Lojja By Taslima Nasrin (লজ্জা পর্ব – 11) Lajja PDF
পর্ব – ১৪
তাপস পালকে থামিয়ে দিয়ে সুরঞ্জন বলে–ধুত্তোরি, রাখো তোমার জ্বালানো পোড়ানো খবর। তার চেয়ে বরং একটা গান গাও।
—গান? আসরের সবাই অবাক হয়। গান আবার এ সময় হয় নাকি! আজি কি আর অন্য দিনের মত দিন? দেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি মন্দির দোকান লুট হচ্ছে, ভাঙছে, পুড়ছে। আর সুরঞ্জনের কি না গান শোনার শখ হল।
হঠাৎ গানের প্রসঙ্গ ছেড়ে সুরঞ্জন বলে—খুব ক্ষিদে পেয়েছে কাজলদা। ভাত খাওয়াবেন?
—এই অসময়ে ভাত? দু-একজন অবাক হয়।
পেট ভরে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে সুরঞ্জনের। একথাল ভাত, চেপা শুটকি দিয়ে মেখে মেখে খেতে ইচ্ছে করছে। ভন ভন করে মাছি ঘুরবে, বাঁ হাত দিয়ে তাড়াবে আর খাবে। সে রামরতিয়াকে দেখেছিল এরকম খেতে, ব্ৰহ্মপল্লীর বাড়ির উঠোনে বসে। রামান্নতিয়া ছিল রাজবাড়ি স্কুলের সুইপার। মায়াকে নিয়ে এসেছিল স্কুল থেকে, সেদিন মায়ার পেট খারাপ ছিল, বাচ্চা মেয়ে, দৌড়ে বাথরুমে যাবে সে বুদ্ধি হয়নি, সাদা পাজামা হলুদ বানিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, হেডমিস্ট্রেস রামরতিয়াকে দিয়ে মায়াকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিরণময়ী রামারতিয়াকে ভাত দিয়েছিলেন খেতে, এত তৃপ্তি করে যে ভাতের মত জিনিস খাওয়া যায়, রামরতিয়ার খাওয়া না দেখলে সুরঞ্জন জানতই না। এখন সে একঘর লোকের সামনে ভাত খেতে চাইছে, সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে! পাগল হঁয়ত নয়, পাগল হলে কি বুক ভেঙে এমন কান্না নামে! গভীর আলোচনা হচ্ছে ঘরে, আর এর মধ্যে সে যদি হু হু করে কেঁদে ওঠে, কেমন বিচ্ছিরি লাগবে না। সারাদিন রোদে রোদে ঘুরেছে সে। পুলকের বাড়ি যাবার কথা। টাকা ফেরত দিতে হবে। মায়ার দেওয়া নোটটি এখনও খরচ হয়নি। রাতে একবার পুলিকের বাড়ি যেতে হবে। তার ক্ষিদে লাগছে, ঘুমও পাচ্ছে।
Lajja By Taslima Nasrin
সুরঞ্জন তন্দ্রার ভেতরে শুনতে পায় কে যেন বলছে নরসিংদির লোহারকান্দা গ্রামের বাসন রানী চৌধুরিকে গ্রামের লোকেরা নিজের বাস্তুভিটে থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাসনার ছেলেকে ছুরি দেখিয়ে স্ট্যাম্প ও সাদা কাগজে সই নেয়। ওরা যাবার আগে বলে যায়। এই ঘটনা কাউকে জানালে বাসনা আর তার দুই ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। বাসনা কি করুণাময়ীর মত দেখতে? কিরণময়ীর মত নরম, নিরীহ, নিরুপদ্রব মানুষ? মাদারিপুরের রমজানপুর গ্রামে সবিতা রানী আর পুষ্প রানীকে ধর্ষণ করে ইউনুস সদরের লোকেরা। খুলনার ভুমুরিয়ায় অৰ্চনা রানী বিশ্বাস, ভগবতী বিশ্বাসকে বাজার.থেকে বাড়ি ফেরার পথে মালো পাড়ায় ভ্যান গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে দু বোনকে নামিয়ে ওয়াজেদ আলীর বাড়িতে ধর্ষণ করে। কারা করে? কারা? কি যেন নাম, মধু, শওকত, আমিনুর। চট্টগ্রামের পটিয়ায় পরিমল দাসের ছেলে উত্তম দাসকে বাদশা মিয়া, নূর ইসলাম, নূর হোসেন রাত তিনটের সময় ঘরে ঢুকে হত্যা করে। মামলা করেছিল উত্তমের লোকেরা, এর ফলে এদের ভিােট ছাড়া করবার চক্রান্ত চলছে। সিলেটের বড়লেখা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সবিস্তা রানী দে রাতে পড়ছিল, এমন সময় নিজামুদ্দিন গুণ্ডােপাণ্ড নিয়ে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। সবিতার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বগুড়ার নৃপেন্দ্ৰ চন্দ্র দত্তের মেয়ে শেফালি রানী দত্তকে অপহরণ করে নিয়ে জোর করে ধমন্তিরিত করা হয়। এডমিনিষ্ট্রেশন কোনও হেল্প করেনি। যশোরের শুড়ো আর বাগডোঙা গ্রামে আর্মস নিয়ে চারদিক ঘেরাও করে হিন্দুদের বাড়ি লুট করে, হিন্দুদের ইচ্ছেমত পেটায়, এগারোজন মেয়েকে সারারাত ধলে রোপ করে। তারপর, তারপর? কেউ বোধহয় জানতে চায়। যে জানতে চায় তার চোখ কি বিস্ফারিত হচ্ছে ভয়ে, ঘূণায় নাকি অন্যরকম এক পুলকে? সুরঞ্জনের চোখ বন্ধ, তার ঘুম পাচ্ছে, তার দেখবার ধৈর্য নেই কার এত কৌতুহল এসব শুনতে যে নোয়াখালির ঘোষবাগ এলাকার সাবিত্রী বালা রায় তার স্বামী মোহনবাসি রায় আর যুবতী মেয়ে নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলিপুরের আবদুল হালিম ননু আবদুর রব বাচু মিয়ারা একদিন সাবিত্রী দেবীর বাড়ি গিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য যে চাষযোগ্য জমি বিক্রি কল্লেছিলেন, সেই জমি বিক্রির আঠারো হাজার টাকা ছুরি দেখিয়ে ছিনিয়ে নেয়। তারা তাদের বাকি জমি তাদের নামে লিখে দিয়ে ভারত চলে যেতে বলে প্ৰাণনাশের হুমকি দেয়। তার যাবার সময় গোয়ালের গরুগুলোও নিয়ে যায়। যদি সাবিত্রীরা ভারত না যায় কি হবে? কী হবে। আর, মেরে ফেলা হবে। শেরপুরের সাপমারি গ্রামের তিনশ ষাটটি গোয়ালা পরিবার মৌলবাদীর অত্যাচারে দেশ ত্যাগ করেছে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির চারুচন্দ্ৰ দে সরকার, সুমন্তমোহন দে সরকার, যতীন্দ্রমোহন দে সরকার, দীনেশচন্দ্ৰ দে সরকারের প্রচুর জমাজমি জাল দলিলের মাধ্যমে এলাকার টাউট মুসলমানেরা দখল করে নিয়েছে। ময়মনসিংহের দাপুনিয়ার রঞ্জন রাজভর-এর পরিবারকে জাল দলিল করে ভিটে থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। রঞ্জনের দু বোন মালতী আর রামরতিকে জোর করে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে করে, বিয়ের কিছুদিন পর দু বোনকেই তাড়িয়ে দেয়। জয়পুর হাটের বালিঘাটা গ্রামের নারায়ণ চন্দ্ৰ কুণ্ডের কুড়ি বিঘা জমি জোর করে দখল করে নিয়েছে মুসলমান বগর্দিাররা। তারা ওখানে ঘরবাড়িও বানিয়ে নিয়েছে। সুরঞ্জনের ঘুম পায়, আবার পায়ও না। সে শুনতে চায় না, তবু কানে ভাসে কারও কণ্ঠ-আলী মাস্টার, আবুল বাশার, আর শহীদ মোড়লরা বন্দুক স্টেনগান নিয়ে কমান্ডো কায়দায় নারায়ণগঞ্জের চরগোরকুলের ছটি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছে। তারা সুভাষ মণ্ডল, সম্ভোষ, নেতাই, ক্ষেত্রমোহনের সব কিছু কেড়ে নিয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে।
