সঞ্চারী মধুচন্দ্রিমায় গেছে ।এতক্ষণে হয়ত পোশাক গুলোও সরিয়ে ফেলেছে নিজের শরীর থেকে।এক এক করে ঘরের আলোগুলোও নিশ্চয় নিভিয়ে ফেলেছে।সঞ্চারী নিশ্চয় লজ্জা পাবেনা।কিম্বা পাবে হয়ত!স্বামীর সাথে মিলনের প্রথম রাত বলে কথা।এতটুকু লজ্জার লাল নিশ্চয় তার শ্বেত পদ্মের মতো মুখের উপর টুপ করে এসে পড়েছে।কেমন হবে সেই মুখটা! দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে.. সঞ্জয়ের।
শরীরের প্লেবতায় হঠাৎ যেন জোয়ার এসেছে,কোথায় খুঁজছে সে!এই তো সঞ্চারী।একদম তার হাতের নাগালের মধ্যে। তার সামনেই অন্ধকারে ভাস্বর হয়ে উঠেছে।অখণ্ড শরীরের এক অনাবিল সৌন্দর্য নিয়ে, ঠিক যেন একটা উপত্যকার মতো। বুকের উপর মুখ রেখে গভীরতম নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।হৃদস্পন্দনের দ্রুত ওঠানামা,নিশ্বাসের ঘনঘন আন্দোলন মিলনের আগুনটাকে যেন আরও তীব্র করে তুলেছে।সমস্ত শিরা উপশিরা সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এই মুহূর্তের জন্য।এবার আঁকড়ে ধরতে হবে…শুষে নিতে হবে শেষ জলবিন্দু অবধি।
মৃদু চিৎকারে ঘোর কাটল সঞ্জয়ের।কোথায় সে! অন্ধকার একটা ঘরেই তো!আর কিছু দৃষ্টিতে পড়ছেনা!চোখ সইতে একটু সময় নিল।যেই মুহূর্তে সে সজাগ হল,বুঝতে পারল বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে।তার নাগপাশে যে নারীটি ভীত সন্ত্রস্ত, লজ্জামুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে সঞ্চারী নয়।বাঁধন আলগা করে দিল সঞ্জয়, সরে গেল একটু দূরে। যে মেয়েটি এতক্ষণ তার স্যাঁতসেঁতে বুকের সাথে সন্নিবিষ্ট হয়ে বসেছিল সে তার অনাবৃত শরীরের চারিদিকে চাদর টাকে জড়িয়ে নিল।সঞ্জয় বুকে একটা যন্ত্রণা অনুভব করল। এ কি করছে সে! মাথা ঠিক আছে তো তার! আরও পাঁচটা চিন্তায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলার আগেই সঞ্জয় দ্বিধাভরে ক্ষমা চেয়ে নিল মেয়েটির কাছে,”সরি। আমি ঠিক মানে বুঝতে পারিনি।তোমার লাগেনিতো কোথাও!” মেয়েটি একটা কথাও বললনা।মাথা নামিয়ে কেবল এদিকওদিক ঘুরিয়ে জানালো,”উঁহু”।সঞ্জয় কথা বাড়ালোনা।বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে এলো।একটা সিগারেট ধরালো।মাথার ভিতর টা কেমন ধাঁ ধাঁ করছে।এতক্ষণ যেটা হয়নি,এবার সেটা হল।একটা অজানা অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করল।হুইস্কির নেশায়, বাইরে থেকে আসা মৃদু লাল আলোতে সে হ্যালিউশিনেট করছিল,সঞ্চারীকে, রীতির মধ্যে। রীতি যে কিনা তার স্ত্রী,তার বিন্দুমাত্র আভাসও নিশ্চয় পায়নি।কি জানি মেয়েটা কি ভাবল! হয়ত ভেবেছে ওকে ভালোবেসেই… ওই মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছিলাম।বেচারি জানেও না তার মধ্যে এতক্ষণ অন্য একটা মেয়েকে কল্পনা করছিলাম।হাত দিয়ে ব্যালকনির রেলিং টার উপর আঘাত করল সঞ্জয়। সব তো ঠিক চলছিল। সে তো এখানে তার মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করতেই এসেছে। রীতির সাথে আলোচনা করেই তারা দুজনে মিলে উটিতে এসেছে।দিনের বেলাটা তো বেশ ভালোই কেটেছে।দুজনে মিলে শপিং করতে গেছিল।রীতিকে বেশ সহজ মনে হচ্ছিল।সেও তো বেশ খুশিই ছিল।আর সেটাই তো তার লক্ষ্য।
