পাড়ার ভজাদার কাছে তার হোস্টেল জীবনের নানা মজাদার ঘটনা শুনে সৌভিকের ও হোস্টেল এ থেকে পড়াশুনা করার এক অদম্য জেদ চেপে ধরল। তাই উচ্চমাধ্যমিক এর পর বাইরের কলেজে একরকম জোর করেই ভর্তি হল সে। কলেজের কাছেই তার ছোটো মামার বাড়ি।সৌভিক কে সেখানে থেকেই পড়াশোনা করতে বলে সকলে, কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।যাইহোক শুরু হল তার হোস্টেল জীবন।
কিন্তু সারাজীবন মায়ের আঁচলের সাথে বেঁধে থেকে তিন বেলা খেয়ে কদমফুল হয়ে থাকা সৌভিক হোস্টেলে এসে ঘুঘু আর ফাঁদ একসাথে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হোস্টেলের মজাটা যে কি এবার সে হারে হারে টের পেতে লাগল।একে তো জঘন্য খাবার,,তার উপর এক একটা ছেলে এক এক প্রকারের প্রাণী। কেউ সারাদিন বই নিয়ে পড়ে আছে,, কেউ বা মোবাইল।কেউ প্রেমিকার প্রতারণায় বেঢপ মাতাল, কেউ বা রাত 3টের সময় পাঁচিল টপকে নৈশ বিহারে বেরোচ্ছে।কারোর ঘরে ৩-৪টে ঠাকুরের ছবি, তো কারোর ফোনে ৩-৪ রকমের vpn app; একটা টাচেই নিজের nationality পাল্টে আধ্যাত্মিক লেভেলে বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে যেন একটা চিড়িয়াখানা।
কিন্তু চিড়িয়াখানায় এলে নিজেকেও পশু হয়ে থাকতে হবে। সৌভিক তাই আস্ত ছাগলছানা হয়ে রইল।
এই ছাগলছানার roommate হল গিয়ে এক ধূর্ত শেয়াল,, নাম পনৎলাল সিং,, সংক্ষেপে পন্টাদা।জাতে পাঞ্জাবী হলেও দীর্ঘদিন কলকাতায় থাকায় বাংলাটা খাসা বলত।সে ব্যাটা আবার এক উদ্দাম নেশাখোর। আরো দুজন roommate অসিত আর প্রীতম কয়েকদিনের মধ্যেই পন্টাদার পার্টনার হয়ে উঠল।তিনজনে একসাথে নেশা করে, সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা মারে, ফুর্তি করে।
তবে পন্টাদা সাধারণ মাতাল না,, বলা যায় এক্সপেরিমেন্টাল মাতাল।নেশা করার নতুন কায়দা বের করায় তার নোবেল আটকায় কে। একবার Vodka, Rum আর Scotch একসাথে মিশিয়ে খেয়ে তার কি বমি। একবার তো আড়াই বোতল whiskey খেয়ে ভুল করে গার্লস হোস্টেলে চলে গেছিল। সব জানাজানি হতে পরদিন তার বাপকে ফোন warden এর। তার বাবা এসে সেদিন কি মার টাই না মেরেছিল তাকে। তবে তখনও নেশাগ্রস্ত থাকার সুবিধাটা সে পেয়েছিল- বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ আসেনি তার।
এরকমই একদিন হঠাৎ পন্টাদার পেটের পোকা নড়ে উঠল। সন্ধ্যায় হোস্টেলে নিজের ঘরে বসে শরবত সেবনের শখ হল। সৌভিক এসবের মধ্যে নেই। তার এমন শখের কথা শুনেই শুকিয়ে গেছে; ইয়ে মনে গলা।কিন্তু যেহেতু সে এ ঘরের বাসিন্দা,তাই চাঁদা তাকে দিতেই হবে। কিছু সময়ের মধ্যেই চার বোতল তরল guard আর warden এর চক্রব্যুহ ভেদ করে ঘরে উপস্থিত হয়ে গেল। তিন জন মিলে আসর বসল।সৌভিক ভয়ে ভয়ে নিজের বিছানায় বসে একটা বই পড়তে লাগল।
এদিকে পন্টাদার হঠাৎ ভীমরতি উঠল, সোডা বা জল ছাড়া বিশুদ্ধ তরল পান করবে সে।ফলে দুই সাগরেদ কেও তাই খেতে হবে।এখানেই শেষ নয়, চাটের মেনুতে চানাচুর-চিপসের সাথে এক প্লেট শুকনো লঙ্কা যুক্ত করল পন্টাদা। শুরু হল তাদের আজব নেশাকান্ড। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজনে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল। এবার তাদের ফুর্তি দেখে কে। এই হাসে,, পরক্ষনেই কাঁদে।পন্টাদা হটাৎ কেঁদে ওঠে ” কত ভালোবাসতাম রে ওকে, তাও ছেড়ে চলে গেল। শুধুমাত্র KTM আর DSLR নেই বলে আমাকে পেহেলি ফুরসৎ মে নিকাল বলে চলে গেল। দুঃখে বকুল(মাতালের ব্যাকুল) হয়ে একটা কবিতাও লিখেছিলাম”-
