লিখেছেন – অনন্য দেবরায়
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। নিজের ফোনের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার উইন্ডটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহুল। দয়িতার ছবির পাশে একবিন্দু সবুজ আলোটা জ্বলজ্বল করছে…অথচ রাহুলের পাঠানো একটা টেকস্টও সিন করেনি দয়িতা।প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে পাঠিয়েছিলো রাহুল টেকস্ট গুলো। রাহুলের সামনের সেন্টার টেবিলটায় ওর ল্যাপটটা রাখা,সেটাতেও ফেসবুক অন করা আছে…সেটারও ম্যাসেঞ্জার টাই খোলা আছে,সেটাতেও দয়িতার চ্যাট উইন্ডোটাই খোলা…আর সেখানে একটার পর একটা ম্যাসেজ ঢুকছে দয়িতার…
-“why Don’t you takling to me..?”
-“please do reply”..
-” please talk to me..”..
-“kotha bolo please..otherwise i can’t sleep … Ghum asbe na amar….”
দু মিনিট অন্তর অন্তর একটা করে ম্যাসেজ করছে দয়িতা…অপেক্ষা করছে রিপ্লাই -এর..দয়িতার প্রাণের আকুলিবিকুলটা পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠছে ম্যাসেজগুলোর প্রতিটা ছত্রে।
রাহুল চোখ তুলে গোটা ঘরটা একবার দেখে নেয়…হালকা নীল রাতবাতির স্নিগ্ধ আলয় গোটা ঘরটা মোটামুটি দৃশ্যমান …..অল্প দূরে সুবিশাল বেডটায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে দাভাই,একটা দামী ব্ল্যাঙ্কেট ওর গায়ে জড়ানো… ওর ভারি ভারি শ্বাসের শব্দ জানান দিচ্ছে দাভাই এখন গভীর ঘুমে।
খানিক ইতস্তত করে রাহুল আবার ল্যাপটপটার দিকে তাকায়…দেখে দয়িতা আরো একটা ম্যাসেজ করেছে…
-“তুমি যদি আমার কথার উত্তর না দাও তবে আমি আর বিরক্ত করবো না তোমায়… ভালো থেকো…”
দয়িতার এই অভিমান ভরা ম্যাসেজগুলো দেখলেই বরাবরই বড্ড বিচলিত হয়ে পড়ে রাহুল…যদিও হওয়া উচিত নয়..তা ও..
সুতরাং আর থাকতে না পেরে একপ্রকার মরিয়া হয়েই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় ও। পায়ে পায়ে ঘুমন্ত দাভাইয়ের পাশে গিয়ে হালকা করে একটা খোঁচা মারে ওর কোমরে.. কয়েক সেকেন্ডে পরেই ভেসে আসে ঘুম জড়ানো দাভাইয়ের গলা..
-“কি হলো..?কিছু বলবি..?”…
-“মানে দয়িতা… দয়িতা অনেক ম্যাসেজ করছে তোকে…তুই যদি একটা রিপ্লাই করিস…”
কথাটা শেষ হবার আগেই বিরক্তি সূচক এক আওয়াজ বের হয়ে আসে দাভাইয়ের গলা থেকে..
-” কি রিপ্লাই দেবো মানে..?নো রিপ্লাই..ব্লক হার….আর রাতের বেলা ডাকিস না যেনো…কাল আর্লি মর্নিং শুট আছে… ঘুমাতে দে…”
কথা শেষ করে পাশ ফিরে শোয় দাভাই।রাহুল আবার ল্যাপটপটার কাছে ফিরে দেখে আর একটাও ম্যাসেজ করেনি অভিমানী দয়িতা…তবে ওর ছবির পাশে সবুজ বিন্দুটা কিন্তু এখনো জ্বলন্ত।ল্যাপটপটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে সোফায় বসে রাহুল। টাইপ করতে শুরু করে..কিন্তু কিছুটা লেখার পর কি মনে হতে লেখাটা শেষ না করেই নিজের ফোনটা টেনে নেয়…
নাঃ, দয়িতা এখনো তার পাঠানো ম্যাসেজ গুলো সিন করেনি।তবুও নিজের ফোনের ম্যাসেঞ্জার থেকেই রাহুল দয়িতাকে লেখে..