কে একজন সুরঞ্জনকে ডাকে-ওঠ, ওঠ সুরঞ্জন, খেয়ে নাও! ভাত দিয়েছে।
কাজলদাই ডাকছেন মনে হয়। মায়া এরকম ডাকে, দাদা এস, ভাত দিয়েছি, খেয়ে নাও। মায়ার নোটটি রাতে সে ভাঙাবো। কটা ঘুমের ওষুধ কিনবে। কতদিন মনে হয় ঘুমানো হয় না। তার। রাত হলেই ছারপোকা কামড়ায়। বিছানা ভরা ছারপোকা, ছোটবেলায় সুরঞ্জন দেখত কিরণময়ী হাতপাখা মেঝোয় টুকে ঠুকে ছারপোকা মারতেন। মায়াকে বলে আজ রাতেই ঘরের সব ছারপোকা মেরে ফেলতে হবে। টুকটুক করে কামড়ায় সারারাত। মাথার ভেতর কামড়ায়। সুরঞ্জনের আবার বিমঝিম করে ওঠে মাথা। বমি আসতে চায়। এর মধ্যে কে একজন বলে, তার বাড়ি রাজবাড়ি, সম্ভকত তাপসের গলা। এটি, আমাদের ওখানে তিরিশটি মন্দির আর মন্দিরের আশেপাশের বাড়িঘরে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটি কণ্ঠ সন্ধের ঝোঁকে গলগল করে বলে-নোয়াখালির খবর বলি শোন, সুন্দলপুর গ্রামে সাতটি বাড়ি আর অধরচাঁদ আশ্রম লুট করে আগুন জ্বলিয়ে দেয়। জগন্নানন্দ গ্রামে তিনটি বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন লাগিয়ে দেয়। গঙ্গাপুর গ্রামেও তিনটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিয়েছে। রাগারগাঁও গ্রাম, দৌলতপুর গ্রাম, ঘোষবাগ, মাইজদি, সোনাপুরের কালী মন্দির, বিনোদপুর আখড়া, চৌমুহুনির কালী মন্দির, দুৰ্গাপুর গ্রাম, কুতুবপুর, গোপালপুর, সুলতানপুরের অখণ্ড আশ্রম, ছয়আনি বাজারের কয়েকটি মন্দির ভেঙে ফেলেছে। বাবুপুর তেতুইয়া, মহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গির পাড়, কাজির হাট, রসূলপুর, জমিদারহাট, চৌমুহঁনি পোড়াবাড়ি, ভবভদ্রী গ্রামে দশটি মন্দির আঠারোটি বাড়িতে আগুন জ্বালানো হয়। কোম্পানিগঞ্জে বড় রাজপুর গ্রামে উনিশটি বাড়িতে লুটপাট, মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটানো হয়। রামদি গ্রামে আজ বিপ্লব ভৌমিক নামের এক লোককে দা দিয়ে কোপানো হয়েছে।
সুরঞ্জন যদি তুলো দিয়ে কানের ফুটো দুটো বন্ধ করে রাখতে পারত। চারদিকে বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ, চারদিকে ভাঙা পোড়ার গল্প। আহ, যদি কোনও নির্জনতা পেত সুরঞ্জন। এই সময় ময়মনসিংহে চলে যেতে পারলে ভাল হত। এইসব ভাঙাভাঙিগুলো ওখানে কম। ব্ৰহ্মপুত্রে সারাদুপুর স্বান করতে পারলে বোধহয় শরীরে যে জ্বালা ধরছে, কিছু জুড়তো। ঝাঁট করে উঠে পড়ে সে। ঘরের লোক অনেকে এর মধ্যে চলে গেছে। সুরঞ্জনও যাবার জন্য পা বাড়ায়। কাজলদা বলেন–টেবিলে ভাত আছে, খেয়ে নাও। এই অসময়ে ঘুমোলে যে! শরীর খারাপ?
সূরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বলে—না কাজলদা, খাব না। ইচ্ছে করছে না। শরীরটা যেন কেমন কেমন লাগছে।
–এর কোনও মানে হয়?
—মনে হয়ত হয় না। কিন্তু করব কি বলুন। একবার ক্ষিদে লাগে, একবার ক্ষিদে চলে যায়। টক ঢেকুর উঠছে, বুক জ্বলছে। ঘুম পায়, কিন্তু ঘুমোতে গেলে ঘুমও আসে না আর।
যতীন চক্রবর্তী সুরঞ্জনের কাঁধে হাত রেখে বলেন—তুমি ভেঙে পড়ছি সুরঞ্জন। আমাদের কি এভাবে হতাশ হলে চলবে? শক্ত হও। বেঁচে তো থাকতে হবে।
সুরঞ্জন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল, যতীনন্দার কথাগুলো সুধাময়ের কথার মত শোনায়। বাবার অসুস্থ শিয়রে তার কতদিন বসা হয় না। আজ আর দেরি করবে না বাইরে। কাজলদার বাড়ি এলেই এই হয়, নানারকম লোক আসেন। ধুম আড্ডা হয়। রাজনীতি, সমাজনীতির কঠিন কঠিন কথাবাত চলে অর্ধেক রাত পর্যন্ত। সুরঞ্জন কতক শোনে, কতক শোনে না।
টেবিলে বাড়া ভাত রেখেই সে চলে যায়। অনেকদিন বাড়িতে খায় না, আজ খাবে। আজি মায়া, কিরণময়ী, সুধাময়কে নিয়ে সে একসঙ্গে খেতে বসবে। এতদূরত্ব তৈরি হচ্ছে বাড়ির সবার সঙ্গে, দূরত্ব তৈরির কারণ অবশ্য সে নিজে। সামনে আর দেওয়াল রাখবে না। সুরঞ্জন। সকালে যেমন খুব মন ভাল ছিল, তেমন ভাল মন নিয়ে সে সবার সঙ্গে হাসবে, কথা বলবে, ছোটবেলার সেই রোদে বসে ভাপা পিঠে খাওয়ার দিনের মতা-মনেই হবে না। কেউ কারও পিতা পুত্র, কেউ কারও ভাই বোন, যেন বন্ধু সব, খুব কাছের বন্ধু। আজ আল্প কারও বাড়িতে যাবে না। সে, পুলকের বাড়ি না, রত্নার বাড়ি না। সোজা টুিকটুলি গিয়ে ডাল ভাত যা হোক খেয়ে সবার সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবে, তারপর ঘুম দেবে।
কাজলদা নীচের গেট অদি এগিয়ে দেন। খুব আন্তরিক কষ্ঠেই বলে-তোমার কিন্তু এভাবে বাইরে বের হওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমরা এই বাউন্ডারির ভেতরেই যা চলাফেরা করছি, এর বাইরে নয়। এ বাড়িতে যারা এসেছে তারা কেউ দূর থেকে আসেনি। আর তুমি দিব্যি একা একা শহর ঘুরে বেড়ােচ্ছ। কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না।
সুরঞ্জন কোনও কথা না বলে দ্রুত সামনে হাঁটে। পকেটে টাকা আছে, দিব্যি রিক্সা নেওয়া যায়। কিন্তু মায়ার টাকাটায় রীতিমত মায়া বসে গেছে, খরচ করতে ইচ্ছে করছে। না। সারাদিন সিগারেট ফোঁকেনি সে। টাকার মায়া ফুঁড়ে সারাদিন পর রাত ঘন হয়ে এলে তার সিগারেটের তৃষ্ণা হয়; দোকানো দাঁড়িয়ে এক প্যাকেট বাংলা ফাইভ কেনে, রাজা রাজা লাগে নিজেকে। হেঁটে হেঁটে কাকরাইলের মোড়ে এসে সে রিক্সা নেয়। শহর যেন অনেক আগেই আজকাল ঘুমিয়ে পড়ে। অসুস্থ থাকলে মানুষ যেমন সকাল সকাল ঘুমায়, শহরও তেমনি। শহরের রোগটা কি? ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে তার এক বন্ধুর পাছায় বড় এক ফোঁড়া হয়েছিল, দিনরাত চিৎকার করত, কিন্তু ওষুধ দেখলে ভয় পেত, ইনজেকশন দেখে তার রীতিমত কাঁপুনি উঠত। শহরের পাছায় কি তেমন একটি ফোঁড়া হয়েছে। সুরঞ্জনের সেরকমই মনে হয়।
৬ঘ.
-আচ্ছা মায়া, সুরঞ্জনের হয়েছে কি বল তো? সে এ সময় বাইরে বাইরে ঘুরছে। কোথায় বল তো দেখি। সুধাময় জিজ্ঞেস করেন।
—পুলকদার বাড়ি যাবে বলেছে। ওখানে আড্ডায় বসেছে নিশ্চয়।
—তাই বলে সন্ধের আগে বাড়ি ফিরবে না?
—কী জানি, বুঝতে পারি না। ফেরা তো উচিত?
