লিখেছেন – অনির্বান
গাড়ি থেকে নেমে শশধর ঘোষ প্রথমে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে আবার দুটো গালি দিয়ে, কোমর কাছটা চেপে অদ্ভুত ত্রিভঙ্গ মুরারি ভঙ্গিতে দাঁড়ালো কোনমতে । মুখে থাকা পান দোক্তার রস পাশের দেওয়ালে ছুড়ে দিয়েই ব্যাথা জরানো গলায় অস্ফুট চিৎকার জেগে উঠলো,
— সুভাষ এই সুভাষ, কোথায় গেলি? মরে গেলি নাকি?
একটা রোগা কালো প্যাকাটির মতো লোক গাড়ির পিছন থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এসে শশধর ঘোষের পাশে দাড়ালো।
— এইতো মেজবাবু, চলে এসেছি। আবার কোমরে লাগল। হাতটা ধরুন।
— আর বলিসনা, এই বোকাচোদা কোমরটা। একটু ধর তো। কে শালা এই গান্ডু যে এখানে এই ফ্ল্যাট বানিয়েছে।
— স্যার অখিল মিত্তির।
— সে কে বে?
— প্রোমোটার স্যার। ঐযে বললেন কে বানিয়েছে ফ্ল্যাটটা।
— আহ । কোমরটা। তা শালা আর জায়গা পাইনি এই বস্তি এরিয়ার মধ্যে এই সরু রাস্তার ধারে একখানা ফ্ল্যাট।
— কি যে বলেন স্যার। আপনি এই এরিয়াতে নতুন তাই জানেন না। খুব বড় প্রোমোটার। পাঁচ বছরের মধ্যে দেখুন এই জায়গা পুরো ভোল পাল্টে দেবে।
— হুম। তা শালা তার আগেই তো নিজের ভোল না পাল্টে যায়। শুরুতেই তো বাড়া মার্ডার হয়ে গেল।
— মার্ডার কি বলেন স্যার!!! আমি তো ভাবলাম সুইসাইড কেস।
— আমি ও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু বডিটাকে দেখার পর ।
জানিসতো প্রথম প্রথম যখন এই পুলিশের চাকরি জয়েন করি তখন, তখন ডেড বডি দেখে খুব ভয় করতো। প্রথম বার যেদিন দেখি সেদিন তো স্টেশনে ফিরে হড়হড় করে বমি করে দিয়েছিলাম। গায়ের ভেতর না শিরশির করতো। কত দিন মাকে কোয়ার্টার তে এনে রেখেছিলাম। এখন হাসি পায় সে সব ভাবলে। তারপর সব সয়ে গেল। কত লাশ দেখলাম জীবনে। মাথা কাটা, পা কাটা, টুকরো করা, পচা গলা লাশ। এখন আর ভয় হয় না। নিজে হাতে কতবার মড়া ঘেটেছি । কিন্তু জানিস এই বডিটাকে দেখে অনেক দিন পর গাটা কেমন কেঁপে উঠল। শিরশিরানীটা ঘাড়ের কাছে ফিরে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য।
— তা ওটা মার্ডার কি দেখে মনে হলো স্যার?
— নারে ওটা মার্ডার। কাঁচ গুলো দেখেছিলি কি ভাবে বডিটাতে ঢুকেছে। ও গুলো প্রিমর্টাম উন্ড ছাড়া কিছুই নয়।
— কি যে বলেন স্যার জানলার কাঁচ কে ভেঙ্গে তাও ভেতরের দিকে ভেঙ্গে মেয়েটার বডিটাতে চারদিকে ঢোকাবে স্যার। তা হয় নাকি! ও সব সিনেমা নাকি?
— জানি না তবে ওগুলো আমি সিওর প্রিমর্টাম উন্ড। তাছাড়া বডিটাতে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। মেয়েটার চোখ দেখেছিলি, কাঁচের টুকরোগুলো যেন কেউ বিধিয়ে দিয়েছে যখন তখনো যেন কিছু দেখে যাচ্ছে, মুখটা… যেন কেউ ওর প্রানটা ওর ভেতর থেকে টেনে বের করে নিয়েছে। যেন মৃত্যুর আগে কেউ ওর সারা শরীরে কাঁচ গুলো আস্তে আস্তে পুঁতেছে তারপর ওকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে ঐ ভাঙা জানলা দিয়ে নীচে। আর তারপর ওর শরীর থেকে ওর আত্মাটা টেনে বের করে নিয়েছে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ঐ হাসিটা। আচ্ছা কেউ মড়ার সময় বিশেষত ঐ ভাবে মড়ার সময় হাসতে পারে! কে জানে?