সঞ্চারীকে সে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল যে সেও সুখী হতে পারে।কিন্তু সে কি হেরে গেল! হ্যাঁ নিশ্চয় যে মুহূর্তে সে রীতির মুখে সঞ্চারীর মুখ বসিয়ে নিয়েছে,সেই মুহূর্তে সে হেরে গেছে।সঞ্জয় চোখ বন্ধ করে নিল।কল্পনার দৃশ্যপটে সে সঞ্চারীকে দেখতে পেলো। সঞ্চারী হাসছে। শব্দ করে করে হাসছে।চিৎকার করে বলছে,”পারলে নাতো! পারলে নাতো! আমাকে ছাড়া তুমি সুখী হবে ভাবলে কি করে! কত বোকা তুমি! আর বোকা বলেই তো আমি তোমার কাছে আসিনি। ইউ আর আ লুজার সঞ্জয়।আর একজন লুজার আমার মতো সুন্দরীকে ডিজার্ভ করেনা।” সেই হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।কল্পনা আর বাস্তবের সূক্ষ্ম দেওয়াল ভেঙে দিতে লাগল।সঞ্জয় চিৎকার করে উঠল,”সাট আপ।” রাতের নির্জনতায় সেই চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার ফিরে আসতে লাগল। সঞ্জয় আবার বাস্তবে ফিরে এলো।ওর হাতের সিগারেট টা ও নিজের অজান্তেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।কি করছে কি সে! এখনও নেশা কাটেনি তার।ঘরের ভিতর ফিরে এলো সঞ্জয়। অনেকেই বিরক্ত হতে পারে।হওয়ারই কথা। অনেক রাত হয়েছে।কেউ দেখেনি নিশ্চয় যে সে’ই চিৎকারটা করেছে।এত রাতে হোটেলের স্টাফরা খোঁজ নিতে এলে সেটা ভীষণ লজ্জার হবে।রীতি কি ভাবছে কে জানে! রীতি ওকে নিশ্চয় নেশাগ্রস্থ পাগল ভাবছে।ওর উপর অদ্ভুত ইম্প্রেশন ফেলছে সে।এভাবে সারাজীবন কি সে সুখী রাখতে পারবে রীতিকে! ও নিশ্চয় সব ছেড়ে ওর কাছে এসেছে।অবাক হয়ে গেল সঞ্জয়! এসব কি ভাবছে ও।সঞ্চারীকে ছেড়ে রীতির দিকে ঘুরে গেল কেন তার চিন্তাটা! রীতি এখন তার স্ত্রী।তার সাথে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।পারবে কি সে!বাকি জীবনটা অনেকটা বেশি সময় মনে হল সঞ্জয়ের।
ঘরে ফিরে সঞ্জয় দেখল, রীতি তার নাইট গাউনটা আবার পরে নিয়ে,বুকে একটা বালিশ চেপে খাটের এক পাশে হেলান দিয়ে বারান্দার দিকেই তাকিয়ে ছিল।চোখের দৃষ্টিতে প্রশ্ন।বাইরের কুয়াশা থেকে ঠিকরে আসা মায়াবি আলোতে সঞ্জয় রীতির চোখ দুটো দেখতে পেলো। কি নিরীহ! কি মায়াবী! কি সুন্দর! সঞ্জয়ের বুকের ভেতরটা আবার মোচড় দিয়ে উঠল।এই রাতের অভদ্রতার জন্য নিজেকে সে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবেনা।তবে মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাওয়া দরকার।এক্ষুনি।সঞ্জয় বিছানার উপর বসে কিছু বলার অভিপ্রায় করতে যাবে এমন সময় রীতি বলে উঠল,”একটু জল খাবে!” সঞ্জয় কথাটা বলতে পারলোনা।ঘার কাত করে সম্মতি জানালো।রীতি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে পাশের টেবিল থেকে জলের জাগ টা তুলে নিয়ে তার পাশে রাখা গ্লাসে ঢেলে নিল।তারপর গ্লাসটা তুলে এনে সঞ্জয়ের হাতে দিল।সঞ্জয় কিছু বলল না।চুপচাপ ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের জলটা ঢেলে দিল শুকিয়ে আসা গলার প্রকোষ্ঠে।গ্লাসটা রীতির হাতে দিতে, সে সেটাকে টেবিলের উপর রেখে, বিছানার উপর এসে বসল আবার।তারপর সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে একটু উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করল,”মাথা ব্যথা করছে তোমার! কপাল টিপে দেবো!”
সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,”না।তুমি শুয়ে পড়ো।আমিও শুয়ে পড়ছি।”
রীতির মন যেন মানল না,সে আবার বলল,”কিছু লাগলে আমাকে ডেকো।”
সঞ্জয় মৃদু হাসল,”চিন্তা করোনা।তুমি শুয়ে পড়ো।রাত হয়েছে।”
রীতি কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করল।সঞ্জয় জেগে রইল। ঘুম আসছেনা তার।না আসার ই কথা। একমনে সে রীতির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল.. মেয়েটা সুন্দর।স্রেফ রূপ নয়। শুধু রূপের সৌন্দর্য এত তীব্র হয়না।মেয়েটার ভিতর টা পরিষ্কার। স্বচ্ছ ঝরণার জলের মতো।পাহাড়ি নদীর মতো স্নিগ্ধ। সেই স্নিগ্ধতাই মেয়েটির সৌন্দর্যকে অপার্থিব করে তুলেছে।এই মুহূর্তে সঞ্চারীও কি এতটা সুন্দর হতে পারতো!রূপের সৌন্দর্যে হয়ত ওকে হারানো যেতনা,কিন্তু এই মেয়েটির সম্মিলিত সৌন্দর্যের কাছে এই মুহূর্তে সঞ্চারীও হেরে যাবে।আত্মতৃপ্তিতে সঞ্জয়ের মনটা ভরে উঠল।পরমুহূর্তে সে আশ্চর্যও হয়ে গেল! এরকম মনে হওয়ার কারন কি! সে তো সঞ্চারীকে ভালোবাসে।তার জীবনের একমাত্র সত্যি তো সঞ্চারী।সেই কলেজের দিন থেকেই।স্মৃতিগুলো স্বপ্নের বেশে আরোও একবার জুড়ে বসল সঞ্জয়ের দৃষ্টিপটে।
ক্লাসে প্রথম বার সঞ্চারীকে দেখেই পাগল হয়ে গিয়েছিল সে।এত অপরূপ সুন্দরী দুচোখে ধরা দেয়নি কোনোদিনো সঞ্জয়ের,আর এত কাছাকাছি অবস্থান ও করেনি।লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে কিছু আছে কিনা জানা নেই সঞ্জয়ের,তবে সঞ্চারীকে দেখা মাত্রই ওর মন বলেছিল এই মেয়ের জন্য সে সবকিছু করতে পারবে।সবকিছু। একে কাছে পেলে সে আজীবন আগলে রাখবে,ঠিক যেভাবে ঝিনুক মুক্তোকে আগলে রাখে।প্রথম ভালোবাসার স্বাদ পেতে না পেতেই বন্ধুত্ব, ক্লাসনোটস এর অদলবদল,সদলবলে আড্ডা দিতে যাওয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা ওদের মধ্যে যে দূরত্বটা ছিল সেটাকে অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল।সঞ্জয় প্রথম থেকেই সঞ্চারীর প্রতি কেয়ারিং ছিল।রাস্তা পার করার সময় নজরে নজরে রাখা,ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে পরে ফোন করে খবর নেওয়া।আরও অনেক ছোটখাটো ব্যাপার।সব মুখে বলা যাবেনা।সঞ্জয়ের অন্যান্য বন্ধুরা আড়ালে ওদের দুজনকে নিয়ে অনেকরকমের কথা বলতো।সঞ্জয় সব জানতো।চাপা গর্বে বুক ভরে যেতো সঞ্জয়ের।এই সুখটুকুই তো সে আকণ্ঠ পান করতে চেয়েছিল।এটুকুই তো তার পাওনার মেঘ।কিন্তু প্রথম বর্ষার বৃষ্টিটা আসার আগেই ঝড় এসে সব শস্য তছনছ করে দিয়ে গেল।
একটা সুবৃহৎ ঢেউ তীরে সজোরে ধাক্কা মেরেছিল সেইদিন, যেদিন সঞ্জয় সঞ্চারীকে মনের সমস্ত অনুভূতি উজাড় করে দিতে গিয়েছিল।চুপচাপ দাঁড়িয়ে পাঁচমিনিট ধরে সবকথা শোনার পরে সঞ্চারী জবাবে বলেছিল,”কিছু মনে করিস না সঞ্জয়।আমি তোর ফিলিংস গুলোকে রেসপেক্ট করছি,কিন্তু আমার পক্ষে এগুলোকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়,আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।” সঞ্জয়ের শিরদাঁড়া দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল সেইমুহূর্তে। শুকনো মুখে সে কেবল এই কথাটাই বলতে পেরেছিল,”কিন্তু আমি যে তোকে ভালোবাসি। জীবনে প্রথম কাউকে এতটা ভালোবেসেছি। আমি কি করবো বল!”