-” দাভাই ঘুমিয়ে পড়েছে তাই তোমায় রিপ্লাই দিতে পারছে না.তবে ঘুমানোর আগে তোমায় বলে দিতে বলেছিল যে, ও কাল সকালে তোমায় ফোন করে নেবে..আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই তোমায় জানাতে দেরি হয়ে গেলো..sorry “…
কিছুটা মিথ্যাই বলে রাহুল।কারণ দাভাই ফোন করার কোনো কথাই বলেনি রাহুলকে..তবুও দয়িতাকে হতাশ করতে ইচ্ছে করেনা রাহুলের… টেকস্টটা পাঠানোর কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই সিন করে দয়িতা..পরক্ষণেই রিপ্লাই…
-” আমায় এটা আগে জানালেই পারতে রাহুল..কাল আমার কলেজ আছে..বেকার এতো রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম..any ways thanks for informing … “
জবাবে দয়িতাকে আরও কিছু লিখতে যাচ্ছিলো রাহুল কিন্তু তার আগেই ঝুপ করে সবুজ বিন্দুটা নিভে গেলো দয়িতার নামের পাশে…
রাগে অপমানে মাথাটা দপদপ করে ওঠে রাহুলের।নিজকে অনেকটা হাইফেনের মত মনে হয় তার। দয়িতা,আর দাভাইয়ের মাঝে একটা ছোট্ট হাইফেন… যার তেমন কোনো গুরুত্ব নেই,আলাদা অস্তিত্ব নেই,যেটার থাকা না থাকা প্রায় সমান…
অসহ্য অপমানের জ্বালায় গা’টা যেন জ্বলছে রাহুলের।চুপচাপ উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় ও।দক্ষিণ কোলকাতার পশ এলাকার এক অভিজাত বহুতলের সাত তলায় দাভাইয়ের বিলাসবহুল এই ফ্ল্যাটটা। বাইরে দাঁড়াতেই ঠান্ডা বাতাস এসে কামড় দেয় রাহুলের মুখের প্রতিটি পেশিতে।ফ্রেবরারির প্রথম দিক এখন…এই বছরের মত চলে যাওয়ার আগে শীত তার মরণ কামড়টা দিয়ে যাচ্ছে…মুখে ঠান্ডা মেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রাহুল…রাতের আকশে ঝকঝক করছে বেশ কিছু তারা..তিনটে তারার দিকে চোখ আটকায় রাহুলের…অনেকটা ত্রিভুজ আকৃতিতে মিটমিট করছে তিনটে তারা..দুটো খুব কাছাকাছি আর একটা খানিক দূরে.. দয়িতা আর দাভাইয়ের রিলেশনে রাহুলের অবস্থানও অনেকটা ওই দূরর তারাটার মত…
★★★★★★★★★
রাহুল মিত্র….কোলকাতার এক নামকরা শিল্পপতির ছোটো ছেলে…বড় ছেলের নাম সোমক মিত্র…রাহুলের নামটা সেরকম কেউ না জানলেও সোমকের নামটা বর্তমানে বাংলার ঘরে ঘরে পোঁছে গেছে.. সে এক নামকরা টেলিভিশন চ্যানেলের বহুলপ্রচরিত এক সিরিয়ালের বর্তমান হিরো…বাংলার ঘরে ঘরে সোমকের চর্চা এখন.. সপ্তাহের সাতদিন সন্ধ্যেবেলা সে হানা দেয় বাংলার ঘরে ঘরে..মোটামুটি হাই টি.আর.পি সোমকের সিরিয়ালটার..মাত্র দুটো বছরেই বেশ নাম যশ করে ফেলেছে সোমক।
রাহুল সোমকের থেকে বছর তিনেকের ছোটো..দেখতে শুনতে সে সোমকের থেকে অনেক বেশি সুন্দর.. সেও আজকাল মডেলিং করে বেশ নামডাক করেছে… তবে দাদার ফেমের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে রাহুল..