–সে কি একবারও ভাবে না বাড়িতে মানুষগুলো দুশ্চিন্তা করছে, এবার বাড়ি ফিরি।
মায়া থামিয়ে দেয় সুধাময়কে। —থাক তুমি এত কথা বলে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তোমার। উচিতও নয়। চুপচাপ শুয়ে থােক। এখন অল্প একটু খাবে। এরপর কোনও বই-টই যদি পড়ে শোনাতে হয়, শোনাব। ঠিক দশটায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। এর মধ্যে দাদা ফিরবেই, তুমি ভেব না।
—তুই আমাকে শিগরি ভাল করে তুলছিস মায়া। আমি না হয় আরও কটা দিন পড়ে থাকতাম বিছানায়। ভাল হওয়ার কিন্তু বিপদও আছে।
—কি রকম বিপদ? মায়া বিছানায় বসে ভাত চটকায় আর জিজ্ঞেস করে।
সুধাময় হেসে বলেন–তুই মুখে তুলে খাওয়াচ্ছিস, কিরণময়ী হাত পা মালিশ করছে। মাথা টিপে দিচ্ছে। এত আদর কি ভাল হয়ে গেলে পাব? তখন রোগী দেখ, বাজার কর, মায়ার সঙ্গে দুবেলা ঝগড়া কর। সুধুময় হেসে ওঠেন। মায়া অপলক সুধাময়ের হাসির দিকে তাকিয়ে থাকেন। অসুখের পর আজ প্রথম হাসতে দেখছে সে সুধাময়কে।
তিনি কিরণময়ীকেও বলছেন—আজ সব জানালা খুলে দাও তো। ঘর এত অন্ধকার হয়ে থাকে, ভাল লাগে না। আজ একটু হাওয়া ঢুকুক। শীতের হাওয়ার স্বাদই পেলাম না। কেবল কি বসন্তের হাওয়ায় সব ভাল লাগা? যৌবনে কনকনে শীতে দেওয়ালে পোস্টার লাগাতাম। গায়ে একটা ফিনফিনে শার্ট থাকত। মনি সিং-এর সঙ্গে সুসং দুগাপুরের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি। সে সময়ের টংক আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহের কথা কিছু জানো কিরণময়ী?
কিরণময়ীরাও মন ভাল, বলেন—তুমি বিয়ের পর কত না গল্প করেছ। নেত্রকোণার এক অচেনা বাড়িতে মনি সিং-এর সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলে!
—আচ্ছা কিরণ, সুরঞ্জন কি গরম কাপড় পরে গেছে।
মায়া ঠোঁট উল্টে বলে—আরে না। তোমার মতই ফিনিফিনে শার্ট পরা। তিনি তো আবার এ কালের বিপ্লবী। গায়ে তার প্রকৃতির হাওয়া লাগে না। যুগের হাওয়া সামলাতে ব্যস্ত।
কিরণময়ীর কণ্ঠে রাগ ফোটে–সারাদিন কোথায় থাকে, কী খায় না খায়। আন্দেী খায় কি না। ওর উচ্ছঙ্খলতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
তখনই দরজায় খুটি খুঁট শব্দ। সুরঞ্জন এল নাকি? সুধাময়ের শিয়রের কাছে বসেছিলেন কিরণময়ী, উঠে যান দরজার দিকে। সুরঞ্জন ঠিক এভাবেই শব্দ করে। বেশি রাত হলে ও অবশ্য তার ঘরেই সোজা ঢোকে। কখনও দরজায় তালা দিয়ে যায়। তালা না দিলেও বাইরে থেকে ভেতরের ছিটিকিনি খুলবার কায়দা জানে। ও। বেশি রাতে যখন হয়নি, সুরঞ্জনই বোধহয়। মায়া সুধাময়ের জন্য জাউদ্ভাতে ডাল মাখছিল। খাবার ডলে ডলে সে নরম করছিল, সুধাময়ের খেতে যেন অসুবিধে না হয়। অনেক দিন লিকুইড খাওয়ানো হয়েছে। ডাক্তার সেমি সলিড খাবার কথা বলে গেছেন। শিংমাছের ঝোল করা হয়েছে। সামান্য ঝোল নিয়ে মাখছে। যখন মায়া, তখনই দরজায় খুঁট খুঁট শব্দ শোনে। কিরণময়ী দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছেন কে। ওদিক থেকে কি উত্তর আসে কান পেতেছিলেন সুধাময়। কিরণময়ী দরজা খুলবোর সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে ঢোকে সাতজন যুবক। চারজনের হাতে মোটা লাঠি, আর বাকি তিনজনের হাতে কি দেখবার আগেই ওরা কিরণময়ীকে ডিঙিয়ে ভেতরের ঘরে ঢোকে। বয়স ওদের একুশ বাইশ হবে। দুজনের মাথারটুপি, পাজামা পাঞ্জাবি পরা। বাকি তিনজনের শার্ট প্যান্ট। ওরা ঢুকে কারও সঙ্গে কোনও কথা নেই টেবিল চেয়ার, কাচের আলমারি, টেলিভিশন, রেডিও, থালাবাসন, গ্লাস, বাটি, বইপত্র, ড্রেসিং টেবিল, কাপড়াচোপড়, পেডেস্টাল ফ্যান যা সামনে পাচ্ছে উন্মত্তের মত ভাঙতে শুরু করে। সুধাময় উঠে বসতে চান, পারেন না। মায়া চিৎকার করে ওঠে বাবা বলে। কিরণময়ী দরজা ধরে স্তব্ধ দাঁড়িয়েছিলেন। কী বীভৎস দৃশ্য। একজন কোমর থেকে একটি রামদা বের করে, বলে—শালারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছিস। তোদের আস্ত রাখব ভেবেছিস?
ঘরের একটি জিনিসও আস্ত থাকে না। ঝনঝনি করে সব ভেঙে পড়তে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যায় সব, কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই। মায়াও ছিল স্থির, স্তব্ধ। হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে যখন তার হাত ধরে টান দেয়। ওদের মধ্যে একজন। কিরণময়ীও তার ধৈর্য ভেঙে আর্তনাদ করে ওঠেন। সুধাময় গোঙান কেবল। তাঁর ভাষা ফোটে না। তিনি চোখের সামনে দেখেন মায়াকে ওরা টেনে নিচ্ছে। মায়া খাটের রেলিং ধরে নিজেকে আটকে রাখছে। কিরণময়ী দৌড়ে এসে দু হাতে আটকে রাখেন মায়াকে। দুজনের গায়ের শক্তি, দুজনের আর্তনাদকে ছুড়ে দিয়ে ওরা মায়াকে টেনে নিয়ে যায়। পেছন পেছন দৌড়েন। কিরণময়ী। চিৎকার করে বলতে থাকেনা-বাবারা ছেড়ে দাও। আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।
রাস্তায় দুটো বেবি ট্যাক্সি দাঁড়ানো ছিল। মায়ার হাতে তখনও সুধাময়ের জন্য ভাত মাখানোর দাগ। ওড়না খুলে পড়ে গেছে। ওর। সে ‘মা গো মা গো চিৎকার করছেই। পেছনে আকুল চোখে তাকাচ্ছে কিরণময়ীর দিকে। কিরণময়ী তাঁর শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়েও মায়াকে ধরে রাখতে পারেননি। ওদের চকচকে রামদাকে তুচ্ছ করে কিরণময়ী ঠেলে সরাতে চেয়েছিলেন দুজনকে। পারেননি। ছুটে যাওয়া বেবি ট্যাক্সির পেছন পেছন তিনি দৌড়োতে থাকেন। পথচারী যাকে পান, বলেন-আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। একটু দেখুন, দেখুন না। দাদা। মোড়ের দোকানে কিরণময়ী থামেন। চুল খোলা, খালি পা, কিরণময়ী মতি মিয়াকে বলেন-একটু দেখবেন দাদা, কারা এইমাত্র ধরে নিয়ে গেল মায়াকে, আমার মেয়েকে। সকলে নিরুজ্ঞাপ চোখে তাকায় কিরণময়ীর দিকে। যেন পথের পাগল আবোল-তাবোল বকছে। কিরণময়ী দৌড়োতে থাকেন।
সুরঞ্জন বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে অবাক হয়। দরজা হাট করে খোলা! জিনিসপত্র সব তছনছ, টেবিল উল্টে পড়ে আছে, বইপত্র মেঝোয় গড়াচ্ছে। বিছানার তোষক চাদর বিছানায় নেই। আলনা ভেঙে পড়ে আছে, কাপড়চোপড় ছড়িয়ে আছে। সারা ঘরে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঢোকে। মেঝে ভর্তি ভাঙা কাচের টুকরো, চেয়ারের ভাঙা হাতল, ছেড়া বই, ওষুধের শিশি। সুখময় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন ঘরের মেঝোয়। কাতরাচ্ছেন। মায়া, কিরণময়ী কেউ নেই। সুরঞ্জনের জিজ্ঞেস করতে ভয় হয় বাড়িতে কী হয়েছে’। সুধাময় নীচে পড়ে আছেন কেন? ওরাই বা কোথায়? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সুরঞ্জন ট্রের পায় তার গলা কাঁপছে। সে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে।
সুধাময় ধীরে, বেদনায় উচ্চারণ করেন-মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে।
সুরঞ্জন আমূল কেঁপে ওঠে–ধরে নিয়ে গেছে? কারা নিয়েছে, কোথায়? কখন?
