কলমে —-সন্মিতা_দেবনাথ
ছোট্ট রিমি ছটফট করছে , চিৎকার করে কাঁদছে মায়ের কাছে যাবে বলে । হাতে চ্যানেল করা , স্যালাইন চলছে । বুকে অনেকগুলো তার লাগানো , বেডের চারপাশে নানারকম মেশিনের সঙ্গে সেগুলো জড়িত । দুজন নার্স শক্ত করে চেপে ধরে আছে ওর হাত , ডাক্তার পাশে দাঁড়িয়ে ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা ঠিক করছে । উফ কত বড় সিরিঞ্জটা । ওই পুরো ওষুধটা রিমির শরীরে ঢুকিয়ে দেবে ! কাঁচের জানলার পর্দা সরানো । রিমির মা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছে এই দৃশ্য । দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । নিজের মেয়ের এই কষ্ট আর দেখতে পাচ্ছে না । গলাটা বুজে আসছে । বুকের উপর যেন একটা পাথরের ভার , দম বন্ধ হয়ে আসছে । ডাক্তার সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে দিল ওর শরীরে । মাআআআআআআ……আর্ত চিৎকারটা কাঁচ ভেদ করে এসে মায়ের কানে পৌঁছালো । তারপর সঙ্গে সঙ্গেই রিমির ছোট্ট শরীরটা এলিয়ে পড়ল বিছানায় ।
– রিমিইইইইইইইই…….বলে চিৎকার করে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল মানসী ।
– কি হল ? তাপস বলল ।
মানসীর চিৎকারে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে । বেড সুইচ অন করে লাইট জ্বালিয়ে তাকাল ওর দিকে । দেখল ও হাঁপাচ্ছে । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে । চোখের দৃষ্টি সামনে স্থির । বুঝল আবার রিমিকে নিয়ে কোনো একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে । হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা নিয়ে এগিয়ে দিল ওর দিকে । এক ঢোঁক খেয়েই সরিয়ে দিল মানসী ।
– কি হল ? আবার কোনো বাজে স্বপ্ন দেখলে ?
তাপস বলল ।
– রিমি….আমার রিমি…..
ডুকরে কেঁদে উঠল মানসী । তাপস জানে এইরকম পরিস্থিতিতে মানসী ওর কোনো কথা শুনবে না । তাই স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল না । দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল শুধু । মানসীর মাথাটা নিজের বুকের কাছে ধরে রাখল অনেকক্ষণ । মানসী কাঁদতে কাঁদতে এবার থম মেরে গেছে । তাপস ধীরে ধীরে ওকে ধরে শুইয়ে দিল । তারপর লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ল । সারারাত তাপস জেগে রইল । আর মানসীও । এইরকম পরিস্থিতিতে মানসীর আর ঘুম আসেনা , তাপসও জেগে থাকে । শুধু কেউ কোনো কথা বলে না । ওরা অপেক্ষায় থাকে অপরজনের ঘুমানোর ! একবার মানসীর এইরকম একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল । সেই সঙ্গে তাপসেরও । কিন্তু পরে তাপস ঘুমিয়ে পড়ে । (সন্মিতা) হঠাৎ কিসের আওয়াজে ঘুম ভেঙে দেখে মানসী পাশে নেই । শোবার ঘর থেকে উঠে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখে – মানসীর ডান হাতে একটা ছুরি আর বাঁ হাতের কবজি থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে । গভীর রাতে অনেক কষ্টে দৌড় ঝাঁপ করে সেই যাত্রা মানসীকে বাঁচাতে পেরেছিল । সেই রাতের পর থেকে মানসীর ঘুম ভেঙে গেলে তাপস আর ঘুমায় না ।
রিমি – ওদের মেয়ে । বছরখানেক হল মারা গেছে । মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ওর মা – বাবার মায়া কাটিয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে । ডাক্তার বলেছিল জন্ডিস । শেষ পর্যায় । একমাত্র লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করলেই ও বাঁচবে । (সন্মিতা) মানসী আর তাপস একটুও সময় নষ্ট করেনি কিন্তু রিমি সময় দেয়নি । মায়ের কোলেই ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়েছিল । রিমি মারা যাওয়ার পরে প্রথম দিকে দুজনেই খুব ভেঙে পড়েছিল । কোনোদিকে মনোযোগ ছিল না কারোর । প্রথম কয়েকদিন বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের যাতায়াত ছিল , পরে যখন ক্রমশঃ তা কমে এল তখন ওরা আরো একা হয়ে গেল । বাড়িতে শুধু মানসী আর তাপস । যে বাড়িটা দুষ্টু রিমি সারাক্ষণ বকবক করে মাতিয়ে রাখত সেই বাড়ি তখন খাঁ খাঁ করত । রিমির গলার স্বর , হাসির আওয়াজ , বায়নার সুর , কান্না —- কিছুই নেই । কোথাও নেই রিমি । সারা বাড়িতে হু হু করে শুধু হাওয়া বয়ে যেত । রিমিইইইই বলে চিৎকার করে ডাকলেও কেউ আর সাড়া দিত না । মানসী – তাপস কেউই কারোর খেয়াল রাখত না , বেশী কথা বলত না একে অপরের সাথে । মানসী ওর খেলনাগুলোতে হাত বোলাতো । রিমিকে মনে করে পুতুলগুলোকে আদর করত । আলমারী খুলে ওর জামাকাপড় গুলো হাতে নিয়ে গন্ধ শুকতো । কখনো ওগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠত । মাঝে মাঝে চিৎকার করে কেঁদে উঠত , যখন তখন ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যেত । কোথায় যাচ্ছে কিছু বলত না । জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলত । শেষে যখন আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করল , তখন তাপসের সম্বিত ফিরল । সে বুঝল রিমির সাথে মানসীকেও যদি হারাতে হয় তাহলে কি করবে ও ? কি নিয়ে বাঁচবে ? তারপর থেকে তাপস অনেক শক্ত করেছে নিজেকে । নিজেকে বুঝিয়েছে মানসীর জন্যই শক্ত হতে হবে ওকে ।