বরাবরই কিন্তু দাদার ছত্রছায়ায় থাকতে ভালোবাসে রাহুল..নিজের কাজের সময় টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময় দাদার ছায়া সঙ্গী সে…দাদার সাথে থাকলে বেশ পরিচিতি বারে..ভি আই পি ট্রিটমেন্ট পাওয় যায়…যখন ওরা কোনো ফাংশন বা পার্টি বা যে কোনো গ্যাদারিং-এ যায়… সেখানে যে রয়্যাল খাতিরযত্নটা পায় রাহুল দাদার দৌলতে.. সেটাকে খুব এনজয় করে ও…
দাদার সাথে শুটিং ফ্লোরে প্রায় বেশি সময়েই থাকে ও…দাদার স্টেডি গার্লফ্রেন্ড উপলা.. সেও এক উটতি মডেল..মোটামুটি নামডাক।উপলা প্রায়ই সোমকের ফ্ল্যাটে এসে থাকে..আর যে যে দিন গুলোতে উপলা আসে না,সেই সব রাত গুলোতে রাহুল থাকে সোমকের ফ্ল্যাটে।
সোমকের সাথে রাতে থাকার এক আলাদা আগ্রহ আছে রাহুলের..সোমকের ফেসবুকে একটা নিজস্ব পেজ আছে…সেখানে হাজার হাজার ফ্যান ফলোয়িং দাদার..ম্যাক্সিমামই মেয়ে..প্রায় সবকটাই দাদার প্রেমে গদগদ.. সোমক নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী এক একদিন একএকটা মেয়ের সাথে চ্যাট করে..দিন দুই পর বোর হয়ে গেলে অন্য মেয়ে খুঁজে নেয় দাদা..কিন্তু আগের মেয়েটি ততদিনে টি.ভি স্টারের প্রেমে পাগল… তার তরফ থেকে ম্যাসেজ বন্যার ন্যায়ে আসতে থাকে দাদার ইনবক্সে..কিন্তু দাদা সেগুলো খুলেও দেখে না…আর তখন ফিল্ডে আসে রাহুল..দাদার একাউন্ট থেকে তাদের সাথে প্রেমপ্রেম খেলাটা কন্টিনিউ করে রাহুল.. মেয়ে গুলোর আবেগ ভরা ম্যাসেজগুলোয় বেশ স্পেশাল ফিল হয় রাহুলের।রাহুলের অল্প ইগনোরেন্সে কি ভীষণ আকুলিবিকুলি মেয়েগুলোর…বেশ এনজয়েবেল ব্যপার একটা।কিন্তু এইসব মজা মশকরার মাঝে রাহুল ভুলে গেছিলো ওর নিজের অস্তিত্বটা , সোমকের হেভিওয়েট ব্যক্তিত্বের আড়ালে রাহুল আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল।
★★★★★★★★★
মাস ছয়েক আগে মধ্য কলকাতার এক কলেজের ফাউন্ডেশন ডে’র ফাংশনে প্রথম বার দয়িতাকে দেখেছিল রাহুল।দাভাই ওই ফাংশানে ইনভাইটেড ছিলো,যথারীতি ফাউ হিসাবে বেশ করে মাঞ্জা দিয়ে রাহুলও পৌঁছে গেছিলো দাভাইয়ের ছত্রধর হিসাবে।সেদিন শয়ে শয়ে স্টুডেন্টসদের মাঝে আলাদা করে রাহুলের চোখ টেনেছিল দয়িতা।একটা হলুদ ফুলহাতা সালোয়ারে অল্প পৃথুলা চশমিশ দয়িতা ছিলো সবার থেকে অন্যরকম।
সেইদিন প্রথম দাভাইয়ের গাদাগুচ্ছের ফ্যানদের ছেড়ে দয়িতার দিকে মন দিয়েছিল রাহুল।অল্প লক্ষ্য করতে রাহুল বুঝেছিল দয়িতা স্টুডেন্ট না, দয়িতা বেশ অনেকটাই বড়ো স্টুডেন্টগুলোর থেকে।
নিজেই যেচে দয়িতার সাথে আলাপ করেছিল রাহুল।উপর উপর দয়িতা দেখতে গম্ভীর হলেও বেশ সাবলীল ভাবেই রাহুলের সাথে কথা বলেছিল সে।তবে কোনো বারতি উচ্ছ্বাস ছিলো না ওর বডি ল্যাংগুয়েজে।সোমকের ভাই যেচে এসে কথা বলছে…অন্য মেয়েদের কাছে আহ্লাদে গলে যাবার জন্য এটাই যথেষ্ট কিন্তু দয়িতা ছিলো সেদিন বেশ নিস্পৃহ। কথায় কথায় রাহুল সেদিন জেনেছিল দয়িতা স্টুডেন্ট না,লেকচারার।