সুধাময় পড়ে আছেন, না পারছেন নড়তে, না পারছেন কাউকে ডাকতে। সুরঞ্জন আলগোছে সুধাময়কে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। দ্রুত শ্বাস ফেলছেন তিনি, কুলকুল ঘামছেন।
—ম কোথায়? সুরঞ্জন অক্ষুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
সুধাময়ের নীল হয়ে গেছে মুখ শঙ্কায়, হতাশায়। সারা শরীর কাঁপছে তাঁর। প্রেসার বাড়লে যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে এখন সুধাময়কে দেখবে, নাকি মায়াকে খুজতে যাবে। কিছুই স্থির করতে পারে না। সুরঞ্জন। তারও গা হাত পা কাঁপে। তার মাথার ভেতর পাক খায় ক্রুদ্ধ অস্থির জল। পাক খায় একপাল হিংস্ৰ কুকুরের মুখে পড়া একটি আদুরে বেড়ালী ছানার মায়াময় মুখ। সুরঞ্জন দ্রুত বেরিয়ে যায়। সুধাময়ের অচল হাতটি ছুঁয়ে বলে যায়–মায়াকে যে করেই হোক নিয়ে আসব বাবা।
হায়দারের বাড়ির দরজা জোরে ধাক্কায় সুরঞ্জন। এত জোরে যে হায়দার নিজে দরজা খোলে।
সুরঞ্জনকে দেখে চমকে ওঠে। বলে–কী খবর সুরঞ্জন? হয়েছে কি তোমার?
সুরঞ্জন প্রথম কিছু বলতে পারে না। গলার কাছে আটকে থাকে দালা-পাকানো কষ্ট। –মায়াকে ধরে নিয়ে গেছে। কলবার সময় কণ্ঠ বুজে আসে সুরঞ্জনের। তার আর বোঝাতে হয় না। মায়াকে কারা ধরে নিয়ে গেছে।
–কখন নিয়েছে?
সুরঞ্জন উত্তরে কিছু বলে না, কখন নিয়েছে এই খবরটির চেয়ে মায়াকে যে নিয়ে গেছে, এটিই কি জরুরি নয়? হায়দারের কপালে ভাঁজ পড়ে ভাবনার। দলের মিটিং ছিল, মিটিং সেরে সে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। এখনও কাপড় পাল্টানো হয়নি। শার্টের বোতাম খুলছে কেবল। সুরঞ্জন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হায়দারের দিকে। বানে সৰ ভেসে গেলে যেমন দেখতে হয় মুখ, তাকে ঠিক লাগছে তেমন। সূরঞ্জন দাঁড়িয়েছিল। দরজা ধরে, যে হাতে দরজা ধরা সে হাতটি কাঁপছে তার। কপিন থামাবার জন্য সে মুঠি করে ধরে হাতটি। হায়দার তার কাঁধে হাত রেখে বলে-শান্তু হয়ে ঘরে বস, দেখি কি করা যায়।
কাঁধে হাত পড়তেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সুরঞ্জন। হায়দারকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলে–মায়াকে এনে দাও হায়দার। মায়াকে দাও।
সুরঞ্জন কাঁদতে কাঁদতে নত হয়। নত হতে হতে সে হায়দারের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। হায়দার অবাক হয়। এই লোহার মত শক্ত ছেলেটিকে কখনও সে কাঁদতে দেখেনি। তুলে তাকে দাঁড় করায় সে। হায়দার তখনও রাতের খাবার খায়নি, ক্ষিদে পেটে। তবু চল দেখি বলে বেরিয়ে যায়। হোন্ডার পেছনে সুরঞ্জনকে বসিয়ে টিকাটুলির অলিগিলিতে খোঁজে। সুরঞ্জন চেনে না। এমন সব ঘরে ঢেকে। টিমটিম করে বাতি জ্বলছে এমন কিছু পান বিড়ির দোকানঅলার সঙ্গেও ফিসফিস করে কথা বলে। টিকাটুলি পার করে ইংলিশ রোড, নবাবপুর, লক্ষ্মীবাজার, লালমোহন সাহা স্ট্রিট, বকশি বাজার, লালবোগ, সূত্রপুর, ওয়াইজ ঘাট, সদরঘাট, প্যারীমোহন দাস রোড, অভয় দাস লেন, নারিন্দা, আলু বাজার, ঠাঁটারি বাজার, প্যারীদাস রোড, বাবুবাজার, উর্দু রোড, চক বাজারে বোঁ বোঁ করে ঘুরুল হায়দারের হোন্ডা। এঁদো গলির ভেতর কাদাজলে হাঁটু ডুবিয়ে গিয়ে এক-একটি অস্বীকার বাড়ির কড়া নেড়ে হায়দার কাকে যে খোঁজে, সুরঞ্জন বুঝে পায় না কিছু। হায়দার এক-এক জায়গায় নামে আর সে ভাবে এখানেই বুঝি আছে মায়া। মায়াকে বোধহয় এখানেই হাত পা বেঁধে ওরা পেটাচ্ছে, কেবল কি পেটাচ্ছেই নাকি আরও কিছু করছে। সুরঞ্জন কান পেতে থাকে মায়ার কান্নার শব্দ কোথাও থেকে ভেসে আসে কি না।
লক্ষ্মী বাজারের কাছে একটি কান্নার শব্দ শুনে সুরঞ্জন হোল্ডা থামাতে বলে। বলে–শোন তো, মায়ার কান্না মনে হচ্ছে না?
কান্নাটির পেছন পেছন যায়। তারা দেখে টিনের একটি দোচালা বাড়িতে বাচ্চা কাঁদছে। বিলি কেটে কেটে খোঁজে হায়দার। রাত গভীর হতে থাকে। সুরঞ্জন থামে না। গলিতে গলিতে দিলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লাল চোখের ছেলেরা, দেখে সুরঞ্জনের মনে হয়, বুঝি। এরাই নিয়েছে, এরাই বুঝি তার নিরীহ মায়া মায়া মুখের বোনটিকে আটকে রেখেছে।
—হায়দার, পাচ্ছ না কেন? এখনও পাচ্ছ না কেন মায়াকে?
–আমি তো চেষ্টা করছিই।
—যে করেই হোক মায়াকে আজ রাতের মধ্যেই পেতে হবে।
—এমন কোনও মস্তান ছেলে নেই যাকে খুঁজছি না। না পেলে কি করব বল। সুরঞ্জন একটির পর একটি সিগারেট ধরায়। মায়ার টাকায় কেনা সিগারেট।
—সুপারস্টারে চল কিছু খেয়ে নিই। ক্ষিধে পেয়েছে।
পরোটা মাংসের অডার দেয় হায়দার। দু প্লেট। সুরঞ্জন খেতে চায়, পরোটার টুকরো তার হাতেই রয়ে যায়, মুখে ওঠে না। যত সময় যায়, বুকের মধ্যটা খালি হয় তত। হায়দার গোগ্রাসে খায়। খেয়ে সিগারেট ধরায়। সুরঞ্জন তাড়া দেয়। —চল উঠি, এখনও তো পাওয়া যাচ্ছে না।
–আর কোথায় খুঁজিব, বল। বাকি তো রাখিনি কোনও জায়গা। নিজের চোখেই তো দেখলে!
–ঢাকা একটা ছোট্ট শহর। এখানে মায়াকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কথা হল? থানায় চল।
থানায় ঘটনাটি জানালে পুলিশের লোক ভাবলেশহীন মুখে ডায়রি করুবার খাতা টেনে নাম-ধাম লিখে রাখে। ব্যস। থানা থেকে বেরিয়ে সুরঞ্জন বলে-ওরা কোনও কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে না।
—করতেও পারে।
–ওয়ারির দিকটা চল যাই। ওখানে চেনা কেউ আছে-তোমার?