জানলার কাঁচ ঠেলে ভোরের আলো এসে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে । তাপস একবার উঁকি মেরে দেখল – মানসী ঘুমাচ্ছে । এরপর খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল , যাতে কোনো শব্দ না হয় । বাথরুমের কাজ সেরে সোজা ঢুকে গেল রান্নাঘরে । সকালের চা জলখাবারের ব্যবস্থা করতে লাগল । মানসী এখন অনেকক্ষণ ঘুমাবে । ডিপ্রেশনের ওষুধের সাইড এফেক্ট । মানসীর আচরণগুলো প্রথমদিকে নিতান্তই শোকের বহিঃপ্রকাশ ভেবে তাপস ওতটা গুরুত্ব দেয়নি । কিন্তু দিনে দিনে ওর অস্বাভাবিক আচরণ , শেষে আত্মহত্যার চেষ্টা দেখে তাপসের সম্বিত ফেরে । মনোবিদের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না । মনোবিদের বলা সেদিনের কথাগুলো এখনো ওর কানে বাজে ।
– এই ডিপ্রেশনের একমাত্র কারণ হল রিমির মৃত্যু । তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনারা আর একটা বাচ্চা নিয়ে নিন । একটা ফুটফুটে ছোট বাচ্চাই পারে ওনাকে সুস্থ করতে ।
– ওষুধে কোনো কাজ হবে না ?
– দেখুন , ওষুধে কাজ হবে । কিন্তু শুধু ওষুধ ওনার চিকিৎসা নয় । উনি যদি এখন একটা বাচ্চার সান্নিধ্য পান , তাহলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন এবং ভবিষ্যতটাও সুরক্ষিত থাকবে ।
– ভবিষ্যত সুরক্ষিত থাকবে মানে ?
– মানে উনি ধরুন ওষুধের এফেক্টে অনেকটা ভালো হয়ে উঠলেন । কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে যে আবার এরকম কোনোদিন হবে না , এর গ্যারান্টি চিকিৎসা বিজ্ঞান দিতে পারে না ।
– আসলে আমাদের আর বাচ্চা হবে না । ওর জরায়ু বাদ দিতে হয়েছে একটা সমস্যার জন্য ।
– ওহ্ , তাহলে আপনারা একটা কাজ করুন না , বাচ্চা দত্তক নিন । তবু একটা বাচ্চাকে আপনাদের মাঝে আনুন ।
তাপস অনেকবার বুঝিয়েছে মানসীকে কিন্তু ওর এক গোঁ । নিজের (সন্মিতা) সন্তান ছাড়া অন্য কারো সন্তান দত্তক নেবে না । বিরক্ত হয়ে বলেছিল ,
– অন্য কারো রক্ত আমি দত্তক নেব না ।
– কেন ? কি অসুবিধা ?
– না । মা- বাবা জানিনা কিরকম ছিল ? রক্তের দোষ বলেও একটা কথা হয় , শুনেছ তো ? সেই বাচ্চা বড় হয়ে কেমন হবে কে জানে ?
– বাচ্চা মানুষ হয় ভালো পরিবেশ পেলে । আমরা ওকে সুস্ঠ পরিবেশ দেবো ।
– তুমি কি চাও বল তো ? রিমিকে ভুলে একটা অজানা অচেনা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা ভেবে আদিখ্যেতা করব ?
– রিমিকে কি আমরা ভুলতে পারব মানসী ?
– তাহলে বলছ কিভাবে এই কথা ?
– তোমার সুস্থতার কথা ভেবে বলছি ।
– আমার সুস্থ হওয়ার কোনো দরকার নেই । যে সুস্থতা আমার রিমিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায় – আমার দরকার নেই এমন সুস্থতার ।
– আচ্ছা আমার কথা একবার ভাবো তো ? আমি রিমির এই শূণ্যস্থানটা আর মেনে নিতে পারছি না । এই ঘর দোর এত খাঁ খাঁ করে , দমবন্ধ হয়ে আসে আমারও । সেখানে যদি একটা ছোট্ট বাচ্চা ঘরটাকে ভরিয়ে রাখে….
– তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব এই বলে দিলাম তোমাকে । মরে যাব তবু অন্য কারো বাচ্চা এই ঘরে আনব না । রিমির জায়গায় আর কাউকে বসাতে পারব না ।
রেগে চিৎকার করে কথাগুলো বলেছিল মানসী । এরপর আর তাপস দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি । ও জানত মানসীর মানসিক অবস্থা এমন , ও সত্যিই হয়ত কিছু একটা করে বসবে । মনে মনে স্থির করেছিল ওষুধে কিছুটা কাজ দিলে আবার বোঝানোর চেষ্টা করবে ।
নটা বাজে । সকালের খাবার তৈরি করে তাপস স্নানে গেল । আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবিতা চলে আসবে । সবিতা বছর কুড়ির মেয়ে – সারাদিন মানসীর সাথে থাকে , রান্না করে , ঘরের কাজ গুছিয়ে দেয় আর মানসীকে সঙ্গ দেয় । আসলে তাপস মানসীকে একা ঘরে রেখে অফিসে যেতে ঠিক সাহস পায় না । তাই এই ব্যবস্থা । তাপস বাথরুম থেকে বেড়িয়ে দেখে মানসী উঠে গেছে ।
– ঘুম হল ?