— স্যার ও স্যার। বলছি আজকাল একটু বেশি সিনেমা দেখছেন না।
— চুপ কর শালা।
— তা বলছি আজ কি বাড়িতে যাচ্ছেন?
— কেন?
— না মানে গাটা শিরশির করছেন বললেন তো তাই। মানে বৌদির পাশে …
— বোকাচোদা গাড় না মারিয়ে ভোলার দোকান থেকে তর্কা রুটিটা নিয়ে আয়। আর বডিটাকে পোষ্ট মর্টেম পাঠিয়েছিস?
— হ্যাঁ।
— অদ্ভুত মৃত্যু।
— নামটাও অদ্ভুত স্যার।
— হ্যাঁ কি যেন? আত..আত্ম..আত্মিকা, আত্মিকা চট্টরাজ ওরফে শিনা।
২.
আজ বেশ ভালো গরম পরেছে বাইরে। তবে শিনার গরম লাগছে না। যদিও শিনা এখন এইসব গরম ঠান্ডা থেকে অনেক দূরে আছে। ওর নার্ভের অসুখটা ওকে কবেই এইসব বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই হুইলচেয়ারে বন্দি করে ফেলেছে। এখন এই ঘরটাই ওর জগত। আর এই ঘরের ভিতরের পরিবেশটা, এই বদ্ধ ঘরটা…
প্রথম প্রথম যখন এই রোগটা ওকে বিছানা বন্দি করে দিয়েছিল তখন খুব কাঁদতো শিনা। পাগল পাগল লাগতো ওর। ওর বন্ধু ওর স্কুল ওর …।
শুধু কি ওই কাঁদতো। কতদিন ঘুম চোখে দেখতো ওর বাবাকে রাতের বেলা অপলকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর তারপর চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে জল। এক ফোঁটা, এক ফোঁটা করে। কত ডাক্তার কত হসপিটালে কত জায়গায় ছুটেছে ওর বাবা ওকে নিয়ে। দেশে বিদেশে। তারপর… তারপর আস্তে আস্তে সব কি রকম ঠিক হয়ে গেল। সবাই ভুলে যেতে লাগলো ওকে । সবাই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেল এই ঘটনায়। ওর বাবাও। সবাই যেন মেনে নিয়েছিল এই নিয়তি। শুধু শিনা ছাড়া। সবাই যেন এড়িয়ে যেতে লাগলো ওকে। ও বাড়ির বাকি আসবাবপত্র মতো একটা কিছু হয়ে পরে থাকলো। ও আর ওর অসহয়তা। ও আর ওর একাকীত্ব। ও আর ওর … । হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া শারীরবৃত্তীয় রক্তে ভিজে যাওয়া বিছানার চাদর মধ্যে বসে থেকে অসহায় কান্না আর ঘেন্নার নরক থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য অব্যাক্ত গোঙানির মাঝে ছিন্ন হওয়া অন্তরাত্মা কখনও বলে উঠেছে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ, মৃত্যুই পরমপ্রাপ্তি ।
এই সব পারার দুনিয়াতে না পারা গুলো ওকে রাগিয়ে তুলতে লাগলো বারবার। সময়ের সরলরেখায় রাগ বারতে লাগলো অসহয়তার হাত ধরে। কথা বলার সাথে কাজ না হওয়া কে ওর মন ধরে নিত অবজ্ঞা বলে। পরে যখন মাথা ঠান্ডা হতো তখন কত করে নিজেকে বুঝিয়েছে শিনা কিন্তু সময় বড্ডো ভয়ঙ্কর। একবার পিছলে চলে গেলে হাতে ধরা দেয় না কখনও। একবার বলে ফেলা কথা স্বাভিমানের জোরে আটকে দেয় ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছাটাকে।
তবে এই কয়েকদিনে অনেকটা বদলে গেছে ও। তার কারণ এই নতুন ফ্ল্যাটটা। কোন এক ডাক্তার কয়েকদিন আগে ওর বাবাকে বলেছিল জায়গা পরিবর্তন করতে। বাবা তাই এই ফ্ল্যাট টা কিনেছিল। প্রথম প্রথম যদিও এই ফ্ল্যাট নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না তবুও এখানে আসার পর বদলে গেছে ওর জীবন। আবার নতুন করে ভালো লাগতে শুরু করেছে নিজেকে। ভালো লাগার এই নিজের নতুন ঘরটাকে বা আরো ভালো করে বলতে এই জানলার ধারটা।