“এত ভালো বাসতাম তোমায় তবুও গেলে চলে
শুধু আমার DSLR আর KTM নেই বলে
বিকেলে পার্কে বসে আমরা খেতাম বাদামভাজা
আজ তোমার দুঃখে আমি টানছি শুধু গাঁজা
তোমার নামের ট্যাটু আমি করিয়াছিলাম হাতে
আমায় ল্যাং মেরে চলে গেলে এক জাম্বুবানের সাথে
তুমি একটা পেত্নী, তোমার বাপ বুড়ো টেকো
আমার দুঃখে কাটছে জীবন, তবু তুমি ভালো থেকো “
“চু চু ভীষন প্যাথেটিক”- প্রীতম বলে উঠল। অসিত বলে “আরে যেতে দাও,, It’s her choice। তুমি তো তাও পেয়েছিলে,, আমায় দেখ তো, কেউ crush খেল না, পাত্তা দিল না, আজন্ম সিঙ্গেল ই থেকে গেলাম, মনে হচ্ছে আমায় যেন সিঙ্গেলাইটিস রোগে ধরেছে।”
সৌভিক সামনে বই খুলে ওদের কথা শুনতে থাকে।
এদিকে দুঃখে বিমোহিত হয়ে হঠাৎ একসাথে 5 টা শুকনো লঙ্কা তুলে নেয় পন্টাদা, তার মধ্যে 3টে মুখে চালান দিয়ে দেয়। আর অমনি একসাথে তিরিশ টা খিস্তি সুউচ্চ স্বরে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে। ঝালে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘরময় তিড়িং বিড়িং করে লাফালাফি শুরু করে দেয়। হাতের দুটো লঙ্কা কে চটকে চুরমুর বানিয়ে ফেলে। প্রায় 2 বোতল জল গোগ্রাসে গিলে আধঘণ্টা পর ধাতস্থ হয়। নেশা টেশা তার তখন অনেকটাই ছুটে গেছে।
এদিকে এতখানি জলপান করায় পন্টাদার মধ্যতলদেশের জলাধারে বন্যা দেখা দিল। ফলে তাকে যেতে হল বাথরুমে । কিন্তু সেখানে আরেক কান্ড। লঙ্কা চটকানো হাত যেই না নিজের হাতিয়ারে পড়া ওমনি তার সর্বাঙ্গে বজ্রাঘাত। বাথরুম কাঁপিয়ে তখন লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছে। আশপাশ থেকে সব ছেলেপুলে ছুটে এসেছে।সৌভিক ও ছুটে গেছে।
ঘরের দুই মাতাল তখনও নেশার ঘরে অদৃশ্য পন্টাদার সাথে কথা বলেই চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পন্টাদা ঘরে ফিরে এল। সব কিছু দেখে শুনে সৌভিকের অবস্থা তখন খুব সঙ্গিন।
কিন্তু মাতালের তো আর লজ্জা নেই।খানিকক্ষণ গালাগাল দিয়ে,পুরুষত্বের দম্ভ দেখিয়ে পন্টাদা আবার নতুন করে শুরু করল।
কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়।সমস্ত বিপদ এক সাথেই ঘিরে ধরে। কিছুক্ষণ পর বাইরে ঠক ঠক শব্দটা শুনে এবার সৌভিকের আত্মারাম খাঁচায় ভেতর তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। warden আসছে ঘর চেক করতে। নির্ঘাত চেঁচামেচির শব্দ পেয়েছে, কিন্তু এত দেরি করে আসার কারন টা মাথায় ঢুকল না তার।সৌভিক প্রমাদ গুনল। এবার কি হবে। বুদ্ধি শুদ্ধি কম থাকলে যা হয়, সৌভিক গেল মাতালদের বোঝাতে। পন্টাদাকে যেই বলেছে যে warden আসছে অমনি পন্টাদার খিস্তিখেউর শুরু। warden এর শত গুষ্টির মুন্ডপাত শুরু করল। এই বেগতিক এ সৌভিক আরো বুদ্ধি হারাল।কি করবে বুঝতে না পেরে পন্টাদার গালে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিল। কিন্তু চড় খেয়ে সামান্য হুশ ফিরল পন্টাদার। সৌভিকের কথায় বাহ্যিক পরিস্থিতিটা খাপছাড়া ভাবে বুঝে নিয়ে জড়ানো গলায় বলল, “তোকে কিছু ভাবতে হবে না , এই শর্মাকে ধরা মুশকিল ই নেহি নামুমকিন হ্যায়।” বলে খানিকটা টলতে টলতেই দুই সাগরেদ কে তুলে বিছানায় বসাল, দুজনের সামনেই বই খুলে রেখে দিল।তারপর নিজেও বিছানায় উঠে সামনে বই খুলে বসে রইল। কিছুক্ষন পরে warden এসে দরজায় টোকা দিয়েছে। সৌভিককেই দরজা খুলতে হল। সৌভিক খানিকটা পিছিয়ে এসে পন্টাদার দিকে তাকাল। তখন তার অভিনয় দেখে কে। একবার ভ্রু কুঁচকে বই পড়ছে, তো পরক্ষনেই মাথা উপরে তুলে আঙ্গুল দিয়ে শুন্যে আঁকিবুকি কাটছে।সৌভিকের একটা অস্কার ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছা হল।