–আমি পাটির ছেলেদের লাগিয়ে দিয়েছি। ওরাও খুঁজবে। তুমি ভেব না তো।
হায়দার চেষ্টা করছে, তবু দুশ্চিন্তার বোলতা সুরঞ্জনের সারা শরীর কামড়ায়। সারারাত হায়দারের হোন্ডটি পুরনো শহরে ঘোরে। মস্তানদের মদের আড্ডা, জুয়োর আড্ডা, স্মাগলারদের ঘুপচি ঘর খুঁজতে খুঁজতে একসময় আজান পড়ে। আজানের সুরটি সুরঞ্জনের ভালই লাগত, ভৈরবী রাগে গাওয়া। এটি আজ বড় বিচ্ছিরি লাগে তার। আজান হচ্ছে, তার মানে রাত শেষ হয়ে এল, মায়াকে পাওয়া হল না!! টিকাটুলিতে এসে হোল্ডা থামায় হায়দার। বলে—সুরঞ্জন, মন খারাপ করো না। কাল দেখি কী করা যায়।
লণ্ডভণ্ড ঘরে বসে কিরণময়ী ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে ছিলেন দরজার দিকে, সুরঞ্জন মায়াকে নিয়ে ফিরবে। এই আশায় সুধাময়ও তাঁর চেতনাহীন অঙ্গ নিয়ে নিদ্রাহীন উদ্বিগ্ন সময় পার করছিলেন। ওঁরা দেখেন ছেলে খালি হাতে ফিরেছে। মায়া নেই। ক্লান্ত, ব্যর্থ নতমুখ, বিষন্ন সুরঞ্জনকে দেখে দুজনই বাকরুদ্ধ হন। তবে কি মায়াকে আর পাওয়া যাবে না? দুজনই ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। বাড়ির দরজা জানোলা সব বন্ধ, কোনও ঘরে ভেন্টিলেটর নেই। হাওয়া আটকে আছে। ঘরে। ভ্যাপসা গন্ধ বেরোচ্ছে। হাত পা মাথা গুটিয়ে বসে আছেন ওঁরা। কেমন ভূতের মত দেখতে লাগে ওঁদের, সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে। ওঁদের দু চোখে একগাদা প্রশ্ন। সব প্রশ্নের তো উত্তর একটিই, মায়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মেঝোয় পা ছড়িয়ে বসে পড়ে সুরঞ্জন। তার বমি বমি লাগে। এতক্ষণে মায়ার ওপর সম্ভবত গণধর্ষণও সারা। আচ্ছ এরকম কি হতে পারে না, ছ। বছরের মায়া যেমন দু দিন পর ফিরে এসেছিল, সেরকম এবারও ফিরে এল! সুরঞ্জন দরজা খুলেই রেখেছে, মায়া ফিরে আসবে, ফিরে আসুক মায়া, ছোটবেলার মত উদাসীন পায়ে হেঁটে ফিরে আসুক। এই ছোট্ট, বিধ্বস্ত, সর্বস্বাস্ত সংসারে ও ফিরে আসুক। হায়দার কথা দিয়েছে মায়াকে খুঁজবে আরও। কথা যখন দিয়েছে, সুরঞ্জন কি এই স্বপ্ন দেখতে পারে যে মায়া ফিরবে! মায়াকে কেন ধরে নিয়ে গেল ওরা? মায়া হিন্দু বলে? আর কত ধর্ষণ, কত রক্ত, কত ধনসম্পদের বিনিময়ে হিন্দুদের বেঁচে থাকতে হবে এই দেশে? কচ্ছপের মত মাথা গুটিয়ে রেখে! কতদিন? সুরঞ্জন নিজের কাছে উত্তর চায়। পায় না।
কিরণময়ী বসেছিলেন ঘরের এক কোণে, দেওয়ালে পিঠ রেখে, কারও জন্য নয়, নিজেকে শুনিয়ে তিনি বলেন–ওরা বলল, মাসিমা, আপনাদের দেখতে এসেছি কেমন আছেন। আমরা পাড়ারই ছেলে। দরজাটা খুলুন। ওদের বয়স আর কত, কুড়ি একুশ, বাইশ এরকম। আমি কি ওদের সঙ্গে পারি শক্তিতে? পাড়ার বাড়িগুলোয় গিয়ে কেঁদে পড়লাম, সবাই শুনল শুধু। চুক চুক করে দুঃখ করল, কেউ কোনও সাহায্য করল না। ওদের একজনের নাম রফিক, টুপিঅলা একটা ছেলেকে ডাকতে শুনলাম। পারুলের বাড়ি লুকিয়ে ছিল। ক’দিন। ওখানে থাকলে বেঁচে যেত। মায়া কি ফেরত আসবে না? তার চেয়ে বাড়িটা পুড়িয়ে দিত। নাকি বাড়িঅলা মুসলমান বলে পোড়ায়নি। তার চেয়ে মেরে যেত, আমাকেই মেরে যেত। তবু নিরপরাধ মেয়েটিকে রেখে যেত। জীবন তো শেষই ছিল আমার, ওর তো ছিল শুরু।
প্রচণ্ড ঘুরে ওঠে মাথা সুরঞ্জনের। সে গলগল করে বমি করে কলঘর ভাসিয়ে ফেলে।
পর্ব – ১৫
৭ক.
রোদ পড়েছে বারান্দায়। কালো সাদা বেড়ালটি এদিক ওদিক হাঁটছে। ও কি কাঁটা খুঁজছে, নাকি মায়াকে খুঁজছে। মায়া ওকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াত, মায়ার লেপের তলে ও গুটিসুটি ঘুমিয়ে থাকত। ও কি জানে মায়া নেই?
মায়া নিশ্চয় খুব কাঁদছে। ‘দাদা দাদা’ বলেও হয়ত ডাকছে। মায়ার কি হাত পা বেঁধে নিয়েছে ওরা? মুখে কাপড় খুঁজে? ছ’ বছর আর একুশ বছর এক নয়। দু বয়সের মেয়েকে ধরে নেবার উদ্দেশ্যও এক নয়। সুরঞ্জন অনুমান করতে পারে একুশ বছর বয়সের একটি মেয়েকে নিয়ে সাতজন পুরুষ কি করতে পারে। তার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে ওঠে ক্ষোভে, যন্ত্রণায়। মরে গেলে যেমন কাঠ হয়ে পড়ে থাকে শরীর, অনেকটা সেরকম। সুরঞ্জন কি বেঁচে আছে? বেঁচে তো আছেই। মায়া নেই। মায়া নেই বলে মায়ার আত্মীয়রা বেঁচে থাকবে না? জীবনের ভাগ কেউ কাউকে দেয় না। মানুষের মত স্বার্থপর প্রাণী জগতে আর নেই।
হায়দার খুঁজেছে ঠিকই। তবু সুরঞ্জনের মনে হয়, হায়দার যেন ঠিক মন দিয়ে খোঁজেনি! সুরঞ্জন মুসলমান দিয়ে মুসলমানদের খুঁজিয়েছে, কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তুলতে হয়, তেমন। শুয়ে শুয়ে উঠোনের রোদে শোয়া বেড়ালটি দেখতে দেখতে সুরঞ্জনের হঠাৎ সন্দেহ হয়, হায়দার আসলে জানে মায়াকে কারা নিয়ে গেছে। ও যখন সুপারস্টারে খাচ্ছিল, হাপুস হুপুস করে, ওর মুখে কোনও দুশ্চিস্তার ভাঁজ ছিল না। বরং খাবার পর বেশী তৃপ্তির ঢেকুর ছিল, সিগারেটের ধোঁয়াও যখন ছাড়ল, এত আয়েশ ছিল ওর ধোঁয়া ছাড়ায়, মনে হয়নি ও কাউকে খুঁজতে বেরিয়েছে, এবং খুঁজে পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। গুর আবার রাতভর নিশাচরের মত শহর ঘুরুবার শখ আছে। ও কি শখ মেটালো। তবে? মায়াকে ফিরে পাবার সত্যিকার কোনও উৎসাহ ছিল না? যেটুকু ছিল তা যেন তেন করে বাঞ্ছাস্ট্রের দায় শোধ। থানার লোককেও তেমন জোর দিয়ে বলেনি, পাটির যে ছেলেদের সঙ্গে সে কথা বলেছে, আগে পার্টির কথা সেরে পরে বলেছে, যেন মায়ার বিষয়টি জরুরি কুতুব এক নম্বরে নয়, দুই নম্বরে। হিন্দুৱা দেশের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তাই বলেই কি?
সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় না মায়া পাশের ঘরে নেই, যেন সে এক্ষুণি ওঘরে গেলেই দেখতে পাৰে মায়া সুধাময়ের ডান হাতটির ব্যায়াম করিয়ে দিচ্ছে। যেন ওঘরে গেলেই শ্যামলা মেয়েটির মুখে দাদা কিছু একটা করা-র আকুলতা ফুটে উঠবে। মেয়েটার জন্য কিছুই করা হয়নি। থাকে না দাদার কাছে আবদার, বেড়াতে নাও, ওটা কিনে দাও, এটা দাও। আবদার তো করেই ছিল মায়া, সুরঞ্জন রাখেনি, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে৷ দিনরাত। বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, পার্টি-কে মায়া, কে কিরণময়ী, কে সুধাময়, তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনে তার দরকার কী! সে এই দেশকে মানুষ বানাতে চেয়েছিল, সুরঞ্জনের সাধের দেশটি কি মানুষ হয়েছে আদৌ?
নটা বাজলেই হায়দারের বাড়ি ছোটে সুরঞ্জন। কাছেই বাড়ি।–তখনও ঘুমোচ্ছে হায়দার। বাইরের ঘরে অপেক্ষা করে সে। অপেক্ষা করতে করতে তার সন্দেহ হয়, ওদের সাতজনের একজনের নাম ছিল রফিক, ছেলেটিকে বোধহয় চেনে হায়দার। এমনও হতে পারে রফিক তার আত্মীয় হয়। গা শিউরে ওঠে সুরঞ্জনের। দুঘণ্টা পর ঘুম ভাঙে হায়দারের। সুরঞ্জনকে বসে থাকা দেখে সে জিজ্ঞেস করে–ফিরেছে?