দয়িতার মধ্যে মনে হয় সত্যিই কিছু অন্যরকম ছিল.. তাই সেইদিন সোমকও নিজের ফ্যানদের সরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল রাহুল আর দয়িতার কাছে,নিজে যেচে আলাপ করেছিল দয়িতার সাথে…সোমকের সাথে কথা বলার সময়েও দয়িতা তেমন কোনো আলাদা আগ্রহ দেখায়নি।
অথচ এই দয়িতাকে নিয়ে আশ্চর্য রকমের আগ্রহ দেখিয়েছলো সোমক।সেদিন রাতে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেই রাহুল কে হুকুম করেছিল…
-“ফেসবুকে দেখ তো…দয়িতাকে পাশ কি না…”
সেই রাতে প্রথম বারের মতো বুকের বাঁ পাশটা ভারভার লেগেছিল রাহুলের। বিশেষ বেগ পেতে হয়নি ফেসবুকে দয়িতাকে খুঁজতে,হয়তো ওর নামটা আনকমন বলেই একচান্সেই পেয়ে গেছিলো।দাভাইয়ের হুকুম অনুযায়ী ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠিয়ে দিয়েছিল।
সেই রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না রাহুলের। এক অজানা অস্বস্তিতে ছটফট করেছিল গোটা রাতটা।তারপর কি মনে হতে ভোর রাতের দিকে নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে দয়িতাকে একটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ছিলো
পরের দিন দুইজনের রিকোয়েস্টই এক্সেপ্ট করেছিল দয়িতা।অবাক হয়ে দেখতো রাহুল এই দয়িতার সাথে কি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে চ্যাট করতো দাভাই।প্রথম দিকে দয়িতা বিশেষ উত্তর দিতো না,তবে মেয়ে দের মন জয় করার ক্ষেত্রে দাভাইয়ের এক বিশেষ ট্যালেন্ট আছে।তাই মাস দুয়েকের চেষ্টায় শেষমেশ দয়িতার মন জয় করেই নিয়েছিল দাভাই।
সব ব্যপারটা পুতুলের মতো বসে বসে দেখত রাহুল…এই প্রথম বার দাভাইয়ের ছত্রছায়াটা অসহ্য লাগতে শুরু করেছিল রাহুলের।রাহুলও মাঝেমধ্যে দয়িতাকে ম্যাসেজ করত.. তবে বেশির ভাগ ম্যাসেজেরই উত্তর দিতো না দয়িতা।
দয়িতাকে দাভাই একটু বেশিই পাত্তা দিতো,দয়িতাই সেই মেয়ে যাকে দাভাই পার্সোনাল কন্ট্যাক্ট নাম্বার দিয়েছিলো,নিজের হোয়াটসঅ্যাপে এড করেছিলো..তবে ব্যাপারটা ভালোবাসা ছিলো না… কারণ ততদিনে রাহুলদের বাড়িতে সোমক আর উপলার এনগেজমেন্টের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
একরাতে থাকতে না পেরে শেষমেশ রাহুল জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল…
-” দাভাই তুই তো দয়িতাকে ভালো বাসিস না..তবে ওর ইমোশান নিয়ে এই ভাবে মজা করছিস কেন? দয়িতা ভালো মেয়ে..অনেক অন্যরকম…”
রাহুলকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে হেসে উঠেছিল দাভাই… তারপর বিয়ার ক্যানে আরামের চুমুক দিয়ে বলেছিল..
-“হুম দয়িতা সত্যিই অন্যরকম, লুক এট হার,..কি এট্রাকটিভ বডি ওর.. অল্প হেভি ফিগার..উফফ আই লাভ দ্যাট..এখনকার সব মডেল গুলো ইনক্লুডিং উপলা ডায়েট করে করে সব শুকিয়ে কাঠ..বাট দয়িতা তেমনটা নয়..আই নিড হার..”
শেষের দিকে দাভাইয়ের গলাটা জড়িয়ে এসেছিল।এর আগেও বহু মেয়েকে নিয়ে দাভাই এমন কথা রাহুলের সামনে বলেছে..তবে সেই প্রথমবার দাভাইকে ঘেন্না হয়েছিলো রাহুলের । ইচ্ছে হয়েছিল চিৎকার করে দাভাইকে বলে…
-“দয়িতাকে তাদের সাথে গুলিয়ে ফেলিস না দাভাই,যাদের নিয়ে তুই ফূর্তি করিস..”..
