রাত্রে শোবার আগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা ধরিয়েছিল সুমিত.. ঘরের মধ্যে শ্রীতমা তাদের তিন বছরের মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে..
আজ অনেকদিন পরে অর্চিতা এসেছিল তাদের বাড়ি .. প্রায় নয় বছর পরে,
অর্চিতা… তার প্রাক্তন প্রেমিকা..
অর্চিতা খুব ভালো করেই জানে তার এবাড়ি আসাটা কেউ পছন্দ করবেনা, তাও তার নির্লজ্জতা দেখে একটু অবাক হয়েছিল সুমিত, সেই সঙ্গে বিরক্তও..
যদিও শ্রীতমা কে বিয়ের আগে অর্চিতার ব্যাপারে সবকিছুই জানিয়েছিল, কারণ তার মনে হয়েছিল স্বামী স্ত্রী দুই জনের মধ্যে কোনো আড়াল রাখা উচিৎ নয়, তবুও কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেছিল সে, তার শান্ত সুন্দর নিস্তরঙ্গ সংসারে অর্চিতার অযথা আত্মঅহংকারের ঢেউ সে কিছুতেই চায়না,
অর্চিতা একবার তার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ছিল সে..একসময় অর্চিতা সুমিতের বাবার খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল , পড়তে আসতো তাদের বাড়ি..সুমিত অর্চিতার থেকে তিন বছরের সিনিয়র হলেও …পড়তে আসার সূত্রে তাদের আলাপ, সেই আলাপ ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা হতে বেশি সময় লাগেনি ,
দুজনেই পড়াশোনাতে ভালো হলেও… অর্চিতা জয়েন্ট পরীক্ষায় পাশ করার পরে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে কি বুঝলো কে জানে !!
তাদের চার পাঁচ বছরের প্রেমকে নিমেষে শেষ করতে একটুও বাঁধেনি তার , অর্চিতা হয়তো ভেবেছিল সে ডাক্তার হবার পর সুমিতের মত ছাপোষা মানুষের ঘর সে করতে পারবে না,
অথচ অর্চিতার সাথে তাদের বাড়ির সম্পর্কও এতটাই গভীর ছিল যে রীতিমতো অর্চিতা তাদের বাড়িতে যখন তখন আসতো যেত, এলাকার সবাই জানত ওরা বিয়ে করবে, দুই পরিবারের মধ্যে বসে কথাবার্তাও মোটামুটি পাকা হয়ে গিয়েছিল.. প্রতীক্ষা ছিল শুধু দুজনের প্রতিষ্ঠিত হবার,
কিন্তু ডাক্তারি পড়ার সময় অর্চিতার মধ্যে আমূল পরিবর্তন হচ্ছে সেটা বুঝতে পেরেছিলো সুমিত, আর তারপর অর্চিতা যখন নিজে সরাসরি সুমিতকে ইগনোর করে বুঝিয়ে দিতে থাকলো যে… সে আর এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়না… তখন সুমিত আর আটকানোর চেষ্টা করেনি, কারণ সে জানতো.. কেউ যদি একবার মনস্থির করে এই সম্পর্ক রাখবেনা, তখন তাকে যতই বোঝাও…ফিরবেনা সে আর কখনোও,
কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে বড্ড ভেঙে পড়েছিল, তাছাড়া সুমিতের বাবা এই এলাকায় একজন যথেষ্ট সম্মানীও ব্যক্তি, এই ব্যাপারএর পর সুমিতের বাবা-মাও বেশ অসম্মানের সম্মুখীন হয়েছিলেন.. কারণ এলাকার অনেকেই সুমিতের বাবাকে বলত “কি হবু বৌমা তো ডাক্তারি পড়তে গেছে….শুভ পরিণয় টা কবে হবে? “
পরে যখন জেনে ছিল একজন ডাক্তার কে বিয়ে করেছে অর্চিতা..মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিলো তাঁদের.. |
সুমিত তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে সামলেছে.. নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে..হয়তো অর্চিতার স্টেটাস এর সাথে তার সত্যি মেলেনা, কিন্তু
সে নিজে এখন একজন টেলিকম অফিসের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার .. শ্রীতমাও এই এলাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের টিচার, সে আর শ্রীতমা তাদের তিন বছরের মেয়ে মিষ্টি আর বাবা মা কে নিয়ে খুব সুখী তাদের সংসার..