আধুনিক হুইলচেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে গেল শিনা জানলার পাশে। একটু আগে ঘরের লাইটটা নিভিয়ে লাল ছোট আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছে ও।
— অ্যালেক্সা প্লে মাই নিউ ফেবারিট মিউজিক।
একটা নীল আলো এই লালচে কালো এই মায়াবী ঘরের ভেতর তরঙ্গ তুললো একমুহূর্ত জন্য। তারপর যান্ত্রিক এক অলৌকিকতায় এক সুরের মায়া খেলা করে উঠলো ঘরের ভেতর। শিল্পা রাও এর গলা গেয়ে উঠলো…
বাত বাসসে নিকাল চলি হে
দিল কি হালাত সামাল চলি হে
আব জুনুন হাদ সে বার চলা হে
আব তবিয়াত বেহাল চলি হে
ইউহি পেহলু মে ব্যাঠা রাহু
ইউহি পেহলু মে ব্যাঠা রাহু
আজ জানে কি…
আজ জানে কি জিদ না করো…
শিনা আস্তে করে জানলাটার দিকে এগিয়ে গেল। পরদার ফাঁক দিয়েও কখন যেন তীব্র এসি জানলার কাঁচে ঘামের বিন্দু তৈরি করেছে। শিনা হাত দিয়ে আস্তে করে বিন্দু গুলো মুছে দিতেই কাঁচের ভিতর দিয়ে উল্টোদিকে জানলাটা নজরে পড়লো শিনার। সে জানলার ভিতর দিয়ে ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে অস্পষ্ট। সে অস্পষ্টতার ভেতরে এক অনুজ্জ্বল আলোর মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অর্দ্ধ নগ্ন দেহ। গ্রিক মুর্তির মতো সে শরীরে উপর রয়েছে একটা অসাধারণ সুন্দর মুখ। আর সেই মুখের কিছু অংশ ঢেকে আছে হাল্কা কোকড়ানো লম্বা চুলে।
শিনার বুকের ধুকপুক টা বেড়ে উঠছে আবার। সুন্দর সে রূপকথার রাজপুত্রের এই প্রথম নজর পড়েছে তার উপর। সে এগিয়ে এসেছে তার জানলার ধারে। কি অনিন্দ্যসুন্দর তার চোখ। বিষাদ মাখা কিন্তু কি গভীর। সরল কিন্তু ভালোবাসা মাখা। সে উজ্জ্বল চোখের তারা যেন হেসে উঠলো একবার। হাত নেড়ে কিছু বললো সে শিনাকে। আবার হারিয়ে যাচ্ছে শিনা। আবার ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে তার নিজেকে। জানলার পরদাটা দিয়ে হুইলচেয়ারটা সরিয়ে খাটের পাশে এসে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো শিনা।
আজ জানে কি…
আজ জানে কি জিদ না করো…
৩.
আস্তে করে চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে এক মুখ হাসি দিয়ে সামনে তাকালো সাব ইনস্পেক্টর শশধর ঘোষ।
–কোন দোকান ?
— অ্যা! মানে…
— কি চা খান বলুন তো ম্যাডাম মুখে পুরো লেগে থাকে? কি স্বাদ কি গন্ধ।
— আমি জানি না মানে আমি এই সব শপিং করি না।
— কে যায়?
— স্বপন। আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড।
— ডেকে দেওয়া যাবে? মানে জিজ্ঞেস করতাম।
— ও একটু বেড়িয়েছে।
— ও আচ্ছা। আপনাদের ফ্ল্যাট টা কিন্তু দারুন। তা কত করে স্কয়ার ফিট?
— ফ্ল্যাট টা আমার স্বামীর কেনা, আমি জানি না।
— ও, তা আপনার ইন্টেরিয়র ডিজাইন খানা জবরদস্ত। বেশ একটা পুরানো রাজবাড়ীর ফিলিং দেয়। এটা কার প্ল্যান?
