নয়েলা বসু।বয়স ২৬।স্কুল টিচার। বর্তমানে তার একটাই পরিচয় সে একজন বিবাহযোগ্য কন্যা।তাই বাবা মা থেকে মাসি মেসো, পাড়ার চিনু কাকা থেকে ও’পাড়ার সুমিতাকাকিমার পর্যন্ত চিন্তার নেই!! রোজই প্রায় একটা করে বিয়ের সম্বন্ধ আসে নয়েলার জন্য কিন্তু প্রতিবারই সে, হয় ছেলের মধ্যে কিংবা ছেলের বাড়ির লোকেদের মধ্যে কিম্ভুতকিমাকার কিছু খুঁত বের করে তাদের রিজেক্ট লিস্টে ফেলে দেয়! কোনোবার ছেলের নাক ভোঁতা, কোনোবার আবার ছেলের বাবা জর্দা দেওয়া পান খায়, একবার তো আবার ছেলের মাসি শুটকি মাছ ভালবাসে এটা শুনে বিয়েতে ব্যাগরা দিয়েছিল, ওর সাফ কথা মাসি খায় মানে বোনপোও খায়, তাই ওমন সৃষ্টিছাড়া জিনিস খাওয়া ফ্যামিলির সাথে বিয়ে, নৈব নৈব চ! এদিকে নয়েলার এমন নাকউঁচু স্বভাবের জন্য বাবা মা খুবই চিন্তিত কারন সবাইকে এভাবে রিজেক্ট করতে থাকলে আদেও কি মেয়ের বিয়ে তারা দিতে পারবেন!!!আর তাছাড়া মেয়ে হয়ে একটু আধটু মানিয়ে নিতে হয়, সবসময় এতো মুখ ব্যাঁকালে চলে?!!
আজ রবিবার। নয়েলার বাড়ির ঠিক করা ঘটকমশাই নতুন এক সম্বন্ধ এনেছেন! পাত্র ডাক্তার, জেনারেল ফিজিশিয়ান।ডাক্তার শুনে সবাই ভাবল যাক এবার নিশ্চয় নয়েলার ছেলে পছন্দ হবে কিন্তু নয়েলার মাথায় ঘুরছিল অন্য চিন্তা।এই ছেলে নিশ্চয় মা বাবা কাকা কাকিমা মাসি পিসি ভাই বোন মিলে একটা ফুল ফ্যামিলি প্যাকেজ নিয়ে হাজির হবে।তারপর শুরু হবে সবার র্যাপিট ফায়ার রাউন্ড। কেউ ওর হাত দেখবে, কেউ পা, কেউ মুখ, কেউ বা আবার চুল।কিন্তু এত ভাবনার ভাসান ঘটিয়ে ছেলে কিনা একা এসে হাজির, এক্কেবারে একেলা! ছেলের বন্ধুদের নিয়ে মেয়ে দেখতে আসার উদাহরণ থাকলেও ছেলের একা আসার ঘটনা মনে হয় ইতিহাসে এই প্রথম!!বয়স ৩০, হাইট ৫’৮” মতো হবে, গায়ের রং শ্যামলা, বেশ হ্যান্ডসাম। ছেলের সাহস আছে বলতে হবে! না হলে নয়েলার হোল ফ্যামিলি নামক আগুনের গোলার সামনে একা বুকচিতিয়ে এন্ট্রি মারতে পারে। ছেলের সামনে তখন মেয়ের মাসি পিসি বাবা মা মিলিয়ে হোল বিগ্রেড, শুরু হলো তাদের প্রশ্নবান।ছেলে কেন একা এলো, বাবা মায়ের সাথে কি সম্পর্ক নেই? নাকি নিজেই সর্বেসর্বা। মাইনে কেমন, হবি কি ইত্যাদি ইত্যাদি। অদ্ভুতভাবে ছেলে কিন্তু মুখ কুঞ্চনবিহীন করে ফটাফট সব উত্তর দিয়ে গেলো!!তার বাবা মা নাকি তাকে নিয়ে খুবই উদাসীন, তার ছেলে মাইনের বেশিরভাগ টাকা খরচ করে ফেলে, রাতে দেরী করে বাড়ি ফেরে, রাতদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, তাই তারা ধরেই নিয়েছেন এই ছেলের বিয়ে দিয়ে কোনো অসহায় মেয়ের কপাল তারা পোড়াতে চান না! এটাই তাদের এখানে অনুপস্থিতির কারণ!এমন অকপটে স্বীকারোক্তি নয়েলার মনে দাগ কেটে গেল কিন্তু ওর ফ্যামিলির কপালে ১০০০ হার্চ তরঙ্গযুক্ত ঢেউ খেলানো ভাঁজের সৃষ্টি করল!!নয়েলার মনে হলো সে বেশ হটকে সবার থেকে, অফবিট,বেশ ইন্টারেস্টিং!
