকায়, সন্দেহ হয়। দ্রুত হাঁটে সে সামনের দিকে, ফে এইসব ঘরবাড়ি পুড়ে যাক, তার কী? সামনে সে দেখতে যাচ্ছে আর কী কী পুড়েছে, আৰু কি পোড়া পেট্রোলের মত পােড়া ইট কাঠের ভ্রাণ নিতে অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে। হবে হয়?। হাঁটতে হাঁটতে সে সি পি বি অফিসের সামনে দেখে মানুষের ভিড়। রাস্তায় ইট পাটকলের ছড়াছড়ি। ফুটপাতে বই-এর দোকান ছিল। সূরঞ্জন এই ফুটপাত থেকে প্রচুর বই কনেছে। আধাপোড়া একটি বই সুরঞ্জনের পায়ে ঠেকে, ম্যাক্সিম গোর্কির মা। মুহূর্তে মনে হয়। সে পাভেল ভলািসভ। আর সে তার মায়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে পায়ের নীচে পিন্ধই। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সুরঞ্জনের। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে পোড়া বইটির সামল। চারদিকে জটলা, ফিসফিস কথা, চরম উত্তেজনা পুরো এলাকায়। কী হয়েছে, কী হবে এসব নিয়ে কথা বলছে সবাই। সি পি বি অফিসটি পোড়া। কমিউনিস্টরা তাদের স্ত্র্যাটেজি চেঞ্জ করে আল্লাহ খোদার নাম নিচ্ছে, তারপরও রেহাই পেল না। আগুন থেকে? কমরেড ফরহাদ মারা গেলে বড় জানাজা হল, মিলাদও হল, তারপরও সাম্প্রদায়িকতার আগুন কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পোড়ায়! পোড়া অফিস্টর দিকে নির্বক তাকিয়ে থাকে সুরঞ্জন। হঠাৎ সামনে পড়ে কায়সার। উড়েইগড়া চুল। শেভ না করা গাল, রক্তাভ কনজাংটিভা, কণ্ঠে উদ্বেগ তার, বলে—তুমি বেরিয়েছ কেন?
—আমার কি বেরোতে মানা? সুরঞ্জন পাল্টা প্রশ্ন করে।
—মানা নেই। তবু জানোয়ারগুলোকে তো বিশ্বাস নেই। এরা যে এত ধর্ম ধর্ম করে, আসলে কি কোনও ধর্ম মানে, বল?? জামাত শিবির যুব কমান্ডের সন্ত্রাসীরা গতকাল দুপুরে এসব করেছে। পার্টি অফিস, ফুটপাতের বইয়ের দোকান, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো তাকে তক্কে থাকে কোথাও একটা ইস্যু তাদের ফেভারে নিয়ে চিৎকার করতে। যেন তাদের উঁচু গলাটা সবাই শোনে।
পাশাপাশি তোপখানার দিকে হাঁটতে থাকে দুজন। সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে—আর কোথায় কোথায় আগুন ধারালো ওরা?
–চট্টগ্রামের তুলসীধাম, পঞ্চাননধাম, কৈবল্যধাম মন্দির ভেঙে গুড়ো করে দিয়েছে। মালিপাড়ী, শ্মশান মন্দির, কোরবানিগঞ্জ, কালীবাড়ি, চট্টেশ্বরী, বিষ্ণুমন্দির, হাজারিলেন, ফকিরগািড়া এলাকার সব মন্দির লুটপাট করে আগুন জেলে দিয়েছে। অবশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিলও বেরিয়েছে।
সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কায়সার ডান হাতে এলেচুলগুলো পেছন দিকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে—কাল শুধু মন্দির নয় মাঝিরঘাট জেলেপাড়ায় আগুন জ্বেলে দিয়েছে। অন্তত পঞ্চাশটি ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
—আর? সুরঞ্জন নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
—জয়দেবপুরের মাধব মন্দির আর দুর্গ মন্দিরে হামলা হয়েছে। শেরপুরের কৃষি সেন্টারে অন্নপূর্ণ মন্দির, শেরিঘাট আশ্রমের কালী মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে। ফরিদপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরগুলো লুট হয়েছে। মহারাজা আর তার ছাত্ররা সিরিয়াসলি ইনজিউরড।
—আর? সুরঞ্জনের উদাসীন স্বর।
-নরসিংদিতে চালাকচড় আর মনোহরাদির বাড়ি আর মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ থানার মর্যাপাড়া বাজারের মন্দির ধ্বংস করেছে। কুমিল্লার পুরনো অভয় আশ্রমটি জ্বলিয়ে দিয়েছে। আর নোয়াখালিতেও জঘন্য সব কাণ্ড করেছে।
—কি রকম?