বলে গালে আলতো হাত রাখল ।
মানসী কোনো উত্তর দিল না ।
– তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও । খাবার রেডি আছে । সবিতাও চলে আসবে ।
– শোনো ।
তাপস ঘরে যেতে গিয়েও দাঁড়াল ।
– রিমির মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী তাই না ?
– না । তুমি কেন দায়ী হবে ? ওর অসুখের কোনো লক্ষণই তো আগে ধরা পড়েনি !
– তবু , আমি তো মা । আমারই তো সবার আগে বোঝা উচিত ছিল ওর সুবিধা অসুবিধার কথা ।
– মানসী , ও তো কোনোদিন খাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা করেনি, কিংবা ধর পেটে ব্যথা বা বমি এই জাতীয় কিছুও কোনোদিন হয়নি ওর । ডাক্তার কিন্তু একটা বলেছিল তোমার মনে আছে ? বলেছিল , ওর চোরা জন্ডিস ছিল । যার লক্ষণ সচরাচর আগে দেখা যায় না । একদম শেষে এসেই রোগ ধরা পড়ে ।
মানসী টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা নীচু করে বসে রইল । তাপস বলল ,
– শোনো , আজ অফিস থেকে ফিরে বাইরে ডিনার করব । তুমি রেডি হয়ে থেকো ।
অফিসে দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাপস আর দাঁড়ালো না । সাড়ে নটায় বেরোনোর আগেই দেখল সবিতা এসে গেছে । নিশ্চিন্ত হয়ে বেরোলো ।
তাপস সবসময় চায় মানসী আবার আগের মত হাসুক , কথা বলুক । রিমির শূণ্যস্থান ওর ভিতরেও কান্নার সুর তোলে । রিমির হাসিমাখানো কচি মুখের ছবিটার দিকে তাকালে চোখে জল চলে আসে , বুকটা মুচরে ওঠে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায়। কাউকে কিছু বলতে পারে না ও । মানসীরই এখন ওকে ভীষণ দরকার । ও মানসীকে মনের জোর দেয় । সেখানে নিজে কিভাবে ভেঙ্গে পড়বে ওর সামনে ? মানসী খুব সুন্দর গান গাইত । দরাজ গলা ছিল । (সন্মিতা) কাজ করতে করতে সারাদিন গুনগুন করত । তাপসের খুব ভালো লাগত ওর গলায় গান শুনতে । ও চায় মানসী আবার গানটা শুরু করুক , ওর ভালো লাগবে । কিন্তু ওকে রাজি করাতে পারেনি । কেমন যেন জেদি একগুঁয়ে নিরস পাথরের মত হয়ে গেছে সেদিনকার সেই হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মেয়েটা ! কবে যে আবার সবকিছু আগের মত হবে কে জানে ! আদৌ কোনোদিন কি সত্যিই সব আগের মত হবে ? বুক নিঙড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে তাপসের । অফিসটাইমের রাস্তার যানজট গাড়ির শব্দ , এত ভীড়ের মাঝেও ও নিজেকে বড়ো একা অনুভব করে ।
আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরল অফিস থেকে । তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে কাজে খুব ব্যস্ত ছিল । সারাদিনে মোটে একবার ফোন করতে পেরেছে বাড়িতে । অফিসে লাঞ্চের সময় । তারপর এখন বাজে সন্ধ্যে ছটা । ঘরে ঢুকে দেখে সবিতা আর মানসী চা খাচ্ছে । রিমি মারা যাওয়ার পর থেকে মানসী আর ঠাকুর পুজো দেয় না , সন্ধ্যাবাতি জ্বালে না । ঠাকুরের ওপর থেকে ওর সব বিশ্বাস উঠে গেছে । যে মেয়ের জন্য এত মানত করলো তার একটাও কাজে এল না ! তাই কিসের ঠাকুর ? কিসের ভগবান ? সব মিথ্যে । সব কুসংস্কার । এই ছিল ওর যুক্তি । তাপস চেষ্টা করেও এই যুক্তি ভাঙতে পারেনি । শেষে ভেবেছে , যাক , যা করে ও ভালো থাকে থাকুক । ঘরে ঢুকে বলল ,
– এখনো রেডি হওনি ! তাড়াতাড়ি চলো ।
– আমি যাব না ।
নির্লিপ্ত গলায় বলল মানসী ।
– যাবে না ! কেন ? আমি তাড়াতাড়ি এলাম । চলো ।
– নাহ , আমার ভালো লাগছে না ।
– তুমি চলো ভালো লাগবে । কথা দিচ্ছি ।
– বললাম তো যাব না ।
মানসীর গলায় বিরক্তির সুর ।
তাপস কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর দিকে । ভাবতে লাগল কি বললে ওকে রাজি করানো যাবে । যদিও ও জানে মানসী ঘরেও যেমন বাইরেও ঠিক তেমন হয়েই থাকবে । তবু মনোবিদের কথা অনুযায়ী ওকে মাঝে মধ্যে একরকম জোর করেই বাইরে ঘুরতে নিয়ে বেরোয় । এইভাবে চলতে থাকলে নাকি ওর মনের ভিতরে পরিবর্তন আসবে ! বলল ,
– তুমি যাবে । যেতেই হবে । সবিতা বৌদিকে একটা শাড়ি বের করে দে তো ! দেখি কেমন না যায় ?