— দেখুন অফিসার আমার মেয়ে মারা গেছে , সেই ঘটনা সহ্য করতে না পেরে আমার স্বামী হসপিটালাইজড। আন্ডার ভেন্টিলেশন। আমার এখন কোন মানসিক অবস্থা নেই যে আপনার সাথে এইসব চা বা ফ্ল্যাট নিয়ে গল্প করব। যদি আপনার কথা বলা হয়ে যায় তবে আপনি… আমি একটু রেস্ট নিতে চাই।
— সরি ম্যাডাম।
— ইটস ওকে। আসলে…
— আসলে আপনার মেয়ের মৃত্যু নিয়ে আমি একটু কনফিউজড। তাই হয়তো…
— কনফিউজড!!
— হ্যাঁ মানে ঐ একটুখানি কি আর বলি?
— কি বলতে চান বলুন তো? আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন?
— না মিসেস চট্টরাজ মানে…
— মিস বসু।
— মানে ?
— মানে আমি মিস বসু । আমাদের কয়েকদিন আগে সেপারেশন হয়ে গেছে।
— ও।
— আপনি বলুন কি বলছিলেন?
— না মানে। আসলে মেয়েটা, মানে আপনার মেয়ে জানলার কাঁচ ভাঙলো, সেটা নিজের গায়ে ফোঁটালো তারপর বাইরে লাফ মারলো কিন্তু কেউ জানতে পারলোনা। কোন শব্দ হলোনা। আর সে যখন লাফ দিলোই তবে কাঁচ… খুব অদ্ভুত। আপনার এ ব্যাপারে কি মনে হয় ম্যাডাম?
— জানি না। জানতে চাই না।
— তাই তো! আপনার এই অবস্থা। আচ্ছা ম্যাডাম আপনি এই বাড়ি থাকেন না?
— না। আপাতত আমার বাপের বাড়ি থাকি।
— ও তা সেদিন?
— আমি অফিসের একটা কাজে বেড়িয়েছিলাম।
— তো জানলেন কি ভাবে?
— স্বপনই ফোন করে জানায়।
— কাছে পিঠেই ছিলেন বোধহয় কাজে তাই না ম্যাডাম।
— মানে?
— মানে যখন লোকজন ছুটে আসে স্পটে তখন আপনাকেও কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটে আসতে দেখা গেছে ওখানে। মানে আসে পাশের লোক তাই বলছে। তাই বললাম হয়তো কাছেই কাজ ছিল, হয়তোবা এই ফ্ল্যাটে। মানে ঐ আপনার পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস চৌধুরী বলছিলেন আপনাকে বলে ঘটনার দিন কিছুক্ষণ আগে ফ্ল্যাটে…
— আপনি কি বলতে চান অফিসার ? আমি নিজের মেয়েকে মেরেছি।
— সেটাই তো অস্বাভাবিক লাগছে ম্যাডাম। মেয়েটা আপনার নিজের তো মানে আপনার ঔর…
— হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট।
— আসলে আপনিও যদি সত্যিটা ঠিক করে বলতেন…। আপনি সেদিন কোথায় ছিলেন ম্যাডাম?
— দ্যাটস নন অব ইউর বিজনেস।
— বিজনেস তো বটেই ম্যাডাম। জানতে তো আমায় হবেই। নাহলে … বলে দিন ম্যাডাম। লাভ নেই লুকিয়ে।
— লাভ ক্ষতির হিসেব করে আর কি হবে। ধরে নিন ওটা আমি কখনোই বলতে পারবোনা।
— ফাঁসি কাঠে চরলেও বলবেননা।
— না।
— ঠিক আছে। চলি ম্যাডাম । তবে বলতে আপনাকে হবেই ম্যাডাম। আজ নয়তো কাল।
— গুড ডে অফিসার।
শশধর ঘোষ বেড়িয়ে যেতেই আস্তে করে দরজা বন্ধ করে মিস বসু তারপর ল্যান্ডফোন টা তুলে বোতাম টিপে অপেক্ষা করলেন কিছুক্ষণ। অপর পাশের উপস্থিতি তার মুখে ভাষা ফুটিয়ে তুললো…
— পুলিশ এসেছিল।… না বলিনি।… ভয় নেই আমার জীবন ভেসে গেছে বলে তোমার টা নষ্ট করবো না।… আমি বেঁচে থাকতে কখনো তোমার নাম কেউ জানবেনা। … পরে ফোন করবো, রাখছি।
ফোনটা রেখে আস্তে আস্তে পর্দা গুলো টেনে দিয়ে ঘরটা অন্ধকার করে সোফায় শরীর এলিয়ে দিলো সে। এক ভেঙে পরা কিন্তু উদাত্ত নারী কন্ঠে তখন সেই অন্ধকার ঘর ভরে উঠছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তুমি কবিতায়…
আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে
তোমার দু’চোখে তবু ভীরুতার হিম।
রাত্রিময় আকাশের মিলনান্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করোছো অসীম।
বেদনা মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর
অনুভবে মনে হয় এখনও চিনি না
তুমিই প্রতীক বুঝি এই পৃথিবীর
আবার কখনও ভাবি অপার্থিব কিনা।….