—সুধারাম থানার অধর চাঁদ আশ্রম আর সাতটা হিন্দুর বাড়ি জ্বলিয়ে দিয়েছে। গঙ্গাপুর গ্রামে যত হিন্দু বাড়ি ছিল, প্রথম লুট করেছে, পরে পুড়িয়ে দিয়েছে। সোনাপুরের শিব-কালী মন্দির আর বিনোদপুর আখড়া ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনির কালীমন্দির, দুৰ্গাপুরের দুৰ্গর্বিাড়ি মন্দির, কুতুবপুর আর গোপালপুরের মন্দির ভেঙেছে। ডাঃ পি কে সিংহের ওষুধের ফ্যাক্টরি, আখন্দ আশ্রম, ছয়আনি এলাকার মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনি বাবুপুর, তেতুইয়া, মেহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গিরপাড়, কাজিরহাট, রসুলপুর, জমিদারহাট, পোতাবাড়ির দশটি মন্দির আর আঠারোটি হিন্দু বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। একটি দোকান, একটি গাড়ি, একটি মহিলাও পুড়েছে। ভাবর্দির সতেরোটি বাড়ির মধ্যে তেরোটি বাড়িই পুড়ে গেছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়ির মেয়েরা নিৰ্য্যতিত হয়েছে। বিপ্লব ভৌমিক স্টেবডি। গতকাল বিরাহিমপুরের সবকটি বাড়ি এবং মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। জগন্নাথ মন্দির, চরহাজারি গ্রামের তিনটি দোকান, ক্লাব লুট করেছে, ভেঙেছে। চরপার্বতী গ্রামের দুটো বাড়ি, দাসের হাটের একটি বাড়ি, চরকুকরি আর মুছাপুরের দুটো মন্দির, জয়কালী মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। পিরোজপুরের প্রতিটি মানুষ মার খেয়েছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়িগুলো শেষে পোড়ানোও হয়েছে।
–ও।
সুরঞ্জন আর কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে চায় না। ছোটবেলার মত রাস্তার যে কোনও ইট বা পাথরের টুকরো পায়ে ছুড়ে ছুড়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে তার। কায়সার আরও কী কী সব বলে, আরও মন্দির পোড়ানো, আরও বাড়িঘর লুটপাট, পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। সুরঞ্জন সব শোনেও না। তার শুনতে ইচ্ছেও করে না। প্রেস ক্লাবের সামনে দুজনই দাঁড়ায়। সাংবাদিকদের জটলা, গুঞ্জন দু চোখ ভরে দেখে সে। শোনেও কিছু। কেউ বলছে-ভারতে এ পর্যন্ত দুশর ওপর লোক দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। আর এস এস, শিবসেনাসহ মৌলবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ, লোকসভায় বিরোধী নেতার পদ থেকে আদভানি পদত্যাগ করেছে। কেউ বলছে-চট্টগ্রামে, নন্দনকানন তুলসীধামের এক সেবক দীপক ঘোষ পালিয়ে যাবার সময় জামাতিরা তাকে ধরে জ্বলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। পাশে কয়েকজন দারোয়ান ছিল, ওরা দীপককে মুসলমান পরিচয় দিলে জামাতিরা দীপককে মারধোর করে ছেড়ে দেয়।
সুরঞ্জনকে পরিচিত যারাই দেখে চমকে ওঠে। বলে—কী ব্যাপার তুমি বাইরে বেরিয়েছ যে! বিপদ হতে পারে। বাড়ি চলে যাও।
সুরঞ্জন কোনও উত্তর করে না। বড় অপ্রতিভা লাগে নিজেকে। তার নাম সুরঞ্জন দত্ত বলে তাকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হবে। আর কায়সার, লতিফ, বেলাল, শাহীন এরা বাইরে বেরোবে, কোথায় কী হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা করবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মিছিলও করবে। কিন্তু সুরঞ্জনকে বলবে বাড়ি চলে যাও, এ কেমন কথা? সুরঞ্জন কি ওদের মতই বিবেকবান, মুক্তবুদ্ধির, যুক্তিবাদী মনের মানুষ নয়? দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে উদাসীন, সিগারেটের দোকান থেকে এক কাঠি বাংলা ফাইভ কেনে, আগুনমুখো দড়ি থেকে সিগারেট ধরায়। নিজেকে বড় বিচ্ছিন্ন বোধ করে সুরঞ্জন। এত লোক চারদিকে, অনেকেই চেনা, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠও, তবু এক লাগে তাঁর। যেন এই যে এত মানুষ হাঁটছে, কথা বলছে, বাবরি মসজিদ ভাঙা আর সেইসূত্রে এ দেশের মন্দির ভাঙা নিয়ে উত্তপ্ত কথাবাত চলছে, এসব সুরঞ্জনের বিষয় নয়। সে মিশে যেতে চাইলেও পারছে না। কোথায় যেন একটা বাধা অনুভব করছে সে। সুরঞ্জন বুঝতে পারছে তাকে সকলেই আড়াল করছে, করুণা করছে, তাকে দলে টানছে না। সুরঞ্জন গাল ভরে ধোঁয়া নিয়ে ধোঁয়ার রিং ছুড়ে দেয়। চারদিকে উত্তেজনা আর সে তার অলস শরীরের ভার দেওয়ালে ছেড়ে দেয়। অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে সুরঞ্জনকে। বিস্মিত হয়। কারণ একটি ‘হিন্দু ও আজ ঘরের বার হয়নি। ভয় পেয়ে গর্তে লুকিয়েছে সব। আর সুরঞ্জনের সাহস বা স্পধর্ম দেখে লোকে অবাক হবেই বা না কেন!