– উফফ , বললাম তো যাব না । আমার ভালো লাগছে না ।
কথাগুলো না শোনার ভান করে তাপস বেডরুমে চলে গেল । মানসীও কেমন যেন জেনে গেছিল তাপসের এই ধরণের জেদের কাছে ওকে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে । তাই একরকম অনিচ্ছা সত্ত্বেও ও রেডি হল । এরপর গাড়ি নিয়ে চলে গেল সোজা গঙ্গার পাড়ে বাবু ঘাটে । সেখানে সিঁড়ির শেষ ধাপে গিয়ে পাশাপাশি বসল দুজনে । মানসী স্থির দৃষ্টিতে ওপারের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল । ওর হাতটা আলতো করে নিজের হাতে রেখে তাপস তাকাল ওর মুখের দিকে । গোধুলির মৃদু আলোয় মানসীর চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেমন একটা কষ্ট হল তাপসের । মানসীকে আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক করে তোলার ওর আপ্রাণ প্রচেষ্টাটা যেন একটা অসহায়তার আড়ালে বিদ্রুপ করে যেতে লাগল । নদীর ছোট ছোট ঢেউগুলো পাড়ে এসে ভাঙছিল । তাদের মৃদু ছলাৎ শব্দ সব কোলাহল ভেদ করে মর্মে এসে আঘাত করছিল । ঠিক কি বলতে চাইছিল ওরা , সেটা তাপসের পুরোপুরি বোধগম্য হল না । শুধু মনে হল ঢেউগুলো বার বার ওদের কাছে এসে কি যেন বলতে চাইছে ! হয়ত বলছে আমাকে কাছে টেনে নাও , কোলে তুলে নাও ! বলেই আবার চলে যাচ্ছে । কাছে টেনে নেওয়ার সুযোগটুকু দিচ্ছে না । এ কি হল আজ হঠাৎ তাপসের ? মানসীর সাথে কি ও আজ….না , ওকে শক্ত হতেই হবে । বাইরে বেরোলে ওই বেশী কথা বলে । নানান বিষয়ে মানসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওর মনটাকে অন্যদিকে ঘোরাতে চায় । কিন্তু আজ এমন কেন হচ্ছে ওর ? কেন এত হতাশ লাগছে ? অফিসের অধিক পরিশ্রমের ফল ? নাকি সত্যিই মানসীকে সুস্থ করতে গিয়ে ভিতরে ভিতরে ভাঙতে শুরু করেছে । নাহ , আর নয় ওকে শক্ত হতেই হবে । কিছু একটা বলে এই পরিবেশটাকে হালকা করতেই হবে । এমন সময়ে হঠাৎ শুনতে পেল মানসী গুনগুন স্বরে গান ধরেছে –
” আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে ?
বসন্তের বাতাসটুকুর মত ।
সে যে ছুঁয়ে গেল , নুয়ে গেল রে ।
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত ।
সে চলে গেল বলে গেল না –
সে কোথায় গেল বলে গেল না…..”
মানসীর অন্তর ঠেলে উঠে আসা তীব্র হাহাকার গানের প্রতিটা লাইনের সাথে মিশে যেতে লাগল । চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল । তবুও ও গান থামালো না । তাপস আজ অনেকদিন পরে শুনল ওর গান । (সন্মিতা) অথচ ভালো লাগছিল না ওর , ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল । গোধুলির মৃদু আলো , নদীর স্নিগ্ধ বাতাস , সেই সাথে মানসীর এই গান মুহূর্তটাকে বড়ই বিষন্ন করে তুলেছিল । সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এলেও সে বিষন্নতা কারোর কাটল না । দুজনেই দুজনের বুকে জমিয়ে রাখা বেদনাভার নিয়ে সেখান থেকে উঠে রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গেল । সে খাবারও সেদিন বড় বিস্বাদ মনে হল ওদের । সময়টা হঠাৎ করে কেমন যেন থম মেরে গেল । তাপস সেদিন আর অন্যদিনের মত বেশী হাসিখুশি হতে পারল না , চেষ্টা করেও কিছুতেই সেদিন আর পারল না । এইভাবে চলতে থাকল তাপস আর মানসীর সন্তানবিহীন এক অবসন্ন দাম্পত্য জীবন ।
এইভাবেই একটা একটা করে দিন কাটতে লাগল । দিন গড়িয়ে মাস হল । তাপসের নিরলস প্রচেষ্টার ফল এবার ধীরে ধীরে ফলতে শুরু করেছিল । মানসী অনেকটাই সুস্থ , তবে এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি । এখন ও আগের থেকে যথেষ্ট কথা বলে । তবু হঠাৎ হঠাৎ মনমরা হয়ে পড়ে । তখন আবার আগের মত স্থানুবৎ হয়ে পড়ে । কয়েকদিন এভাবে কাটে , তারপর আবার নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায় । তাপস প্রত্যেক মাসে একবার নিয়মকরে ওকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যায় । মনোবিদের কথামতই ওরা এখন ভোরে একসাথে হাঁটতে বেরোয় , প্রতি সপ্তাহে বাইরে ঘুরতে যায় , সিনেমা দেখে , মাসে একটা ছোটখাট ট্যুরও করে ফেলে । মানসী এখন আর আগের মত ওতটা একগুঁয়েমি করে না । ও তাপসের এই সঙ্গ মেনে নেয় । ওর এই পরিবর্তন দেখে তাপস একদিন সাহস করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল , একটা শেষ চেষ্টা । সেই ব্যাপারে মানসীকে আগে থেকে কিছু জানাল না । একদিন রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে চা জলখাবার খেয়ে মানসীকে তৈরি হয়ে নিতে বলল । এখন মানসীই রান্না করতে পারে । রান্নাঘর থেকে ঘেমে নেয়ে উত্তর দিল ,
– এখুনিই ? কোথায় যাব ?
