“ইসস জামাইবাবু আপনি আবার একখানা ঝাড়লেন না?” দিগম্বর গম্ভীর গলায় অনুযোগ করে।
“জামাইবাবুকে নিয়ে এইসব বলতে তোমার মুখে বাধে না দিগম্বর! বাবা মা এই করতেই পড়াশোনা শিখিয়েছেন তোমাকে?” কিঙ্করবাবু ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠেন।
কিন্তু পাদটা যে তিনি বিলক্ষণ ঝেড়েছেন সেটা তিনিও ভালো করেই জানেন। তাই মোবাইলে চার্জ দেবার নাম করে উঠে গেলেন।
“আর বলিস না দিগম্বর, তোদের দাদার এই পাদের চক্করে পড়ে আমি শীতকালে আলাদা ঘরে ঘুমোই।” মিনতিদেবী মিনমিন করে ওঠেন, উনি কিঙ্করবাবুর পয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত স্ত্রী।
“ছিঃ গিন্নি, শাখা সিঁদুর পরে নিজের স্বামীর নামে মিথ্যে কথা বলতে তোমার ধর্মে কুলোয়? শোনো দিগম্বর তোমার দিদি গেল শীতে এমন একখানা লেপের তলায় দিয়েছিলো যে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে পড়েছিল আমার।” কিঙ্কর এবার থাবা তোলেন।
“সেই গো! ডিসেম্বরে বিয়েবাড়িতে রাতে মাংস খেয়ে শোবার সময় বিষাক্ত গ্যাসগুলো দিয়ে আমাকে তুমি বমি করিয়েছিলে। কাজের মাসি আরতি তখন রাতে বাড়িতে থাকতো, সে উল্টোপাল্টা ভেবে পরদিন ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছিলো আমাকে!”
“ছিঃ ছিঃ দিগম্বরের সামনে এইসব কথা বলতে মুখে বাঁধলো না তোমার? অতো কথা না বলে একটু চা করে আনো।” কিঙ্করবাবু কথাটা ঘোরাতে চাইলেন।
দিগম্বর ঘোড়েল লোক, সে দাঁত বের করে বললো, “কিন্তু জামাইবাবু সেবার ধর্মতলা থেকে উবেরে উঠে এসি গাড়ির মধ্যে আপনি যে বেড়ে পাদখানা দিয়েছিলেন, ইতিহাসে লেখা থাকবে। কাচবন্ধ গাড়িতে বিহারি ড্রাইভার ‘ডাস্টবিনকা গন্ধ আতাহে’ বলে কাঁচটা নামালে সে যাত্রা সবাই ফুরসৎ পায়।”
দিগম্বর কথাটা বলেই ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে থাকে।
কিঙ্করবাবুর গা পিত্তি জ্বলে যায় ওই হাসি দেখে। তিনি রাগত গলায় বলে ওঠেন, “তা অতই যখন সমস্যা তখন তো মেট্রো করেই আসতে পারতে। গাড়ি ছাড়া তো তোমাদের চলেনা, বাবু মানুষ।”
“তারপর জামাইবাবু আপনার মনে আছে, সেবার গাড়ি পাইনি বলে গিরিশ পার্ক থেকে মেট্রোতে উঠে আপনি কি মোক্ষম একখানি বিষাক্ত মিসাইল ছেড়েছিলেন?” দিগম্বর আবার সেই ফিচেল হাসিটা হাসে।
“আবার ছাগলের মতো কথা বলছো! মেট্রোতে তুমি দিয়েছিলে ঐটা।” কিঙ্কর ডিফেন্সে ব্যাট চালান।
“কি হয়েছিল রে কিঙ্কর? মেট্রোর ব্যাপারটা তো জানিনা।” মিনতিদেবী মিনতি করে জিজ্ঞাসা করেন।
“আর বলিস কেন দিদি, তুই তো লেডিস সিটে বসে পড়লি, এদিকে আমিও ওই ভীড়ে বসতে পারলেও জামাইবাবু সিট পাননি, দাঁড়িয়েই ছিলেন। ওনার সামনের সিটে একজন বেঁটে টাকমাথা লোক বসে ছিল। জামাইবাবু এমন গ্যাস ছাড়লেন যে ওপাশের সিটের লোকগুলো কাহিল হয়ে পড়লো। আমার এদিক পর্যন্তও গন্ধ চলে এসেছিলো। আর জামাইবাবুও বলিহারি, পাদটা দিয়েই সামনের ওই বেঁটে লোকটার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন পাদটা ওই দিয়েছে। ওনার দেখাদেখি আরো চার পাঁচজন তাকালো ওই লোকটার দিকে। শেষে পার্কস্ট্রিট আসতেই লোকটা এমনভাবে সিট ছেড়ে পালালো যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।” একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দিগম্বর থামলো।
“মানে পুরো যা তা কথাবার্তা, এই তোমার কোনো কাজ নেই দিগম্বর? চাকরি বাকরি তো করো না, আমার একজন পরিচিতের অফিসে একজন লিফটম্যান লাগবে, তোমার নামটা পাঠিয়ে দি? “
“লিফ্ট বলতে মনে পড়লো, সেইবার গোলকের ছেলের অন্নপ্রাশন খেতে যাবার সময় লিফটে জামাইবাবু এমন একখানা ডিনামাইট ছাড়লেন যে পাশের পাড়ার পুকু মোহন্ত রুমালে বমি করে ফেললো।”
কিঙ্করবাবু আর কথা বাড়ালেন না। দিগম্বর পুরো ছাগল প্রকৃতির ছেলে, এমন ছেলে কিনা আবার তাঁর শালা!