কায়সার একটি দলে ভিড়ে যায়। মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। সাংবাদিকরা কাঁধে ঝোলা বা ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করছে। এদের মধ্যে লুৎফরকে দেখেও সুরঞ্জন ডাকে না। ও একসময় নিজেই এগিয়ে আসে। চোখ কপালে তুলে বলে-দাদা, আপনি এখানে কেন?
—কেন থাকতে নেই?
লুৎফরের চোখে মুখে চরম উৎকণ্ঠা। জিজ্ঞেস করে–বাড়িতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
লুৎফরের কথায় এবং বলবার ভঙ্গিতে এক ধরনের অভিভাবকত্ব আছে। সুরঞ্জন টের পায়। এই ছেলেটি মুখচোরা স্বভাবের ছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও কথা বলেনি এমনই বিনত, লাজুক, ভদ্র। ছেলেটিকে সুরঞ্জনই ‘একতা’ পত্রিকার সম্পাদককে বলে-কয়ে চাকরি নিয়ে দিয়েছিল। লুৎফর একটি বেনসন ধরায়। সুরঞ্জনের খুব কাছে সরে এসে বলে—সুরঞ্জনদা, অসুবিধে হয়েছে কোনও?
সুরঞ্জন হেসে জিজ্ঞেস করে–কি অসুবিধে?
লুৎফর একটু অপ্রস্তুত হয়। বলে—কী আর বলব দাদা। দেশের যা অবস্থা…
সুরঞ্জন তার সিগারেটটির ফিল্টারটুকু নীচে ফেলে পায়ে পিষতে থাকে। লুৎফর তার সঙ্গে সব সময় নীচু কণ্ঠে কথা বলত, আজি কণ্ঠটা তার উঁচুই মনে হয়। ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে, কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, বলে—দাদা, আজ বরং আপনি অন্য কোথাও থাকুন। বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না। আচ্ছা আশেপাশের কোনও মুসলমানের বাড়িতে অন্তত দুটো রাতে থাকার ব্যবস্থা করা যায় না?
সুরঞ্জনের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে দোকানের আগুনমুখে দড়িটির দিকে তাকিয়ে বলে—না।
—না? লুৎফর চিন্তিত হয়। ওর ভাববার ভঙ্গিতেও অভিভাবকত্ব টের পায় সুরঞ্জন। সে বুঝে যায়, যে কেউই এখন এ ধরনের অভিভাবকত্ব দেখাবে। না চাইতেই আগ বাড়িয়ে উপদেশ দেবে। বাড়িতে থাকা ঠিক নয়, লুকিয়ে থাকে। ক’দিন বাড়ি থেকে বেরিও না। নাম পরিচয় বলো না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে না হয় বেরোও, এসব। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে আরও একটি সিগারেট ধরাতে। কিন্তু লুৎফরের গুরুগম্ভীর উপদেশ তার ইচ্ছেটিকে নষ্ট করে দেয়। শীত নেমেছে বেশ। সে হাতদুটো ভাঁজ করে -বুকের ওপর রেখে গাছের পাতার সবুজ-গাঢ় সবুজ রং দেখে। শীতকালটা সে সব সময়ই বেশ উপভোগ করে। সকালে গরম ভাপাপিঠে, রাতে গায়ের ওপর রোদে দেওয়া লেপ, মায়ের মুখে ভূতের গল্প-ভাবতেই এক ধরনের রোমাঞ্চ হয় সুরঞ্জনের। লুৎফরের সামনে –দাঁড়িয়ে একটি ঝোলা কাঁধের দাড়িঅলা যুবক নাগাড়ে বলে যায়-ঢাকেশ্বরী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, মহাপ্রকাশ মঠ, নারিন্দা গৌড়ীয় মঠ, ভোলাগিরি আশ্রমে মিছিল করে গিয়ে লোকেরা ইট মারছে, লুট করছে। স্বামীবাগ আশ্রম লুট হয়েছে। শনির আখড়ার পচিশটি বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। শনির মন্দির, দুর্গ মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। নারিন্দার ঋষিপাড়া আর দয়াগঞ্জের জেলেপাড়াও রক্ষা পায়নি। ফার্মগেট, পল্টন ও নবাবপুরে মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান, টিকাটুলির দেশবন্ধু মিষ্টির দোকান লুট করেছে, ভেঙেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঠাঁটারি বাজারের মন্দিরে আগুন লাগিয়েছে।