অর্চিতা আজ এসেছিল একটা বড় নতুন স্করপিও গাড়ি নিয়ে, তাদের মেয়ের জন্য একটা মানুষ সমান টেডি বিয়ার কিনে নিয়ে এসেছিল…
তবে অর্চিতার আসার পেছনে যে কিছু স্বার্থের কারণ অবশ্যই ছিল.. সেটা সুমিত বুঝেছিলো ,
অর্চিতা মুখে তো বলছিল.. স্যার এর আশীর্বাদ নিতে এসেছে.. এখানে নতুন চেম্বার খুলবে তাই , আসলে আশীর্বাদ টাত কিছু নয়, একচুয়ালি পারমিশন নিতে এসেছিল , সে এখন গাইনোলজিস্ট, সুমিতের এলাকার, ওদের বাড়ির কাছেই একটা বড়ো ওষুধ দোকান এ নিজের চেম্বার খুলতে চায়, অতীতের ঘটনা যেন এতে কোনো প্রভাব না ফেলে তার একটা সুক্ষ ডিল যাকে বলে…
আর সেইসঙ্গে এটাও দেখাতে এসেছিল.. সেদিনের ডিসিশন নিয়ে সে কোনো ভুল করেনি, কোথায় সে একজন গাইনোলজিস্ট, প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, আর কোথায় সুমিত… এক টেলিকম অফিসের সরকারি কর্মচারী …
সুমিতের বাবা-মা অমায়িক মানুষ, তারা মুখে অমলিন হাসি রেখে সব কিছু শুনতে বাধ্য হচ্ছিলেন, আর অর্চিতা নির্লজ্জের মতো তাদের ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে… কি সুন্দর ভাবে হেসে হেসে অহংকার এর সাথে বলে যাচ্ছিল.. কত জায়গায় সে চেম্বার খুলেছে, সল্টলেকের কোথায় ফ্ল্যাট কিনেছে…..
সুমিতের আজ খুব অবাক লাগছিল এই ভেবে যে.. এই মেয়েটিকে সে একদিন ভালবেসে ছিল..
একদিকে নিজের এই অস্বস্তিকর পরিবেশ, তার উপর শ্রীতমার কথা ভেবে আরো খারাপ লাগছিল সুমিতের, কোন স্ত্রীর পক্ষে এই পরিস্থিতি মেনে নেওয়া সম্ভব নয় ..
তবে শ্রীতমার ব্যবহারে সে খুব অবাকও হয়েছিল , অর্চিতা কে চা করে এনে দিয়ে শ্রীতমা হাসিমুখে বলেছিল… “আপনার গল্প আমি শুনেছি ওর মুখে, ভালোই হলো আপনার দেখা পেলাম, আপনার কয়েকটা মূল্যবান জিনিস আমাদের কাছে আছে, সেটা ফেরত দেবার সুযোগ পেলাম,একটু ওয়েট করুন আমি আসছি,. “
এই বলে অর্চিতাকে অবাক করে দিয়ে..শ্রীতমা পাশে তাদের রুমে চলে গিয়েছিলো |
সুমিতও ভেবে পাচ্ছিল না অর্চিতার এমন কি মূল্যবান জিনিস আছে তাদের কাছে যে সে নিজে জানে না!!