—ফিরলে কি আর এসেছি তোমার কাছে?
—ও। হায়দারের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে লুঙ্গি পরা, খালি গা, গা দু হাতে চুলকোয়। বলে–এবার শীত পড়েনি তেমন, তাই না? আজও সভানেত্রীর বাড়িতে মিটিং আছে। সম্ভবত মিছিল করার প্রস্তুতি চলবে। গোলাম আজমের ব্যাপারটা যখন তুঙ্গে, তখনই শাল দাঙ্গা বাঁধল। আসলে এগুলো হচ্ছে বি এন পি-র চাল, বুঝলে! ইস্যুটািকে ঘুরিয়ে দেওয়াই তাদের ইচ্ছে।
—আচ্ছা হায়দার, রফিক নামের কোনও ছেলেকে চোন? ওদের মধ্যে রফিক নামের একটি ছেলে ছিল।
—কোন পাড়ার?
—জানি না। বয়স একুশ বাইশ হবে। এ পাড়ারও হতে পারে।
—এরকম কাউকে চিনি না তো! তবু লোক লাগাচ্ছি।
—চল বেরোই। দেরি করাটা তো ঠিক হচ্ছে না। মা বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। বাবার স্ট্রোক হয়েছে, এই টেনশনে আবার না বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
—এ সময় আমার সঙ্গে ঘোরাটা তোমার ঠিক হবে না।
—কেন, ঠিক হবে না কেন?
–বুঝতে পারছি না কেন। বোঝার চেষ্টা কর।
সুরঞ্জন বুঝবে না কেন, ঠিকই বুঝতে পারছে হায়দার কেন বলছে তার না থাকবার কথা। তার সঙ্গে থাকাটা এখন ঠিক হবে না। কারণ সুরঞ্জন হিন্দু, হিন্দু হয়ে মুসলমানদের গাল দেওয়া ঠিক ভাল ঠেকে না। সেই মুসলমান চোর হোক, কী বদমাশ হোক, কী খুনি হোক। মুসলমানের কবজ থেকে হিন্দু মেয়েকে ছিনিয়ে আনাটাও বোধহও বেশি ঔদ্ধত্য দেখানো হয়ে যায়।
সুরঞ্জন ফিরে আসে। কোথায় ফিরবে। সে? বাড়িতে? ওই খাঁ খাঁ করা বাড়িতে তার ফিরতে ইচ্ছে করে না। সুরঞ্জন মায়াকে ফিরিয়ে আনবে এই আশায় চাতক পাখির মত তৃষ্ণা নিয়ে বসে আছেন ওঁরা। মায়াকে ছাড়া বাড়ি ফিরতে তার ইচ্ছে করে না। হায়দার নাকি লোক লাগিয়েছে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ওর লোকেরা মায়াকে একদিন উদ্ধার করবে, আবার সংশয় দানা বাঁধে, মায়া নেই তাতে ওদের কী, ওদের তো আর মায়ার জন্য কানও মায়া নেই। হিন্দুদের জন্য মুসলমানের মায়া থাকবে কেন, মায়া থাকলে আজ পাশের মুসলমান বাড়ি তো লুট হয় না, ওদের বাড়ি ভাঙা হয় না, ভাঙা হয় কেবল রঞ্জনের বাড়ি, পোড়ানো হয় গোপাল হালদারের বাড়ি, কাজলেন্দু দে’র বাড়ি। সুরঞ্জন বাড়ি ফেরে না। পথে পথে ঘোরে। সারা শহর ঘুরে মায়াকে খোঁজে। কী অপরাধ ছিল মায়ার যে ওকে ওরা জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? হিন্দু হবার অপরাধ এত বেশি? এত বশি যে তার বাড়িঘর ভাঙা যায়, তাকে ইচ্ছেমত পেটানো যায়, তাকে ধরে নেওয়া যায়, তাকে ধর্ষণ করা যায়। সুরঞ্জন এদিক ওদিক হাঁটে, দৌড়োয়। রাস্তায় একুশ বাইশ বছরের যে কোনও ছেলেকে দেখেই মনে হয় এই ছেলেই বোধহয় মায়াকে নিয়েছে, তার ভতর সংশয় জমা হয়। হতেই থাকে।
ইসলামপুরের এক মুদি দোকানে দাঁড়িয়ে সে এক ঠোঙা মুড়ি কেনে। দোকানচঅলা তার দিকে আড়ে আড়ে তাকায়, সুরঞ্জনের মনে হয় এই লোকটিও বোধহয় জানে যে তার বোন অপহৃত। সে এলোমেলো হাঁটে, নয়াবাজারের ভাঙা মঠের ওপর বসে থাকে। কিছুক্ষে স্বস্তি পায় না। সুরঞ্জন। কারও বাড়িতে গেলে সেই বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গ। সেদিন তো সেলিম বলেই বসল, তোরা আমাদের মসজিদ ভাঙতে পারিস, আমরা মন্দির ভাঙলে ক্ষতি কী? সেলিম অবশ্য হাসতে হাসতে বলছিল, হেসেছে বলে সেলিমের মনে যে এই প্রশ্নটি কাজ করেনি তা নয়।
মায়া যদি এর মধ্যে বাড়ি ফেরে, ফিরতেও তো পারে। ধর্ষিতা হয়েও সে ফিরে আসুন তবু ফিরে তো আসুক। মায়া ফিরেছে, ফিরেছে এই ভাবনায় সুরঞ্জন বাড়ি ফেরে, দেখে দুটো মানুষ চোখ কান নাক সজাগ রেখে বসে আছে নিম্পন্দ নিথর, মায়ার অপেক্ষায়। মায়া যে ফেরেনি। এর চেয়ে নিষ্ঠুর নির্মম ভয়ঙ্কর সংবাদ আর কী আছে! বালিশে মুখ ডুবিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে সুরঞ্জন। ওঘর থেকে সুধাময়ের গোঙানোর শব্দ আসে। রাতের স্তব্ধতা ফুঁড়ে বিঝির ডাকের মত ভেসে আসা কিরণময়ীর মিহি কান্না সুরঞ্জনকে একফোঁটা ঘুমোতে দেয় না। তার চেয়ে যদি বিষ পাওয়া যেত, তিনজনই খেয়ে মরে যেতে পারত। কষ্টগুলো এভাবে ফালি ফালি কাটত না তাদের। কী দরকার বেঁচে থেকে? হিন্দু হয়ে এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ হয় না।
৭খ.
সেরেব্রাল থ্রমবসিস বা এমবলিসম জাতীয় কিছু ঘটেছে সুধাময় অনুমান করেন। যদি হেমোরেজ হত নির্ঘাত মরে যেতেন। মরে গেলে খুব কি মন্দ হত? সুধাময় মনে-মনে বড় একটি হেমোরেজ। আশা করছেন। তিনি তো অর্ধেক মৃতই ছিলেন, নিজের বিনিময়ে যদি মায়া অন্তত বাঁচতে পারত। বড় বেঁচে থাকবার শখ ছিল মেয়েটির। একা একই পােরন্সলর বাড়ি চলে গিয়েছিল, তাঁর অসুস্থতাই তার অপহরণের জন্য দায়ী। অপরাধের ঘুণ প্ৰামায়কে কুরে খায়। বারবার তাঁর ঝাপসা হয়ে যায় চোখ। তিনি কিরণময়ীকে একক্স স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়ান। নেই, কেউ নেই। সুরঞ্জনও কাছে নেই, মায়া * তাঁর জল খেতে ইচ্ছে করে, শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে জিভ, আলজিভ, কণ্ঠদেশ।
কিরণময়ীকেও তিনি কম কষ্ট দেননি। পুজো করবার অভ্যোস ছিল কিরুণাময়ীর। বিয়ের পরই সুধাময় জানিয়ে দেন এ বাড়িতে পুজোটুজো চলবে না। কিরণময়ী গান গাইতে জানতেন ভাল, লোকে বলত বেহায়া বেশিরম মেয়ে, হিন্দু মেয়েদের লজ্জা-শরম নেই এই সব কটাক্ষ কিরণময়ীকে অস্বস্তিতে ফেলত। নিজেকে সংযত করতে করতে কিরকময়ী গান গাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলেন। এই যে তিনি গান ছাড়লেন, সুধাময় আর কতটুকুছ তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়ত তিনিও এরকম ভাবতেন লোকে যখন মন্দ বলৱ তখন কী আর করা। একুশ বছর তিনি কিরণময়ীকে পাশে নিয়ে শুয়েছেন। কেন্ম শুয়েছেনই। কিরণময়ীর সতীত্বকে আগলে রেখেছেন। কি দরকার ছিল তাঁর স্ত্রীর সতী উপভোগ করবার? এও তো এক ধরনের পারভারশান। শাড়ি গয়নার দিকেও কিক্সমবায়ীর তেমন আকর্ষণ ছিল না। কখনও তিনি বলেননি ওই শাড়িটি চাই, বা একজাড়া ইয়ারিং দরকার। সুধাময় প্রায়ই বলতেন-কিরণময়ী, তুমি কি মনে কোনও কষ্ট লুকিয়ে রাখা?