টুকটাক জলযোগের পর সব দেখাশোনার অঘোষিত নিয়ম অনুসারে ছেলে মেয়ের আলাদা করে কথা বলা অবধারিত! সেইমতো নয়েলা আর মিস্টার হ্যান্ডি গেলেন উপরের বারান্দায়।শুরু হলো আলাপন, এদিকে নীচে জোরদার আলোচনা শুরু হলো নয়েলার বাড়ির লোকেদের মধ্যে, আলোচ্য বিষয়- ছেলে মাসের সব মাইনে দিয়ে করে টা কি, নেশা টেশা নয়তো? আবার রাত করে বাড়ি ফেরে, কোনো খারাপ সঙ্গ নেইতো? তাই দলমত নির্বিশেষে এই ছেলে সবার রিজেক্ট লিস্টে নাম লিখিয়ে ফেলল!!!
-” নমস্কার, আমি সপ্তক!!”
-” হুম জানি। আর কিছু!!”
-” আমি পেশায় ডাক্তার কিন্তু স্বভাবে বাউন্ডুলে!! “
-” বাই দা ওয়ে! আই লাইক বাউন্ডুলেস। আচ্ছা আপনি বললেন যে হঠাৎ করে রাতদুপুরে বেরিয়ে যান।বিয়ের পরও কি তাই করবেন নাকি?”
-” ক্রমশঃ প্রকাশ্য!!তার আগে আমার কিছু ক্যারেক্টারিশটিক্স অর্থাৎ বৈশিষ্ট্যের কথা জেনে নেওয়া দরকার!!”
-” বলুন শুনছি!”
-” মানে আমি কিন্তু খুব খেতে ভালোবাসি। মানে ইয়ে পেটুক,বিশেষ করে চিকেন রোল। তাই মাঝেমধ্যে আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসলে কিন্তু টিপিকাল বউদের মতো ঘ্যানঘ্যান করা চলবে না!”
-” ওকে, ডান!”
-” আর মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে রক মিউজিক শোনা আমার বহুদিনের অভ্যাস! শো এরফলে আপনারো ঘুমের ১২ থেকে ১৪ টা বেজে যাবে।”
-” এটা আবার কিরম অভ্যাস?”
-” মেলাতে পারবেন না, আমাকে ২+২ করে মেলাতে যাবেন না। আমি সব হিসেবের উর্দ্ধে! “
-” তাহলে বিয়ে করতে চাইছেন কেনো। আপনার মতো বাউন্ডুলেদের তো একা থাকাই বেস্ট!!”
-” আরে সবারই লাইফে একটা টাইমের পর সাথী দরকার। তাই একজন বাউন্ডুলীনির খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি! হেঃহেঃহেঃ!”
-” আমি এ’রকম ছন্নছাড়া মানুষ হয়ে মানুষের জীবন বাঁচান কি করে?!আই মিন একজন ডাক্তার হয়ে..!!”
-” বললাম না,সব হিসেব মিলবে না।আমি জানি আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি।তবে মানুষ হিসাবে আমি কিন্তু মন্দ ছিলাম না ম্যাডাম!”
-” শুধু মানুষ নিয়ে কি ধুয়ে জল খাবো। আপনি তো মাইনের বেশিরভাগ টাকাই খরচ করে ফেলেন।তাহলে হোয়াটস এবাউট আওয়ার ফিউচার?”
-” এই চিন্তা আপনার অমূলক নয় কিন্তু কি করব বলুন আমার যে কিছু রেসপন্সিবিলিটি আছে!”
-” বন্ধু মনে করলে বলতে পারেন!!”
-” আসলে ছোটবেলা থেকে অনাথ, পথশিশুদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা হতো কিন্তু তখন তো আর রোজকার করতাম না, তাই মনের ইচ্ছা মনেই লুকিয়ে রেখেছিলাম!!তারপর যখন চাকরি পেলাম,নিজে রোজকার করলাম,সেদিন থেকেই মনে লুকোনো ইচ্ছাটা আবার আস্কারা দিয়ে উঠল!!সে’জন্য একটা এনজিও তে যোগ দিলাম। ওখানে প্রতিমাসে মাইনের অর্ধেক টাকা দিয়ে দি! আর হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে একটা অনাথ আশ্রমে যাই, বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে। তাই বাড়ি ফিরতে রাত হয়! তারপর মাঝেমধ্যেই ওই আশ্রমের বাচ্চারা যখন অসুস্থ হয়ে পরে তখন রাতদুপুরে ছুটে যাই ওদের চিকিৎসা করার জন্য! আর আমার এই সৃষ্টিছাড়া কাজের জন্য বাবা মায়ের কাছে আমি তাদের অযোগ্য ছেলে হয়ে উঠেছি! আপনিও নিশ্চয় এসব শোনার পর আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন না! তবু জানেন আমার কেন জানিনা মনে হয় একদিন ঠিক আমি আমার বাউন্ডুলিনী’কে পাবো, পাবো’ই!!”