“রেখে দে আর নয়ত পুড়িয়ে ফেল।”
পোড়াবে কি করে সঞ্জয়। জীবনে প্রথম এই অনুভূতির বীজটাকে মাটিতে পুঁতেছিল সে। নিয়ম করে জল দিয়েছে।সার দিয়েছে।বড়ো হতে হতে সেই গাছটাই যখন প্রথম গোলাপ ধরল, তখন সে জানতে পারল গাছের মালিক অন্যকেউ।
ভালোবাসা এমনই এক অনুভূতি, মানুষকে যত তাড়াতাড়ি উপরে তোলে, তার থেকেও তাড়াতাড়ি টেনে নীচে নামায়।মানুষের আর নিজের কোনোকিছুর উপরেই নিয়ন্ত্রণ থাকে না।মানুষ অসহায় জীবে পরিণত হয়। সঞ্জয়ের মনে হয়েছিল তার বেঁচে থাকার সমস্ত স্পৃহা কেউ যেন এক নিমেষে কেড়ে নিয়েছে।তবে মনুষ্যজাতির আরও একটি বাজে গুন হচ্ছে তারা সহজে হার মানেনা।তল পাবেনা জেনেও তল হাতড়িয়ে বেড়ায়।সঞ্জয়ও চেষ্টা করেছিল।দূর থেকে। কাছ থেকেও।নির্বিবাদে সঞ্চারীর পাশে দাঁড়িয়েছে।কখনো বুক ফুলিয়ে বলেছে,”নে তোকে ছেড়ে দিলাম।” কখনও হাতজোর করে ভিক্ষা করেছে,”একটা সুযোগ দে। বিশ্বাস কর তোকে যেকোনো মানুষের থেকে ভালো রাখবো।আমার সবটা দিয়ে দেবো,স্রেফ একটা সুযোগ দে। একবার প্রমাণ করতে দে।” সঞ্চারী কখনো মুখ ভার করে,কখনো অসম্ভব খারাপ ভাষায় তাড়িয়ে দিয়েছে সঞ্জয়কে।সে বারংবার বিতাড়িত হবার পরও আত্মমর্যাদা বিকিয়ে ফিরে গেছে সঞ্চারীর চৌকাঠে।
কলেজের পাট চুকে গেলে সঞ্চারী সব রকমের যোগাযোগ ছিন্ন করে দিতে চেয়েছিল।সঞ্জয় তবু হার মানেনি। নিজেকে সে বারবার প্রশ্ন করেছে কি করলে সে সঞ্চারী কে পেতে পারে।নিজেই নিজেকে উত্তর দিয়েছে,তুমি ওর যোগ্য না।নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করো।তারপর অ্যাপ্রোচ করো।তোমার ভবিষ্যতের ওজন বাড়লে সঞ্চারীও তোমাকে ফেরাতে পারবেনা। লক্ষ্যে পৌঁছতে তার তিনবছর লাগল।এই তিনবছরে সে প্রতিদিন ভেবেছে,কিভাবে পৌঁছোবে সঞ্চারীর কাছে।কবে তাকে বিয়ে করবে! কোন কোন জায়গায় ওকে নিয়ে বেড়াতে যাবে! কিভাবে ওকে হাসাবে! কেমন করে ওকে আদর করবে! কিন্তু চাকরি পাওয়ার উচ্ছ্বাস কাটতে না কাটতেই সঞ্চারীর বিয়ের খবর সঞ্জয়ের কানে এলো।সে শেষ একবার অনুরোধ নিয়ে গেল।সঞ্চারী ওর মুখের উপর জানিয়ে দিল,”আমি সুখী সঞ্জয়।আমি যে মানুষ টাকে ভালোবেসেছি,তাকেই বিয়ে করছি। তুই যতো বড়ো মানুষই হোস আমি তাকে ছেড়ে তোর কাছে আসবোনা।তুই আমাকে ভুলে যা। আর যোগাযোগ রাখিস না আমার সাথে।যদি আমাকে এতটুকু ভালোবেসে থাকিস তাহলে আমার এই সুখের জীবনের পথে আসিস না।পারলে নিজে সুখী হ।যদি পারিস।”
সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ ভাবে কিভাবে নিজেকে শেষ করা যায়।নিজেকে কষ্ট দিতে পারলে,নিজেকে শেষ করে দিতে পারলেই মুক্তি। আর পাঁচটা মানুষ যেভাবে দুঃখবিলাস করে,সঞ্জয়ও সেভাবে করল,নিজেকে নেশার মধ্যে বুঁদ করে রেখে।রোজ দুঃখ করতে শুরু করলে মানুষের সেটা অভ্যেসে পরিণত হয়।দুঃখ করাটাও একটা নেশা।ভয়ংকর নেশা।সহজে যায়না। দুঃখের রেশ কিছুটা কেটে গেলে মানুষের মনে ঘৃণা জন্মায়।এই ঘৃণা আর কিছুই না আত্মরক্ষার একটি কৌশল।সঞ্জয় ঠিক করে সে এবার থেকে সঞ্চারী কে ঘৃণা করবে। সঞ্চারী কে হয় তার জীবনটাকে শেষ করে দেওয়ার! সঞ্জয় সুখী হবে,সুখী হয়ে সে দেখিয়ে দেবে সঞ্চারী কে তার আর তাকে প্রয়োজন নেই।তাই অনেকটা জেদের বশেই সঞ্চারীর প্রায় সাথে সাথেই সঞ্জয় বিয়ে করে নেয়।রীতির সঙ্গে।এমনকি হানিমুনের ডেটটাও হিসেব করেই ঠিক করে।কোনোমতেই সে পিছিয়ে পড়তে চায়না সঞ্চারীর থেকে।তাকে সবকিছুতেই সঞ্চারীকে হারাতে হবে,এমনকি সুখী হওয়ার ব্যাপারেও।কিন্তু শুধু ঢেকে রাখলেই কি ঘা শুকিয়ে যায়!বিশেষত বহু পুরোনো ঘা।তাই হানিমুনে এসেও নেশার মধ্যে সে সঞ্চারীকেই খুঁজেছে।
ভালো লাগছেনা সঞ্জয়ের।মনটা বিষিয়ে গেছে।ঘুম আর আসবেনা।পাশের ডেস্কে থাকা ফোনের স্ক্রিন টা অন করে সময় দেখলো।তিনটে বাজছে।আবার বারান্দায় যাবে কি! হাতের উপর একটা কিছুর চাপ অনুভব করে চমকে উঠল সঞ্জয়।দেখলো রীতি উঠে বসেছে।ওর হাতের উপর হাত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সঞ্জয় কিছু বলতে যাওয়ার আগেই রীতি প্রশ্ন করল,”ঘুমালে না!”
“আমার ঘুম আসছেনা।তুমি উঠলে কেন?”,সঞ্জয় ওর মায়া মায়া মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল।
“আমারও ঘুম আসছেনা।”
“তাও শুয়ে পড়ো।”
“ওই মেয়েটির কথা ভাবছো বলো!”
