দোল পূর্ণিমা নিশি নির্মল আকাশ,
মৃদুমন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস”…
দোলের দিন ভোর ভোর স্নান সেরে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়া শেষে ঠাকুরঘরে সকল দেবদেবীর পায়ে আবির দিয়ে পুজোআরতি শেষ করেন শ্রীরূপাদেবী।তারপর নাতি সৌরদীপ ওরফে ওনার আদরের দীপের ঘরে যান প্রতিবারের মত এবারও।কিন্তু দীপ নেই বিছানা খালি।অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো উত্তর মেলেনা। ছাদ, বারান্দা কোত্থাও নেই।কোথায় গেল দীপ!তবে কি ওয়াশরুমে আছে ও?শ্রীরূপাদেবীর চোখ যায় সেদিকে।না,ওখানকার দরজাটাও তো বাইরে থেকে বন্ধ।তবে কোথায় গেল ছেলেটা?ভোজবাজির মত উবে গেল নাকি জলজ্যান্ত একটা প্রাণ নাকি ওনাকে না জানিয়ে অভিসারে গেছে দীপ?;একটা অজানা ভয় গ্রাস করে শ্রীরূপাদেবীর মনকে।দীপ তো যথেষ্ঠ বিচক্ষণ ছেলে এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কোথায় চলে যাবে কিছু না বলেকয়ে?আর তাছাড়া ওনাদের ঠাকুমা আর নাতির যা সহজসরল সম্পর্ক তাতে তো অভিসারে গেলেও লুকোচুরির করার মত কিছু নেই।ওই যে কি যেন মেয়েটার নাম হ্যাঁ তিতলি, সংবাদপত্রের অফিসে কাজ করে দীপের সাথেই ওই মেয়েটাই তো ওর বিশেষ বান্ধবী।তিতলির আবার কোনো বিপদ আপদ হয় নি তো তাই ঝট করে বেরিয়ে গেছে?বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক হরিকাকাকেও কিছু বলে যায়নি মনে হয়।তবুও মনকে বোঝানোর জন্য শ্রীরূপাদেবী হরিকে দীপের ব্যাপারে কিছু জানে কিনা জানতে চাইলে ও জানায়,”ভোরে উঠে বাড়ির গেট খুলতে গিয়ে ও দেখে গেট ততক্ষণে খোলা।”
সত্যি মা বাপ মরা ছেলেটাকে নিয়ে কি যে করেন শ্রীরূপা বিশেষ কিছু বলতেও পারেননা যদি অভিমান করে এই ভেবে।কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করেও কোনো খবর পাওয়া যায় না দীপের।ধাতবকণ্ঠ জানায় ফোন পরিষেবা সীমার বাইরে বা বন্ধ।অগত্যা রায়চৌধুরী বাড়ির টানা বারান্দায় এসে বসেন শ্রীরূপা।বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে তখন প্রভাতফেরীর দল বেরিয়েছে। ওদের ছড়ানো আবিরে আর ফাগে রঙিন হয় চারদিক হরি ইতিমধ্যে বার দুই এসে ওনাকে চা দেবার কথা বলেছে কিন্তু ওকে হাতের ইশারায় বারণ করেছেন শ্রীরূপা।দীপকে ছেড়ে আজকের দিনে কিভাবে খাবার মুখে তুলবেন উনি? ওই তো ওনার শেষ বয়সে একমাত্র আশা ভরসা বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।জীবন সমুদ্রের ঢেউ তো অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে শ্রীরূপার থেকে।প্রথমে ওনার স্বামী শেখরবাবু আর তারপর একটা পথ দুর্ঘটনায় ওনার একমাত্র ছেলে আর বৌমাকে। রায়চৌধুরী বংশের একমাত্র পিদিম বলতে ওই নাতি সৌরদীপ।আস্তে আস্তে বেলা বাড়ার সাথে সাথে চারপাশ রঙিন হয়ে উঠলেও শ্রীরূপার অন্তহীন অপেক্ষা যেন শেষ হয় না।চোখ যায় অদূরে বাড়ির বাগানে দিগন্ত আলো করে ফুটে থাকা পলাশ,শিমুল ফুলগাছের দিকে।বসন্তের বাতাসে কেমন সুন্দর মাথা নাড়াচ্ছে ওরা।মনে হচ্ছে যেন একটা চলমান ছায়াছবি দেখছেন উনি।শ্রীরূপার নিজের মনের স্মৃতিপটে বসন্তের বাতাসের মত এবার ভেসে ওঠে কিছু ছবি আবার পরক্ষণে বুদবুদের মত মিলিয়েও যায়।তবে এই বুড়োবয়সে কিশোরীবেলার কথাই মনে পড়ে বেশি।