– চলো না , সারপ্রাইজ !
– আরে বাবা , বলবে তো কোথায় ? একি বিকেল বেলা যে চলো একটু বেরিয়ে আসি । এই গরমে রোদে কোথায় টো টো করব ?
তাপস ঠোঁট টিপে হেসে বলল ,
– ওটাই তো সারপ্রাইজ ! আগে থেকে বলব না চলো । তবে এটুকু বলতে পারি সেখানে গেলে তোমার ভালো লাগবে ।
– ঠিক আছে । চলো দেখি । এই গরমে খাঁ খাঁ রোদে কোথায় গেলে আমার ভালো লাগবে !
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়ল । ওদের গাড়িটা এসি নয় । রাস্তার জ্যামে , রোদের তাপে , গায়ের ঘামে মানসী নাজেহাল হয়ে গেল । অথচ এই পরিস্থিতিতেও তাপসকে আজ বড়ই ফুরফুরে মনে হচ্ছে ! ওকে দেখে মানসী বেশ অবাকই হল । মনে মনে ভাবতে লাগল , এমন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে যে আজ ও এত খুশি ? কাছাকাছি আত্মীয় স্বজন বলতে এক ওর দূর সম্পর্কে মামা । বাকিরা সবাই কলকাতার বাইরে থাকে । সেই মামার বাড়িতে যাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই ওর এত আনন্দ হবে না । আর কলকাতার বাইরে কোথাও গেলে অন্ততঃ একদিনের জামাকাপড় তো গুছিয়ে নিতে হত । সেটাও যখন নিতে বলল না , তখন কোথায় যেতে পারে ! দেখা যাক । মনের ভেতরে কৌতুহল চেপে গাড়িতে বসে রইল । প্রায় তিরিশ মিনিট পরে ওদের গাড়িটা যেখানে ঢুকল , সেখানকার নাম লেখা বোর্ডটা দেখেই মানসী প্রচন্ড রেগে গেল ,
– তুমি এখানে নিয়ে এসেছ আমাকে ? গাড়ি থামাও । ঘুরিয়ে নিয়ে চল বাড়ির দিকে ।
– আহা , তুমি এত রাগ করছ কেন ? আমার এখানে একজনের সাথে একটু দরকার আছে । তাই…..
– কি দরকার ? আমাকে সাথে এনেছ কেন ? আর আমি তোমাকে বলেছি না আমার কি মত । সেটা জেনেও তুমি আমাকে এখানে আনলে কিভাবে ?
– তুমি এখানেই বসে থাকো , প্লীজ । তোমাকে নামতে হবে না । আমি যাব আর আসব । ওকে ?
নিজের মোবাইলটা গাড়িতেই ফেলে রেখে তাপস চলে গেল । ওরা এসেছে আশা অনাথ (সন্মিতা) আশ্রমে । গাড়ির ভিতরে মানসী মুখ ভার করে বসে রইল । বাইরের রোদের তাপ গাড়ির ভিতরে প্রবেশ না করলেও , যেন ওর মাথার ভিতর পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিচ্ছিল । ও বুঝতে পারে না , কিভাবে তাপস রিমির বদলে অন্য কাউকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতে পারে ! কোনো মা বাবা কি পারে ? নিজের অপত্য স্নেহ অন্য কারো সাথে ভাগ করে নিতে ? সেই বাচ্চা দত্তক নেওয়ার পরে যখন তাকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা দিতে পারবে না , তখন তার শিশুমনের উপর দিয়ে কি প্রভাব পড়বে ? এসব কথা কখনো ভেবে দেখেছে তাপস ? তাপসের ওপর রাগে এবার মাথাটা ব্যথা করতে শুরু করে দিল । এমন সময় একটা ফোন এল তাপসের মোবাইলে । অচেনা নম্বর । ধরল না ফোনটা । মাথা গরম আছে , কে না কে ফোন করছে , তাকে হয়ত উল্টোপাল্টা কিছু বলে দেবে । ফোনটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল । একটু পরেই আবার ফোন এল । উফফফ , এবার ধরেই ফেলল ।
– হ্যালো ।
– হ্যালো । একটু মিস্টার বিশ্বাসের সাথে কথা বলতে পারি ?