কিরণময়ী বলতেন–না তো। আমার এই সংসারেই আমার স্বপ্ন সুখ সব। নিজের জন্য আমি আলাদা করে কোনও আনন্দ চাই না।
সুধাময়ের মেয়ের শখ ছিল। সুরঞ্জনের জন্মের আগে কিরণময়ীর পেটে স্টেথেসকোপ লাগিয়ে বলতেন—আমার মেয়ের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি কিরণময়ী। তুমি শুনবে?
সুধাময় বলতেন— বাপ মা’কে শেষ বয়সে মেয়েরাই দেখে। ছেলেরা বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। মেয়েরাই স্বামী সংসার ফেলে বাপ মায়ের যত্ন করে। আমি তো হাসপাতালে থাকি, দেখি। অসুস্থ বাপ মা’র শিয়রে বসে আছে মেয়েরা। ছেলে আছে, অতিথির মত দেখতে হয়ত আসে, এর বেশি না।
স্টেথোর নল কিরণময়ীর কানে লাগিয়ে তিনি তাঁকেও শোনাতেন হৃদপিণ্ডের লাবড়াব শব্দ। জগতসুদ্ধ সবাই পুত্ৰ চায়, আর সুধাময় চাইতেন কন্যা। ছোটবেলায় সুরঞ্জনকে ফ্রক পরিয়ে সুধাময় বেড়াতে নিতেন। মায়া জন্ম নেবার পর সুধাময়ের আশা পূরণ হল। ‘মায়া’ নামটি সুধাময় নিজেই রেখেছিলেন, বলেছিলেন—এ আমার মায়ের নাম। আমার এক মা গেছেন, আরেক মা এলেন।
রাতে মায়াই সুধাময়কে ওষুধ খাইয়ে দিত। ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। কখন। তিনি ‘মায়া মায়া’ বলে তাঁর প্রিয় কন্যাকে ডাকেন। পড়শিরা ঘুমিয়ে গেছে সব। তাঁর ডাকটি জেগে থাকা কিরণময়ী শোনেন, সুরঞ্জন শোনে, সাদা কালো বেড়ালটিও শোনে।
পর্ব – ১৬
৮ক.
উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলবার পর সারা ভারত জুড়ে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল তার মাত্রা কমে আসছে। ধীরে ধীরে। ভারতে মৃতের সংখ্যা এর মধ্যে আঠারশ ছাড়িয়ে গেছে। কানপুর ও ভূপালে এখনও সংঘর্ষ চলছে। প্রতিরোধ করতে গুজরাট, কণাটক, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় সেনাবাহিনী নেমেছে। তারা টহল দিচ্ছে। ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোর দরজায় তালা পড়েছে।
শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য ঢাকায় সর্বদলীয় স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হচ্ছে, তাতে কী। এদিকে শদ্ভূ-গোলকপুরের ত্ৰিশজন হিন্দু মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, চঞ্চলী, সন্ধ্যা, মণি..। মারা গেছে নিকুঞ্জ দত্ত। ভয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে এক বৃদ্ধা, ভগবতী। গোলকপুরে দিনের বেলায়ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মেয়েরাও ধর্ষিতা হয়েছে। দাসের হাট বাজারের নাটু হালদারের চৌদ্দশ মণ সুপারির আড়ত ছাই হয়ে গেছে। ভোলা শহরের মন্দির ভাঙচুরের সময় পুলিশ, ম্যাজিষ্ট্রেট, ডি সি নীরবে: দাঁড়িয়ে ছিল। জুয়েলারিগুলো প্রকাশ্যে লুট হয়েছে। হিন্দু ধােপাবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। মানিকগঞ্জ শহরের লক্ষ্মী মণ্ডপ, সার্বজনীন শিববাড়ি, দাশেরা, কালিখলা, স্বর্ণকার পট্টি, গদাধর পালের বেভারেজ ও সিগারেটের বড় মজুত দোকান ভাঙচুর করা হয়। তিন ট্রাক ভর্তি লোক ত্বরা, বানিয়াজুরি, পুকুরিয়া, উথলি, মহাদেবপুর, জোকা, শিবালয় থানায় হামলা চালায়। শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বেতিলা গ্রামে হিন্দুদের ঘর লুট করা হয়। পোড়ানো হয়। বেতিলার শত বছরের পুরনো নাটমন্দিরে হামলালানো হয়। গড়পাড়ায় জীবন সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার তিনটে গোয়াল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কয়েকশ মণ ধানও পুড়ে গেছে। ঘিওর থানার তেরাষ্ট্ৰীবাজারের হিন্দুদের দোকান, গাণ্ডভুবি, বানিয়াজুরি, সেনপাড়ার হিন্দু বাড়িগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনপাড়ায় এক হিন্দু গৃহবধূকেও ধর্ষণ করা হয়েছে। পিরোজপুরের কালীবাড়ি দেবার্চনা কমিটির কালী মন্দির, মনসা মন্দির, দুর্গা মন্দির, শীতল মন্দির শিব মন্দির, নারায়ণ মন্দির, পিরোজপুর মদনমোহন বিগ্রহের মন্দির, আখড়াবাড়ি, রায়েক্লাঠি কালীবাড়ির মন্দির, কৃষ্ণনগর রাইরাসরাজ সেবাশ্রম, ডুমুরতলা শ্ৰীশুরু সংঘের আশ্রম মন্দির, দক্ষিণ ডুমুরতলার সুরেশ সাহার বাড়ির কালী মন্দির, ডুমুরতলার নরেন সাহা বাড়ির মনসা মন্দির, রমেশ সাহার বাড়ির মনসা মন্দির ও বসতবাড়ি, ডুমুরতলা বারোর কালী মন্দির, সুচরণ মণ্ডল, গৌরাঙ্গ হালদার, হরেন্দ্রনাথ সাহা, নরেন্দ্রনাথ সাহার বাড়িল্লমন্দির, ডুমুরতলা হাই স্কুলের পাশে কালী মন্দির, রানীপুর পঞ্চদেবীর মন্দির, হুলারাহাট সার্বজনীন দুৰ্গ মন্দির ও কার্তিক দাসের কাঠের দোকান, কলাখালি সনাতন আশ্ৰৱল কালী মন্দির, জুজখোলা গৌরগোবিন্দ সেবাশ্রম, হরিসভার সনাতন ধর্মমন্দির, রনজিৎ শীলের বাড়ির কালী মন্দির, জুজখোলা বারোয়ারি পূজামণ্ডপ, গাবতলা স্কুলের পাশে সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, কৃষ্ণনগর বিপিন হালদারের বাড়ির মন্দির, নামাজপুর সার্বজনীন কালী মন্দির, কালিকাঠি বিশ্বাস বাড়ির মন্দির ও মঠ, লাইরি কালী মন্দির, স্বরূপঠি থানার ইন্দের হাট সার্বজনীন মন্দির, ইন্দের হাট কানাই বিশ্বাসের বাড়ির দুর্গ মন্দিরবানকুল সাহার সিনেমা হল, অমল গুহর বাড়ির দুর্গ মন্দির, হেমন্ত শীলের বাড়ির মন্দির, মঠবাড়িয়া থানার যাদব দাসের বাড়ির কালী মন্দির জ্বালানো হয়। সৈয়দপুর মিস্ত্রী পাড়ায় শিব মন্দিরও ভাঙা হয়। নড়াইল জেলার রতডাঙ্গা গ্রামে সাৰ্বজনীন মন্দির, বারোর ঘোনা সার্বজনীন মন্দির, কুডুলিয়ার সার্বজনীন শ্মশানঘাট, নিখিল চন্দ্ৰ দে’র পারিবারিক মন্দির, কালীপদ হাজরার পারিবারিক মন্দির, শিবুপ্রসাদ পালের পারিবারিক মন্দির, বাদন গ্রামের দুলাল চন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ির মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্র লস্করের বাড়ির মন্দির, তালতলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের বৈদ্যনাথ সাহা, সুকুমার বিশ্বাস, পাগলা বিশ্বালে পারিবারিক মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির ও লোহাগড়া থানার দৌলতপুর পূর্বপাড়া নারায়ণ জিউ মন্দির ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়। খুলনায় দশটি মন্দিল্লী ভেঙেছে। পাইকপাড়ার রাডুলি, সোবনাদাশ। আর বাকা গ্রামে চার-পাঁচটি মন্দির ভাঙচুহু কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট করা হয়। রূপসা থানার তালিমপুর এলাকায় দুটো মন্দির-ভেঙে দেওয়া হয়। পাশের হিন্দু বাড়িগুলো লুট করা হয়। দীঘলিয়া আর সেন✉ট এলাকায় আটই ডিসেম্বর রাতে তিনটি মন্দির ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেনীর সহদেবপুর গ্রামে একদল মিছিলকারী তেরোটি বাড়িতে হামলা চালায়। ছাগল-ইয়ার জয়পুর গ্রামে হামলা হওয়ায় বিশজন আহত হয়েছে। লাঙ্গলবোয়া গ্রাম থেকে মোয়াজেম হোসেনের নেতৃত্বে দুশ লোক গোবিন্দপ্ৰসাদ রায়ের বাড়িতে হামলা চালাম্বী কমল বিশ্বাস নামে একজন গুরুতর আহত হয়। সম্ভবত মারা যাবে।
বিরূপাক্ষ, নয়ন, দেবব্রত, সুরঞ্জনের সামনে বসে গলগল করে ভাঙচুরের বমি করে। সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। একটি কথাও সে এতগুলো ভাঙনের গল্প শুনবার পরও উচ্চারণ করে না। এরা কেউ জানে না কেবল ভোলা চট্টগ্রাম পিরোজপুর সিলেট কুমিল্লার হিন্দু বাড়ি লুট হয়নি, টিকাটুলির এই বাড়ি থেকে লুট হয়ে গেছে মায়া নামের একটি চমৎকার মেয়ে, মেয়েমানুষ তো অনেকটা সম্পদের মত, তাই সোনাদানা ধনসম্পদের মত মায়াকেও তুলে নিয়ে গেছে ওরা।
–কি ব্যাপার সুরঞ্জন কথা বলছি না কেন? হয়েছে কি তোমার? দেবব্রত প্রশ্ন করে।
–মদ খেতে চাই। পেট ভরে মদ খাওয়া যায় না আজ?