৪.
আজ সকাল থেকে জোর বৃষ্টি নেমেছে চারপাশে। অন্ধকার করে আসা বাইরে থেকে একটানা বৃষ্টির আওয়াজ কোনভাবেই আসার কথা না শিনার এই কাঁচের জানলা দিয়ে ঢাকা বদ্ধ ঘরটাতে। তবু চোখ বন্ধ করলে ও শুনতে পাচ্ছে কোথায় যেন টিপটিপ করে জল পরে চলেছে। শুধু পরছে না একটা জলতরঙ্গের মতো শব্দ উঠে আসছে সেই জলের ফোঁটা থেকে। একটা চেনা সুর যেন ভেসে আসছে তার থেকে। গুনগুন করে একটা গান গেয়ে উঠলো শিনা। একটা মন কেমন করা অলসতার গন্ধ ভেসে আসছে ওর নাকে। চোখ বন্ধ করে হুইলচেয়ারের সিটে নিজের মাথাটা রেখে দিল শিনা।
— অ্যালেক্সা প্লে নেহি সামনে বাই সুখবিন্দর অ্যানড হরিহরণ।
অ্যালেক্সার যান্ত্রিক গলা থেকে এক আদ্রতা মাখা সুর বেড়িয়ে এসে বরফ রাজ্যের বরফ দূর্গের ছোট্ট কারাগারের মতো ঘরটাকে অদ্ভুত রঙিন করে দিলো।
দেখো ছোড়কে কিস রাস্তে ওহ যাতে হে
সারে রাস্তে বাপস মেরে দিলকো আতে হে
নেহি সামনে
নেহি সামনে ইয়ে আলগ বাত হে
নেহি সামনে ইয়ে আলগ বাত হে
মেরে পাস হে তু
মেরে পাস হে তু মেরে পাস হে
মেরে পাস হে তু মেরে পাস হে
মেরে সাথ হে, মেরে সাথ হে…….
চোখ খুলে শিনা নিজের হাত দুটো সামনে ধরলো। কব্জির উল্টোদিকে শিরার উপর দিয়ে একটা কালচে সবুজ রেখা উঠে এসেছে উপরের দিকে। একটা যেন কাঁটা গাছ বেড়ে উঠেছে। তার গায়ে ফল ফুলের মতো কালো হার্ট চিহ্ন রয়েছে। একটা ট্যাটুর মতো। শুধু পার্থক্য এ ট্যাটু নিজের থেকেই হয়েছে আর নিজেই বেড়ে চলেছে। সেদিন উল্টো দিকের জানলায় ওর রাজপুত্র যেন এই চিহ্ন টাই এঁকে দিয়েছিলো। তারপর থেকে এই চিহ্ন টা একটা গাছের মতো বেড়ে চলেছে।
আরেক বার চোখ বন্ধ করলো শিনা। একটা বিদ্যুৎ যেন ঝলসে উঠলো ওর কব্জিতে। গাছটা বড় হয়ে এগিয়ে আসছে ওর বুক লক্ষ্য করে। একটা সুন্দর আঙুল যেন সেই গাছের উপর দিয়ে পরম ভালোবাসায় বুলিয়ে এগিয়ে আসছে আদর করতে করতে ওর শরীরে গোপন ভালোবাসা ভরে দিতে। একটা অস্ফুট শীৎকার বেরিয়ে এলো শিনার গলা দিয়ে। এ অনুভূতি তার প্রথম কিন্তু এ অনুভূতি যেন সর্বশ্রেষ্ঠ।
আবার চোখ খুললো শিনা। এবার এগিয়ে গেলো জানলাটার দিকে । অদ্ভুত এই জানলাটা। পুরানো বাড়ির নকশা কাটা কাঠের ফ্রেমের কাঁচের জানলাটার বাইরে যেন এ এক অন্য দুনিয়া থাকে। এ দুনিয়া এক রূপকথার জগত। তার এই জগতে ঐ জগতটা যে কোন অস্তিত্ব নেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না শিনার। ঐ দুনিয়ায় সে এক গাছপরি আর তার সামনে তার রূপকথার রাজপুত্র। জানলাটার পরদা সরিয়ে সামনে তাকায় শিনা। বৃষ্টির ছাঁটে জানলার কাঁচে অদ্ভুত মায়াবী জগতের সৃষ্টি করেছে। উল্টোদিকের জানলাটায় তাকায় শিনা। না তার রাজপুত্র নেই সেখানে। তার বদলে একটা মেয়ে দাড়িয়ে রয়েছে সেখানে। আবছা