Bangla Golpo – শ্রেষ্ঠ উপহার – Bengali Story

Bongconnection Original Published
11 Min Read
Bangla Golpo - শ্রেষ্ঠ উপহার - Bengali Story
Loading...




চোখটা ছলছল করছে আনন্দির, আনন্দি জানে তার চোখের এই জল খুশির। আকাঙ্খা আজ পুরস্কার নিতে স্টেজে উঠেছে। এ বছর মাধ‍্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সে। আজকের দিনটা বোধ হয় আনন্দির জীবনে সবচেয়ে খুশির দিন। প্রাইজ নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে আসে আকাঙ্খা, সেই ছোট্টবেলার মতোই। আনন্দি দূর থেকে তাকে দেখে আর মনে মনে ভাবে মেয়েটা আমার সেই ছোট্টই রয়ে গেল। সেই ছোট্টবেলার মতোই প্রাইজ নিয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তার অগ্নি আঙ্কেলকে। এবার জড়িয়ে ধরেই বলে, “Thank you uncle. সব তোমার জন‍্যে। তোমার পজেটিভ ভাবনাচিন্তা আর আমার ওপর বিশ্বাসের জন‍্যেই আজ এই জায়গায় আমি।” অগ্নি হেসে বলল,” ঠিক আছে ওদিকে যাও। ওদিকে একজন তো হিংসেতে জ্বলে যাচ্ছে, তুমি আমার এত প্রশংসা করছো দেখে।” তারপর আকাঙ্খার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”যাও এবার মার কাছে যাও। আনন্দি বহুদিন ধরে এই দিনের অপেক্ষায় ছিল। আজ তোমার এই সাফল্যে তোমার মায়ের একটা স্বপ্ন পূরণ হল। আকাঙ্খা মাকে প্রণাম করে খুব আদুরে স্বরে বলে, “তুমি তো ভেবেছিলে আমি পারবোনা। আমি কিন্তু করে দেখালাম।” আনন্দি ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলে,
” আমি জানি মা। জীবনের সব পরীক্ষায় তুমি আমাকে এইভাবেই ভুল প্রমাণ করো, অনেক বড়ো হও মা।” আনন্দির খুশি আজ বাঁধ মানছে না, বাঁধ মানছে না চোখের জলও। আনন্দি পিছন পিছন হাঁটতে থাকে আর  প্রাইজ, সার্টিফিকেট সব  মাকে ধরিয়ে দিয়ে হাজার কথার ঝুড়ি নিয়ে সামনে সামনে তার অগ্নি আঙ্কেলের হাত ধরে হাঁটতে থাকে আকাঙ্খা ছোটোবেলার মতোই। ছোটো থেকেই ওর যত আজগুবি কথা আর বকবকানি শোনানোর জায়গা তো একটাই ওই যে ওর অগ্নি আঙ্কেল। “অশেষ ধৈর্য বটে ওর। হ‍্যাঁ অশেষ ধৈর্য। না হলে কি আর…”ভাবতে ভাবতে রাস্তায় হোঁচট খায় আনন্দি। অগ্নি ছুটে আসে,”উফফফ!!কী এত ভাবছো তুমি। চলো গাড়িতে ওঠো।”

গাড়িতে উঠে পুরোনো সব কথা মনে পড়তে থাকে। অনেক ছোটো থাকতেই আনন্দির মা-বাবা মারা যান। কোনো মতে গ্র‍্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করার পরই কাকুমণি ব‍্যাংকে চাকুরিরত পাত্র পেয়ে যায়। আনন্দি সুন্দরী, খুব সহজেই তাকে পছন্দ হয়ে যায় পাত্রপক্ষের। আনন্দির  কাকা-কাকি নিঃসন্তান হওয়ায় বিয়েটা বেশ ধূমধাম করে হয়।