সেই কাঁটাতারের ওপারে ফেলে আসা দেশটায় আম, কাঁঠাল,হিজলে ঢাকা ভিটেমাটির সোদা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে ওনার। দেশভাগের সময় সব ফেলে চলে এসছিলেন শ্রীরুপারা। কিন্তু আসল মনটাই যে ফেলে এসছিলেন ওখানে।আজও সেই কথা মনে হলে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায় সারা শরীর জুড়ে।সেটাও ছিল এরকম একটা দোলের দিন। দুপুরে পুকুরপাড়ে বসে পেয়ারা মাখা খেতে খেতে আচমকাই প্রতিবেশী তরুণ ফয়জল শ্রীরূপার সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছিল লাল আবিরে।চমকে উঠে কিশোরী শ্রী বলেছিল,”এটা কি করলে তুমি?লাল রং সিঁথিতে পড়া মানে জানো।”
__”ওসব জানিনা।তোকে ভালোলাগে তাই দিলাম পরিয়ে।তোর ভালো না লাগলে মুছে দিতে পারিস। তাছাড়া তোকে আমি ছাড়া কেউ দেখেনি এই অবস্থায় এখন যে কথাটা পাঁচকান হবে!” এই বলে শ্রীরূপার তপ্ত ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল ফয়জল।চরম আবেশে ওর পিঠটা খামচে ধরেছিল সেদিন শ্রী।সেই প্রথম ভালোলাগার রং ধরেছিল হৃদয়ের গহীন জলে।ওরা দুজনেই ভালোমতই জানত সমাজ ওদের সম্পর্ক মানবে না কিন্তু তা সত্ত্বেও লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করা চলত গ্রামের শেষ প্রান্তে পুকুরটার পাড়ে বা ভাঙ্গা মন্দিরের পিছনে পলাশ ফুলগাছের নীচে।দাঙ্গা বাঁধবার পরে যখন ও দেশ ছেড়ে চলে আসার কথা হল সেদিন ওখানে দাঁড়িয়েই ভিজেছিল দুটো হৃদয় ফয়জল আর শ্রী।বিনিময় হয়েছিল দুটো সাদাকালো ছবি আর একটা ডায়েরির পাতা।একে অপরের সম্পর্কে কিছু লেখা ছিল সেখানে।পার্থিব স্মৃতি বলতে ওইটুকুই যা বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্রীরূপা এখনও পর্যন্ত সকলের চোখ এড়িয়ে।কিন্তু এসব কি ভাবছেন উনি পরপুরুষের কথা,এসব ভাবাও তো পাপ। না আরেকবার দীপকে ফোন করে দেখবেন কি?যদি কোনো উত্তর মেলে।
সবে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবেন এমনসময় কানে যায় দীপের বাইকের আওয়াজ। একটু স্বস্তিবোধ করেন শ্রীরূপা।কিন্তু দীপের সাথে ও কে ঢুকলো বাড়ির ভিতর? খুব চেনা রুপোলি চুলের এক বৃদ্ধ।শ্রীরূপাদেবীর বুকের মধ্যে যেন শতেক বীণা ঝঙ্কার তোলে।চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলেও অস্ফুটে ওনার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,”ফয়জল তুমি কি করে এখানে এতগুলো বছর পর?”