চমকে উঠল সঞ্জয়,”মেয়েটি! রীতিকে তো সঞ্চারীর সম্বন্ধে একটা কথাও বলেনি সে।”
“হুম ওই যার ছবি তোমার পার্সে আছে।”
“পার্সে!”,সঞ্জয়ের মনে পড়ল তার পার্সে সত্যিই সঞ্চারীর একটা ছবি আছে।সে ছবিটা রেখেই দিয়েছে।
“হুম কিছু মনে করোনা।আমি আজ তোমার জামাকাপড় গোছাতে গিয়েই তোমার পার্সটা চোখে পড়ে।আর তখনি দেখতে পাই।মেয়েটিকে তুমি খুব ভালোবাসোনা!”,রীতি মুখে জোর করে হাসি টেনে আনল।
পালানোর জায়গা নেই।অস্বীকার করার কোনো মানেই হয়না।এর অন্য কোনো ব্যাখ্যাও হয়না।কিন্তু কি করবে সঞ্জয়! হ্যাঁ বলবে! তাহলে তো চরম অপমান করা হয় মেয়েটিকে। অনেক দুঃখ দেওয়াও হয়। স্রেফ না বললে,ও ভাবতে পারে বানিয়ে মিথ্যে বলছি।ঢোক গিলল সঞ্জয়।সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রীতি আবার বলল,”তোমার আপত্তি থাকলে বলতে হবেনা।আমি জোর করবোনা।”
এই মেয়েকে সে কি বলবে! এরকম একটা সহজ সুন্দর মেয়েকে! মিথ্যে বলতে বুকে বাঁধল সঞ্জয়ের।সে বলল,”বাসি কিনা বলতে পারবনা,তবে এককালে ভীষণ ভালোবাসতাম।ছবিটা অনেক আগে রেখেছিলাম পার্সে।খেয়াল ও নেই আর। অভ্যেস মতোই রেখে দিয়েছি।আমি সরিয়ে ফেলবো।”
“সরানোর কি দরকার আছে! থাক না।ভারী সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে।”,রীতি মিষ্টি করে হাসল।
“তোমার খারাপ লাগছেনা!”,সঞ্জয় অবাক হয়ে গেল।
“খারাপ কেন লাগবে! মানুষের কি অতীত থাকতে নেই! মানুষ কি অন্যকাউকে ভালোবাসতে পারেনা!
“কিন্তু তাও নিজের স্বামীর..”, কথা শেষ করতে পারলোনা সঞ্জয়, তাকে থামিয়েই রীতি উত্তর দিল,”তুমি আমার স্বামী হয়েছ কতদিন!তোমার তার আগের স্মৃতি তো অনেক দিনের।যাকে ভালোবাসো তার ছবি রেখেছো এতে খারাপ ভাবার কি আছে!”,তারপর গলার সুর অভিমানী করে রীতি বলল,” হ্যাঁ তবে আমার সাথে আরও কুড়ি বছর থাকার পরেও যদি তুমি ওই ছবি রাখো,তাহলে একটু দুঃখ পাবো।”
সঞ্জয়ের বিস্ময়ের ঘোর কাটেনা,কত সহজে কথা গুলো বলে দিল মেয়েটি।এতটুকু বাধল না।কি করে পারলো! সত্যি ভোরের আলোর মতোই সুন্দর মেয়েটি।সঞ্জয়ের চোখ ভরে এলো।দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো।অনেক অনেক ঘৃণা যন্ত্রণা যেগুলো এতগুলো বছর ধরে জমেছিল তারা এসে ধরা দিল চোখে।রীতিকে ধরে শিশুর মতো কেঁদে উঠল সঞ্জয়,”আমাকে ক্ষমা করে দিও রীতি। আমার সঞ্চারীর উপর রাগ অভিমান থেকেই বিয়ে করা।কারন ও কোনোদিনো আমার হয়নি।এত কিছু করলাম তাও হলনা। আমি তোমাকে এর মধ্যে টানতে চাইনি,বিশ্বাস করো। আমি তোমাকে টানতে চাইনি।”
রীতির চোখদুটোও ভিজে এল।ও একহাতে সঞ্জয়ের মাথা বুকে টেনে ধরে, অন্যহাতে ওর চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,”আমি কিছু মনে করিনি সঞ্জয়।আমি তোমার সাথে আছি।এখন থেকে সারাজীবন থাকবো।তুমি শান্ত হও।”