নাঃ পারেনি রাহুল,কিচ্ছু বলতে পারেনি..হেভিওয়েট পার্সোনালিটির দাভাইয়ের সামনে বধির হয়ে গেছিলো রাহুলের পরজীবি ব্যক্তিত্ব।জড়ভরতের মতো বসে বসে রাহুল দেখেছিল বিয়ারের ঘোরে ঘুমিয়ে পড়া দাভাইয়ের ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে দয়িতার পাঠানো লাস্ট টেকস্ট.টা..
-“I love you Somak..”…
দয়িতাই সেই মেয়ে যার সাথে দাভাই পার্সোনালি মিট করেছিলো একদিন কোলকাতার এক নামজাদা কফিশপে। দাভাইকে ফলো করে সেখানে পৌঁছে গেছিলো রাহুল।কফিশপের ঘষা কাচের দেওয়ালের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে দয়িতা আর দাভাইয়ের উপর নজর রাখতে রাখতে সেই দিন প্রথম বার উপলব্ধি করেছিল রাহুল…
ভালোবেসে ফেলেছে সে…দয়িতাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে।
★★★★★★★★★★
তবে মাস চারেক পরেই দয়িতা দয়িতা খেলাটায় বোর হয়ে গেছিলো সোমক।এক রাতে নিজের ল্যাপটপটা অবজ্ঞা ভরে ঠেলে দিয়ে সোমক বলেছিল…
-“ধ্যাত… এই দয়িতাটা কোনো কম্মের না।আমি ভেবেছিলাম দেখতে শুনতে ভালো,হাইলি কোয়ালিফায়েড..ভালো জব করে..নিশ্চয়ই মডার্ন গার্ল হবে। কিন্তু অল বোগাস..ও সেই রবীন্দ্রনাথের প্রেমে বিশ্বসী… জাস্ট ডিসগাস্টিং…”..
বিরক্তি ঝরে পড়েছিলো দাভাইয়ের স্বরে।তারপর রাহুলের উদ্দেশ্যে বলেছিল…
-“তোর ইচ্ছে হলে চালিয়ে যেতে পারিস।তোর তো আবার প্রাক্টিক্যালের থেকে থিওরিটিক্যাল প্রেম বেশি পছন্দ. “..
দাভাইয়ের বোর হয়ে যাওয়া গার্লফ্রেন্ডদের সাথে প্রেম প্রেম খেলাটা কন্টিনিউ করাটা যে রাহুলের বেস্ট হবি,সেটা সোমক জানত…তাই দয়িতাকেও অক্লেশে রাহুলকে দিয়ে দেয় সোমক, যেন দয়িতা একটা খেলনা….
সেই শুরু হয়েছিল রাহুল আর দয়িতার অলিক প্রেম কাহিনী…রাত রাত জেগে চ্যাটিং..রাহুলের মনে যে এতো ইমোশন লুকিয়ে আছে,তা ও নিজও জানত না…নিজের সবটা উজার করে ভালো বেসেছে রাহুল…শুধু অপরাধ একটাই ও ভালোবেসেছিল সোমকের ছায়ার আড়াল থেকে।
দয়িতাও যে এতো টকেটিভ,এতো বাবলি গার্ল তা ওর আপাত গম্ভীর মুখ দেখলে বোঝা যেত না।অন্তর নিংড়ে নিঃস্ব হয়ে দয়িতাকে ভালোবেসেছিল রাহুল,দয়িতাও প্রাণ উজার করে ভালো বেসেছিল তবে সোমককে।
দয়িতা মাঝেসাঝে অব্দার করতো চ্যাট বন্ধ করে ফোন কল করতে অথবা দেখা করতে…তখন রাহুলের নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো.. এড়িয়ে যেতো প্রসঙ্গটা, তখন দয়িতা অভিমান ভরে লিখতো