– না । উনি এখন বাইরে ।
– একটু ডেকে দিন না প্লীজ । আমার ভীষণ আরজেন্ট দরকার আছে ।
– আচ্ছা , আপনি একটু পরে ফোন করুন ।
বলেই ফোনটা রেখে দিল । ওর একটুও ইচ্ছে করছিল না ভিতরে ঢুকে তাপসকে ফোনটা দিতে । ওর বিরক্ত লাগছিল এটা ভেবে , কেন ও ফোনটা গাড়িতে ফেলে চলে গেল । দেখতে দেখতে পাঁচ মিনিট কেটে গেল । এখনও তাপস এল না । আবার ফোনটা এল । উফ , প্রচন্ড রেগে গিয়ে এবার নিজেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা দিল অফিসের দিকে । ফোনটা ছুঁড়ে দিয়ে আসবে তাপসকে । একটা লম্বা বারান্দা পেরিয়ে তবে অফিসঘরের সাইনবোর্ডটা দেখা যাচ্ছে । বারান্দার পাশে পর পর দুটো ঘর । ঘরগুলোর দিকে তাকানোর ইচ্ছাই নেই ওর , যেন একটা ঘৃণ্য জায়গায় এসে পড়েছে । ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আচমকা একরকম হোঁচট খেয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল মানসী । একটা ছোট ফুটবল ওর পায়ের সামনে এসে পড়েছে । আচম্বিতে দাঁড়িয়েই চোখ চলে গেল বলের উৎসের দিকে । দেখল একটা ছোট্ট বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে বলটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে । মানসীর পায়ের কাছে এসে এত বড় একজন মানুষকে দেখে প্রথমটায় সে কিছুটা থতমত খেয়ে গেল । ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে ঘাড় উঁচু করে দেখতে লাগল মানসীকে । তারপর কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে হিইইইইই বলে , সদ্য গজানো দুটো দাঁত বার করে হেসে ফেলল । মানসীর বুকের ভিতরটা কেমন টনটন করে উঠল । রিমির যখন এরকম ছোট্ট ছোট্ট দুটো দাঁত উঠেছিল তখন সারাদিন ওকে হাসানোর চেষ্টা করত মানসী । ওই সদ্য গজানো কচি দাঁতগুলো দেখবে বলে । ওহ্ কি যে মিষ্টি লাগত তখন রিমিকে । (সন্মিতা) দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কত আদর করত । বাচ্চাটা বল খেলতে খেলতে বারান্দার বাইরের দিকে হামাগুড়ি দিতে লাগল । মানসীর চোখ কেমন করে যেন ওর দিকে আটকে গেল । ও চোখ ফেরাতে পারছিল না , কেন তা নিজেও জানে না । বারান্দা থেকে মাটিটা তিনটে সিঁড়ির ধাপ নীচে । বাচ্চাটা হামা টানতে টানতে ওই দিকে চলল । ও বোঝেও না ওর সামনে বিপদ ! (সন্মিতা) সিঁড়ির অনেকটা কাছে চলে যাওয়ার পরে মানসীর হুঁশ ফেরে , বুকটা ধরাস করে ওঠে । বাচ্চাটা তো পড়ে যাবে ! আবার একটা বিপদ হবে ? ওর পা দুটো আপনা আপনিই নিজের জায়গা থেকে সরে গেল । একছুটে এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল বাচ্চাটাকে । বাচ্চাটাও বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে । এতক্ষণে মানসী ওকে ভালোভাবে দেখল । মিষ্টি….খুব মিষ্টি মুখটা । নীচের পাটির দাঁত দুটো সেই মিষ্টত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে । কিছুক্ষণ একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে মানসীর চোখ জলে ভরে উঠেছিল তা ও নিজেও বুঝতে পারেনি , দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার পরে বুঝল । আশ্চর্যের বিষয় বাচ্চাটিও ওর কোলে চুপ করে আছে । বলের কথা ও ভুলেই গেছে । ওর কচি হাতটা নিজের হাতে ধরে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল মানসী । যেন কতদিন পরে বহু কাঙ্খিত ধন নিজের হাতে পেয়েছে । সম্মোহিতের মত ধীর পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল । সেখানে দেখল , আরো অনেক বাচ্চা ছেলে মেয়ে বিভিন্ন বয়সের , কেউ খেলছে , কেউ ছবি আঁকছে , কেউ হয়ত শুয়ে আছে । মানসীর পা আপনা আপনিই ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল । একটা মেয়ের দিকে ওর চোখ আটকে গেল । অনেকটা রিমির বয়সী । জানলার পাশে বসে ওরই সমবয়সী আর একজনের সাথে বসে পুতুল নিয়ে খেলা করছে । মেয়েটা রিমির মত অতটা ফর্সা নয় , তবে মুখের আদল খানিকটা যেন মেলে ! আর একটা ছেলে বছর তিনেক বয়স হবে বোধহয় । আপন মনে একটা খাতায় রঙপেন্সিল নিয়ে হিজিবিজি কাটছে । আরে , রিমিও তো স্কুলে ভর্তির আগে ঠিক এই ভাবেই সব খাতা রঙ করে ভর্তি করত । আর ঘরের দেওয়ালগুলো তো ওর আঁকার খাতা হয়ে উঠেছিল । কত আধো আধো কথা বলত তখন ও ! কষ্ট….শুধু কষ্ট হচ্ছে খুব ওদের দেখে । কেন ? দূরে একটা বছর দশেকের মেয়ে হবে , একমনে একটা বই নিয়ে পড়ছে । ঘরের এত কথাবার্তা ওর কানেই যাচ্ছে না । আহা , রিমিটা বড় হলে ওকেও ঠিক এইভাবেই গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করবে বলে ভেবেছিল মানসী ।