“আহা চটছ কেন আমার ভাইটার ওপরে, পাদ তো তুমি নতুন নতুন দিচ্ছনা।” মিনতি টিটকিরি কাটেন।”
“নতুন নতুন দিচ্ছিনা মানে? মানে আমি পেঁদে অভ্যস্ত এটাই বলতে চাইছো?”
“নানা ছিছি অমন কথা বলিনি। মানে আমি বলতে চেয়েছি যে তুমি তো আর সবসময় দাওনা ওগুলো।”
“কেউই সবসময় গ্যাস ছাড়েনা গিন্নি, এক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক বলেছেন, পাদ কোনোসময় আটকে রাখতে নেই, ছেড়ে দিতে হয়।”
কথাটা বললেন বটে কিন্তু তাঁর হঠাৎ পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে গেল।
মনে পড়ে গেল যে ছোটবেলায় ক্লাস টেনে ক্লাসে বিধুমোহন স্যারের মেঘনাদবধ কাব্য পড়ানোর সময় কিঙ্করের পাদের চোটে সেই ক্লাস বানচাল হয়েছিল।
মেঘনাদ বধ হবার সময় পেয়েছিলো কিনা জানা নেই কিন্তু টিফিনের পনেরো মিনিট আগে অযাচিত ছুটি পেয়ে ক্লাসের সবাই বিশেষ আহ্লাদিত হয়েছিল।
তারপর হরিপদ মাস্টারের কাছে তবলা শেখার সময় তবলার আওয়াজের নিচে কিঙ্করের দেওয়া পাদে তাঁর বোন ফুলমনি হেঁচকি দিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছিলো।
হরিপদ পরেরদিন আধঘন্টা দেরি করে এসে কিঙ্করবাবুর মাকে অত্যন্ত বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে কিঙ্করের পেটের চিকিৎসার জন্য তাঁরা কোনো ডাক্তার দেখাচ্ছেন কিনা নয়তো দুলু কবিরাজের কাছে একবার দেখানো যায়।
সেই থেকে কিঙ্করবাবু পাদের অত্যাচারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
মোক্ষম জায়গায় পাদ যে কিভাবে চলে আসে তিনি তা আজও বুঝতে পারেননি।
কলেজে বসুন্ধরা বলে একটি মেয়ের সাথে তাঁর একটু গভীর বন্ধুত্ব ছিল। একবার কলেজের সামনে রাস্তায় কিছুক্ষন আবডালে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে প্রেমের আবেশে একটি গান গাইতে বলেন।
বসুন্ধরা রবি ঠাকুরের “আমারো পরানো যাহা চায়” গাইবার সময়তেই এমন জোরে কিঙ্কর একটি শব্দ করেন যে মেয়েটি পরদিন থেকে আর সেরকম কথা বলতোনা। তাঁর পায়ুদ্বারকে তিনি মারাত্মক ভয় পেয়ে চলেন।
দিগম্বরের ডাকে সম্বিৎ ফেরে।
“দিদি তোর মনে আছে তোকে বিয়ের পিঁড়ি করে সাতবার ঘোরানোর সময় একটা বিটকেল গন্ধ এসে নাকে লেগেছিলো?”