বিয়ের প্রথম প্রথম সব ঠিকঠাক থাকলেও একমাস পর থেকেই শুরু হয় দাবি দাওয়া, ছোটো-বড়ো বিভিন্ন রকম।  ধীরে ধীরে কাকুমণির কাছে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় তার। আনন্দি কাকুমণিকে বলতে পারে না কিছুই। কারণ আনন্দি ভালোবেসে ফেলেছিল সেই মানুষটাকে আর ভেবেছিল সেও নিশ্চয়ই ভালোবাসবে তাকে, কাকুমণি তাকে বলতেন সবসময় “একসাথে থাকতে থাকতে অচেনা মানুষও কাছে আসে রে পাগলি।” আর তাই সেও ভেবেছিল তেমনই হবে। আসলে কী সবার ভাগ‍্য বোধ হয় সৃষ্টিকর্তা একইসময়ে একইভাবে রচনা করেন না। তাই সবাইকে নিজের জীবনের পথ নিজের মতো করে সাজাতে হয়। তাই মানিয়ে নেওয়ার ব‍্যর্থ চেষ্টা করতে  থাকে সে। কাকুমণিকে কিছু জানতে দেয় না, সে যে তার কাকুমণির প্রাণ সে তবুও চাহিদা মেটাতে টিউশন শুরু করে, কিন্তু যারা লোভী তাদের লালসা মেটানো অত সহজ নয়। আনন্দিও পারে না। শুধু ভেবেছিল ওর নিজের যে মানুষটা সে অন্তত বুঝবে ওকে। কিন্তু শরীরের ক্ষত বাইরে থেকে দেখা যায় মনেরটা ক্ষত মনেই থাকে। সে ক্ষত মনকে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আনন্দি বুঝতে পারে শারীরিক আর মানসিক উভয় দিক থেকেই সে মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। এবার মুক্তির পালা হয় ওই বাড়ি থেকে, নয় এই জীবন থেকে। কিন্তু হার মানতে শেখেনি আনন্দি। কিন্তু এবার কাকুমণির কাছে নয়, নিজের মতো করে সব শুরু করার জন‍্য বেরিয়ে পড়ে সে। সবকিছু ছেড়ে অজানা পথের দিকে।

আনন্দি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে জানলা দিয়ে। ওদিকে অগ্নি আর তিতিরের (আকাঙ্খার ডাক নাম তিতির) খুনশুটি সমানেই চলছে। অগ্নি এক ঝলক তাকায় আনন্দির দিকে, চোখের ইশারায় চোখের জল মুছতে বলে। আনন্দি হাসে আর ভাবে আজও কীভাবে অগ্নি বলার আগেই বুঝে যায় সবকিছু।

আনন্দি যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সুজয়(আনন্দির স্বামী) খোঁজ নেয়নি তার একবারও। শুধু ডিভোর্সের চিঠিটা কীভাবে ঠিকানা জোগাড় করে পাঠিয়ে দেয় সুজয়, তা আজও জানে না আনন্দি। কাকুমণি সব জানতে পেরে অনেকবার নিয়ে যেতে চান কিন্তু আনন্দি আর চায়নি কাকুমণির ভার বাড়াতে। ততদিনে ও একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছে, তাই একাই থাকবে ঠিক করে।