এদের কেউই রিমি নয় । তবু যেন রিমি ! কারোর মা বাবার কোনো পরিচয় নেই । কেউ হয়ত আস্তাকুঁড়ে ন্যাকড়া জড়ানো অবস্থায় পড়েছিল , বা কাউকে হয়ত তার বাবা রাস্তার মাঝে একা ফেলে চলে গিয়েছিল ; অন্য সংসারের টানে ! এদের অনেকের জন্ম কোথায় হয়েছে সেটাও কেউ জানে না ! মানসী আজ নিজের জগত ছেড়ে একটা অন্য জগতে এসে পড়েছে । ও নিজের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ দুঃখ – কষ্টের যে দীপ সর্বক্ষণ জ্বালিয়ে রাখত – সেগুলো এই বাচ্চাগুলোর যন্ত্রণার কাছে এক ফুৎকারে নিভে গেল । আজ যদি মানসী আর তাপস মারা যেত , তাহলে কে দেখত তাদের আদরের রিমিকে ? আত্মীয়রা কি আর সারাজীবন কেউ ওর দ্বায়িত্ব নিত ? বাপের বাড়ির অমতে প্রেম করে বিয়ে করার ফলে এমনিতেই ওই বাড়ির সাথে মানসীর খুব একটা সুসম্পর্ক নেই । কে দেখত তাহলে ওকে ?(সন্মিতা) তখন হয়ত ওরও জায়গা হত এরকমই কোনো অনাথ আশ্রম । উফফফ ভাবতেই বুকটা মুচড়ে উঠল । বাচ্চাগুলো কিভাবে পারে ওদের মা – বাবাকে ভুলে এখানে থাকতে ! মা – বাবা ছাড়া পৃথিবীতে শিশুরা কতটা অসহায় । একটা এত ছোট বাচ্চা , যে হয়ত একবারের জন্যেও মায়ের দুধের স্বাদ পায়নি – তার চেয়েও কি মানসীর কষ্ট বড় ? ক্ষুদ্র দুঃখ যখন বৃহত্তর দুঃখের সামনে এসে পড়ে , তখন সে আপন ক্ষুদ্র আকৃতি সম্পর্কে অবহিত হয় । আজ মানসীরও তাই হল । নিজের জগতের দুঃখটাই ওর কাছে এতদিন বিরাট শুষ্ক মরুভূমির মত ছিল । আজ এক ঘর বাচ্চার ভিতর ছড়িয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু দুঃখগুলো এক বিরাট সমুদ্র হয়ে ওর মনকে সিক্ত করল । ও বুঝতে পারল , এই বিরাট পৃথিবীর দুঃখ কষ্টের কাছে তার দুঃখ কষ্টগুলো একটা ফোঁটার মত সামান্য ! হঠাৎ কাঁধে পরিচিত স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকাল । দেখল তাপস মৃদু হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । এতক্ষণ আড়াল থেকে সবটাই দেখেছে ও । মোবাইলটাও ইচ্ছে করেই ফেলে এসেছিল গাড়িতে , আর ফোনটাও অফিসে বসা লোককে দিয়ে নিজেই করিয়েছিল । আগে একদিন এখানে এসে মানসীর সম্পর্কে সবটাই খুলে বলেছিল তাপস । সব শুনে ওরাও সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল । আজ প্ল্যান করেই মানসীকে ও এখানে নিয়ে এসেছে । তাপস দেখল মানসী চোখ জলে ভেজা ।
– মানসী , তুমি কাঁদছ !
– দেখ তাপস , দেখ এই বাচ্ছাটাকে ।
কোলের শিশুটিকে দেখিয়ে বলল ।
দেখ কেমন দুটো দাঁত উঠেছে ওর । দেখ , আমাদের রিমির মত না ? আর দেখ , ওই যে জানলার পাশে বসে থাকা মেয়েটা । ওকে অনেকটা আমাদের রিমির মত দেখতে না ? আর ওই যে ওই ছেলেটা কেমন রঙ করছে দেখ……
মানসী বলে যেতে লাগল । তাপস দেখল আজ বহুদিন পর ও অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে । (সন্মিতা) বুকের ভিতর একটা স্বস্তি অনুভব করল । এই মানসীকেই তো ও ফিরে পেতে চেয়েছিল এতদিন ! আজ কি সত্যি সত্যিই সে চাওয়া পূর্ণ হল ? একটা বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে তাকাল মানসীর দিকে । দেখল ওর চোখে একটা অদ্ভুত ব্যস্ততা । যেন কত কিছু দেখার আছে , করার আছে । কোলের বাচ্চাটা এতক্ষণ ওর কোলেই ছিল । এবারে বোধ হয় তার একটু হামা দিতে ইচ্ছে করছিল । সে বেঁকে চুরে কোল থেকে নেমে গেল । মানসী আর তাপস এক ঘর বাচ্চার মাঝে দাঁড়িয়ে রইল । তাপস দেখল মানসী খুব মনোযোগ সহকারে ওদের প্রত্যেককে লক্ষ্য করছে । ঠিক এই সুযোগটাই ও কাজে লাগাল । ফিসফিস করে বলল ,
– মানসী , এদের মধ্যে থেকে কাউকে আমরা আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারি না ? তুমি কাকে চাও ? বল ?