দীপ ওর ভ্রু দুটো নাচিয়ে বলে,”কি ঠাম্মী ডার্লিং কেমন সারপ্রাইজ?একদিন ইয়ার্কি করে বলেছিলাম তোমার বয়ফ্রেন্ড এনে দেব আজ সত্যিই সেটা করলাম।”
__”কিন্তু দীপ তুই এসব কি করে করলি?আমি তো তোকে কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলিনি ওর ব্যাপারে।”;শ্রীরূপা বলেন কাঁপাকাঁপা গলায়।
মৃদু হেসে দীপ উত্তর দেয়,”হ্যাঁ তুমি কিছু বলোনি ঠিকই। একদিন আনমনে চিলেকোঠার ঘরে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম টিনের সিন্দুকটা খোলা।তুমি বোধয় সেদিন চাবি দিতে ভুলে গেছিলে কোনো কারণে। কৌতূহলবশে ঘেঁটে দেখতে দেখতে দেখি ফেলি ছবি আর চিরকুটে লেখা ফয়জল নামটা আর তখনই ঠিক করি পুরো প্ল্যানটা।সঙ্গে অবশ্যই ছিল মুস্কিল আসান ফেসবুক, সংবাদমাধ্যমের কিছু সূত্র আর তিতলি।খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পাই ফয়জল দাদুর প্রোফাইল,বর্তমান চট্টগ্রামের ঠিকানা।যোগাযোগ করি তখনই।কপালক্রমে উত্তর মেলে সপ্তাহখানেক পর।কে বলে ফেসবুক সম্পর্কগুলো শুধু ফোন বা ট্যাবের স্ক্রীনে বন্দী থাকে।কিছু এমন সম্পর্ক থাকে যেগুলো দেশ, কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে জীবন সায়াহ্নের বসন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার জন্য। ঠিক যেমন এই দাদু।কখন যে দুজন দুজনের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠলাম দেশ,কাল, সীমানার বয়সের পার্থক্য ছাড়িয়ে।তাই ভাবলাম তোমার কিশোরী বয়সে সেই রংটা আবার নতুন করে ফেরৎ দিই ক্ষতি কি তাতে!”
__”ধুস তাই আবার হয় নাকি? ফয়জলের তো ঘর সংসার আছে নাকি?”শ্রীরূপা বলেন ধীর কণ্ঠে।
অনেককালের নীরবতা ভেঙে ফয়জল এবার বলেন,”তুমি চাইলে নিশ্চয় হয় শ্রী।আর তুমি না চাইলে ফেরত যাব। আসলে কেমন আছ দেখতে খুব ইচ্ছে করলো এতগুলো বছর পর।আমার সংসার বলতে ওই ভাইপো ভাইঝিরা।”
__”সেকি তুমি বিয়ে করোনি ফয়জল?”অবাক হয়ে শ্রীরূপা জিজ্ঞাসা করেন।
চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ ফয়জল বলেন,”তোমার মত কাউকে পেলাম না যে শ্রী।দেশভাগ হবে বলে তুমি এদেশে চলে এসছিলে বটে কিন্তু আমার মনটা তো আর ভাগ হয় নি।” শ্রীরূপাদেবী এবার নাতির দিকে তাকিয়ে বলেন,”তাহলে দীপ কি বলিস তুই? জীবনসায়াহ্নে হলেও বসন্ত আরেকবার এলো তাহলে?”হেসে ওঠেন সকলে। গুমোট ভাবটা কেটে গিয়ে রামধনু রঙের আলো উঁকি দেয় রায়চৌধুরী বাড়ির অন্দরমহলে।ততক্ষণে সৌরদীপের বান্ধবী তিতলিও এসে হাজির হয় আবির আর নকুরের মিষ্টি নিয়ে।জমে ওঠে ওদের ঘরোয়া হোলি পার্টি।
বহুবছর আগের মত একইভাবে ফয়জল শ্রীরূপার সিঁথি রাঙিয়ে দেন লাল আবিরে। শ্রীরূপা বলেন,”আজ পলাশ আর শিমুল ফুলের মত তোমার দেওয়া আবিরের ছোয়ায় জীবনটা আবার রঙিন হয়ে উঠলো।”অদূরে পাড়ার ক্লাবে মাঠে দোল উৎসবের মঞ্চ থেকে ভেসে আসে জনৈক শিল্পীর মিষ্টি কণ্ঠের গান
“ফাগুন,হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান–
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান–
আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ॥