warden ঘরে ঢুকেই থমকে গেছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেঝেতে তাকিয়ে সৌভিকের চোখ কপালে উঠল, পেটের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল, কিডনি টা চুলকোতে লাগল।ঘরের মাঝখানে মেঝেতে চারটে বোতল, তিনটে গ্লাস, একটা প্লেটে কিছুটা চানাচুর আর একটা প্লেটে শুকনো লঙ্কা, দুটো ফাঁকা চিপস এর প্যাকেট। এই হচ্ছে মাতালের মাস্টারমাইন্ড। ইতিমধ্যে ধপ করে একটা শব্দ পেয়ে সৌভিক আর warden দুজনেই মাথা তুলল। প্রীতম নেশার ঘোরে বসে বসে ঘুমাচ্ছিল, এবার সে বইয়ের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে।পন্টাদার এসব দিকে হুশ নেই।সে একেবারে চরিত্রে ঢুকে গেছে।অসিতের ও চোখ বন্ধ,, এই পরে কি সেই পরে। Warden এর রক্তচক্ষু সৌভিকের দিকে ফিরল।জবাফুলের মত লাল চোখদুটো দেখে সৌভিকের মনে হল এই বুঝি তাকে ভস্ম করে দেয়।warden এর চোখ আবার মেঝের দিকে ফিরল। এবার সে এগিয়ে গিয়ে একটা বোতল তুলল, তার প্রায় অর্ধেক তখনও ভর্তি। এরপর যেটা সৌভিক দেখল সেটা সে কল্পনাও করে নি। warden সেই অবশিষ্টাংশ পাঁচ ঢোকে চোঁ চোঁ করে মেরে দিল। তারপর বোতল নামিয়ে চানাচুরের প্লেটটা তুলে নিয়ে কোনো কথা উচ্চারণ না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সৌভিকের মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। পন্টাদার দিকে তাকিয়ে দেখে ব্যাটা এখনও চরিত্রে ডুবে আছে, অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি তার।সৌভিক আর কিছু বলতে গেল না তাকে।মাতালকে বোঝানোর শখ মিতে গেছে তার। পরদিন কি হবে এই ভেবে ভয়ে সৌভিকের খাওয়া দাওয়া লাটে উঠল। বাড়িতে জানতে পারলে যে কি হবে সেটা ভেবে আবার শুঁকিয়ে গেল, ইয়ে গলা।ভয়ে ভয়ে সন্ধ্যায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন কলেজ ১০টা থেকে।হোস্টেল থেকে হেঁটে মিনিট দুয়েক এর পথ। সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠে কিছু না খেয়েই বেরিয়ে পরে সৌভিক। দুপুর বারোটায় কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখে, নবাবপুত্রগন তখনও ধ্যানমগ্ন। দুটো নাগাদ এক এক করে ধ্যানভঙ্গ হল সবার। মোটামুটি ফ্রেস হয়ে এসে পন্টাদা সৌভিক কে জিজ্ঞেস করল,,” হ্যাঁ রে কাল হয়েছিল কি, নেশার ঘোরে পড়াশুনা করেছি নাকি, সবার সামনে বই খোলা?”
সৌভিক গত রাতের ঘটনার পুরো বর্ননা দিতেই warden কে পন্টাদার আবার খিস্তিখেউর শুরু।
“শালা, হারামজাদা,, হোস্টেলে ঢোকার সময় ধরা পড়ে যাওয়ায় আরো বেশি দামি এক বোতল কিনে এনে warden টাকে রীতিমত ঘুষ দিয়ে ঢুকলাম, তাও ব্যাটা পরে এসে তোকে ঘাবড়ে দিয়ে আমাদের সম্পত্তিতে ভাগ বসিয়ে গেল।আবার আমাকে দিয়ে acting ও করিয়েছে।বটে,, দাঁড়া আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।”
সব শুনে সৌভিক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শুধু। পেটের ভেতর টা কিচিরমিচির করতে থাকে তার।warden এর রাতে দেরি করে চেক করতে আসার কারন টা এবার তার মাথায় ঢোকে।সে ব্যাটাও প্রথমে নেশাগ্রস্ত ছিল, পরে নেশা কিছুটা কাটার পর বোধ হয় কেউ কমপ্লেইন করে। ঘরে এসে অবশিষ্ট whiskey টা পেয়ে লোভ সামলাতে পারে নি। সেটা খেয়ে আবার নেশা চড়ে যাওয়ায় কিছু না বলে ওভাবে বেরিয়ে গেছিল। খুব বাঁচা বেঁচে গেছে কাল সৌভিক।সত্যি এটা হোস্টেল না চিড়িয়াখানা! কাল চিড়িয়াখানার নেকড়েটার দেখা পেয়েছিল তাহলে।