মানসী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ,
– কাউকে মানে ! কাকে ? কোনো একজনকে ? কাকে ? এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে ? তাহলে ওই লাল ফ্রক পড়া মেয়েটা কি দোষ করল ? আর ওই যে ছেলেটা শুয়ে আছে ? ইস , ওর মনে হয় শরীর খারাপ…..
– কিন্তু , আমাদের তো সবাইকে নিতে দেবে না । যে কোনো একজনকে নিতে হবে ।
অবাক চোখে মানসী তাকাল , চোখে একরাশ প্রশ্ন । তাপস ঠিক বুঝতে পারল না এমন প্রশ্নমাখা দৃষ্টির কারণ কি । ও নির্বোধের মত তাকিয়ে রইল । তারপর ধীরে ধীরে মানসী বলল ,
– আমি মা হতে চেয়েছিলাম….মা….। মা মানে কি শুধুই নিজের ঔরসজাত সন্তানের মা ? তার বাইরে কি সত্যিই মা হওয়া যায় না ? কৃষ্ণের মা হিসাবে যশোদাকে তাহলে সবাই মনে রাখত কি ? শুধু মা হওয়া নয় , মা হয়ে ওঠাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ।
একটু থেমে বলল ,
ওদের মাকে দরকার , আর আমার সন্তানের । তাহলে ওরা যে কেউ একজন তার মাকে পাবে আর বাকিরা কেন বঞ্চিত হবে ? মা তো একজনই হয় , কিন্তু তার সন্তান তো অনেক হতে পারে ।
তাপস কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল , ওকে বলতে না দিয়েই মানসী বলে উঠল ,
তাপস , আমি ওদের সবার মা হব । ওদের সবার মধ্যে আমি আমার রিমিকে দেখতে পেয়েছি । আমি সবাইকে চাই – সবাইকে । ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে হয়ত আমার রিমির আত্মাও শান্তি পাবে । আমি ওদের সবাইকে চাই , সবাইকে ।
মানসীর মনের ভিতর জমে থাকা পাষানকঠিন কষ্টগুলো তরল হয়ে ওর চোখ দিয়ে ঝরতে শুরু করল । যে গ্রীষ্মের দাবদাহে একটু আগেই ও জ্বলছিল , সেখানে এখন শীতল বারিসঞ্চার ঘটল ।
– কিন্তু মানসী , এখানে একটা নিয়ম আছে….
– জানি তো ! শুধু এখানে কেন ? সব জায়গাতেই এরকম নিয়ম আছে । তাই আমি কাউকে আলাদা করে আমার কাছে নিয়ে যাব না , বরং নিজে এখানে আসব – রোজ । তুমি আমাকে না কোরো না প্লীজ । আজ থেকে আমি ওদের সবার মা । মায়ের দ্বায়িত্বটা ঠিকমত পালন করতে দাও ।
সেই ঘরের যারা একটু বড় , তারা ওদের সব কথাই মন দিয়ে শুনছিল । ওদের জামাকাপড় , বইপত্র কিংবা মাঝে মধ্যে ভালো খাবার দেওয়ার মত এরকম ভালো মানুষ অনেকেই ছিল । তাই ওদের কথাগুলো শুনতে একটু অন্যরকম মনে হলেও ব্যাপারটা অন্যদের মতই সাধারণ মনে হয়েছিল । (সন্মিতা) ওদের এই ভুল ভাঙতে বেশী দেরী হল না । মানসী প্রতিদিন নিয়ম করে সেখানে যেত । রোজ সকালে তাপস অফিসে বেরোনোর সময় ওকে নিয়ে বের হত । মানসী সারাদিন ওখানে থাকত । যারা একটু বড় , তাদের দেখভাল করে স্কুলে পাঠাত । আর যারা তার চেয়েও ছোট তাদের খাওয়ানো , স্নান করানো , খেলা করা , ঘুম পাড়ানো – মায়ের সমস্ত দ্বায়িত্ব নিজে হাতে পালন করত । এখন ওর দৈনন্দিন রুটিন বদলে গেছে – একজন ব্যস্ত মা হিসাবে । ওদের সবার মধ্যেই নিজের হারানো রিমিকে খুঁজে পেয়েছিল । রাত্রে অফিস থেকে ফেরার পথে তাপস ওকে বাড়ি নিয়ে আসত । কোনো কোনোদিন ওরা সবাই মানসীকে রাত্রে থেকে যাওয়ার জন্য বায়না করত , ও থেকে যেত । মায়ের মত নিঃস্বার্থভাবে কারোর কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়ে বাচ্চারাও সর্বস্ব দিয়ে ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল । তাপসও কখনো ওকে বারণ করে নি , কারণ বাচ্চাদের সান্নিধ্য পেয়ে মানসী আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল – সেই প্রাণবন্ত , হাসিখুশী মেয়ে । ওর গলায় আবার সুর ফিরে এসেছিল । এমন মানসীকেই তো ও দেখতে চেয়েছিল । রিমিকে হারানোর পরে এটাই তো ওর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ! তাপসও বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে । এইভাবেই অনেকগুলো সদস্য নিয়ে গড়ে উঠল ওদের এক নতুন পরিবার । হয়তো রিমিও ঠিক এটাই চেয়েছিল ; ওর মা বাবাকে ছেড়ে সকলের অগোচরে বহুদূরে কোথাও থেকে হয়ত এইভাবেই কিছু জীবিত মাতৃহারা বাচ্চাকে তাদের মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল । হয়ত এটাই ছিল রিমির উত্তরজীবনের প্রাপ্তি !