সঞ্জয় কথা বলতে পারলোনা।দুহাতে রীতিকে শক্ত করে ধরে ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে গেল অঝোরে। প্রকৃতির বুকেও যেমন নিম্নচাপ ঘনীভূত হলে সে বৃষ্টির হাত ধরে শান্ত হয়।আমরা মানুষরাও তার ব্যতিক্রম নই।আমাদের বুকেও ঘনীভূত হয়ে আসা নিম্নচাপ দুচোখের বৃষ্টির হাত ধরেই মুক্তির খোঁজ করে।কিন্তু মানুষ এতই দুর্বল জীব, তার কাঁদার জন্যও একটা কোল চায় কিম্বা একটা কাঁধ।অনেকগুলো বছরের জমানো অভিমানের বরফ, গলতে সময় নিল।সঞ্জয় রীতিকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল।শেষ গ্লানিটুকু ঝরিয়ে দিয়ে সে যখন মুখ তুলল তখন তার মনের আকাশে নিম্নচাপ অনেকটা কেটে গেছে। চোখ মুছে সঞ্জয় বলল,”কিছু মনে করোনা রীতি। অনেকটা ঘেঁটে ছিলাম।তুমি এভাবে টেনে না নিলে হয়ত বুকের ওজন অনেকটা বাড়ত।বেড়েই চলতো দিনের পর দিন।তোমাকে বলে অনেকটা হালকা লাগছে।”
রীতি হাসল,”আমি তো সেইজন্যই তোমার কাছে আছি।যদি তোমার যন্ত্রণাটুকুও বুকে টেনে নিতে না পারলাম,তাহলে নিজেকে তোমার স্ত্রী বলি কি করে!”
সঞ্জয় রীতিকে দেখল।বাইরের ওই মিহি আলোটাই বড্ড তীব্র হয়ে ঘরে ঢুকছে।জানালা খোলা বলেই হয়ত।সেই আলোতেই সঞ্জয় রীতিকে দেখল।অপরূপ সুন্দরী।অসম্ভব স্নিগ্ধ। এই রাতের শুরুতেও এতটা সুন্দর মনে হয়নি।হঠাৎ যেন কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতায় সে আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে।ভয়ংকরতম।
শান্ত হতে সঞ্জয় প্রশ্ন করলো,”আচ্ছা রীতি তুমি কোনোদিনও কাউকে ভালোবাসোনি।”
রীতি সমহিমায় হাসল,”সবার ভালোবাসার অধিকার থাকেনা!”
“মানে?”
“কিছুনা”,রীতি আবার হাসল,”বাবা ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন।মামার বাড়িতে বড়ো হয়েছি।মা রোজগার করলেও,মামা মামীমা খুব একটা পছন্দ করতেন না আমাদের থাকাটা।আমরা পরাধীন ই ছিলাম।আমার কোনো কাজের জন্য যাতে মাকে কোনো কথা শুনতে নাহয়,তাইজন্য খুব সাদামাটা জীবন কাটিয়েছি। কলেজে উঠতেই মায়ের শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। বুঝতে পারলাম,মায়ের পক্ষে বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হবেনা। আর সেই অর্থটুকু মা মামার বাড়িতে না দিতে পারলে আমরা বাড়তি বোঝা ছাড়া আর কিছু হয়ে থাকবোনা।বুঝলাম যেকোনোদিন আমাকে বিয়ে করতে হবে,হয়ত মামা মামীমার পছন্দ করা ছেলেকেই। তাই কোনোদিনও কাউকে ভালোবাসার সাহস পাইনি।ভালোবাসলে প্রচুর কষ্ট পেতে হয়।তুমি আমার থেকে ভালো জানবে।”,কিছুক্ষণ থামল রীতি,তারপর আবার বলতে শুরু করল,”তাও কলেজে পড়তে একজন অনেক চেষ্টা করেছিল,আমাকে ধরে রাখার।ওর নাম আবীর ছিল।আমি জানতাম ও আমাকে ভালোবাসে। অনেকবার বলেওছিল।আমি ফিরিয়ে দিয়েছি,প্রতিবার।হয়ত নিজেরও কষ্ট হয়েছে তাও দিয়েছি।কারন মিথ্যে সম্পর্কের স্বপ্ন দেখিয়ে একটা মানুষকে ঠকানোর মতো মন করে উঠতে পারিনি।আর আমি জানতাম,আমার বিয়ে যখন ঠিক হবে ততদিনের মধ্যে ওর পক্ষে চাকরি পাওয়া সম্ভব হবেনা।তাই আমি অনুভূতি গুলোকে প্রশ্রয়ই দিইনি।ঠিক করেছিলাম যার সাথে বিয়ে হবে তাকেই ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবো।আর কালক্রমে তোমাকে পেয়ে গেলাম।”