কাঁচে মেয়েটার মুখ টা বোঝা যাচ্ছে না। তবু চেনা খুব চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে। কোথায়! খবরের কাগজে। হ্যাঁ। খবরের কাগজেই। দশ বছর আগের কোন ঘটনা। মা মেয়েকে মেরেছে প্রেমিকের সাথে প্ল্যান করে । এরকম কোন ঘটনা। মা ছাড়া পেয়েছে সবে কোন প্রমানের অভাবে। এই নিয়ে টিভি আর কাগজে খুব খবর আসছে কয়েকদিন। মেয়েটা তারদিকে তাকিয়ে আছে এক মনে। কি যেন দেখছে সে। অদ্ভুত চোখটা তার। সম্পূর্ণ কালো। তবে সে আর একা নেই। তার পাশে এসে দাড়িয়েছে একটা বাচ্চা ছেলে। সেও তাকিয়ে শিনার দিকে। তার চোখটাও সেই কালো। তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা বয়স্কা মহিলা। আরো অনেকে একে একে এসে দাড়াচ্ছে তাদের পাশে। এখন জানলা ভর্তি লোক। সবাই শিনার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু শিনা যাকে খুঁজছে সে কোথায়। তার রূপকথার রাজপুত্র। হঠাৎ তাকে দেখতে পেলো শিনা। একটা কালো টক্সিডো পরা। লোক গুলোর মাঝ থেকে এগিয়ে আসছে সে শিনার দিকে। তার চোখে এক অদ্ভুত আকুতি। ভালোবাসার আকুতি। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে জানলার কাঁচ ধরলো রাজকুমার। নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা শিনা। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো নিজের জানলার কাঁচ। যেন ছুঁয়ে নিতে চাইলো নিজের রাজপুত্র কে। আঙুলের ডগায় কাঁচের ঠান্ডা স্পর্শ সাথেই চির ধরলো জানলার কাঁচে। ভেঙে যাচ্ছে যেন দুই জগতের মধ্যেকার বাধা। হুইলচেয়ারের বাধা থেকে আস্তে আস্তে হাওয়ায় ভেসে উঠলো শিনা। ভেঙে যাওয়া কাঁচ গুলো তার গায়ে বিধে যাচ্ছে কিন্তু কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না। বরং একটা অনাবিল সুখ অনুভব করছে ও। দুটো কাঁচের টুকরো এগিয়ে আসছে তার চোখের দিকে। শেষ বারের মতো তাকালো শিনা । উল্টো দিকের জানলাটা এখন খালি। শুধু তার রাজপুত্র দাড়িয়ে সেখানে। আর তার পাশে ফুটে উঠছে তার নিজের অর্থাৎ শিনা আগ্রয়ালের একটা প্রতিবিম্ব। ঠোঁটের কোনে হাসির একটা আভাসের সাথে শিনার দেহ ছিটকে বেড়িয়ে এলো পনেরো তলার ফ্ল্যাটের ভাঙা জানলাটা দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে ঝরে পরতে। ঘরের ভিতরে তখন শিনার গলায় একটা শব্দ ভেসে আসছে।
— অ্যালেক্সা প্লে মাই নিউ ফেবারিট মিউজিক।
হাল্কা সুরে ভাঙা কাঁচ আর বৃষ্টি ভেজা আকাশের গায়ে সুরের ছোঁয়া লেগেছে ।
বাত বাসসে নিকাল চলি হে
দিল কি হালাত সামাল চলি হে
আব জুনুন হাদ সে বার চলা হে
আব তবিয়াত বেহাল চলি হে
ইউহি পেহলু মে ব্যাঠা রাহু
ইউহি পেহলু মে ব্যাঠা রাহু
আজ জানে কি…
আজ জানে কি জিদ না করো…
৫.