-” যা ভালো বোঝো করো..আফটার অল you are a star…”
★★★★★★★★
মাস দুই যে কি ভাবে কেটে গেছে তা দয়িতাতে বুঁদ রাহুল বুঝতেও পারেনি।আজকাল আর ও দাভাইয়ের ছায়া হয়ে ঘুরেবেড়ায় না… ভালো লাগেনা দাভাইয়ের স্টারডাম।
নিজের ফেসবুক একাউন্ট থেকে মাঝেসাঝে দয়িতাকে ম্যাসেজ করে দেখেছে রাহুল,সে ভাবে রেসপন্স পায় নি।দয়িতা খুব কম সময় অনলাইন থাকে আর যতটুকু অনলাইন হয় শুধু রাহুলের সাথে কথা বলে..বলা ভালো সোমক রূপে রাহুলের সাথে। দয়িতার কলেজ যাতায়াতের পথে বেশ কয়েকবার ইচ্ছে করে ঘুরঘুর করে দেখেছে রাহুল,সামান্য হাসি ছাড়া আর কোনো রিয়েক্সান পায়নি রাহুল দয়িতার তরফ থেকে।
★★★★★★★★
দুটো মাস স্বপ্নের মতো কাটলেও তাল কাটলো গত তিনদিন আগের এক রাতে।সেদিন মধ্যরাতে দয়িতার সাথে চ্যাটে ব্যস্ত ছিলো রাহুল…সোমক গেছিলো তার এক কোস্টারের পার্টিতে।আজকাল আর দাভাইয়ের পিছুপিছু পার্টিতে যায় না রাহুল।সে রাতে রাহুলকে চ্যাটে মগ্ন দেখে ভুরু জড়ো হয়েছিল সোমকের…
-“কার সাথে চ্যাট করছিস..?”
-“দয়িতা..”
-“দয়িতা..!!!…এখনো চালাচ্ছিস..?”
সোমকের গলায় উষ্মা স্পষ্ট ছিলো সেরাতে।
-“জানিস না তুই,ও সিলি সিরিয়াস টাইপের মেয়ে..প্রেম বিয়ে.. এইসব কখনসেপ্ট বয়ে বেড়ায় এখনো..বিয়ে না করলে বেড শেয়ার করা অন্যায় এই আইডিওলজি মানে ও…জাস্ট লিভ হার…”
সোমকের ব্যবহারে প্রথমবার অবাক হয়েছিলো রাহুল, বলেছিল…
-“তাতে তোর কি প্রব্লেম..ও তো আমার সাথে কথা বলছে… তুই চাপ নিচ্ছিস কেন..?…”
-“তোর সাথে কথা বলছে..!!! “..হেসে উঠেছিল সোমক… তাচ্ছিল্য চলকে উঠেছিল ওর হাসিতে।
-” ও তোর সাথে কথা বলে না স্টুপিড তুই ওর কাছে ম্যাটার করিস না…ওর তোকে মনে আছে কি না তার ঠিক নেই,ইনফ্যাক্ট যাদের সাথে তুই ডেইলি কুচিমুচি চ্যাট করিস তারা কেউ তোকে চেনে না..এখন দয়িতা যদি বেশি ইমোশনাল হয়ে বিয়ে বিয়ে করে পাগল হয় তখন ইমেজ নষ্ট হবে আমার…সোস্যাল স্টেটাস ডেস্ট্রয় হবে আমার..তোর কিস্যু হবে না…”
..অল্প বিরতি নিয়ে সোমক..রাহুলের বেদনাক্লিষ্ট মুখটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার বলেছিল
-“ও তোর থেকে অনেক বড়ো প্রায় তিন বছরের…ওকে ছাড়।নিকির উপর কনসেন্ট্রেট কর..প্রমিসিং ফেস মডেল ওয়ার্ল্ড-এ..তোকে লাইকও করে… .স্টপ টকিং উইথ দয়িতা..আদারওয়াইস আই উইল চেঞ্জ মই ফেসবুক পাসওয়ার্ড।আমি এখনই ওকে হোয়াটসএপে ব্লক করছি।..”