রীতি দম নেওয়ার জন্য একটু থামলে সঞ্জয় বলল,”আর যাকে তোমার ভালোবাসার জন্য ঠিক করলে সেই এরকম হল। এরকম অযোগ্য একজন মানুষ। “
রীতি একবার সঞ্জয়ের চোখের উপর চোখ রাখল তারপর বলল,”সেটা সময় বলবে। আমি যখন ঠিক করেছি তোমাকে ভালোবাসবো,তখন আজীবন তোমাকেই ভালোবাসবো।আমি সময়ের উপর বিশ্বাস করি। আর এটাও বিশ্বাস রাখি একদিন তোমাকে ঠিকই নিজের করে নিতে পারবো।”
এরপর কোনোমানুষেরই কিছু বলার থাকেনা।সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে যেমন অন্য আলো জ্বালতে নেই,পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে যেমন উচ্চতার গল্প করতে নেই,তেমনি জীবনের কিছু মানুষের সামনে প্রতিবাদ করতে নেই।চুপ করে থাকতে হয়।সঞ্জয়ও মিষ্টি করে হাসল,রীতির মুখখানা একহাতে ধরে বলল,”তোমার মতো মানুষকে যদি খালি হাতে ফিরিয়ে দিই,তাহলে নিজেকেই কোনোদিন নিজে ক্ষমা করতে পারবোনা।” রীতিও কথা বলল না।হাসল। সেই হাসিতে এত মলিনতা ছিল,সেটা সঞ্জয়ের মনকেও শান্ত করে দিল। দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ নিজের স্ত্রীর মুখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সঞ্জয় একসময় ওর ঠোঁট দুটো এগিয়ে নিয়ে গেল,তারপর রীতিকে আঁকড়ে ধরে ওর ঠোঁটের উপর সেগুলো অর্পণ করে দিল।চোখ বন্ধ হয়ে এলো দুজনের।নিশ্বাসের দ্রুততা নেই।আগের রাতের তাড়াহুড়ো নেই।শান্তভাবে সঞ্জয় আকণ্ঠ পান করলো রীতির ভালোবাসাকে।সঞ্জয় বুঝল ভালোবাসলে তাকে শান্তভাবে লালন করতে হয়।বৃষ্টির মতো।ভালোবাসা দিয়ে।ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নেওয়া যায়না।ভালোবাসা এমন কিছু নয় যেটাকে যুদ্ধ করে জয় করতে হয়।ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে হয় শান্ত মনে।ভালোবাসার মধ্যে মুগ্ধতা না থাকলে সেটা কখনোই পরিপূর্ণতা পায়না।সঞ্চারীকে সে ভালোবাসতো কিনা জানেনা,হয়ত বাসতো,হয়ত বাসতোনা।কিন্তু এই মুহূর্তে সে নির্দ্বিধায় বলতে পারে সে রীতিকে ভালোবাসে।ভালোবাসার জন্য সবসময় বহুযুগ লাগেনা।মুহূর্তের উপলব্ধিতেও একটা মানুষকে ভালোবাসা যায়।খোলা জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকল ঘরে।শান্ত হাওয়ার আরামে দুজন দুজনকে জাপটে ধরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল জানা নেই। ঘুমের মধ্যেই সঞ্জয় ঠিক করে নিল রীতির কথাটা রাখবেনা,কালই পার্স থেকে আগের মানুষের ছবিটা বের করে ফেলে দেবে সে। এবার নতুন একজনের ছবি রাখবে ।”
বাংলা গল্প – আমার হাতটা ধরবি প্লিজ ?