দোতলায় ওদের ওয়েটিং রুম আর রিসেপশন; রিপোর্ট ওখানেই দেয়। অতি সুন্দরী এবং স্মার্ট এক মহিলা সেখানে বসে আছেন। সুন্দরী মহিলার চোখে চোখ রেখে কথা বলার ইচ্ছা ছিল, কাকভেজা হয়ে যাওয়ায় কনফিডেন্স পাচ্ছি না। মাপা গলায় ভদ্রমহিলা বললেন, “ইয়েস?”
নাম ?
আমি নাম বললাম । তিনি কম্পিউটারে খুটখাট করে বললেন, “সরি,আপনার রিপোর্টটা এখনো রেডি হয় নি। আপনি হাফ এন আওয়ার বসুন, রেডি হয়ে যাবে।”
অত্যন্ত বিরক্ত হলেও সুন্দরী মহিলাদের সাথে বিরক্তি দেখানো যায় না। আমি ‘কী আর করা’ টাইপ এক্সপ্রেশন দিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসলাম।
এক ভদ্রলোককে দেখলাম কাউন্টার থেকে রিপোর্ট নিলেন, নিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমার পাশের চেয়ারে বসে তিনি হাতের রিপোর্টটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। খাম না খুলে সেটা ভাঁজ করে বুকপকেটে রেখে দিলেন। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলেন। এরপর সেই খাম বের করে আবার হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রাখলেন। খুলতে গিয়েও খুললেন না খামটা। আবার সেটা বুকপকেটে রেখে দিলেন। আমার ধারণা পুরোটা সময় আমি ড্যাবডেবে চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কারণ উনি আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে হেসে বললেন, “খামটা খুলতে ভয় লাগছে ভাই!”
আমিও একটু হেসে উত্তর দিলাম, “কিসের রিপোর্ট?”
“প্রেগন্যান্সি টেস্টের। আমার ওয়াইফের।”
এইবার আমি একটু বিব্রত হলাম। বিব্রতভাব কাটাতেই বললাম, “প্রথমবার বাবা হচ্ছেন?”
“হচ্ছি কিনা সেইটা তো রিপোর্টে লেখা আছে। সেইটাই দেখার সাহস পাচ্ছি না।”
আমি বললাম, “আরে দাদা, খুলে দেখে ফেলুন। সুখবর জানতে দেরি করতে হয় না।”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “মিলি আর আমার বিয়ে হয়েছে আজ থেকে দশ বছর আগে।”
এইবার আমি বুঝলাম ভদ্রলোক কেন ভয় পাচ্ছেন। দশ বছর ধরে নিঃসন্তান একটি দম্পতির জন্য এই খবরটা কতখানি আকাঙ্ক্ষিত, আমাদের বোঝার কথা না। পরিস্থিতি একটু হালকা করতেই বললাম, “বৌদির নাম মিলি, আপনার নাম জানা হয় নি।”
“আমার নাম সাগর।”
“আমি আকাশ ।”
আকাশ ভাই, তোমাকে একটা গল্প শোনাই।”
রিপোর্ট দিতে দেরি আছে। সাগর নামের লোকটাকে খারাপ লাগছে না। তার গল্প শুনতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তিনি বলা শুরু করলেন, “মিলির সাথে আমার পরিচয় প্রায় ষোলো বছর আগে। আমি তখন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি। সকাল বিকেল দুটো টিউশনি করি আর চাকরির ইন্টারভিউ দিই। আমার বাড়ির অবস্থা ভালোই, শিলিগুড়িতে বাবার করা বাড়ি আছে। হাত খরচের জন্যই টিউশনি করা। মিলি আমার ছাত্রীর মামাতো বোন। ও তখন পড়াশুনা করে ওই বাড়িতে থাকে। ওর বাবা মারা গেছেন। পড়াশুনা-ভরণপোষণ সব পিসির ওপরে। মাঝে মাঝে চা দিতে আসতো, সেভাবেই চিনতাম। একসময় বুঝতে পারি, ওকে আমার একটু একটু ভাল লাগে। আমি অপেক্ষা করি কখন চায়ের কাপ হাতে মিলি রুমে ঢুকবে। এটাও ভেবে ফেললাম, মোটামুটি একটা চাকরি হয়ে গেলে এই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।”
সাগরদা বিরতি নিলেন। আমি বললাম, “তারপর?”