সেইদিন প্রথম নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছিল রাহুল…ঠিকই তো ওকে তো দয়িতা ভালো করে চেনেই না।ওর ভালোবাসাটা যতই খাঁটি হোক না কেন…আদতে ও অস্তিত্বহীন একটা কায়া মাত্র…
সেইদিনের পর থেকে দয়িতাকে আর ম্যাসেজ করেনা রাহুল।দয়িতাও আচমকা বদলে যাওয়া রাহুলের থুড়ি সোমকের ব্যবহারে ছটফট করতে থাকে..ম্যাসেজ করে বারবার জানতে চায় কেন সোমক দয়িতাকে ফোনে,হোটাসএপে ব্লক করেছে,ফেসবুকে কেন রিপ্লাই করছে না…
দয়িতার অভিমান ভরা ছটফটানি বুকে কষ্টের ঢেউ তোলে রাহুলের
★★★★★★★★★★
বারান্দায় কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল রাহুল তা ঠিক খেয়াল নেই, হুঁশ ফেরে পাখির কলতানে…সিধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে রাহুলের..পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে নিজের ফোনটা তুলে নেয় ও…
দু চার বার রিং হতেই দয়িতার ঘুম জড়ানো স্বর ভেসে আসে।রাহুলের নাম্বারটা পর্যন্ত জানে না দয়িতা..অচেনা স্বরে বলে..
-“হ্যালো..কে..?”
-“দয়িতা… আমি রাহুল,সোমকের ভাই…”..
সোমকের নাম শুনতেই দয়িতার স্বভাব গাম্ভীর্য খসে পড়ে..আকুল কন্ঠে জানতে চায়…
-“কি হয়েছে সোমকের..ও কথা বলছে না কেন??..ঠিক আছে তো ও..?..”
-“হুম দাভাই ঠিক আছে..আমার কিছু বলার আছে দয়িতা…একটু ধৈর্য্য ধরে শোনো প্লিজ.. “
অল্প বিরতি নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে শুরু করে রাহুল…
-“দয়িতা..তোমার আর দাভাইয়ের রিলেশনে আমার অবস্থান একটা হাইফেনের মতো..একটা ছোটো হাইফেন যেটা দুটো শব্দের মঝে প্রায় হারিয়ে যায়, আপাত দৃষ্টিতে যেটার তেমন কোনো গুরুত্ব নেই কিন্তু যেটা না থাকলে শব্দ দুটোর যথাযথ মর্ম বোঝা যায় না…আমি তেমনই একটা হাইফেন… দয়িতা ভালোবাসাটা আমার কিন্তু অধিকারটা দাভাইয়ের,তোমার সাথে দেখা স্বপ্ন গুলো আমার অথচ বাস্তবটা দাভাইয়ের..তোমার জন্য আবেগটা আমার কিন্তু তোমার মনটা দাভাইয়ের..আমি থার্ড পার্সেন সিঙ্গুলার নাম্বার হয়েই থেকে গেলাম তোমার জীবনে…
আমি জানি আমি ভুল করেছি…যার ক্ষমা হয় না..আমায় ক্ষমা কোরো না দয়িতা..ক্ষমা করলে যদি আমায় ভুলে যাও..তুমি ঘেন্না হিসাবেই না হয় আমায় মনে রেখো…
আজ রোজ ডে..আজকের দিনে আমি আমার জীবনের জীবন্ত গোলাপটাকে উপড়ে ফেললাম…ভালো থেকো দয়িতা…”
ফোনটা কাটার সময়ে দয়িতার ফোঁপানি কানে এসেছিলো রাহুলের।
★★★★★★
রাত প্রায় বারোটা,কাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে।দাভাই উপলাকে নিয়ে পার্টিতে গেছে।রাহুলকেও যেতে বলেছিল..যায় নি রাহুল..
নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছে রাহুল। গত এক সপ্তাহ সে দাদার ফ্ল্যাটেও যায় নি,নিজেদের বাড়িতেই থেকেছে…ফেসবুকে দাভাই আর রাহুলকে ব্লক করে দিয়েছে দয়িতা…
গত একসপ্তাহ রাহুল দয়িতা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে নি… নিজের ফোনে দয়িতার ছবিগুলো দেখতে দেখতে চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার…ফোনটা রেখে বালিশে মুখ গুঁজে শোয় রাহুল…
টুং শব্দে একটা ম্যাসেজ ঢোকে রাহুলের ফোনে…চোখ মুছে ফোনটা টেনে নেয় রাহুল…নর্মাল টেকস্ট..দয়িতার নাম্বার থেকে…
-“আমার জীবনে থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার থেকে ফার্স্ট পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার হবে..?”…