টিংটং…টিংটং …
দরজা খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকলো মিস্টার সেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বড় পোষ্ট তাকে সাধারণত এতো সকাল সকাল বাড়ি ফিরবার পারমিশন দেয় না তবু আজকের দিনটা স্পেশাল। ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে দিতে দিতে মিস্টার সেন প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন তাদের সবসময়ের কাজের লোক শিখাদির দিকে…
— বৌদি ফেরে নি?
— ফিরেছেন । বাথরুমে আছেন।
— আমাকে এক কাপ চা দাও।
— দিচ্ছি।
— এইতো তুমি। কতক্ষণ এলে?
মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে আসা মিসেস সেন উত্তর দিলেন…
— মিনিট দশেক। চা কফি কিছু খাবে?
— হ্যাঁ। শিখাদিকে বলে দিয়েছি। তোমার তৈরি হতে কতক্ষণ লাগবে?
— আধ ঘন্টা।
— ও তা বাবলির কি করবে?
— কি করবো মানে ও থাকবে।
— না মানে ওকে নিলে হতোনা।
— ওর কাল এক্সাম আছে।
— ছাড়োতো একদিন গেলে কি হবে!
— কি হবে মানে! ওর ক্লাস থ্রি। এখন থেকেই ও যদি সিরিয়াস না হয়। তাছাড়া এবার ওকে ক্লাসিক্যাল ড্যান্স শিখাবো। তো তাতে একটু সময় নেবেই। তাই পড়াশোনা টা যতটা এগিয়ে রাখবে তত ভালো। তাছাড়া শিখাদি তো আছেই। আমাদের আসতেও দেরি হবে । সকালে ওর ব্যাডমিন্টন ক্লাস ও আছে।
— না মানে নতুন ফ্ল্যাটের আনন্দে ডিনার আর ও থাকবেনা।
— ওর জন্য জোমেটোতে কিছু বুক করে দাও। তাছাড়া ওকে একটু শাস্তি দেওয়া উচিৎ। আজকাল বড্ড মিথ্যা কথা বলছে।
— কেন কি বলেছে?
— আরে বোলোনা কাল বলছে ওর ঘরের উল্টোদিকে জানলায় বলে একটা বাচ্চা ছেলে ওর সাথে ইশারায় কথা বলে।
— সে কি ওর ঘরের উল্টোদিকে তো কোন ফ্ল্যাট নেই।
— তাইতো বলছি মিথ্যা বলতে শিখেছে তোমার মেয়ে।
— হুম
— হুম নয়। কিছু স্টেপ নিতে হবে। ভালো কথা ইন্টেরিয়র ডেকরেটরের টাকাটা দিয়েছো। সেদিন ফোন করেছিল। যাই বলো ওরা কাজটা ভালোই করেছে।
— হ্যাঁ।
— বাবলির ঘরটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে বিশেষত জানলা গুলো। সেদিন শ্রেয়া চাইছিল ওদের নম্বরটা।
— তুমি তৈরি হও। বাবলি কোথায়?
— একটু আগে দেখলাম জানলা দিয়ে বাইরে দেখছে।
— চলো তাহলে বেড়িয়ে পরি।
— চলো। শিখা দি আমরা বেরচ্ছি দরজা বন্ধ করে দাও।
দরজা বন্ধ হতে হতেই ব্যাস্ত মিস্টার সেনের মোবাইল বেজে উঠলো কোন দরকারি ফোনে। অনুপম রায় গেয়ে উঠতে লাগলো ফোনের ভিতর দিয়ে…
আর আমি আমি জানি জানি
চোরাবালি কতখানি গিলেছে আমাদের রোজ
আর আমি আমি জানি জানি
প্রতি রাতে হয়রানি, হারানো শব্দের খোঁজ
আর এভাবেই নরম বালিশে,
তোমার ওই চোখের নালিশে
বেঁচে থাক রাত পরীদের স্নান
ঠোঁটে নিয়ে বেঁচে থাকার গান…
আমাদের অন্যান্য গল্পঃ-
আমারও পরানো যাহা চায়
অঙ্কটা মিলে গেলো