এইভাবেই কেটে যায় আরও একটা বছর। অগোছালো জীবনটাকে একটু একটু করে গোছাতে শুরু করেছে, এরই মধ্যে একদিন এক কলিগের বিয়েতে প্রথম দেখা হয় অগ্নির সাথে। অসম্ভব সুদর্শন না হলেও বেশ সপ্রতিভ। অগ্নির প্রথম দেখাতেই ভালো লাগে আনন্দিকে। কথা বলতে চায়  কিন্তু কথা হয় না, আলাপ হয় বটে। আনন্দির সেই কলিগের থেকে ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করে বসে আনন্দিকে। ইচ্ছে না থাকলেও অগ্নির কথায় এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল যাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি আনন্দি, তার নিঃসঙ্গ জীবনে অন্তত একটা কথা বলার মানুষ তো ছিল, যাকে সে সব বলতে পারত, একটা ভালো বন্ধুর মতো। কিন্তু অগ্নি তাকে বন্ধুর থেকে একটু বেশিই ভেবেছিল। আনন্দির সুন্দর মনটাকে ভালোবেসেছিল সে, যার জন্য আনন্দির পুরোনো জীবন তাকে কোনো দিনই ভাবায়নি। তবে আনন্দি তার প্রস্তাব  বারবারই ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ আনন্দি তার পুরোনো জীবনের ক্ষতগুলোকে ভুলতে পারেনি কোনোদিন। অগ্নিকে অনেক বুঝিয়েছে আনন্দিকে, নিজের মতো করে জীবন শুরু করার জন্য। অগ্নি শুধু একটা কথাই বলে গেছে সবসময়,” আমি জানি তুমি আমাকে তোমার সাথে থাকতে দেবে না, কিন্তু পাশাপাশি চলতে তো পারি। আমি শেষ পর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে চাই।”তারপর ওর সদা হাস‍্যময় ভঙ্গিতে বলে, “একদিন না একদিন ম‍্যাডামের মন গললে না হয়…হা হা হা।” এরপর থেকে আনন্দির অনেক বারণ সত্বেও তার জীবনের প্রতিটি পরীক্ষা আর সিদ্ধান্তে পাশে থেকেছে অগ্নি। এইভাবে এত বছর পার করে কবে যে সেই দিনের সেই সপ্রতিভ  ছেলেটা আজকে ছোট্ট আকাঙ্খার অগ্নি আঙ্কেল হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি আনন্দি।

হঠাৎ তিতিরের ডাকে ঘোর কাটে আনন্দির, “মামমাম এত কী ভাবছ তুমি, বাড়ি পৌঁছে গেলাম তো নামো এবার গাড়ি থেকে। আচ্ছা মাম মাম আজ কী মনে আছে তোমার।” আনন্দি উত্তর দেয়,”হ‍্যাঁ রে মা মনে আছে আজ তো তোর জন্মদিন, আজই তো..।” অগ্নি আনন্দিকে থামিয়ে বলে, “ম‍্যাডামের গিফ্টটা কী চাই শুনি।” তিতির একগাল হেসে বলে,”Just wait and watch.. ঠিক সময়ে চেয়ে নেব বিকেলে।”

