আমাকে কেমন লেগেছে আপনার?
অর্কর দিকে তাকিয়ে একরাশ উৎসুকতা নিয়ে জিজ্ঞেস করল মেহুল। অর্ক কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ৷ মেহুল আবার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল – কোথায় বললেন না তো আমায় কেমন লেগেছে। অর্ক এবারও কোনো উত্তর দিল না। মেহুল এবার অর্ধৈয্য হয়ে উঠল। এটা তার জীবনে একষট্টি তম সম্বন্ধ। যার সাথে তার বৈবাহিক বাধন স্থাপিত হয়েছে। অর্কের সাথে তার পরিচয়টুকুও হয় নি ভালো করে। তার আগেই বিয়ে করে চলে আসতে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি। আর তাই তার অনেক প্রশ্ন জমেছে মনে। প্রতিবারই সম্বন্ধদের মুখে সে না শুনে অভ্যস্ত হয়ে পরেছিল। অনেক সময় পাত্রের বাড়ির লোক তার দিকে তাকিয়ে কটাক্ষের দৃষ্টিতে বলেছে,- কি কুসিৎ রে বাবা। দাঁত আর চোখ ছাড়া কিছুই যে সাদা নেই৷ ঘটকের দিকে তাকিয়ে অনেক পাত্রের মাকেই সে বলতে শুনেছে,- বলছি দাদা আমার ছেলে কি আফ্রিকার মেয়ে ঘরে তুলবে নাকি? ঠোঁট নাক গড়ন দেখতে পান না? নাক না তো যেন বল্টু। আর ঠোঁট? দিনরাত সিগারেট খেলেও এত কালো হয় না। মাগো। কি কদাকার মেয়ে৷ মেহুলের চোখ বেয়ে প্রতিবার নেমে এসেছে কান্না। নিজেকেই নিজে সে জিজ্ঞেস করেছে- কালো হওয়া কি পাপ? প্রতিটা মুহুর্ত কেন এত অবহেলা? উত্তর পায় নি সে। প্রতিটা বার সে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে।আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নতুন দিন শুরু করেছে। আবার সে বসেছে গিয়ে চেম্বারে। রোগী দেখেছে। রোগীরা হাত ধরে তাকে বলেছে,- আপনি মানুষ নয় ভগবান। কিন্তু বিয়ের বাজারে তার গায়ের রঙ ছাড়া পাত্রের বাড়ির লোক আর কিছুই দেখতে পায় নি। তার মানবিক সত্ত্বা হার মেনেছে গায়ের রঙের কাছে। বেস্ট হার্ট সার্জেনের খেতাব পাওয়া সত্ত্বেও সে পাত্রের মায়েদের কাছে লাঞ্ছিতা৷ প্রতিবার তাকে অনুভব করানো হয়েছে সে কালো, সে অচল, তার মূল্য নেই। টিভিতে ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন বিরতি দেখে তার চোখ জলে ভরেছে। সবাই নাম লিখিয়েছে ফর্সা হওয়ার দৌড়ে। তার বান্ধবীরা তাকে নিয়ে ছবি কিংবা তোলার সময় বিউটি প্লাসের মত বিভিন্ন ফোটো এডিটিং অ্যাপ ব্যবহার করে তাকে ফর্সা করার জন্যে। যদিও বা মেহুল পছন্দ করে না এসব একেবারেই। মেহুল যে নিজের গায়ের রঙ নিয়েই সন্তুষ্ট। সেই কারণেই বান্ধবীদের তাকে ফর্সা করার চেষ্টা তার কাছে অপমান স্বরূপ। হয়ত তারা ভাবেও নি তাদের এই মজা তীরের মত বিদ্ধ করেছে মেহুলের হৃদয় সবসময়।এবার তাই আর তার বাবার বন্ধুর ছেলে ডঃ অর্কপ্রভ মুর্খাজী এবং তার পরিবারের সামনে আসতে রাজী হয় নি মেহুল। শেষ অব্দি তার পিসির জোর জবরদস্তিতে পিসির মান রাখতে এসেছিল সে অর্কদের সামনে। তার পছন্দ অপছন্দ জিজ্ঞেস না করেই অর্কের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন মেহুলের বাবা। কিন্তু মেহুলের মনে প্রশ্নের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল৷ অর্কের মত সুদর্শন ছেলে যে কিনা অস্ট্রেলিয়াতে মেডিক্যাল প্রক্টিশনার সে কেন রাজি হবে তার মত এক কদাকার মেয়েকে বিয়ে করতে? অর্কের জন্যে তো মেয়ের অভাব হবে না। তাহলে সে কেন? তাহলে কি অর্কের পরিবার এমন মেয়ে চায় যাকে তারা দমিয়ে রাখতে পারবে পায়ের নিচে যেমনটি তার বেস্টফ্রেন্ড ফাগুনের সাথের হয়েছিল? মেহুলের বেস্টফ্রেন্ড ফাগুনও ফর্সা, সুন্দরী, এবং সেও মেধাবী ডাক্তার। বিয়ে তার হয়েছিল এক এন আর আইয়ের সাথে। তারাও তাকে যত্ন করেই বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু বিয়ের পরেই ফাগুনের সামনে উন্মুক্ত হয়েছিল তার স্বামীর স্বরূপ। বহু নারীতে আসক্ত সে। আর ছেলের স্বভাব বদলাতেই সুন্দরীর সাথে বিয়ে দিয়েছিল তাকে। এক ভোরে খবর আসে স্বামীর পরকীয়ার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয় ফাগুন। অর্কের পরিবারের এতটা ভালো ব্যবহার দেখে তার মনেও ভয় জন্মায়। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে “আমাকেও কি ফাগুনের মত বলি হতে হবে?” প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ফুলশয্যার রাতেই সে অর্কের দিকে ছুড়ে দিয়েছে নিজের প্রশ্নবান। কিন্তু অর্ক উত্তর না দেওয়ায় অর্ধৈয্য হয়ে পরে সে। অর্ক বুঝতে পারে মেহুলের চঞ্চলতার কারণ। মেহুলের হাতে হাত রেখে সে তাই জিজ্ঞেস করে,”তোমার কি মনে হয় মেহুল?” মেহুল একটু উত্তেজিত হয়েই বলে,”কালো মেয়েদের আর কি বা মনে হওয়ার থাকতে পারে? বাড়ির ঝি চাকর হওয়াই কপালে লেখা থাকে আমাদের।” অর্ক তার হাত এবার শক্ত করে ধরে তার দিকে তাকিয়ে বলল,”আমার মাসির মেয়ে ফাগুন কিন্তু ফর্সা ছিল মেহুল। গায়ের রঙটাই সব হলে ওকে কি চলে যেতে হত? আসলে মেহুল ভালোবাসা গায়ের রঙ বোঝে না। ভালোবাসা অন্ধ হয় জানো তো। সে কি আর গায়ের রঙ দেখবে? ” মেহুল আবার উত্তেজিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,”তাহলে আমাকে বিয়ে করার কারণ? ভালোবাসা তো ওই টুকু সময়ে হতে পারে না তাই না?” অর্ক স্মিত হেসে অবিচলভাবে বলল,” ঠিকই বলেছ তুমি এত কম সময়ে ভালোবাসা হয় না। কিন্তু আমি যে তোমায় ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি। আমি তোমায় তখন থেকে ভালোবাসি যখন তুমি রোজ ছুটির পর নিজে টিফিন না খেয়ে টিফিন বাঁচিয়ে রাখতে স্কুলের পাশে শুয়ে থাকা অনাহার ক্লিষ্ট মানুষগুলোর পেট ভরানোর জন্যে, আমি তোমায় তখন থেকেই ভালোবাসি। আমি লক্ষ্য করতাম কিভাবে অন্যের বিপদ আপদে ঝাঁপিয়ে পরতে তুমি, আমাকেও তো একবার বাঁচিয়ে ছিল সাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট থেকে। তুমি ভুলে গিয়েছ। আমি কি করে ভুলি আমার জীবনদাত্রীকে? আমি তোমায় তখনও ভালোবাসি যখন সোশাল মিডিয়া মেতে ওঠে তোমার কাজের বাহবা দিতে। যখন তুমি গ্রামের বস্তির রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষগুলোর বিনে পয়সায় চিকিৎসা করো, আমার ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়। এত সুন্দর মনের কাছে যে আমি রূপকে পাত্তা দিতে শিখি নি। আমি তো ছোটবেলা থেকেই তোমাকে ভালোবেসেছি শুধু তুমিই জানো নি। তোমাকেই যে সারাটা জীবন নিজের করে চেয়েছি। ” অর্কর কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিল মেহুল। তাকেও কেউ ভালোবাসতে সে যে তা কল্পনাও করতে পারে না। সে যে বিভিন্ন সময় একটাই কথা শুনে এসেছে সে কুরূপা। কলেজের ছেলেরা তাকে তার গায়ের রঙ নিয়ে কতই না কটাক্ষ করেছে। কিন্তু কেউ তার স্বপ্ন দেখতে পারে সে ভাবে নি। তবুও যেন কোথাও তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। বিশ্বাস করা ছাড়া যে তার আর কোনো উপায় ছিল না। তাই অর্কের কথাগুলো তার মন স্পর্শ করে গেলেও একটু খটকা লাগছিল তার। এত কম সময়ে এতগুলো না শোনার পরে কিভাবে সে বিশ্বাস করবে? অন্যদিকে ফাগুনের পরিণতি ভাবাচ্ছিল তাকে। অর্ক যতই তার হাত ধরে বলুক তাকে বিশ্বাস করতে। সে পারছিল না। একরকম নিয়ম রক্ষার্থেই কাছে আসে তারা। ধীরে ধীরে বিয়ের বয়স বাড়ে এবং সময়ের বেড়ে চলার সাথে সাথে অর্কর কাজ প্রমাণ করে দিচ্ছিল তার প্রতি অর্কের ভালোবাসা। মেহুলও ভালোবাসতে শুরু করেছে তাই অর্ককে। আজ সে বিশ্বাস করে কেউ তাকে সত্যিই ভালোবাসে। আজ প্রায় তাদের বিয়ের বয়স চারবছর। এক পথ দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছে মেহুল প্রায় তিনবছর । হুইল চেয়ারই সম্বল তার। অর্ক এক মুহুর্তের জন্যেও তার প্রতিবন্ধকতাকে প্রাধান্য দেয় নি। মেহুলকে একই ভাবে ভালোবেসে চলছে সে দিনের পর দিন। চেম্বার থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে তাই মেহুলকে নিয়ে প্রতিদিন ঘুরতে বেরোয় সে। তার জীবন ফাগুনের মত হয় নি। আর তাই আজ আর তার কোনো ভয় নেই। সে আজ শুধু ভয় পায় মরার। অর্ককে ছেড়ে মরতেও চায় না সে। সে যে নিজের পা হারিয়েও ভাগ্যবতী মনে করে অর্ককে তার জীবনে পেয়ে। আর তাই প্রতিদিন বিকেলে গঙ্গার পাড়ে বসে অর্কের হাত ধরে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে গেয়ে ওঠে,
“আমার মত সুখী কে আছে,
আয় সখী আয় আমার কাছে,
সুখী হৃদয়ের সুখের গান
শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।