মিনিট পাঁচেক পরে হাতে করে কয়েকটা ফটো এনে সামনের টি টেবিলের উপর রাখে শ্রীতমা ,সঙ্গে দুটো রঙিন চিঠি, সুমিত ছবিগুলো দেখেই বুঝতে পারে, তার আর অর্চিতার একসাথে তোলা দীঘা আর ভিক্টোরিয়ার ছবিগুলো, যদিও ছবিগুলো থেকে সুমিতের ছবি কেটে আলাদা করা…
ছবিগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিল সুমিত, ছবিগুলো আর চিঠি দুটো দেখেই অর্চিতার মুখটা ছোটো হয়ে গেল…
শ্রীতমা মিষ্টি হেসে বলল..” ছবিগুলো দেখেছিলাম বলে আজ আপনাকে এতো সহজে চিনতে পারলাম, আপনি চিনতে পারছেন তো ছবিগুলো? কিছু দীঘার আর দু তিনটে ভিক্টোরিয়ায় তোলা ..আর ওই দুটো চিঠি আপনার ই লেখা… ও অবশ্য আমাকে বলেছিল পুড়িয়ে ফেলতে..কিন্তু আমার আর পরে মনে ছিল না, যদিও একসাথে ছবিগুলো ছিল.. কিন্তু কিছু মনে করবেন না ভাই… আমার বরকে আমি আমার কাছে রেখে দিলাম, আপনার গুলো আপনাকে ফেরত দিয়ে আজ কিন্তু বেশ শান্তি লাগছে আমার “……. তারপর সুমিতের দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেসের ভঙ্গিতে বলেছিলো ” কিগো আমি ঠিক বলিনি? “
গল্পটি স্পনসর করেছে , Dev Entertainment Ventures , আর গরমের ছুটিতে আসছে “টনিক”
আপনার নিকটবর্তী সিনেমাহলে ..
সুমিত মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে দেখল অর্চিতার এতক্ষণের অহংকারী মুখ এক নিমেষে চুপসে গেছে , তারপর মাথা নিচু করে ছবিগুলো তুলে নিয়ে কাউকে কিছু না বলে গাড়িতে উঠতে যাবে, এমন সময় সুমিত তার মেয়ের জন্য আনা মানুষ সমান লম্বা টেডি বিয়ার টা ফেরত দিয়ে বলল.. ” এত বড় খেলনা..!! মেয়ে অযথা ভয় পাবে, তাছাড়া আমাদের মত ছাপোষা মধ্যবিত্তের বাড়িতে এত বড় গিফট মানায় না..”
কথাগুলো বলে বেশ হালকা লাগছিল সুমিতের….
তার আর শ্রীতমার সুখের সংসারে এতোটুকু দুঃখের আঁচ সে দিতে দেবে না, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতে একটা স্বস্তির হাসি খেলে গেল তার মুখে, এতদিনের একটা ভারী বোঝা যেন তার মন থেকে নেমে গেল,
” এত মন দিয়ে প্রাক্তন প্রেমিকার কথা মনে করে আফসোস করছো বুঝি!! ভাবছো বুঝি কোথায় প্রতিষ্ঠিত গাইনোলজিস্ট, আর কোথায় তোমার বউ একজন সামান্য স্কুল মাস্টারনি !!!”
সত্যি ভাবতে গিয়ে খেয়াল করেনি সুমিত কখন শ্রীতমা চলে এসেছে তার পাশে, শ্রীতমাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে সুমিত বলল..
“ঠিক বলেছ আমি ভাবছিলাম… ভাগ্যিস প্রাক্তন হয়েছিল সে, তাই তোমাকে পেয়েছি, তুমি আমার জীবনে না এলে আমি বুঝতাম না যে ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন..”
তারপর শ্রীতমার থুতনিটা ধরে উঁচু করে মুখের কাছে মুখ এনে বলেছিল… “আর শোনো.. এটা আমি খুব ভাল করেই জানি ‘প্রাক্তন’ কথাটা হল ওষুধের এক্সপায়ারি ডেট এর মত.. যার বর্তমান ও ভবিষ্যতে কোনো মূল্য নেই, তাই আফসোস করার কোন প্রশ্নই ওঠে না..”…
বি : দ্র :-(গল্পের চরিত্রের নামগুলো কাল্পনিক হলেও সত্য ঘটনা অবলম্বনে…
আর হ্যাঁ অর্চিতা ওই এলাকায় আর চেম্বার খোলেনি )