“একদিন আমি পড়াতে গেছি, সে হঠাৎ রুমে এসে আমাকে বলে, “আমাকে এই বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। যে লোকটার সাথে দিচ্ছে, আমার বয়স তার বয়সের অর্ধেক। সেই লোক পড়াশুনাও করে নি। আমি এই লোককে মরে গেলেও বিয়ে করবো না।” আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বললাম, “জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় কীভাবে? কেন দেবে? দিলেই বা তুমি বিয়ে করবে কেন?” সে রেগে গিয়ে বললো, “আপনি জানেন না আমি এই বাড়িতে আশ্রিতা? ওনারা আমাকে যা বলবেন, আমি তা মানতে বাধ্য?” আমি বুঝতে পারলাম। বললাম, “এখন কী করবে তুমি?” সে বললো, “সম্ভব হলে দূরে পালিয়ে যেতাম। কিন্তু এখানে কোথাও আমার আত্মীয়স্বজন নেই আর। পালিয়ে থাকারও জায়গা নেই। আমি জানি না আমি কী করবো।” আমার করণীয় কী সেইটা ঠিক করতে আমার এক মুহূর্তও লাগলো না। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “দেখো, আমি তোমাকে পছন্দ করি। আমি ভেবেছিলাম একটা চাকরি হয়ে গেলে এই বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। তোমার অন্য জায়গায় এক আধাবুরো লোকের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে সেটা আমিও হতে দেবো না। তবু একটা কিন্তু থেকে যায়। তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো?”
আমি মাঝখানে বলে উঠলাম, “এটা তো পুরো সিনেমার কাহিনী দাদা!”
সাগরদা হাসলেন। বললেন, “হ্যাঁ,সিনেমার গল্পের মতোই শোনায়। মিলি চুপ করে মাথা নিচু করে আমার কথা শুনছিলো। কথা শেষেও চুপ করেই রইলো। আমি বললাম, “দেখো,তুমি হ্যাঁ না কিছু না বললে আমি বুঝতে পারবো না কিছুই। কিছু করাও সম্ভব হবে না তখন।” এরপর সে চোখ তুলে তাকালো। চোখভর্তি জল নিয়ে আমার দিকে যখন তাকালো, আমার আর বুঝতে কিছু বাকি রইলো না। আমি সেদিনই বাড়িতে বলে ফেললাম। বাড়ি থেকে সামান্য আপত্তি করেছিলো, আমি পাত্তা দেই নি। মিলির পিসির বাড়িতে জানিয়ে দিলাম আমার চাকরিটা হওয়া পর্যন্ত ওয়েট করতে। এরপর খুব মন দিয়ে চেষ্টা করলাম চাকরির জন্য। ছয় মাসের মাথায় ওকে বিয়ে করে ওই বাড়ি থেকে নিয়ে আসছি আমাদের বাড়িতে।”
“সাব্বাস দাদা!”
“আমি প্রথম প্রথম খুব কনফিউজড ছিলাম। আমার মনে হতো, মেয়েটা কি দায়ে পড়েই আমাকে বিয়ে করলো? প্রথম প্রথম তো কথাই হতো না। আস্তে আস্তে ভাব হলো। একদিন সে কনফেস করলো, আমাকে তার ভালো লাগতো। তার সংকোচের জায়গাটা ছিল এইখানে, সে ভাবতো সে আমাকে আটকে ফেলেছে। আমি ভাল মানুষ বলে নাকি বের হয়ে আসতে পারি নি!” এইটুকু বলে সাগরদা হো হো করে হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে গেলো।
আমি কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে তাকে দেখলাম। মিলি নামের মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। তার স্বামী এইখানে বসে অপরিচিত এক লোকের সাথে তার গল্প করে হাসতে হাসতে কাঁদছে, এই ঘটনা দেখে তার অনুভূতি কী হবে তা জানতে ইচ্ছা করছে।
সাগরদা আবার বলা শুরু করেছেন, “বিয়ের পরে আমাদের প্রেম জমতে জমতে এক বছর চোখের পলকেই চলে গেলো। এরপরে আরেক বছর, আরেক বছর। আত্মীয়স্বজন, পরিবারের মানুষজন ততোদিনে ইশারা ইঙ্গিতে আরো অনেকভাবে আমাদেরকে বলে ফেলেছে, আমরা কেন বাচ্চা নিচ্ছি না, সমস্যা কার ইত্যাদি, ইত্যাদি। এক একজন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই ডাক্তার, ওই ডাক্তার ওষুধ, কবিরাজ, টোটকা আরো কতোকিছুর কথা বলে! আমি যতোটা শুনি, তারচেয়ে বেশি শোনে মিলি। শোনে আর একা একা কাঁদে। আমি কষ্ট পাবো ভেবে আমাকেও বলে না। আমি দেখি, আমিও কষ্ট পাই, কিন্তু এই মেয়েকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা আমার কাছে থাকে না।”
“আপনারা ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?”