নয়েলা এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব কথাগুলো শুনছিল! সত্যিই এই মানুষটা সবার থেকে আলাদা, যেন রূপকথার রাজকুমার! সে হয়তো সাজানো গোছানো পরিপাটি নয় কিন্তু সত্যিকারের বড়ো মনের অধিকারী। বাস্তবের রাজকুমার’রা এইরকমই হয়!
কথাবার্তার শেষে সপ্তক চলে যাওয়ার পর নয়েলার বাড়ির সবাই যখন তাকে বাতিলের তালিকায় ধরে নিয়েছে তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে নয়েলা জানিয়ে দেয় ছেলে তার পছন্দ হয়েছে! এই ছেলেকেই সে বিয়ে করবে! বাড়ির লোকের হাজারো বারন কে উপেক্ষা করে নয়েলা বিয়েতে সম্মতি জানালো!
অনেকদিন পর আজ নয়েলা ডাইরি খুলে নিজের স্বীকারোক্তি লিখল-
#একটা_অগোছালো_প্রেম
একজন সাজানো মানুষ নয় বরং যদি একজন অগোছালো পাগল এসে বলে “বড্ড ভালোবাসি” তাহলে কি প্রেয়সী পারবে তা ফিরিয়ে দিতে?!! তাকে সারাজীবন ধরে সাজাবো আর বলব ” আমার পাগলটা আর মানুষ হলো না!”…দু’হাত ভরে ধোঁয়া মাখানো ভোর দেবো উপহারে আর আঁচল ভরে নিয়ে আসব একমুঠো দোপাটি! একটা ঝগড়ুটে, অবুঝ হনুমান এসে যখন বলবে -” এই ক্ষ্যাপি!” আমি তখন রেগে হবো টইটুম্বুর, নাই বা হলো সে পরিপাটি, তবু সে আমার!
স্টেশনের ফাঁকা প্ল্যার্টফর্ম জুড়ে প্রেমের গ্রাফিতি আঁকবে সে,আমি শুধু নয়ন ভরে তুলে রাখব প্রশান্তিটুকু! উফ! ছেলেটা বড্ড অগোছালো, হোক। নিয়মের বেড়াজালে আমি তাকে বাঁধব না, তাকে উড়তে দেবো, হাসতে দেবো!দেশলাইয়ের ফাঁকা বাক্সটাই কাঠি খোঁজার ব্যর্থ প্রয়াসকে মিথ্যে হতে দেবো না আমি!প্রেম কি শৃঙ্খল, নাতো…তবে…আকাশ তো মুক্ত, বিহঙ্গ…বৃষ্টি কি পারে তাকে পরিসীমায় বেঁধে রাখতে!!? অথচ দেখো সেই বৃষ্টি কিন্তু আকাশের বুকেই মরমে মরে, তার অস্তিত্ব আকাশকে জুড়েই…বড্ড খাপছাড়া…
তাই আমি তোকে গোছাতে আমি চাই না। চাই পরিপূর্ণ করতে।একসাথে পথ চলতে…”- লেখা থামিয়ে নয়েলা মুখটা একবার আকাশের দিকে করে চোখ বন্ধ করে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিলো!!!
সপ্তকের নাম্বারটা নিয়েই রেখেছিল।ফাঁক পেয়েই ফোন করে বলে ফেলল মনে কথা-” এই যে মিস্টার বাউন্ডুলে! আমি আপনার বাউন্ডুলিনী হতে চাই! আজ প্রিন্সেপ ঘাটে একবার আসবেন দয়া করে!আমার মনে আগুন লেগেছে ডাক্তারবাবু। একটা ওষুধ দেবেন প্লিজ?”
ডাক্তারবাবুর অকপট স্বীকারোক্তি -” ক্রিটিকাল ডিজিজ, এর একমাত্র মেডিসিন – ম্যারেজ উইথ এ বাউন্ডুলে… হাঃহাঃহাঃ!!!”