–মদ খাবে?
–হ্যাঁ খাব ৷
— টাকা আছে আমার পকেটে, কেউ গিয়ে এক বোতল হুইস্কি নিয়ে এস।
–বাড়িতে বসে খাবে? তোমার বাবা মা?
–গুল্লি মারো বাবা মা। আমি খেতে চাইছি, খাব। বিরূ যাও, সাকুরা পিয়সি কোনও একটাতে পাবে।
–কিন্তু সুরঞ্জনদা…
–এত হেসিটেট করো না তো, যাও।
ওঘর থেকে কিরণময়ীর কান্নার শব্দ ভেসে আসে।
–কাঁদে কে? মাসিমা? বিরূপাক্ষ জিজ্ঞেস করে।
–হিন্দু হয়েছে যখন, না কেঁদে উপায় আছে?
চুপ হয়ে যায় তিন যুবক। হিন্দু তো ওরাও, ওরাও অনুভব করে মাসিমাকে কাঁদতে হয় কেন। প্রত্যেকের বুকের মধ্য থেকে বোবা কান্না ঠেলে ওঠে। বিরূপাক্ষ টাকা নিয়ে দ্রুত চলে যায়, ফেন চলে গেলেই সে সকল বেদনা থেকে মুক্তি পাবে। যেমন সুরঞ্জন মুক্তি পেতে চাইছে মদ খেয়ে।
বিরূপাক্ষ চলে যেতেই সুরঞ্জন প্রশ্ন করে–আচ্ছা দেবব্রত, মসজিদ পোড়ানো যায় না?
–মসজিদ? তোমার কি মাথা-ট্যাথা খারাপ হয়ে গেছে?
—চল আজ রাতে ‘তারা মসজিদ’ পুড়িয়ে ফেলি। দেবব্রত বিস্মিত চোখে একবার সুরঞ্জনের দিকে, একবার নয়নের দিকে তাকায়।
—আমরা দু কোটি হিন্দু আছি, চাইলে বায়তুল মোকাররমটাকেও তো পুড়িয়ে ফেলতে পারি।
—তুমি তো কখনও নিজেকে হিন্দু বলনি। আজ বলছ কেন?
–মানুষ বলতাম তো, মানবতাবাদী বলতাম। আমাকে মুসলমানেরা মানুষ থাকতে দেয়নি। হিন্দু বানিয়েছে।
–তুমি খুব বদলে যােচ্ছ সুরঞ্জন।
–সে আমার দোষ নয়।
–মসজিদ ভেঙে আমাদের কি লাভ? আমরা কি আর মন্দির ফিরে পাব? দেবব্রত চেয়ারের ভাঙা হাতলে নখ ঘষতে ঘষতে বলে।
–না পাই, তবু আমরাও যে ভাঙতে পারি। আমাদেরও যে রাগ আছে তা একবার জানানো উচিত নয়? বাবরি মসজিদ সাঁড়ে চারশ বছরের পুরনো মসজিদ ছিল। চৈতন্যদেবের বাড়িও তো পাঁচশ বছরের পুরনো ছিল। চার-পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহ্য কি এ দেশে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না? আমার সোবহানবাগ মসজিদটাও ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। গুলশান এক নম্বরের মসজিদটা সৌদি আরবের টাকায় করা। চল ওটা দখল করে মন্দির বানিয়ে ফেলি।
–কী বলছি তুমি সুরঞ্জন? পাগলই হয়েছ বটে। তুমি না। আগে বলতে ‘মন্দির ও মসজিদের জায়গায় দিঘি কেটে নধর পতিহাঁস ছেড়ে দেব?
–কেবল কি তাই বলতাম, বলতাম, গুঁড়ো হয়ে যাক ধর্মের দালানকোঠা, পুড়ে যাক অন্ধাগুনে মন্দির মসজিদ গুরুদয়ারা গির্জার ইট, আর সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর সুগন্ধ ছড়িয়ে বড় হোক মনোলোভা ফুলের বাগান, বড় হোক শিশুর ইস্কুল, পাঠাগার। মানুষের কল্যাণের জন্য এখন প্রার্থনালয় হোক হাসপাতাল, এতিমখানা, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। এখন প্রার্থনালয় হোক শিল্পকলা একাডেমি, কলামন্দির, বিজ্ঞান গবেষণাগার, এখন প্রার্থনালয় হোক ভোরের কিরণময় সোনালি ধানের ক্ষেত, খোলা মাঠ, নদী, উতল সমুদ্র। ধর্মের অপর নাম আজ থেকে মনুষ্যত্ব হোক।
–সেদিন দেবেশ রায়ের একটি লেখা পড়লাম। লিখেছেন বড়ে গোলাম তাঁর সুরমণ্ডল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে গাইছেন, হরি ওম তৎসৎ, হরি ওম তৎসৎ। আজও বড়ে গোলাম সেই একই গান গেয়ে চলেছেন। কিন্তু যারা বাবরি মসজিদকে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে রামলালার মূর্তি বসিয়ে পালিয়ে আসে, সেই হিন্দু এ গান শুনতে পায় না। এ গান আদভানি, অশোক সিঙ্ঘলরা শুনতে পায় না। এ গান রাস্ট্রীয় সেবক সংঘ বা বজরং দল শুনতে পায় না। বড়ে গোলাম আলি মুসলমান ছিলো। অথচ তাঁর গলায় এই হরি ওম তৎসৎ সেইসব মুসলমানরাও শুনতে পায় না। স্বামীনে করে মসজিদ ধ্বংসের একমাত্র প্রতিবিধান হতে পারে মন্দির ধ্বংস করে।
—সুতরাং বলতে চাইছ মন্দির ধ্বংসের কারণে মন্দির ধ্বংস করা ঠিক নয়। তুমি আমার বাবার মত আদর্শবাদের কথা বলছি। আই হেট হিম। আই হেট দ্যাট ওলন্ড হেগার।
সুরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে শোয়া থেকে একলাফে উঠে দাঁড়ায়।
–শান্ত হও সুরঞ্জন। শান্ত হও। তুমি যা বলছ এগুলো কোনও সমাধান নয়।
–আমি এভাবেই সমাধান চাই। আমার হাতেও আমি রামদা কিরিচ পিস্তল চাই। মোটামোটা লাঠি চাই। ওরা পুরনো ঢাকার এক মন্দিরে পেচ্ছাব করে এসেছিল না? আমি পেচ্ছাব করতে চাই ওদের মসজিদে।
–ওহ সুরঞ্জন। তুমি কম্যুনাল হয়ে যাচ্ছ।
— হ্যাঁ আমি কম্যুনাল হচ্ছি। কম্যুনাল হচ্ছি। কম্যুনাল হচ্ছি।
সুব্ৰত সুরঞ্জনের পার্টির ছেলে। নানা কাজে একসঙ্গে থেকেছে দুজন। সে অবাক হয় রঞ্জনের আচরণে। মদ খেতে চাইছে। নিজের মুখে বলছে কম্যুনাল হচ্ছে। বাবাকে পর্যন্ত গাল দিচ্ছে।
Tags – Lojja, Bangla Golpo, lajja