“তা অবশ্য আমি খেয়াল করিনি, পরে শুনেছি একটা বেশ ঝাঁঝালো গন্ধ তোদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।” মিনতি বলেন।
“তা তুমি কি বলছো যে ওটা আমার পাদ? যজ্ঞের আগুন বলেও একটা জিনিস আছে। দিগম্বর জানবে কি করে, ওর তো এখনো বিয়েই হয়নি।”
বৌয়ের সাথে কিঙ্করবাবুর চোখাচোখি হলো একবার।
পয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা।
ভেবেছিলেন অন্তত বৌয়ের সামনে তাঁর এই বদগুনটা প্রকাশ পাবে না। ফুলশয্যার রাত্রে রোমান্টিক পুরুষ কিঙ্কর পাল তাঁর বৌয়ের মাথার বেণী আবেশভরে শুঁকছিলেন আর বেশ রাবীন্দ্রিক ঢঙে বলছিলেন, “তোমার চুলের এই সুগন্ধ আমাকে মোহিত করে দেয়, এই সুগন্ধ যেন এক কস্তুরী, আর তুমি মায়ামৃগের মতো আমাকে আকর্ষিত করো তোমার প্রতি। তুমি… “
কথাটা শেষ হবার আগেই মিনতি, নব বধূবেশে মুখটা বাঁকিয়ে নাকচাপা দিয়েছিলেন।
“কি জঘন্য একটা গন্ধ আসছেনা নাকে? ইঁদুর মরেছে নাকি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাইই হবে। দাঁড়াও দেখে আসি।” সেবেলা কোনোরকমে কিঙ্কর চাপা দিলেও আরো কিছুদিন ধরে সেই একই গন্ধ রাতে মিনতি পাওয়ায় কিঙ্করের এই বিশেষ ক্ষমতাটি জানতে পারেন।
সেই থেকেই দিগম্বর জানে এবং বাকিটা তো ইতিহাস।
কিঙ্করবাবু যদিও কোনোদিন স্বীকারই করেননি যে পাদগুলি তিনিই দেন।
দিগম্বর চলে যাবার পর মিনতি বলে ওঠেন, “বাপু কোনোদিন দেখিনি কাউকে এত পাদ দিতে। আবার একখানা দিলে না? তোমাকে তেলেভাজা দেওয়াটাই অন্যায় হয়েছে। ডাক্তার না করেছে তবু বুড়োর নোলা যায় না।”
“বাজে কথা বলবেনা গিন্নি।” তড়পে ওঠেন কিঙ্করবাবু, “এই গন্ধ তোমার, তুমি দিয়েছো।”
“হ্যাঁ, সেই, তোমার গন্ধ আমি চিনবোনা? পেঁয়াজ আর গোবর মেশালে যে গন্ধ হয় সেই গন্ধ তোমার। হার্টফেল করে না মারা যাই।”
“আর তোমার ফিনাইলের গন্ধ। তোমার সাথে রাতে শোবোই না আমি। মেয়ের কাছে চলে যাবো।”
“যাওনা, দুদিন পর জামাইয়ের নাকে যখন গন্ধটা ঢুকবে তখন পইপই করে এবাড়িতে পৌঁছে দেবে।
“কিঙ্কর পাল এখনো বেঁচে আছে। আমার পাদ, আমি দেবো আর অনেকেই আছে যারা এই গন্ধটা প্রসাদ মনে করে নাকে টেনে নেবে।”
“হ্যাঁ, কোনো মদের আখড়ায় যাও, ওখানে দাও সবাই তোমাকে লুফে নেবে।”
এভাবেই মিষ্টি ঝগড়া চলতে থাকে।
রাতে জল খেতে ওঠার সময় মিনতিদেবী স্বামীর বুকের ওপর চাদরটা টেনে দেন। একটু আপন মনে হেসে ওঠেন।
যতই সারাদিন খেপান স্বামীকে কিন্তু এই মানুষটা সারাজীবন মিনতিকে আগলে রেখেছেন।
পাগলের মতো ভালোবেসে গেছেন।
এমনি বেসেছেন যে কোথাও গিয়ে তাঁর বায়ুনিসঃরনও তাঁর স্ত্রীর কাছে একান্ত প্রিয় হয়ে গেছে।