লুৎফর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—আহা।
সুরঞ্জন লুৎফরের দীর্ঘশ্বাসটি কান পেতে শোনে। সে ভেবে পায় না সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, মিছিলে যোগ দেবে, নাকি দূরে কোথাও চলে যাবে। আত্মীয়হীন বন্ধুহীন কোনও ঝাড় জঙ্গলে একা বসে থাকবে। ঝোলা কাঁধের যুবকটি সরে গিয়ে অন্য আডায় মিশে যায়। লুৎফরও চলে যাবার পাঁয়তারা করে। কারণ সুরঞ্জনের ভাবলেশহীন মুখ আতাকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটে।
চাপা উত্তেজনা চারদিকে। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে দলের সঙ্গে মিশে যেতে। তার ইচ্ছে করে কোথায় কোথায় মন্দির ভাঙল, পুড়ল, কোথায় ঘরবাড়ি দোকান লুট হল এসব খবরে সেও অংশ নিক। সেও স্বতঃস্ফূর্ত বলুক—‘এই ধর্মবাদীদের চাবকে সোজা করা দরকার। <এই মুখোশধারী ধার্মিকেরা আসলে সবচেয়ে বড় প্রতারক।’ কিন্তু পারছে কই। তার —দিকে আড়াচোখে যারাই তাকাচ্ছে সকলের চোখ থেকেই করুণা ঝরছে, যেন তার এখানে শুথিাকা নিরাপদ নয়, যেন সে ঠিক এখানে দাঁড়াবার, ওদের মত উত্তেজিত হবার, ওদের সঙ্গে -মিছিল করবার যোগ্য লোক নয়। সে এতদিন ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে —মঞ্চে বা আড্ডায় তুখােড় তুখোড় কথা বলেছে, অথচ আজ তাকে একটি অদৃশ্য শক্তি বোবা করে রাখছে। কেউ বলছেও না, সুরঞ্জন কিছু বল, কিছু কর, রুখে দাঁড়াও।
কায়সার জটলা ভেঙে সামনে আসে। ফিসফিস করে বলে, ‘বায়তুল মোকাররমে বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে মিটিং হবে, লোক জমছে, তুমি বাড়ি চলে যাও।‘
—তুমি যাবে না? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।
কায়সার বলে—আরে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল করতে হবে না!
কায়সারের পেছন লিটন আর মাহতাব বলে দুজন ছেলে ছিল। ওরাও বলে—আসলে আপনার ভালর জন্যই বলছি। শুনেছি জলখাবারও নাকি পুড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশেই ঘটছে ঘটনাগুলো। আপনাকে চিনতে পারলে কী হবে বলুন তো। ওরা হাতে ছুরি, লাঠি, রামদা নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে।
কায়সার একটি রিক্সা ডাকে। রিক্সায় সুরঞ্জনকে তুলে দেবে সে। লুৎফর এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টান দেয়, বলে–আসুন তো দাদা। সোজা বাড়ি যান। এ সময় কেন যে বাইরে বেরোলেন আপনি।
সুরঞ্জনকে বাড়ি পাঠানোর জন্য অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে চেনে না। এমন দু-একজন ছুটে এসে জানতে চায় হয়েছে কী। ওরা বুঝিয়ে বলে ও হিন্দু, ওর এখানে থাকাটা ঠিক নয়। সকলে মাথা নেড়ে সায় দেয়, হ্যাঁ চলে যাওয়াই উচিত। কিন্তু সে তো ঘরে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসেনি। ওরা তার পিঠ আলতো খুঁয়ে, হাত টেনে রিক্সায় ওঠাতে যাবে আর তখনই সুরঞ্জন হাত ছাড়িয়ে নেয়। সে তার হাতখানা একটু হেঁচকাটানেই ছাড়ায়।