দুপুর থেকেই আজ তিতিরের মাকে সাজানোর ইচ্ছে হয়েছে। কবে অগ্নির সাথে গিয়ে আনন্দির জন্য একটা খুব সুন্দর শাড়ি নিয়ে এসেছে। আনন্দিকে তিতির বলে,”আজ আমি তোমায় সাজিয়ে দেব, রোজ যেমন তুমি সাজাও আমায়”। আনন্দি হেসে বলে,”পাগলি মেয়ে আমার, কী ঘুরছে মাথায় শুনি?” “মা তুমি সব বুঝে যাও না?” বলে তিতির। আনন্দি তিতিরকে জড়িয়ে ধরে বলে,”মায়েরা তো সব বোঝে।” সাথে সাথেই বলে তিতির,”তাহলে তো তুমি জানোই মা এবার জন্মদিনে কী চাই আমি।”আনন্দি অবাক হয়ে তাকায়, তারপর বলে,”এই রে এটা তো জানি না মা।” তিতির বলে,”মা আমি বাবাকে চাই।” আনন্দিত অবাক চোখে তাকায়  তিতিরের দিকে। তিতির বলে, ” আমার আসল বাবা নয়। আমি তাকেই বাবা বলে ডাকতে যার থেকে আমি বাবারা ঠিক কেমন হয় জেনেছি। হুমমম। অগ্নি আঙ্কেলকে চাই আমি, বাবা হিসেবে, আর চাই আমি, তুমি আর  বাবা একসাথে,এক বাড়িতে থাকি সবসময়।আর আঙ্কেল নয় বাবা বলে ডাকতে চাই। সেই ছোট্ট থেকে বাকি সব বন্ধুদের বাবার মতোই তো আঙ্কেল সব করেছে। আঙ্কেলের পজিটিভ ভাবনাচিন্তা
 আমাকে শত খারাপের মধ‍্যেও ভালোটাকে খুঁজতে শিখিয়েছে।” আনন্দির চোখ দিয়ে জল পড়ে যায়, চোখের জল মুছতে মুছতে বলে,”সেই আমি তো কিছুই করতে পারিনি তোর জন্য। কী করব বল আমি তো অমনই। ভালো কিছু ভাবতে বড়ো ভয় হয় যে।” “মাম মাম আমি জানি তুমি সেদিন হসপিটালের গার্বেজ থেকে তুমি আমায় তুলে না আনলে আজ আমি এত কথা বলতেই পারতাম না। তোমার একার জীবনে লড়াই কম ছিল না । তারপরেও তুমি আমায় ঘরে এনেছিলে মাম মাম।তোমার ডায়েরিটা আমি পড়েছি। You are the strongest woman I have ever seen mum mum। তাই আমি জানি কেন তুমি ভালোটাকে এত ভয় পাও। এখন আমি বুঝি মাম মাম। আর এটাও বুঝি অগ্নি আঙ্কেল তোমায় ভীষন ভালোবাসে। আমার থেকেও বেশি। সেই মানুষটাকে তুমি কিন্তু অনেক কষ্ট দিয়েছে।আর দিও না। এটাই আমার জন্মদিনের গিফ্ট মাম মাম। আমি তোমাকে মা আর আঙ্কেলকে একসাথে দেখতে চাই,আর আঙ্কেল না বাবা বলতে চাই।”বলেই আনন্দিকে জড়িয়ে ধরে তিতির আর বলে, “আর কখনও কিছু চাইবো না মাম মাম কিন্তু এটা চাইই।” আনন্দি তিতিরের মাথায় হাত রাখে আর আদর করে, আর বলে,”পাগলী আমার।” ওমনি লাফিয়ে উঠে তিতির বলে,”এই যে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।ভিতরে আসুন। আমার মার সম্বন্ধে এত নেগেটিভ চিন্তা। কী বলেছিলে পারবো না? পারলাম তো? দুজনে দুজনকে খুব ভালোবাসো কিন্তু কেউই বোঝো না।এই রে বেল বাজল। দাদুভাই দিদান এসে গেল। দাদুভাইকে বলেছিলাম রেজিস্টারকে আনতে। আর তুমি পাঞ্জাবিটা পরো বাবা। আমি দরজা খুলি।” বলেই একগাল হেসে বলল তিতির,”বাবা ডাকার পারমিশন পেয়ে গেছি। আর একটু ফর্মালিটিস। যাই দাদুভাইকে দরজা খুলে দিই।” আনন্দি অবাক হয়ে বলে,”কাকুমণি এসেছে?” ঘর থেকে বেরোনোর আগে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয় তিতির,”তোমার জীবনের এত বড়ো দিন মাম মাম। দাদুভাই দিদান ছাড়া কি হয়?”

আনন্দির চোখের জল বাঁধ মানছে না আজ। অগ্নিকে বলে,”সব জানতে তুমি?” অগ্নি উত্তর দেয়,”কিছুটা। রেজিষ্টার-এর কথাটা নয়। এটা নিশ্চয়ই ওই পাকাবুড়ি আর কাকুমণির প্ল‍্যান” আনন্দি বলে, “কবে এত বড়ো হয়ে গেল গো আমার মেয়েটা?” অগ্নি উত্তর দেয়,”তোমার নয় আমাদের। আমাদের ছোট্ট মেয়েটা আজ এত বড়ো হয়ে গেল যে ওর জন্মদিনে আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত উপহারটা দিয়ে দিল, সার্থক নামা আমাদের আকাঙ্খা। চলো চলো। না হলে এবার বকা দিতে চলে আসবে। ভুলে যেও না মেয়ে আর সেই ছোট্টটি নেই আমাদের।”

Share This Article