“অন্তত একশ ডাক্তার দেখিয়েছি! সবাই বলে সবকিছু নরমাল দুইজনেরই। একটু হরমোনাল ডিসব্যালেন্স ছিল,সেটা ওষুধপত্র দিয়েই ঠিক হয়ে যাবে বলে সবাই। বছর যায় ওষুধ খেতে খেতে, মিলি কনসিভ করতে পারে না। সমস্যা হলো, আশেপাশের সবার কথা, নিজের হতাশা, সব মিলিয়ে মিলি যেন কেমন হয়ে গেলো। রাতের পর রাত সে ঘুমোয় না, চোখের নিচে কালি, মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো। একদিন রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে উঠে দেখি সে ছুরি হাতে নিয়ে বসে আছে। বুকের সাথে জাপটে ধরে বললাম, “কী করছো তুমি?” সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “মরে যাই। আরেকটা বিয়ে করো তুমি!” আমি বললাম, “খবরদার, আমার কোনো বাচ্চাকাচ্চা লাগবে না। তুমি যদি সুইসাইড করো, আমিও করবো!” এইভাবে বলায় কাজ হলো কতোটুকু জানি না। সে এরপরেও রাতের পর রাত ঘুমোতো না। কখন কী করে ফেলে সেই টেনশনে আমিও ঘুমোতাম না। আমাকে বলতো, “আচ্ছা ভয় নেই,মরে যাবো না। তুমি ঘুমোও!”
সুন্দরী রিসিপশনিস্ট আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। রিপোর্ট রেডি। খাম হাতে নিয়ে ফিরে এসে আবার বসলাম সাগর বাবুর পাশে। বললাম, “আপনারা দুজন দুজনকে পেয়ে খুব লাকি,জানেন?”
সাগরদা হাসলেন, “জানি।”
“এরপর কী হলো?”
“আমাদের বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা আছে। বাবা সেখানে গাছটাছ লাগিয়েছিলেন। একটা কদম গাছ আছে। এক একটা বর্ষা যায়,কখনো ফুল আসে না। এই গল্পটা বিয়ের পরে একদিন মিলিকে বলেছিলাম। মিলি হাসতে হাসতে বলেছিলো, “এই গাছ আর আমি একসাথে মা হবো। আমারও একটা বেবি হবে,এই গাছেও ফুল আসবে।” পরশু হঠাৎ মিলি বললো, একবার টেস্ট করাবে। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি। তবু ও বলেছে তাই নিয়ে এসে টেস্ট করিয়ে গিয়েছিলাম। গতকাল রিপোর্ট নিতে আসার কথা ছিল, একটা ঝামেলায় আটকে গেলাম শেষে,তাই আর আসা হয় নি। আজকে সকালে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে মিলি কোনো কথাবার্তা না বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বারান্দায়। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, কদম গাছভর্তি ফুল!”
আমি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। বললাম, “দাদা ,আপনি খামটা খুলে রিপোর্টটা দেখুন। সুখে দুঃখে দশ বছর তো কাটিয়ে দিলেনই, নতুন কেউ আসুক বা না আসুক, আরো একশ বছর আপনারা একসাথে অনায়াসে কাটাতে পারবেন। অন্য কারো কথা জানি না। আপনাদের গল্পটা শুনে মনে হলো,আপনারা পারবেন। আমি উঠি।”
“খাম খোলার সাহস হচ্ছে না ভাই। তুমি কি আমার পাশে আরেকটু বসবে?,তোমার পাশে বসে আমি খামটা খুলে দেখি !
আমি দুইদিকে মাথা নেড়ে না করলাম,আমি আর বসতে পারবো না। মানুষের প্রচন্ড আনন্দ এবং প্রচন্ড কষ্টের মুহূর্তে আমার নিজেকে খুব বেশি অসহায় লাগে। অল্পসময়ের পরিচিত লোকটি এবং তার স্ত্রীর জন্য আমি হঠাৎ করে গভীর ভালবাসা অনুভব করলাম। উঠে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে ঘুরে দেখি আমার চোখে জল চলে এসেছে। জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে হবে এখন। গল্পটার শেষটা জানা হলো না। সব গল্পের শেষ জানতে হয় না।
শহরে আবার ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। আজকে সবাই ভিজবে। আমি ভিজবো, সাগর-মিলিরা ভিজবে, কদম গাছটাও!
………………………..
নীচের কমেন্ট সেকশনে আপনার মূল্যবান মতামত জানান…।
আর প্রতিদিন নতুন লেখা পড়তে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে…
ধন্যবাদ ।
আমাদের আরও গল্প ,
সময়
অকাল বিয়ে
সম্পর্ক